তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-২২

0
21

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২২

ড্রয়িংরুমে বসে আছে জামাল সাহেব, পাশেই আদনান ও রোজা বসা। কিছুক্ষন আগে নিজের বাসায় এসেছে রোজা, অন্যসময় হলে বাবার উপস্থিতিতে এ বাড়িতে প্রবেশের অনুমতিই পেতো না কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ শান্ত হয়ে আছেন জামাল সাহেব…

‘ নিষাদ ওকে দিয়ে যাওয়ার সময় কি বলে গেছে?’

‘ তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে রাইসার বয়স কম, ওদের মধ্যে বোঝাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে’

‘যত্তসব ফা’ল’তু কথা, এগুলো কোনো কারণ হলো! এইটুকু কারণের জন্যে ডিভোর্স দেবে? এর পেছনে অন্য কারণ আছে’

‘অন্য কারণ তো আছে বটেই, এই সামান্য বিষয়ে তো কেউ কাউকে তালাক দেয়না ‘

‘কারণটা কি সেটা তোমার ভালোভাবেই জানা বাবা ‘

উত্তর দিলেন না জামাল সাহেব, সেদিন রোজার দেখানো প্রমাণ বিশ্বাস হয়নি ওনার কিন্তু এই ঘটনার পর উনি বুঝতে পারছেন না রোজা সেদিন মিথ্যে বলেনি! বাবার ওপর আজ ভীষন রাগ হচ্ছে রোজার, কিন্তু মেয়ে হিসেবে বাবার ওপর তো আর রাগ ঝাড়তে পারবে না। নিজেকে যথেষ্ট ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো ও…

‘আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। এই ছেলেটা ভালো নয়, প্রমাণ দেখার পরেও তুমি আমার কথা বিশ্বাস করনি। তাতে আমার আফসোস ছিলো না। কিন্তু আমার ওপর রাগ দেখিয়ে তুমি রাইসার জীবনে যে ঝড় তুললে সেটার কি হবে?’

‘তুই ওইদিন চলে যাওয়ার পর এ বাড়িতে কি হয়েছিলো জানিস? ঘরভর্তি আত্মীয় স্বজন যখন জানতে পারলো মেয়ে বিয়ে থেকে পালিয়ে গেছে তখন আমার সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছিলো?বাধ্য হয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম আমি রাইসাকে নাহলে এই উনিশ বছর বয়সে ওকে বিয়ে দিতাম আমি?’

অবাক হলো রোজা, কারণ এতকিছুর পরেও জামাল সাহেবের মস্তিষ্ক থেকে সম্মানের বিষয় বের হয়নি!

‘বাবা প্লিজ! এতকিছুর পরেও তুমি আজ অন্তত এই সম্মানের কথা তুলো না। তোমার কাছে তোমার সম্মান কি তোমার মেয়েদের থেকেও বেশি জরুরি? একজন বাবার কাছে কি তার মেয়েরাই সবচেয়ে সম্মানের বিষয় নয়?’

‘এখন এসব কথা বলে কি আদৌ কোনো লাভ আছে? ভাবতে হবে যে এখন কি করলে ভালো হবে। যদি নিষাদের সঙ্গে কথা বলে…’

‘রাইসা ডিভোর্স দেবে আর ও বাড়িতে ফিরবে না এটাই শেষ কথা, একবার তুমি ওর জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়েছো আর সেটা ভুল হয়েছে। এবার সিদ্ধান্ত ওকে নিতে দাও, রাইসা যা বলবে তাই হবে’

বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ যুক্তিতর্ক হলো রোজার, জামাল সাহেব পূর্বের তুলনায় শান্ত হয়েছেন বটে কিন্তু ওনার মেজাজ একইরকম আছে। রোজা জানে রাইসার এই ঘটনার পর ওনার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসবে অবশ্যই তবে তার জন্যে সময় লাগবে। বাবা মেয়ের কথা মধ্যে না আদনান কিছু বলেছে না রোজার মা! কিছুক্ষণ কথা শেষে বাবার সঙ্গে আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলোনা রোজার! সোফা থেকে উঠলো রোজা..

