#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৫
আদনানকে এতোবার কল করেও না পাওয়ায় চিন্তা বেড়ে গেলো রোজার, সাত পাঁচ না ভেবে এখনই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আদনানের খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবছিলো তখনই এক নার্স দ্রুত পায়ে এসে হাজির হলো…
‘ ম্যাডাম, একটা ইমারজেন্সি পেসেন্ট এসেছে। এখুনি সিজার করা প্রয়োজন ‘
‘ ইমারজেন্সি?’
‘ জ্বি! পেসেন্ট বাথরুমে পড়ে গেছিলো, এরপর থেকে প্রচুর ব্লি’ডিং আর পেট ব্যথা হচ্ছে। নয় মাস চলছে ওনার’
‘ এখন আর কেউ অ্যাভেইলবেল নেই?’
‘ এখন হসপিটালে সিজার করানোর মতো কেউ নেই, আর রোগীর যা অবস্থা তাতে অপেক্ষা করলে মা বাচ্চা উভয়ের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে’
একে মাথায় আদনানের চিন্তা ঘুরছে তার ওপর আগত রোগীর এই অবস্থার কথা শুনে দারুন দোটানায় পড়লো রোজা, নার্স রোজাকে চিন্তিত দেখে প্রশ্ন করলো…
‘ ম্যাডাম, আপনার কি কোনো জরুরী কাজ আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে আমি…’
‘ না, আমিই করবো। দ্রুত রোগীর একটা আল্ট্রা করুন আর অপারেশন থিয়েটার রেডি করুন। আমি আসছি’
রোজার সম্মতি পেয়ে নার্স দ্রুত চলে গেলো, আদনান ফোন ধরছেনা এই চিন্তায় রোজার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এদিকে নিজের রোগীকেও অবজ্ঞা করা যাবেনা। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করলো রোজা, ওটি করতে গিয়ে নিজেকে শান্ত না রাখলে চলবেনা। ফোনটা ডেস্কের ওপর রেখেই কেবিন থেকে বেরোলো। আদনান ঠিক আছে, আপাতত নিজের মস্তিষ্ককে এই বুঝ দিয়েই নিজের দায়িত্ব পালনের দিকে অগ্রসর হলো রোজা। ওটি করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হাত কেঁপেছে রোজার, নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু মস্তিষ্ক যে এ মুহূর্তে আদনানের চিন্তায় মশগুল তার কি করবে? ওটি শেষ করে বেরোতে রাত প্রায় বারোটা বেজেছে, রোগীর স্বামী ওটির বাইরে চিন্তিত হয়ে বসে ছিলেন। রোজাকে বেরোতে দেখেই উনি দাঁড়িয়ে পড়েন..
‘ ডাক্তার! আমার ওয়াইফ কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো? ওর কিছু হবেনা তো?’
‘ অনেকটা ব্লি’ডিং হয়েছে, আপনার ওয়াইফের শরীর এ মুহূর্তে ভীষণ দুর্বল। এ মুহূর্তে বাচ্চার পাশাপাশি ওনারও অনেক যত্নের প্রয়োজন’
‘ আসলে আমার দোষেই হয়েছে, ও বাথরুমে যাওয়ার আগে আমাকে ডেকেছিলো। আমি ঘুমের ঘোরে পাত্তা দেইনি, একা যেতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা…ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না’
কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেংগে পড়লো ছেলেটি, ছেলেটির বয়স আনুমানিক পঁচিশ – ছাব্বিশ হবে। স্ত্রীর এ অবস্থা দেখে সে যে ভীষণ ভয় পেয়েছিলো তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখনই নার্স বাচ্চাটিকে নিয়ে এলো, বাবার কোলে তুলে দিলো তাকে। সদ্যোজাত বাচ্চাটিকে কোলে নিতেই ছেলেটির চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরতে শুরু করলো। রোজা মুচকি হেসে বললো…
‘ মেয়ে মেবি হয়েছে ‘
‘আলহামদুলিল্লাহ ‘
মেয়ের কথা শুনে ছেলেটি ভীষণ খুশি হলো! প্রোফেশনের সুবাদে বহুবার সদ্যোজাত বাচ্চা ও তাকে ঘিরে তার বাবা এবং বাকিদের প্রথম মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছে রোজা। আবার অনেক পরিবারকে মেয়ে বেবির জন্যে মুখ কালো করতেও দেখেছে। কিন্তু বর্তমানে যে ছেলেমেয়ে উভয়েই কাধে কাধ মিলিয়ে চলতে পারে সেটা আমাদের সমাজকে কে বোঝাবে?
