তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০১

0
570

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
মে মাসের শেষে প্রচণ্ড গরম। রোদে ঝলসে যাচ্ছে যেন কলকাতার চারিদিক। এই গ্রীষ্মের দুপুরে ধুঁকছে যেন পুরো শহরটা। তার মাঝেই অর্ণব হাওড়া স্টেশনের বাইরে ঘুরঘুর করছে হাতে একটা ফাইল, আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে। ক্রেডিট কার্ডের সেলস্ বয় ও। এক মাস হলো চাকরিটা পেয়েছে। আজ টার্গেট ফুলফিল হওয়ার শেষ দিন। তবে মনে হয় না চাকরিটা থাকবে আর! এতদিনে মাত্র তিনটে ক্রেডিট কার্ড সেল করতে পেরেছে। আসলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে, শপিং মল, মার্কেট প্লেস, মেট্রো স্টেশন, সব জায়গায় গিয়ে হাজারটা লোককে জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হয় না! বেশির ভাগ লোক বিরক্ত হয়, কোন কথা শুনতে চায় না, বাড়িতে গেলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়, নইলে সেলসম্যান দেখলে পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। আর যারা সামান্য হলেও শোনে, তারা এক দু মিনিট বাদে ” না, লাগবে না” বলে কথা শেষ করে দেয়। এই যেমন আজ হচ্ছে। অর্ণব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে, নিউ কমপ্লেক্স, ওল্ড কমপ্লেক্স, হাওড়া স্টেশনের বাইরে রাস্তার লোকজনদের কাছে গিয়ে কতভাবে চেষ্টা করছে একটা ক্রেডিট কার্ড বিক্রির! কিন্তু কেউই কোন রকম রেসপন্স করছে না। একজন তো বেশ রেগেই বলে দিল,
———” কেন বিরক্ত করছেন দাদা এই গরমে! একেই পোষাচ্ছে না কিছু। যান না প্লিজ..”
কথাটা শুনে অর্ণব আর কোন কথা বাড়ালো না। এগিয়ে গেল অন্য লোকের কাছে থমথমে মুখে। যদিও সেখানে গিয়েও না ই শুনতে হলো। তবে এবার আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ওর। সারাদিন ধরে কিচ্ছু খাওয়া হয়নি জল ছাড়া। এইভাবে আর পারছে না যেন টানতে। আসলে মা যতদিন বেঁচে ছিল, বাবার পেনশনটা পেত। মামারাও তখন ভালোই যোগাযোগ রাখতো। সেই দিনগুলোতে অর্ণব ভাবতেও পারেনি হঠাৎ এরকম দিন দেখতে হবে ওকে! যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিল। স্টুডেন্ট হিসেবে ছোট থেকেই খুব ভালো। এরপর আইআইএম এ হাফ স্কলারশিপে এমবিএ তে ভর্তি হয়েছিল। ভেবেছিল এমবিএটা পাশ করলে একটা ভালো চাকরি ঠিক জোগাড় করে নেবে। কিন্তু শেষ সেমিস্টারটা শুরু হওয়ার কদিন আগেই মা হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চলে গেল। তারপরই জীবনটা কিরকম অন্ধকার হয়ে গেল যেন অয়নের। পেনশনের টাকাটা হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। গয়নাগাটি যা ছিল সেসব তো বাবার ধার শোধ করতে বহুদিন আগেই বিক্রি করে দিতে হয়েছিল মা কে! তাই হাত একদম খালি। এর মধ্যে মামাদের কাছে গেছিল ছেলেটা। শেষ সেমিস্টারের রেজিস্ট্রেশন ফি তো দূরে থাক, সামান্য জল টুকুও দেয়নি ওরা সেদিন। এই সময় অর্ণব বুঝেছিল ও একদম একা হয়ে গেছে। সংসার চালানোর মতন টাকা নেই হাতে। তবে পড়াশোনাটা যেভাবে হোক শেষ করতেই হবে। তাই কোন রকমে এই সেলস্ বয়ের চাকরিটা জোগাড় করেছিল। কিন্তু এখন চারিদিকটা যেন আরো বেশি আবছা লাগছে ওর। আজ এই চাকরিরও শেষ দিন। কিভাবে চালাবে, কি করবে কিছুই ঠিক বুঝতে পারছে না।
