তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-১৭

0
22

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৭

সন্ধ্যার দিকেই আজ রোজার ডিউটি শেষ হয়েছে, সব গুছিয়ে রেখে বাড়ির জন্যে বেরোবে তখনই আদনান এসে হাজির। অসময়ে ওকে হসপিটালে দেখে অবাক হলো রোজা…

‘ তুমি!’

‘ ইয়াহ! এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তুমি ফ্রী থাকলে তোমাকেও পিক করে নেই। কাজ বাকি আছে আরো?’

‘ আজ কাজ শেষ, আমি মাত্রই বেরোচ্ছিলাম। কিন্তু তোমার এখানে আসার প্রয়োজন ছিলো না, একটা কল করে জিজ্ঞাসা করলেই হতো’

ভ্রু কুঁচকে নিলো আদনান…

‘কেনো? নাকি নিজের হাসবেন্ডকে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে চাওনা নাকি?’

রোজা মুচকি হেসে এসে আদনানের বাহু জড়িয়ে ধরে বললো…

‘হ্যাঁ তাই! আমি চাইনা আমাদের হসপিটালের ইয়াং ডাক্তার – নার্সরা আমার হ্যান্ডসাম হাজবেন্ডকে দেখে প্রশংসা করুক। জেলাসি বলেও তো একটা বিষয় আছে নাকি!’

রোজার কথায় হাসলো আদনান, আলতো করে ওর গালটা টেনে দিয়ে বললো…

‘হাউ সুইট! জেলাস ফিল করার কিছুই নেই ডিয়ার, আমাকে যদি লক্ষ মেয়ের মাঝেও দাঁড় করিয়ে দাও তবুও আমার চোখ শুধু তোমাকেই খুঁজবে’

‘হয়েছে! আর ফ্লার্ট করতে হবেনা, চলো’

এই হসপিটালে জয়েন করার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আদনান এলো রোজাকে নিতে, বেরোনোর সময় রোজার যেসব কলিগদের চোখে পড়েছে সবাই ওদের জুটির প্রশংসা করেছে। কয়েকটা ইয়াং নার্স ও মেয়ে ডাক্তার তো আড়চোখে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো, এসবের কিছুই রোজার নজর এড়ায়নি। এজন্যেই আদনানকে হসপিটালে আনতে চায়না ও, মেয়েরা এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আদনানকে দেখলে বড্ড রাগ হয় রোজার! আদনানের হাতের চোট এখনও পুরোপুরি সারেনি, ডাক্তার এখনি ওকে ড্রাইভিং করতে বারণ করেছে তাই ট্যাক্সি নিয়েই চলাচল করতে হয়। ট্যাক্সিতে ওঠার পর কিছুক্ষণ চুপ করেই ছিলো রোজা, হুট করে বলে উঠলো…

‘ তুমি আর আমাকে নিতে আসবে না ‘

‘ সবাই কি সুন্দর আমার প্রশংসা করছিলো, আর তুমি কিনা বলছো আর না আসতে?’

‘ আমি না করছি, আসবেনা। আর যদি আমাকে পিক করতেই হয় তাহলে বাইরে থেকে কল করবে, ভেতরে যাবেনা। সবাই তোমাকে যেভাবে দেখে, আমার ভালো লাগেনা ‘

বউয়ের কথা শুনে আদনান কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, মেয়েটা যেনো দিনদিন ওকে নিয়ে সবকিছুতেই ওভার প্রোটেক্টিক হয়ে যাচ্ছে। তবে বিষয়টা মন্দ লাগেনা আদনানের, রোজা ছাড়া কেই বা ওকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে? বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হতেই পাশের ঘরের সবিতা আন্টি এসে ওদের দরজায় কড়া নাড়লো, আজ তার মেয়ে সায়মাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। ওনার দুটো মেয়ে আর ওনার স্বামী বিদেশে থাকেন বিধায় বাড়িতে আর কোনো ছেলেমানুষ নেই। আদনানকে আগেই বলেছিলো ছেলের বাড়ির মানুষ এলে যেনো ও একটু উপস্থিত থাকে। রোজা দরজা খুলে ওনাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলো…

‘ তারা চলে এসেছে?’

‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে, তোমরাও চলে এসো আমার ঘরে কেমন? তোমাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, আসলে বুঝতেই তো পারছো মানুষ না থাকায়…’

‘না না আন্টি, প্রয়োজনে প্রতিবেশী সাহায্য না করলে আর কেই বা করবে? আপনি যান, আমরা এখুনি আসছি’

সবিতা আন্টি ঘরে গেলেন, রোজাও গিয়ে ওনাকে সাহায্য করলো। কিছুক্ষণ পর পাত্র পক্ষের মানুষ এলো। রোজাও সবিতা আন্টির হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিতে থাকলো, আন্টির মেয়ে সায়মাকে একটু পরে এনে বসানো হলো। পাত্রের মা, বাবা ও ফুপু এসেছে মেয়ে দেখতে। ছেলের মা ফুপু সায়মাকে টুকটাক প্রশ্ন করছিলেন, রোজা তখন পাশেই দাড়ানো ছিলো। এমন সময় ছেলের মা রোজাকে জিজ্ঞাসা করলেন…

‘ তা মা তুমি ওর কি হও?’

