#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৫>
এই ভাবনার ভিড়েই রাতটা কেটেছিল সেদিন অস্মিতার। পরেরদিন অষ্টমীর সকালে মাইকের এনাউন্সমেন্ট বেজে উঠেছিল কখন থেকে মণ্ডপে অঞ্জলীর শুরু। তবে অস্মিতা আজ এই এনাউন্সমেন্ট বাজার আগেই রেডি হয়ে গেছে। আজ আসলে ওর ভীষণ তাড়া অর্ণবের কাছে পৌঁছানোর। সেই মতন রেডিও হয়েছে স্নান করে। খোলা চুল, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, আর লাল রঙের শাড়ি। পুরো সাজটাই সেজেছে ওই ছেলেটার কথা ভেবে। আসলে অর্ণব আগে প্রায়ই বলতো অস্মিতাকে না কি লাল রঙে সব থেকে বেশি মানায়। তাই আজ নিজের জন্য এই রঙটাই বেছে নিয়েছে মেয়েটা আলতো হেসে।
যাইহোক, এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে অস্মিতা অবশেষে মণ্ডপে এসেছিল। এরপর ভিড়ের মধ্যে ও সেই চেনা মুখটাকেই খুঁজছিল। আর কিছুক্ষণের ভিড়ে দেখতেও পেল নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়ে অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে। মুখে হালকা দাড়ি, চোখে চশমা। আজ হঠাৎ অর্ণবকে দেখে সেই পুরোনো ভালো লাগাটা নতুন করে ধরা দিল মনে। অস্মিতা ভাবলো এবার চুপ করে ভিড়ের মধ্যে অর্ণবের পাশে গিয়ে ওর হাতটা ধরবে নিশ্চুপে। কিছু না বলেই বুঝিয়ে দেবে মনের কথা। সেই মতন আলতো পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল ও অর্ণবের কাছে, তবে ছেলেটার পাশে আসতেই ভাবনাগুলো সব ওলোট পালোট হয়ে গেল। ওদের দুজনের মাঝখানে হঠাৎ তিতলি এসে হাজির। নীল রঙের শাড়ি পড়ে গুচ্ছের মেক আপ করে তিতলি পড়ি সেজে অর্ণবের পাশে এসে বললো,
——-” হ্যাপি অষ্টমী অর্ণবদা। আজ কি লাগছে তোমাকে! কেউই দেখে চোখ সরাতে পারবে না। ”
তবে কথাটা শুনে ততক্ষণে অর্ণবের চোখ সরে অস্মিতার দিকে চলে গেছে। মেয়েটা কেমন থম মেরে ওদের দিকে তাকিয়ে এখন। দৃশ্যটা দেখে একবার ঢোঁক গিললো অর্ণব। তবে তিতলি এরপরও না থেমে বলে উঠলো,
——–” তুমি বললে না তো আমাকে কেমন লাগছে শাড়ি পড়ে?”
এই কথায় অর্ণব কি বলবে বুঝতে না পেরে আধো আধো স্বরে বললো,
——–” কেমন আবার লাগবে! যেমন লাগে সেরকমই লাগছে। ”
এই কথায় তিতলি বেশ জোর করে হেসে অর্ণবের গায়ে হাত দিয়ে বললো,
——–” সত্যি অর্ণবদা! তুমি না কেমন একটা! একটু ভালো করে কমপ্লিমেন্টও দিতে পারো না। কিন্তু এটাই তো আমার বেস্ট লাগে। তুমি সব ছেলেদের মতন না। কতটা আলাদা! ”
কথাগুলো পাশ থেকে অস্মিতা শুনে কেমন কান মাথা জ্বলে উঠছিল ওর। তবে এরপর তিতলি আবার বলে উঠলো,
———” একটা জিনিস কি তুমি খেয়াল করেছো আমাদের মধ্যে কমন আজ? বলো তো কি? ”
এই প্রশ্নে অর্ণব কিছু বুঝতে না পেরে বললো,
———” কমন! মানে? কি আবার কমন? ”
কথাটায় তিতলি আলতো হেসে বলে উঠলো,
———” তুমিও নীল, আমিও নীল। তোমার নীল পাঞ্জাবি, আমার নীল শাড়ি। পুরো ম্যাচিং। এগুলোকে কিন্তু বলে কপল গোলস। ”
কথাগুলো বলতে বলতে অর্ণবের গায়ে হাত রেখে কেমন রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। কিন্তু এইসব দেখে অস্মিতার আর সহ্য হলো না যেন। কেমন ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে গেল। তাই আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে ও ভিড়ের মধ্যে দূরে চলে গেল অর্ণবের কাছ থেকে। রাগে কান মাথা সারা শরীর যেন জ্বলছে। এরপর অঞ্জলীর মন্ত্রচ্চারণ শুরু হওয়ায় অস্মিতা সেটাতেই মন দিল।
সেদিন এরপর অঞ্জলী শেষে আর অর্ণবের সাথে দেখা না করেই চলে যাচ্ছিল অস্মিতা বাড়ি। তবে গলির মুখে হঠাৎ অর্ণব পিছন থেকে এসে হাতটা ধরে বললো,
——-” কি হলো? কথাবার্তা কিছু না বলে চলে যাচ্ছো যে? ”
এই কথায় অস্মিতা এবার বেশ রেগে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