সেদিন এই ভাবনার ভিড়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল স্টেশনের ভিতর একটা বেঞ্চে। কিরকম কান্না পাচ্ছিল যেন ওর। মনে হচ্ছিল এখানেই শেষ। এরপর আর কোথাও যাওয়ার নেই, আর কোন আশা নেই। কেমন নিস্তেজ লাগছিল যেন শরীরটা। সেই সময়েই হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। অর্ণব বিষন্ন চোখেই মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই কেমন একটা হালকা ভালো লাগার রেশ ছড়িয়ে গেল মনে। অস্মিতা! ওর জীবনে একমাত্র কাছের মানুষ। অর্ণব কথাটা ভাবতেই চারিদিকের একাকিত্বগুলো যেন কেটে গেল হঠাৎ, আর ও সেই ক্লান্ত শরীরে ফোনটা ধরে আস্তে গলায় বললো,
——–” হ্যালো। ”
এর উত্তরে অস্মিতা আলতো স্বরে বললো,
———” কোথায় এখন? হাওড়া স্টেশন? আজ তো ঐদিকেই যাওয়ার কথা বলেছিলে। ”
এই প্রশ্নে অর্ণব বিষন্ন স্বরেই বললো,
———-” হ্যাঁ, স্টেশনেই আছি। ”
অস্মিতা এর উত্তরে সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———–” আমি ঠিকই জানতাম। যাইহোক, আমি কাছাকাছিই আছি। তুমি ওই ওল্ড কমপ্লেক্সের বড় ঘড়ির সামনে থাকো। আমি আসছি। ”
এই প্রশ্নে অর্ণব বেশ অবাক হয়েই বলে উঠলো,
————” এই ভর দুপুরে তুমি এখানে! ”
কথাটায় অস্মিতা বেশ অভিভাবকের সুরে বললো,
———-” অতো তোমায় ভাবতে হবে না। দেখা হচ্ছে। রাখলাম। ”
কথাটা বলেই অস্মিতা ফোন কেটে দিল। কিন্তু অর্ণব এই অন্ধকার সময়েও এক টুকরো আলো দেখতে পেল যেন চোখের পলকে।
সেদিন এরপর কিছুটা সময় পার করে একটা মেয়ে ঢুকেছিল হাওড়া স্টেশনে। আলগোছে বাঁধা বিনুনি, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, ফর্সা মিষ্টি মুখশ্রী, আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। অর্ণব মেয়েটাকে দেখেই কেমন ক্লান্তি ভুলে গেছিল সব নিজের। আর ওই পরিশ্রান্ত মুখেও এক চিলতে চলে এসেছিল। অস্মিতা সেই মুহূর্তে অর্ণবের খুব কাছে এসে কিরকম চিন্তায় মুখ অন্ধকার করে বলেছিল,
——–” ইশ, কি অবস্থা করেছো নিজের চেহারার! সারাদিন এইভাবে ঘুরে ঘুরে চোখ মুখ বসে গেছে পুরো। যাইহোক, সামনের কোন কল থেকে একটু হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি খাবার এনেছি তোমার জন্য। নিশ্চয়ই সারাদিনে কিছু খাওনি! ”
কথাগুলো শুনে অর্ণব অস্মিতাকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো,
———-” কে বললো খাইনি! খেয়েছি তো। ওই পাড়ার দোকান থেকে ডিম পাউঁড়ুটি টোস্ট খেয়েছিলাম। এতক্ষণ কি না খেয়ে থাকবো না কি!