‘কনগ্রাচুলেশন’
‘থ্যাংক ইউ ডাক্তার!’
সাধারণত বেবি হওয়ার সময় অনেকেই উপস্থিত থাকে কিন্তু রোজা লক্ষ্য করলো এখানে শুধু ছেলেটি ছাড়া আর কেউই নেই, কৌতূহলবশত ও প্রশ্ন করলো…
‘ তা আপনি একা কেনো? আপনার সঙ্গে আর কেউ আসেনি? বাচ্চা নানী – দাদী এ মুহূর্তে সঙ্গে থাকলে সুবিধা হতো। তাদের খবর দিন’
ছেলেটি মলিন হেসে উত্তর দিলো…
‘আসলে, আমরা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছি। আমাদের কারো বাড়ি থেকেই বিয়েটা মেনে নেয়নি। আমি বাড়িতে ফোন করেছিলাম, আমার শাশুড়ি হয়তো আসবে কিন্তু.. যাই হোক। আমার স্ত্রীর জন্যে আশা করি আমিই যথেষ্ট হবো। একবার ভুল করেছি, আর ভুল হবেনা। আমি ওদের দুজনেরই অনেক খেয়াল রাখবো’
মা বাবার হওয়ার মুহূর্তের আনন্দটা নিজের মা বাবাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দটা অন্যরকম কিন্তু ছেলেটির কথা শুনে রোজা বুঝলো এখানে তেমন কিছু হয়তো হবেনা। রোজা আর কথা বাড়ালো না, দ্রুত পায়ে চলে এলো। আসার সময় একটা কথা ওর মাথায় ঘুরছিলো, হুট করেই ওই ছেলে ও মেয়েটির জায়গায় নিজেদের কল্পনা করলো রোজা। ওদের মতো বলতে গেলে আদনান রোজা দুজনেই অসহায়, একে অপরকে ছাড়া কেউই নেই। ভবিষ্যতে এমন কোনো একদিন হয়তো ওদের জীবনেও আসবে। হয়তো সেদিন আদনানকেই সবটা সামাল দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রেশ হয়ে এসে আবারো ফোন হাতে নিলো রোজা, এখনও আদনানের ফোন বন্ধ। দ্রুত হাসপাতালের সব কাজ মিটিয়ে বেরিয়েছে, কি করবে বুঝতে পারছে না মেয়েটা। বাড়ি যাবে না অন্য কোথাও? ভাবতে ভাবতেই রোজার কাছে অচেনা একটি নাম্বার থেকে ফোন এলো, হসপিটাল থেকে এক ডাক্তার ফোন করেছে। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে দেখে রোজার গলা শুকিয়ে এসেছে, আদনানের কোনো বড় ক্ষতি হলো না তো? তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলো রোজা, রিসিপশন থেকে জেনে আদনানের বেড সহজেই খুঁজে পেলো! ডাক্তার তখন চেকাপ করছিলো, রোজা দ্রুত গিয়ে আদনানের পাশে বসলো। আদনানের হাতে ব্যান্ডেজ আর ওকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাক্তারকে প্রশ্ন করলো…
‘ ইজ হি অলরাইট?’
‘ আপনি..’
‘ জ্বি, আমি ওনার ওয়াইফ। আপনি আমাকেই কল করেছিলেন ‘
‘ ওহ আচ্ছা, আপনার হাসবেন্ডের হাতে কিছুটা ফ্র্যাকচার হয়েছে আর কিছু চোট লেগেছে। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি, তবে যেভাবে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তাতে আপনার হাসবেন্ডের ভাগ্য ভালো তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রোপার টেক কেয়ার করলেই উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন’
‘মাথায় কোনো চোট লাগেনি তো? সিটি স্ক্যান করার প্রয়োজন হলে…’
‘ স্ক্যান করা হয়েছে, রিপোর্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। এতো চিন্তার কিছুই নেই, আমার মনে হয় না মাথায় চোট পেয়েছেন কারণ উনি এখানে আসার পরও সজ্ঞানে ছিলেন। আপনার নাম্বার উনিই বলেছেন, এরপর হঠাৎ জ্ঞান হারিয়েছেন। কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম করলেই জ্ঞান ফিরবে’
‘ ওহ, থ্যাংক ইউ ডাক্তার!’