——–” কথা! তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। আমি তো আজকে সব ঝামেলা মান অভিমান মিটিয়ে নেব বলেই এসেছিলাম, কিন্তু আসার পর মণ্ডপে যা দেখলাম! ওই তিতলি মেয়েটা তোমার সাথে তো পুরো ফেবিস্টিক লাগিয়ে জুড়ে আছে। এরপর আর আমার কোন কথা নেই তোমার সাথে। আর তোমার কাছে অন্য কোন রঙের জামা ছিল না? একেবারে নীল পাঞ্জাবি পরেই আসতে হলো? ভেবেই গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। ”
এই কথায় অর্ণব হোঁচট খেয়ে বললো,
——-” নীল পাঞ্জাবি! আমি কি করে জানবো তিতলিও একই রঙের শাড়ি পড়ে চলে আসবে! ”
এই কথায় অস্মিতা বেশ অভিমানের সুরেই বললো,
——–” সেই। তুমি তো কিছুই জানো না! যাইহোক আমার ধারের কাছেও আর ঘেসবে না কখনো। থাকো তুমি তোমার তিতলিকে নিয়ে। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে জোরে পা চালিয়ে চলে গেল অস্মিতা নিজের বাড়ি। কিন্তু অর্ণব কেমন থম্ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। অস্মিতা তার মানে সব ঠিক করতে এসেছিল আজ মণ্ডপে! এদিকে এই তিতলির বাড়াবাড়ির জন্য সবটা ভেস্তে গেল। না, এইভাবে চললে হবে না। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে ওকে।
সেদিন কথাগুলো ভেবেই সন্ধ্যেবেলা ওদের পাড়ার ছোট পার্কটায় ও তিতলিকে ডেকেছিল। তিতলি তো এই নিমন্ত্রণ পেয়ে লাফাচ্ছিল মনে মনে। তাহলে কি অর্ণব আজ স্পেশ্যাল কিছু বলবে ওকে! তাই এইভাবে আলাদা ডাকলো! ভেবেই ভীষণ সেজে গুঁজে হাজির হয়েছিল পার্কে। তবে অর্ণব আজ একা আসেনি। অস্মিতাদের বাড়ি গিয়ে ওকে রীতিমত জোর করে টেনে টেনে নিয়ে এসেছে পার্কে। কিন্তু তিতলি এই দৃশ্যটা দেখে ভ্রুটা কুঁচকে ফেলেছিল নিজের। হঠাৎ এই অস্মিতাদির সাথে কেন এলো অর্ণবদা! কথাটা ভাবতেই অর্ণব অস্মিতা আর তিতলিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলে উঠেছিল তিতলির দিকে তাকিয়ে,
——–” তিতলি, এই হলো অস্মিতা। আর আমি ওকেই ভালোবাসি। তাই দয়া করে আজ থেকে আমাকে লাইন মারা বন্ধ করো। ”
কথাগুলো শুনে তিতলি আকাশ থেকে পড়ে বলেছিল,
——–” মানে! এটা বলার জন্য তুমি আমাকে পার্কে ডেকেছিলে? তার জন্য আমি তিন ঘণ্টা ধরে সাজলাম! আর কি আছে অস্মিতাদির মধ্যে যেটা আমার মধ্যে নেই? ”
এই কথায় অর্ণব ক্লান্ত স্বরেই বলেছিল,
———” প্রথমত, কে বলেছিল তোমাকে এত সাজতে! আর দ্বিতীয়ত, কি আছে অস্মিতার মধ্যে আমি জানি না! আমি শুধু জানি আমার শুধু ওকেই দরকার। এই মানুষটাকে ছাড়া আমার সব কিছু ইনকমপ্লিট। আর অস্মিতা আমার কাছে সবার থেকে আলাদা। ”
কথাগুলো বলতে বলতে অর্ণব কেমন স্থির হয়ে যাচ্ছিল অস্মিতাকে দেখে। এই সময় অস্মিতাও বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্ণব ওকে এতটা ভালোবাসে! কথাটা ভাবতেই খেয়াল করলো তিতলি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে চলে গেল নিজের মতন। অর্ণব এবার অস্মিতার হাত ধরে বললো,
———” হয়েছে শান্তি? এবার আর কেউ কোন দিক থেকে আমাকে লাইন মারবে না। এবার তো রাগটা ভুলে সব মিটিয়ে নেয়া যায়? না কি এবার আমাকে কান ধরে ওঠ বোস করতে হবে? ”
এই প্রশ্নে অস্মিতা আর কোন উত্তর দিল না। হঠাৎ কিছু না বলে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরলো অর্ণবকে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যেন আঁকড়ে ধরতে চাইলো ছেলেটাকে। এতদিনের সব দূরত্ব ভেঙে ভালোবাসতে চাইলো আবার নতুন করে। এই অষ্টমীর সন্ধ্যেতে আলতো করে ছুঁয়ে দিল নিজের ঠোঁট অর্ণবের ঠোঁটে। তারপর খুব জোর দেখিয়ে বলে উঠলো,
——-” তুমি আমার। শুধু আমার। বুঝেছো? ”
অর্ণব এই কথার উত্তরে আলতো হেসে বলে উঠলো,
——–” তোমারি তো হতে চাই। সারা জীবন। ”
সেদিন এই গল্পের মাঝেই একটা গান বেজে উঠলো পাড়ার মাইকে।
” তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো, ছেড়ে দিব না। ”
আর এই গানের লাইনগুলোর সাথে যেন মিলে গেল অস্মিতা আর অর্ণবের জীবনের গল্পটাও।
( সমাপ্ত )