তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০২

0
7

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২>
সেদিন তবে অর্ণবের চাকরি চলে গেলেও আর কোন সমস্যা হয়নি। অস্মিতার দেয়া টাকা থেকেই পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিল ও। আর হাতে বেশ কিছু টাকা বাকি থাকায় একার সংসার চালানোর চিন্তাটাও মাথা থেকে হালকা হয়েছিল। এছাড়াও অস্মিতার দেয়া টিউশন গুলো পড়িয়ে মাস গেলে একটা ঠিকঠাক টাকা হাতে আসছিল। তাই নিজের পড়াশোনাতেও মন দিতে পারছিল। আসলে এটাই ওর কাছে একমাত্র সুযোগ। অস্মিতার জন্য, নিজের জন্য ভালো রেজাল্ট করতেই হবে, যাতে প্লেসমেন্ট পেতে অসুবিধা না হয়। মেয়েটা ওর জন্য নিজের সোনার চেন বিক্রি করে দিয়েছে। এইভাবে পাশে না দাঁড়ালে তো অর্ণব কোনভাবেই আজ এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারতো না!
তবে এই চেন বিক্রির জন্য যদিও অস্মিতাকে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেদিন তো বিকেলে বাড়ি ফেরার পর মা যখন ওর গলায় চেনটা দেখতে পায়নি, তখন তো ভীষণ চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছিল। রাগের মাথায় অস্মিতার গায়ে হাতও তুলেছিল দু তিনবার। সেই মুহূর্তে মা কে বাবাকে চেনটা নিয়ে এইভাবে মিথ্যে কথা বলতে সত্যি খুব খারাপ লাগছিল, কিন্তু কোন উপায় ছিল না। অর্ণব ওই সেলস্ বয়ের চাকরি করে এই কদিনে কোনভাবেই পরীক্ষার টাকা জোগাড় করতে পারতো না! তাই এই চেন বিক্রি ছাড়া কোন রাস্তা খোলা ছিল না অস্মিতার। তবে মা বাবা কেন জানে না সন্দেহ করেছিল ওকে। ওর আধো আধো কথায় এটা কোনভাবেই বিশ্বাস করেনি যে ওই সোনার চেন হারিয়ে গেছে। এমনকি বাবা ওর ব্যাগ, আলমারি, ঘর রীতিমত সার্চ করেছিল টাকাগুলো পাওয়ার জন্য। কিন্তু সব কিছুতেই ব্যার্থ হয়ে শেষে প্রায় আট দশদিন কথা বন্ধ করে দিয়েছিল মা বাবা দুজনেই মেয়েটার সাথে। এই মুহূর্তে অস্মিতার কেমন বুকে পাথর জমে থাকতো যেন। চোখ দুটো ভিজে আসতো বার বার। মা বাবার কাছে ও সত্যিই দোষী। আর সেই জন্য সারাক্ষণ একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। কিন্তু অর্ণব এর জন্য এই অপরাধটা যে ওকে করতেই হতো! ছেলেটার মা বাবা কেউ নেই। আত্মীয় স্বজন সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অস্মিতাও যদি সাথে না থাকে তাওলে তো ছেলেটা হারিয়ে যাবে অন্ধকারে! এই ভাবনা গুলোই অস্মিতাকে মা বাবার সামনে চুপ করে থাকতে বাধ্য করতো।
যাইহোক, এইভাবে বেশ কটা দিন পার হয়ে যাওয়ার পর অর্ণবের লাস্ট সেমিস্টার শুরু হয়েছিল। সেই সময় সময় নষ্ট হবে বলে তো প্রথমে অস্মিতা ছেলেটার সাথে দেখা করতেই রাজি হচ্ছিল না শেষ এক মাস। কিন্তু অবশেষে অনেক সাধ্য সাধনা করে অর্ণব পরীক্ষার আগেরদিন অস্মিতাকে একবার দেখবে বলে ডেকে পাঠিয়েছিল গঙ্গার ঘাটে। অস্মিতাও আর ওই কাতর স্বর শুনে না করতে পারেনি। বিকেলের দিকে এসেছিল ঘাটে। সেদিন অর্ণব ওকে দেখে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল কেমন। আসলে জীবনে একটামাত্র নিজের মানুষ আছে, যার জন্যই ওর পুরো পৃথিবীটা আজ সম্পূর্ন। তাকে না দেখে থাকাটা সত্যিই ভীষণ কঠিন। সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই ওর চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। কিন্তু আচমকা একটা ধাক্কা যেন এক মুহূর্তে অর্ণবকে এই ভাবনা থেকে বার করে মাটিতে ফেলে দিল। আর তারপরই ওর কিছু বোঝার আগেই তিন চারটে কিল ঘুষি চড় পড়তে শুরু করলো শরীরে। অস্মিতার বাবা আজ মেয়ের পিছন পিছন এসেছিল এই গঙ্গার ঘাটে। অয়ন বাবু ওই চেন বিক্রির দিন থেকেই সন্দেহ করছিল যে নিশ্চয়ই কোন একটা চক্কর চলছে মেয়ের। আর আজ সন্দেহটা সত্যি হলো। কথাগুলো ভেবেই উনি অর্ণব কে ছেড়ে অস্মিতাকে প্রায় ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
———-” যেটা ভেবেছিলাম সেটাই মিললো শেষে! তুই এই ছেলেটার জন্যই তোর দিদার হার বিক্রি করেছিস। সত্যি করে বল? এই ছেলেটাই ভুলভাল বুঝিয়ে তোর থেকে টাকা আদায় করেছে তাই না?”

কথাগুলো শুনে অস্মিতা চোখে জল নিয়েই বলে উঠলো,
——–” তুমি অর্ণবের ব্যাপারে এইসব বলছো কি করে বাবা! তুমিও জানো ও ওরকম ছেলে না। কতদিন ধরে দেখছো তুমি ওকে পাড়াতে। টাকাটা আমিই ওকে দিয়েছি, কারণ ওর পরীক্ষার জন্য! ”
না, কথাটাকে অস্মিতার শেষ হতে না দিয়েই অয়ন বাবু এবার অর্ণবের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
———” ভালোই খেয়েছো আমার মেয়ের মাথাটা। ছিঃ! লজ্জা হলো না এইভাবে একটা মেয়ের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে? তবে তোমার মতন ছেলের মনে হয় লজ্জা জিনিসটাই নেই। যাইহোক, আজ আমি বলে গেলাম। দূরে থাকবে আমার মেয়ের কাছ থেকে। এটা কিন্তু একটা ওয়ার্নিং.. ”
কথাগুলো বলে উনি অস্মিতার হাতটা ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল সেদিন গঙ্গার ঘাট থেকে। তবে অয়ন কিরকম ডুকরে কেঁদে উঠেছিল সেই মুহূর্তে। অপমানে লজ্জায় কষ্টে মনটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছিল যেন।
চলবে।