অস্মিতা এই কথায় হঠাৎ অর্ণবের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো,
———” তাই বুঝি। ছুঁয়ে বলো তাহলে খেয়েছো। ”
কথাটায় সাথে সাথেই অর্ণব হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
———” কি যে করো না! কথায় কথায় এইভাবে হাত ছোঁয়ার কি আছে! ”
এটা শুনে অস্মিতা আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
———–” বুঝেছি। যাইহোক, হাত মুখ ধুয়ে এসো। আর দেরি কোরো না। ”
কথাগুলো কেমন অর্ডারের সুরে বললো যেন ও। আর অর্ণবও এরপর বাধ্য ছাত্রর মতন অস্মিতার কথা শুনলো।
তবে সেদিন অস্মিতা এক কৌটো খিচুড়ি বার করে যখন হাতে দিয়েছিল, অর্ণব কিরকম হাতে স্বর্গ পেয়েছিল যেন। গোগ্রাসে খেতে শুরু করেছিল আপন মনে। অস্মিতা বুঝেছিল এই মুহূর্তে ছেলেটা কতটা খিদে সহ্য করে ঘুরছিল এতক্ষণ! কথাগুলো ভাবতেই সেদিন অর্ণব ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
———” খিচুড়িটা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু তুমি এইভাবে নিয়ে এলে, কাকিমা কিছু জিজ্ঞেস করলো না! ”
এই প্রশ্নে অস্মিতা সাথে সাথেই বললো,
———-” মা স্নানে গেছিল তখন, আড়ালে তুলে রেখেছি এটা। আরো এক কৌটো আছে। তোমার রাতের জন্য। ”
কথাটায় অর্ণব কিরকম থমকে গেল যেন লজ্জায়। খাওয়া থামিয়ে খুব করুণ মুখে বললো,
———–” ইশ! আমার জন্য এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার আনতে হয় তোমাকে! আমি যে কিভাবে! ”
অর্ণবের কথাটাকে এই সময় শেষ হতে না দিয়েই অস্মিতা বলে উঠলো ওর হাত ধরে,
———-” অতো ভাবতে হবে না তোমাকে। আর অতো বড় হাড়ি থেকে দু কৌটো খিচুড়ি সরালে কারোর কম হবে না। আর একবার তোমার বউ হতে দাও। তখন দেখো, রোজ কত ভালো ভালো রান্না নিজের হাতে করে তোমাকে খাওয়াবো। ”
শেষ কথাটা বেশ হেসেই বললো অস্মিতা। কিন্তু এই মুহূর্তে অর্ণব আবার খাওয়া থামিয়ে ভীষণ স্থির গলায় বললো,
———-” বিয়ে! আমার মতন একটা বেকার অনাথ ছেলের সাথে তোমার মা বাবা তোমার বিয়ে দেবে! এমনিও আজ আমার চাকরিটা চলে যাবে। যা টার্গেট ছিল সেটা ফুলফিল করতে পারিনি। এরপর কিভাবে এক্সামের রেজিস্ট্রেশন এর ফি দেব, কিভাবে নিজেকে চালাবো কিছুই জানি না! কিরকম মনে হচ্ছে সব কিছু শেষ। ”
কথাগুলো বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাআপনি চলে এলো গলায়। কিন্তু এই মুহূর্তে অস্মিতা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে উঠলো,
———” আজ আমি কিছু নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। প্লিজ ‘ না ‘ বলবে না। আসলে এটা তোমার আর আমার দুজনের জন্যই আমি করেছি। অনেক ভেবে। ”
কথাগুলো কিরকম শান্ত গলায় বলে অস্মিতা ব্যাগ থেকে একটা টাকার বান্ডিল বার করে অর্ণবের হাতে দিল হঠাৎ। অর্ণব সাথে সাথে টাকাগুলো থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,
———” এ বাবা! এসব কি! অস্মিতা এই টাকাগুলো তুমি কোথা থেকে পেলে? ”
এই প্রশ্নে অস্মিতা সেই শান্ত স্বরেই বললো,