‘আমি রাইসার সঙ্গে একটু কথা বলে আসি’

আদনান রোজার হাত ধরে বললো…

‘রোজা, এই অবস্থায় এতো উত্তেজিত হওয়া কিন্তু তোমার ঠিক হবেনা। এতক্ষণ আমি কিছু বলিনি, কিন্তু অযথা উত্তেজিত হয়ে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করো না’

‘রাইসার সঙ্গে উত্তেজিত কেনো হবো বলো? আমি শুধু ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই’

রোজা রাইসার সঙ্গে কথা বলার জন্যে ঘরে যায়, রাইসা আর রোজার একটাই রুম ছিলো। রুমে ঢুকতেই রোজা দেখলো রাইসা আলমারিতে কিছু একটা করছে। হঠাৎ রাইসার নজর পড়লো দরজার দিকে, রোজাকে দেখে যেনো মেয়েটা খুশি হলো না! ওদিকে…রোজা যাওয়ার পর আদনান ওখানেই বসেছিলো, জামাল সাহেবও ওঠেননি। রোজার মা জামাইয়ের জন্যে কিছু নাশতার ব্যবস্থা করতে গেছেন, এরই মাঝে জামাল সাহেব আদনানকে প্রশ্ন করলেন…

‘আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার সংসার বোধহয় ভালোই চলছে’

‘ আলহামদুলিল্লাহ! আপনি যদি হাইপার হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে আপনার ছোটো মেয়েরও সুখের সংসার দেখতে পারতেন ‘

‘ কা’টা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছ নাকি?’

‘ না আঙ্কেল, আমি শুধু আপনার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। মা বাবার নেওয়া সিদ্ধান্ত সবসময় সন্তানের জন্যে সুখকর হয় না, সেখানে আপনি প্রমাণ পাওয়ার পরেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। পরিণতিতে আজ এরকম একটা ঘটনা ঘটলো। আপনার কি মনে হয় না এটা আপনার ভুল হয়েছে?’

আজ অব্দি জামাল সাহেবের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি কিন্তু প্রথমবারের মতো একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ায় নিজের দোষ স্বীকার মেনে নিতে ইগোতে লাগছে ওনার তাও আবার সেই ছেলের সামনে যে ওনার ভুলটা আগেই ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো! কিন্তু এখন আর উপায় নেই, দোষ স্বীকার করেই জামাল সাহেব বললেন…

‘জীবনে প্রথমবার হয়তো আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল হলো, ছেলেটাকে ভালো ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম রোজা যে পথে পা বাড়িয়েছে সেটা ভুল, কিন্তু শেষে আমার সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণিত হলো। মনে মনে তোমার নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে?’

‘মোটেই না আঙ্কেল! বরং রাইসার কথা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। বাবা মায়ের হাতে ছেলেমেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায় শুনেছি, তার বাস্তব প্রমাণও দেখে নিলাম। এটা নিশ্চয়ই আনন্দের বিষয় নয়!’

একটু থেমে আদনান আবারো বললো..

‘রোজার চিন্তা আপনাকে করতে হবেনা, ওর জন্যে আমি আছি তবে বাবা হিসেবে আপনার এখন উচিত রাইসার জন্যে চিন্তা করা। মেয়েটা এখনও ছোটো, আবেগী! এই মুহূর্তে আপনারা যদি ওর সঙ্গে না থাকেন তাহলে ও আরো ভেঙে পড়বে’

জামাল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না, উঠে চলে এলেন ওখান থেকে। হয়তো আদনানের বলা কথাগুলো হজম করতে পারেননি। রোজার মা নাস্তা নিয়ে এসে জামাল সাহেবকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন…

‘ ওর বাবা ঘরে চলে গেছে?’