ডাক্তার স্যালাইনের পরিমাণ ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে গেলেন, রোজা আস্তে আস্তে আদনানের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে প্রাণভরে নিঃশ্বাস ফেললো। অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘুমন্ত অ্যাদনানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো রোজা। কপালের একপাশ অনেকটা কে’টে গেছে, হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সে যে বড়সড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলো তা তার এই অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওর এ অবস্থা দেখে রোজা নিজের কান্না থামিয়ে রাখতে পারলো না, আদনানের হাত জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদলো কিছুক্ষন। এতদিন না বুঝলেও আজ উপলব্ধি করছে এ পুরুষটি ওর জীবনের জন্যে কতোটা গুরুত্তপূর্ণ। মিনিট ত্রিশ পর পরে নিজেকে স্থির করলো রোজা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো এক ভদ্রলোক ড্রাইভ করার সময় কার্ডিয়াক অ্যাটাক করেছিলেন, তখন ওনার গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আর আদনানের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। আদনানের তেমন ক্ষতি না হলেও ওই লোকের অবস্থায় বর্তমানে আশঙ্কাজনক। রোজা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছে, আদনানের কিছু হয়ে গেলে ওর কি হতো তা হয়তো রোজার জানা নেই। আদনান ঘুমাচ্ছে, ওর কাছে কিছুক্ষণ বসে রোজা ডাক্তারের সঙ্গে আরেকবার ভালোভাবে ওর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কথা বলে নিলো, এরপর ওই ভদ্রলোকটিকেও একবার দেখে এলো। লোকটি এ মুহূর্তে আইসিইউতে, বাইরে ওনার পরিবারের লোকজন বসে কান্নাকাটি করছে। রোজা লোকটিকে দেখেই ওখান থেকে আদনানের কাছে এসে একটু মাথা নিচু করে বসে, এতো ঘণ্টার ডিউটি এরপর ওটি করে এখানে ছুটে আসার পর গায়ে বিন্দুমাত্র জোর নেই বিধায় মাথা নিচু করতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে জানা নেই রোজার!
____________________________________
আযানের ধ্বনি কানে পৌঁছাতেই পিটপিট করে চোখ খুললো আদনান, মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। ভালোভাবে চোখ খুলে প্রথমে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করলো। বামহাতটা ভার হয়ে আছে, হুট করে মনে পড়লো গত রাতের দুর্ঘটনার কথা। এই হাতেই তো চোট লেগেছে, কিন্তু ডান হাতেও ভার অনুভব হচ্ছে কেনো? ডান পাশ ঘুরতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো আদনানের, হাতের ওপর রোজা মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। অন্যদিকে মুখ করে শুয়েছে বিধায় ওর মুখটা আদনান দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু মেয়েটার ঘুমন্ত মুখখানি দেখার যে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে! আদনান হাতটা আস্তে আস্তে সরানোর চেষ্টা করছিলো তখনই নড়ে উঠলো রোজা, মেয়েটার ঘুম ভেংগে যাবে বুঝে আদনান আর নড়াচড়া করলো না। কিন্তু তাতে আর লাভ হলো কই? রোজার ঘুম ভেংগেই গেছে, ঘুম ভাঙতেই আদনানকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে হুড়মুড় করে রোজা প্রশ্ন করলো…
‘আদনান, ঠিক আছো তুমি? কোথাও ব্যথা করছে?’
‘ ডোন্ট ওরি ডিয়ার, আই অ্যাম ফাইন!’
রোজা আদনানকে এক নজর দেখে চোখ নিচু করে নিলো, মেয়েটার চোখদুটো আবারো জলে ভরে উঠেছে। মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে বুঝে আদনান ধীরে ধীরে ডানহাতটা তুলে রোজার গালে রাখলো…
‘ ভয় পেয়েছিলে?’
‘ হুমম! এতো রাতে আর কখনো বাইরে যাবেনা তুমি, কি দরকার ছিলো অতো রাতে বেরোনোর হ্যাঁ? নাহলে এসব কিছুই হতো না ‘
‘ একজনের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে গেছিলাম, তখনই…’
রোজা রেগে বলে উঠলো…
‘ যতো জরুরি হোক এরপর থেকে রাতে বের হবেনা, আর যার সঙ্গেই দেখা করার প্রয়োজন দিনের আলো থাকতে করবে ‘
‘ অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে দিনরাতের কি সম্পর্ক? তা তো যেকোনো সময়ই..’
মেয়েটার টলটলে র’ক্ত’চক্ষু দেখে আদনান আর পুরো কথা শেষ করতে পারলো না, ভদ্র মানুষের মতো চুপ রইলো। এবার কথা বাড়ালে হয়তো বউয়ের হাতে মা’র খেয়ে এই হাসপাতালে আরো কয়েকটা দিন বেশি কাটাতে হবে!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]