———-” আমার গলায় যে চেনটা পড়ে থাকতাম, যেটা দিদা দিয়েছিল, সেটা বিক্রি করে দিয়েছি। আর এই টাকাটা তোমাকে রাখতেই হবে। ”
কথাগুলো শুনে অর্ণব কিরকম অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
———” অসম্ভব! আমি এই টাকা কোনভাবেই নিতে পারি না অস্মিতা। আর তুমি কেন করলে এইসব! কোন দোকানে বিক্রি করেছো চেন? এক্ষুনি আমার সাথে চলো। টাকাটা ফেরৎ দিয়ে চেনটা নেবে। তুমি বুঝতে পারছো, কাকু কাকিমা যখন এইসব ব্যাপারে জানতে পারবে তখন কি হবে! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো অর্ণব। কিন্তু এইসব শুনেও অস্মিতা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে উঠলো,
———” আমি মা বাবাকে বলবো চেনটা হারিয়ে ফেলেছি আমি। জানি ঝামেলা হবে। কিন্তু তার বেশি কিছু না। আর অর্ণব তোমার ফাইনাল সেমিস্টারটা দেয়া ভীষণ দরকার। একবার বিটেক কমপ্লিট হয়ে গেলে তুমি একটা চাকরি ঠিক পেয়ে যাবে তোমার ফিল্ডে। তারপর আমরা দুজনেও এক হতে পারবো। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। আর আমি এই টাকাটা নয় তোমাকে ধার হিসেবে দিলাম। তুমি চাকরি পেলে ফিরিয়ে দেবে আমাকে। আর রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েও তোমার এখান থেকে পঁচিশ হাজার টাকা বেঁচে যাবে। সেটা দিয়ে তুমি ভালোভাবেই কটা মাস চালিয়ে নিতে পারবে। আর এছাড়াও আমি আমার কিছু বন্ধুর সাথে কথা বলেছি। শ্রেয়ার দুটো ভাই বোন এর সাইন্সের টিউশন দরকার, অঙ্কিতার কাকার মেয়েরও ইলেভেনের ম্যাথ টিচার দরকার। ওদেরকে তোমার কথা বলেছি। তোমাকে এড্রেস দিয়ে দেব। এই দুটো বাড়িতে টিউশন পড়ালে তোমার ঠিকঠাক ইনকামও হবে। আর এছাড়াও আমি চেষ্টা করছি তোমার জন্য যাতে আরো কটা টিউশন খুঁজে দিতে পারি! ”
কথাগুলো বেশ উজ্জ্বল চোখে বললো অস্মিতা। কিন্তু এইসব শুনে অর্ণব কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। ভাবেনি আসলে ওকে এই অন্ধকার সময়ের মধ্যে কেউ এইভাবে আগলে ধরবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে। তাই অস্মিতার হাত দুটো ধরে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো ছেলেটা। আসলে অস্মিতা যে ওর কারণে নিজের সোনার চেন বিক্রি করেছে, এটা ভেবে ওর মনে কাঁচ বিঁধছে যেন। তবে অস্মিতা এটা বুঝতে পারছিল সেই মুহূর্তে, তাই অর্ণবকে আরো বেশি করে আগলে ছিল ও। আসলে ভালোবাসাটা তো আজকের না! সেই স্কুলের ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে। অর্ণব তখন উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছে। একই পাড়া, একই পড়ার ব্যাচ। কখন যে অস্মিতা এই দিনগুলোতে অর্ণবকে বন্ধুর থেকে বেশি ভাবতে শুরু করেছিল নিজেও বোঝেনি। তবে সেইবার দুর্গা পুজোয় একসাথে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে অর্ণব যখন হঠাৎ ওর হাতে নিজের মনের চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিল, ফিলিংস গুলোকে কিছু শব্দে সাজিয়ে লিখেছিল অস্মিতার জন্য, সেদিন যেন মেয়েটার চারিদিকটা ওলোট পালট হয়ে গেছিল। আর একটা ভালোবাসার ঝড় উঠেছিল মনে। অর্ণবকে ভালোবাসার ঝড়।

চলবে।