‘ জ্বি!’

‘তোমাকে আবার কিছু বলেনি তো?’

‘উনি আমায় কিছুই বলেননি, আর বললেও আমি কিছু মনে করবো না। এ মুহূর্তে উনি চিন্তিত আছেন, চিন্তায় থাকলে কিছু বলার সময় মাথা কাজ করেনা!’

‘ঠিক আছে, অনেকক্ষণ হলো এসেছো। এরকম একটা পরিস্থিতি যে তোমাকে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারলাম না।’

‘এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা আন্টি! আর ব্যস্ত হবারও কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি বসুন’

রোজার মা বসলো, আদনানের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বললো। ওদিকে…রাইসা রোজাকে ভেতরে আসতে বললো…

‘আরে আপু, বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভেতরে আয়’

ধীর পায়ে ভেতরে এলো রোজা, বিছানার ওপর জামাকাপড় ছড়ানো দেখে বুঝলো রাইসা এগুলো গুছিয়ে আলমারিতে তুলছে। রোজা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ওর অবস্থা। রাইসা ভীষন ব্যস্ততা দেখাচ্ছে যেনো রোজাকে ইগনোর করতে চাইছে।

‘ওগুলো রাখ, এদিকে এসে বস আমার সঙ্গে। কতদিন পর দুজনে একসাথে হলাম বলতো?’

‘ এগুলো দুদিন ধরে পড়ে আছে, গোছাতে পারিনি। আজও না গোছালে এভাবে পড়ে থাকবে। আমি আমার কাজ করি। তুই বল না কি বলবি, আমি শুনছি ‘

‘আমাকে দেখে খুশি হোসনি?’

‘কেনো হবো না? কতদিন পর দেখলাম তোকে। কেমন আছিস তুই?’

‘ তুই কেমন আছিস সেটা আগে বল ‘

‘আমার খবর পেয়েই নিশ্চয়ই এখানে এসেছিস, তাহলে আবার আলাদা করে জিজ্ঞাসা কেনো করছিস?’

রোজা বুঝলো রাইসা হয়তো অল্পতেই আলাপ শেষ করতে চাইছে। বিয়ের এক বছর হতে না হতেই স্বামী ছেড়ে গেছে, এই কিশোরী মেয়েটির মনে এই মুহূর্তে কি চলছে তা হয়তো রোজা কল্পনাও করতে পারবে না। সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখার পূর্বেই সেই সংসার ভেঙে গেলো রাইসার!

‘হুমম! ঠিক আছে আমি তোকে সরাসরিই প্রশ্ন করছি। হঠাৎ এমন কী হলো যে নিষাদ তোকে রাতের বেলা এ বাড়িতে দিয়ে গেলো?’

মিনিট দুয়েক নিরব থেকে রাইসা বললো…

‘আমাদের কয়েকদিন ধরেই ঝগড়া চলছিল, অবশ্য সেটা বিয়ের পর থেকেই চলে আসছে। সেদিনও আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো, এক পর্যায়ে ও আমাকে বললো আমার সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব না। ব্যস, এরপর এ বাড়িতে দিয়ে গেছে’

‘ ঝগড়া হয়েছে তোদের?’

‘ হুমম!’

‘রাইসা, আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলতো বোন। নিষাদের বাড়ির লোকেরা তোর ওপর কোনো অত্যাচার করেনি তো? বা নিষাদ তোকে জোড় করে কিছু…’

‘গায়ে হাত তোলার কথা বলছিস? তেমন কিছুই হয়নি, নিষাদ বিয়ের পরেই আমাকে বলেছিল যে ও অন্য কাউকে পছন্দ করে আর আমার সঙ্গে সংসার করার ইচ্ছে ওর নেই। এই নিয়ে সেদিন থেকেই ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া, তুইই বল আপু। একটা মেয়ে কি মেনে নিতে পারবে যে তার বর অন্য কাউকে পছন্দ করে?’

