#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
কিন্তু সেদিন প্রায় রাত দুটোর সময় অস্মিতা অর্ণবকে ফোন করেছিল। অর্ণব যদিও ভীষণ থমকে ছিল। কিন্তু অস্মিতা আজ খুব স্থির গলায় বলেছিল,
——–” ভেঙে পড়লে চলবে না কিন্তু। বাবার প্রত্যেকটা কথার উত্তর তোমার রেজাল্ট দেবে অর্ণব। যেভাবেই হোক ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে প্রুভ করে দাও আমি কোন ভুল করিনি। আর আমার জন্য তোমাকে এটা করতেই হবে। ”
সেদিন কথাগুলো ছেলেটাকে যেন নতুন করে লড়তে শিখিয়েছিল। যেভাবেই হোক অস্মিতার বাবাকে এটা বোঝাতেই হবে অর্ণব লোভী নয়। অস্মিতা কোন ভুল করেনি ওকে ভালোবেসে। আর একটা ভালো রেজাল্টই এর উত্তর। সেদিন এইসব ভেবেই অর্ণব বলেছিল,
———” আমার জন্য আর কোন খারাপ সিচুয়েশন তোমাকে ফেস করতে হবে না অস্মিতা, কথা দিলাম। তুমি তোমার বাবার কথা শুনবে। এরপর আর আমরা কোনভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবো না। যতদিন না পর্যন্ত আমি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারছি, আমি আর তোমার সামনে আসবো না। ”
কথাগুলো বলেই অর্ণব সেদিন ফোনটা রেখে দিয়েছিল। আসলে আজকের অপমানটা ভীষণভাবে লেগেছে ওর। তাই এতটা কঠিন হয়ে গেছে যেন। তবে অস্মিতার কথাগুলো শুনে কিরকম নিঃস্ব লাগছিল হঠাৎ। কিভাবে এই ছেলেটার থেকে দূরে থাকবে এতদিন ভেবে পাচ্ছিল না!
তবে এর দু তিন দিন বাদে বাড়ির শাসন যখন একটু আলগা হয়েছিল, অস্মিতা লাইব্রেরি যাবার নাম করে ভীষণ অস্থির মনে ছুটে এসেছিলো অর্ণবের বাড়িতে। আসলে এই কদিন অর্ণব না ওর ফোন রিসিভ করেছে, না ওর কোন মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছে! অস্মিতা এইসব দেখে বুঝেছে সেদিনের ছেলেটার বলা কথাগুলো হয়তো সত্যি! অর্ণবের আত্মসম্মানে লেগেছে আসলে বাবার কথাগুলো। তাই এতটা কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু অস্মিতা তো পারবে না এইভাবে! এই ছেলেটা ওর কাছে এতটা দামি যে দিনের পর দিন এইভাবে ছেড়ে থাকা সম্ভবই না! সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই ও অর্ণবের বাড়ির দরজা ধাককে অর্ণব অর্ণব বলে চিৎকার করে ডেকেছিল ওকে। ইচ্ছে করেই শুধু বেল না বাজিয়ে নিজে ডেকে উঠেছিল। ভেবেছিলো ওর গলার আওয়াজ শুনে অর্ণব কিছুতেই এতটা কঠিন হয়ে থাকতে পারবে ন। ঠিক দরজা খুলে ওর সামনে এসে দাঁড়াবে।
কিন্তু ভাবনাগুলো মিললো না ঠিক ! আধ ঘন্টা ধরে এতো ডাকার পরেও অর্ণব সেদিন দরজা খোলেনি। শেষে অস্মিতার ফোনে শুধু মেসেজ এসেছিলো একটা, ছেলেটার নাম্বার থেকে। সেখানে কিছু শব্দে লেখা ছিল,