‘ উম্ম, বড় বোনের মতো বলতে পারেন ‘

‘ ওহ আচ্ছা, তা তুমি করো?’

‘ আমি একজন ডাক্তার!’

‘ বাহ, খুব ভালো। তোমার বাড়ি কোথায় মা? আর তোমার বাবা কি করে? কয় ভাইবোন তোমরা?’

পাত্রের মায়ের এতো প্রশ্ন শুনে উপস্থিত সকলেই কিছুটা বিচলিত হলো, রোজা বুঝলো একটা ভুল বোঝাবুঝি হতে যাচ্ছে তখনই আদনান হেসে বললো…

‘ আন্টি, পাত্রী ও নয়!’

‘ হ্যাঁ, কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে আপত্তির কি আছে?’

‘ আমার আপত্তি আছে, কজ সি ইজ মাই ওয়াইফ’

রোজাকে হয়তো পাত্রের মায়ের মনে ধরেছিলো কিন্তু আদনানের কথা শুনেই ওনার মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো। এরপর পাত্রীর সঙ্গেই আরো কিছু কথাবার্তা হলো, মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষে পাত্রপক্ষ জানালো মেয়ের গার্জিয়ানের সঙ্গে তারা বসে পাকা কথা সারবে। বিয়ে মোটামুটি ফাইনাল বলা চলে। পাত্রপক্ষ যাওয়ার পর রোজা আদনান ঘরে আসতে গেলে সবিতা আন্টি না খেয়ে আসতে দেয়নি। ডিনার এখান থেকেই করে যাওয়ায় ঘরে গিয়ে আর রান্নার ঝামেলা করতে হবেনা! ঘরে ফিরতেই রোজা এসে টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, হসপিটাল থেকে এসে একটু বসারও সময় পায়নি। একটু আগের ঘটনা মনে করে হাসলো রোজা, আদনানকে জিজ্ঞাসা করলো…

‘ পাত্রপক্ষ বুঝি মেয়েকে এভাবেই প্রশ্ন করে তাইনা? নিষাদের সঙ্গে যখন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তখন অবশ্য আমাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি ‘

আদনান ওষুধটা খেয়ে গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে এসে রোজার পাশে হেলান দিয়ে বসে বললো…

‘নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে তোমাকে?’

‘ হ্যাঁ, নতুন অভিজ্ঞতাই তো অর্জন করলাম। একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করার ব্যাপারটা, মজাই লেগেছে। আমি অবশ্য শুনেছি এমন নাকি হয়, অনেকসময় একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে ফেলে ‘

আদনান দু হাত ভাঁজ করে ঘাড় কাত করে তাকালো, ভ্রুকুটি কুচকে প্রশ্ন করলো…

‘ যদি তোমাকে পছন্দ করতো তাহলে কি রাজি হয়ে যেতে? বিয়ে করে নিতে তার ছেলেকে?’

‘ আমি কোন যুক্তিতে তার ছেলেকে বিয়ে করবো? আমি তো অলরেডি বিবাহিতা ‘

‘ তাহলে এই নিয়ে এতো আনন্দিত হওয়ার কি আছে?’

রোজা স্মিত হেসে উঠে বসলো, আদনানের গলা জড়িয়ে ওর ঠোঁটে চু’মু খেয়ে বললো…

‘ ইশ! কতো রাগ হয়েছে তাইনা? রাগ ভাঙিয়ে দিলাম, এবার হয়েছে?’

আদনান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো…

‘ কমেনি? আচ্ছা তবে কি করলে আপনার রাগ কমবে শুনি?’

আদনান ছোটো ছোটো চোখ করে রোজার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো, মহাশয়ের হাসি দেখেই রোজার বোঝা হয়ে গেছে উনি কি করতে চাইছেন!

‘তোমার হাতের ব্যথা কিন্তু…’

রোজার বলতে দেরি হলেও কিন্তু আদনানের দেরি হলো না, খপ করে ধরে রোজাকে বিছানায় শুইয়ে ওর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো…

‘এসব বাহানা দিয়ে লাভ নেই, তোমাকে অন্য ছেলের মা পছন্দ করেছে শুনে খুব মজা পাচ্ছিলে তাইনা? এর জন্যে একটু শাস্তি তো আপনাকে পেয়েই হবে ম্যাডাম’

‘ কিন্তু…’

আপাতত আর কথা বলার সুযোগ পেলো না রোজা, তার আগেই আদনান ওর ওষ্ঠোজোড়া দখল করে নিলো…
________________________________

ইদানিং রোজাকে চিন্তিত লাগে আদনানের, ও লক্ষ্য করেছে রোজা একান্তে বসে মাঝে মাঝে গভীর ভাবনায় মশগুল থাকে। এতদিন যদিও বিষয়টা পাত্তা দেয়নি, তবে এ বিষয়ে আর জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলো না। বারান্দায় বসেছিলো রোজা, আদনান এক কাপ কফি এনে ওকে দিলো

‘ ওহ! থ্যাংক ইউ ‘

রোজা সঙ্গে সঙ্গে কফি কাপ হাতে তুলে কয়েকটা চুমুক দিলো…

‘ উম্ম! তোমার হাতের কফি সবসময় বেস্ট হয়’

‘ ইউ আর ওয়েলকাম। রোজা, তোমাকে কয়েকদিন ধরে চিন্তিত দেখাচ্ছে। হসপিটালে কিছু হয়েছে?’