রোজার কাছে এবার বিষয়টা আরো পরিষ্কার হলো, ঘরে বউ রেখে বাইরে পরকীয়া করলে দোষ হবে বিধায় নিজের পথ পরিষ্কার রাখার জন্যেই মূলত রাইসার সঙ্গে এ সম্পর্ক ভাঙতে চাইছে নিষাদ! রোজা কিছু বলবে তার আগেই দুম করে রাইসা বলে বসলো…

‘ তুই তো এসব জানতি তাইনা আপু? এসব জেনেই তুই নিজের সুবিধার কথা ভেবে পালিয়ে গেছিলি তাইনা?’

‘ রাইসা আমি…’

‘সবদিক বিবেচনা করে দেখলে এসব কিছু তো তোর জন্যে হয়েছে আপু। তুই যদি সেদিন ঐভাবে পালিয়ে না যেতি তাহলে নিষাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হতো না’

রোজা ভেবেছিলো রাইসাকে শান্তনা দেবে কিন্তু ওর ছোটো বোন যে সম্পূর্ন ঘটনার জন্যে ওকে দায়ী করে বসবে সেটা ভাবেনি। বোনের মুখে এরকম কথা শুনে চমকে উঠলো রোজা…

‘আমার জন্যে? রাইসা তুই এসব কি বলছিস? আমি যদি জানতাম বাবা অমন কিছু করে বসবে তাহলে আমি কখনও…’

‘কেনো? তুই বাবাকে চিনিস না? জানিস তো কেমন মানুষ তাইনা? তাহলে সেদিন ঐভাবে কেনো চলে গেলি তুই? তোর একবারও মনে হলো না যে আমি সব ছেড়ে চলে গেলেই সমস্যার সমাধান হবেনা?’

রাইসার যে রোজার ওপর ক্ষোভ জমেছে তা রোজা ওর কথা শুনে ভালোই বুঝতে পারছে, মেয়েটার মস্তিষ্কে হয়তো এখন অনেককিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবুও বোনের কথা শুনে ভীষন কষ্ট হলো রোজার! রোজা দু হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো…

‘তুই চিন্তা করিস না রাইসা, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। দেখবি তোর জীবনে আরো ভালো কেউ আসবে’

রোজাকে নিজের থেকে দূরে সরালো রাইসা, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো..

‘এখন এসব শান্তনা দিয়ে আর কি লাভ বল? কিছু কি আদৌ বদলাবে? নিষাদের সঙ্গে আমার ডিভোর্স তো হবেই। লোকে আমায় ডিভোর্সী বলবে। আপু, সেদিন তুই চলে না গেলে ওর বিয়েটা তোর সঙ্গেই হতো আর আমাকে আজ এই দিন দেখতে হতো না। আসলে তুইই দায়ী আমার এই অবস্থার জন্যে’

যে ছোটো বোনটা সবসময় রোজাকে সাপোর্ট করতো, সব আনন্দ দুঃখের সঙ্গী হতো সে যেনো দিনের ব্যবধানে অনেকটা পাল্টে গেছে। পূর্বে রাইসা কোনো দোষ করলে রোজা নিজের ঘাড়ে সে দোষ নিতো যাতে ওকে বাবার বকা না শুনতে হয় কিন্তু সেই বোনই এখন ওকে দোষ দিতে শিখে গেছে। তাও আবার যেই সেই দোষ নয়, জীবন নষ্ট করার দোষ! চোখদুটো ছলছল করে উঠলো রোজার, রাইসার চোখেও পানি। চোখটা মুছে রাইসা বললো…

‘তুই তো তোর হাসবেন্ড নিয়ে ভালো আছিস, ভালো থাক তুই। আমার খোঁজ নিতে হবেনা তোকে, আমি এ বাড়িতে যখন চলে এসেছি আশা করি অন্তত নিষাদদের বাড়ির তুলনায় অনেক ভালো থাকবো’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]