” প্লিজ তুমি যাও। এইভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমি একদিন আসবো তোমার কাছে। মাথা উঁচু করে তোমার বাবার কাছে গিয়ে তোমাকে চাইবো। কিন্তু আজ সেই সময়টা আসেনি। প্লিজ এটা বোঝার চেষ্টা করো। এখন আমি তোমার সাথে কন্ট্যাক্ট রাখতে পারবো না। ”
কথাগুলো পড়ে অস্মিতা কিরকম থমকে দাঁড়িয়েছিল যেন কিছুক্ষণ! ও ভাবতে পারেনি অর্ণব ওর গলার আওয়াজ এইভাবে দরজা বন্ধ করে রাখবে। যেই ছেলেটা অস্মিতার একটা ডাকে ওর কাছে এসে হাজির হতো, সে আজ এতো কঠিন ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল। তারপর দরজা বন্ধ করে একা ঘরে বসে ছিল অনেকক্ষণ।
তবে সেদিনের পরেও অস্মিতা বহুবার ফোন করেছে, মেসেজ করেছে অর্ণবকে। অন্তত মাসে একবার দেখা করার জন্য বলেছে বার বার। কিন্তু অর্ণব এইসবের কোন উত্তর দেয়নি। আসলে অর্ণবের এখন একটা জেদ চেপে গেছে , নিজেকে প্রমাণ করার জেদ। যেদিন পাশ করে একটা ভালো চাকরি পেয়ে অস্মিতার বাবাকে ওই চেন বিক্রির সমস্ত টাকা ফেরৎ দিতে পারবে, লোকটার কাছে প্রমাণ করতে পারবে যে ওনার মেয়ে কোন ভুল করেনি, সেদিন অস্মিতার কাছে যাবে। আর নিজে যদি নিজেকে এই নির্বাসন না দেয়, তাহলে ভালো রেজাল্ট করার, চাকরি জোগাড় করার এতো বেশি খিদে ওর মধ্যে থাকবে না। আসলে অস্মিতাকে সারা জীবনের মতন পাওয়ার জন্যই আজ অস্মিতার থেকে দূরে সরে থাকতে হচ্ছে অর্ণবকে।
তবে এই দিন গুলোতে অস্মিতার মন ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যাচ্ছে কেমন। মনে হচ্ছে বাবা আর অর্ণবের এই লড়াই এর মাঝে সব থেকে বেশি যন্ত্রণা ওকে ভোগ করতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অর্ণবের জীবনে ও নিজের যতটা অস্তিত্ব আছে ভাবতো, সেটা ভুল ছিল। নইলে এইভাবে এতগুলো মাস অর্ণব একদম চুপ হয়ে থাকতে পারতো না। এমনকি সেদিন সেই বৃষ্টির দিনে অটো স্ট্যান্ডে অর্ণবের সাথে দেখা হয়েছিল। রাস্তার দু পাশে ছিল ওরা। বৃষ্টি ভেজা শহরে সেদিন অর্ণবের জলছবি দেখে অস্মিতার চোখ দুটো ভিজে গিয়েছিল। খেয়াল করেছিল অর্ণবও ওর দিকে থমকে তাকিয়ে। প্রায় পাঁচ মাস বাদে আজ আবার দেখা দুজনের। এই মুহূর্তে অস্মিতা প্রায় দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে যেতে গিয়েছিল অর্ণবের কাছে। কিন্তু খেয়াল করেছিল অর্ণব এটা দেখেই একটা চলতি অটো দাঁড় করিয়ে উঠে বসেছিল। তারপর অস্মিতাকে পিছনে ফেলে চলে গিয়েছিল অনেক দূর! কিন্তু অস্মিতা সেই মুহূর্তে পাথরের মতন দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আজ মনে একটা ধারালো কাঁচ বিঁধেছে যেন। এইভাবে অর্ণবের মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়াটা ও আর মানতে পারেনি এতদিন বাদে। আজ মনে হচ্ছে কিছু হয়তো ছিলই না কোনদিন দুজনের মধ্যে! সবটাই অস্মিতার একতরফা।
চলবে।