‘ নাহ!’

‘তাহলে কোনো পেসেন্টের কেস নিয়ে চিন্তিত?’

রোজা খানিকক্ষণ নিরব থাকার পর বললো…

‘কয়েকদিন আগে মা ফোন করেছিলো, আমার বোনকে নাকি আমার জায়গায় নিষাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে বাবা। বিষয়টা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না আদনান, এটা তো ভীষণ অন্যায় হলো মেয়েটার সঙ্গে ‘

অবাক হলো আদনান!

‘হোয়াট! তোমার বাবা তোমাকে দিতে না পেরে শেষে কিনা তোমার বোনকে… আই কান্ট বিলিভ দিস। তোমার বোনের কি অবস্থা এখন?’

‘ মা তো বললো এখনও কোনো ঝামেলা হয়নি, নতুন নতুন কি আর ঝামেলা হবে? আর আমার বোনের বয়স কম, ও নিষাদের বুদ্ধির সঙ্গে পারবে না। আর ও যেমন ছেলে তাতে আমার বোনকে ঠকাবে নিশ্চিত, জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে আমার বোনটার’

যা হয়েছে তার জন্যে রোজা নিজেকে দোষ দিচ্ছে এদিকে আদনান এটা ভেবে অবাক হচ্ছে যে একটা বাবার কাছে তার মেয়ের জীবনের থেকেও সম্মান এতো বেশি প্রিয় কিভাবে হয়? একজন মেয়ের বাবারা এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে?

‘আমার জন্যে হলো এসব, আমি যদি সেদিন ওভাবে চলে না আসতাম তাহলে আজকে…’

‘এখানে তোমার কোনো দোষ নেই রোজা, আই অ্যাম সরি টু সে কিন্তু তোমার বোনের ভবিষ্যত যদি নষ্ট হয় তাতে সম্পূর্ন দোষ তোমার বাবার। কতোটা সিরিয়াস বিষয় হলে একটা মেয়ে বিয়ে না করে পালিয়ে আসে সেটা ওনার একটু ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো ‘

‘ বাবা আমার ওপর সারাজীবন রাগ করে থাকতো তাতে আমার সমস্যা ছিলো না, কিন্তু আমার ওপর রাগ করে যে ওর সঙ্গে অন্যায় করবে সেটা ভাবিনি। এখন যা হয়েছে তা শোধরানোরও কোনো উপায় দেখছিনা’

‘ তুমি এসব নিয়ে ওভার থিঙ্ক করো না, এমনিতেই সারাদিন কাজের প্রেসারে থাকো তার ওপর আরো বাড়তি চিন্তা করলে নিজেও অসুস্থ হয়ে যাবে ‘

‘ কিন্তু আমি না ভেবে পারছি না আদনান, নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জন্যে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো হয়তো। জানিনা কি হবে ওর, শুনেছি অনেক ছেলেরা বিয়ের পর ভালো হয়ে যায়, নিষাদ যদি কোনোভাবে পাল্টে যেতো তাহলে হয়তো আমি কিছুটা স্বস্তি পেতাম’

বোনের জন্যে রোজার চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক, আদনান চাইলেও ওকে থামাতে পারবে না কিন্তু ওর বাবার কর্মকাণ্ডের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে ও। রোজা সেদিন ওর সঙ্গে চলে না এলে কি যে হতো ওর সঙ্গে ভবিষ্যতে ভেবেই চিন্তা হয় আদনানের। আজ আদনান বিজনেস রিলেটেড কিছু কাজে ব্যস্ত ছিলো, দুটো ভিডিও মিটিং করে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। ছোটো একটা অফিস ভাড়া নিয়েছে ও, সঙ্গে এখন সেক্রেটারিও রেখেছে। মিটিং শেষে আদনান বিশ্রাম করছিলো তখন ওর সেক্রেটারি এসে বলে…

‘ স্যার, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে ‘

‘ পাঠিয়ে দিন ‘

মিনিট দুয়েক পর এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক ভেতরে এলেন, আদনান ওনাকে ঠিক চিনতে পারলো না। কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলো পরিচিত কেউ কিনা কিন্তু তাও মনে পড়লো না। পরে ভাবলো কোনো কাজের উদ্দেশ্যে এসেছেন হয়তো, হাসিমুখে আদনান প্রশ্ন করলো…

‘ হ্যালো স্যার, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’

লোকটা কিছুক্ষণ আদনানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, এরপর নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলো..

‘ চিনতে পেরেছো আমায়?’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]