তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০৪

0
5

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৪>
সেদিনের পর অস্মিতাও বন্ধ করে দিয়েছিল অর্ণবকে ফোন আর মেসেজ করা। যে নিজে যোগাযোগ রাখতে চায় না, তার কাছে বার বার এইভাবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে যাওয়ার আর কোন মানে হয় না। কিন্তু এই ফোনটা ওকে ভুলতে দিচ্ছে না কোন কিছু। এতদিনের এত পুরনো হোয়াটস অ্যাপ চ্যাট, একসাথে ছবি, এত মুহূর্তের ভিড় যেন তাড়া করে বেরায় অস্মিতাকে। তাই একদিন ঠিক করলো এই মোবাইলটাই বদলে ফেলবে। এতদিনের টিউশন পড়ানোর সমস্ত জমানো টাকা দিয়ে এরপর নতুন ফোন আর সিম নিল। তারপর এই পুরনো ফোনটাকে আলমারির লকারে বন্দি করে রাখলো অনেক রাগ আর অভিমান নিয়ে। কিন্তু এই সময় ও বাড়িতেও কথা বলা একদম কমিয়ে দিয়েছিল। যেন বাবা মায়ের ওপরও নিঃশব্দে একটা রাগ জমেছিল অস্মিতার মনে। অয়নবাবু এটা বহুদিন ধরেই খেয়াল করেছিলেন। তাই মেয়ের মন গলানোর জন্য দু সপ্তাহের বেড়াতে যাওয়া প্ল্যান করলেন। অস্মিতা যদিও এটা শুনে প্রথমে রাজি হয়নি। মামাবাড়ি চলে যাবে দু সপ্তাহের জন্য ঠিক করেছিল। কিন্তু মা বাবার জোরাজুরিতে অবশেষে রাজি হতেই হল।
কিন্তু এই দু সপ্তাহে একটা ঘটনা ঘটে গেল। অবশেষে অর্ণবদের প্লেসমেন্ট হল, আর ছেলেটা একটা বিশাল বড় মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। স্যালারি পার মন্থ দেড় লাখ। তবে প্রথম আট মাস ওকে নিউ ইয়র্কে গিয়ে সেখানকার ব্রাঞ্চে কাজ করে আসতে হবে। তারপর কলকাতার অফিসে পোস্টিং। আর এই এতগুলো দিনে অর্ণব টিউশন পড়িয়ে ওই চেন বিক্রির পঞ্চাশ হাজার টাকাও জমিয়ে ফেলেছে। তাই অবশেষে সেই সময়টা চলে এসেছে যখন অর্ণব মাথা উঁচু করে অস্মিতার বাবার সামনে দাঁড়াবে। সেদিনের সেই তীব্র অপমানের একটা উত্তর দেবে। এইসব ভেবেই সেই চাকরি পাওয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা ও এসেছিল অস্মিতাদের বাড়ি। কিন্তু এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কেমন। অস্মিতাদের বাড়িতে একটা বড় তালা ঝুলছে। তাহলে কি ওরা নেই বাড়িতে! প্রশ্নটা মনে আসতেই পাশের বাড়িতে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল অর্ণব। তখন অস্মিতার পাশের বাড়ির সেই ভদ্রলোক বলেছিলেন,
——–“ ওরা তো কোথায় একটা বেড়াতে গেছে দু সপ্তাহের জন্য। আজ সকালেই ট্রেন ছিল। এখন থাকবে না অয়নবাবুরা বেশ কদিন। “
কথাগুলো শুনেই অর্ণবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। এদিকে ওর তো দশ দিনের মাথায় নিউ ইয়র্কে জয়েনিং। সেই মতন কোম্পানি টিকিট রেডি করছে। পাসপোর্ট ওর আগেই ছিল। কোম্পানি থেকেই ভিসার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু একবার চলে গেলে তো আট মাসের আগে ফিরতে পারবে না! অস্মিতাকে কথাগুলো বলতেই হবে।
এই ভেবেই সেদিন অস্মিতার ফোনে কল করেছিল ও অনেকদিন বাদে। এমনিতেই এতদিন জোর করে দূরে থেকেছে। এরপর আর এক মুহূর্ত নষ্ট করা সম্ভব না। কথাগুলো ভেবেই ফোনটা কানে ধরেছিল, অস্মিতার গলার আওয়াজ শুনবে বলে। কিন্তু আজ সেই নাম্বারটা সুইচ অফ। অর্ণবের এই সময় যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল কোথায় গেল মেয়েটা! নিজের সাথে সমস্ত রকমের যোগাযোগের ব্যাবস্থা বন্ধ করে হারিয়ে গেল কি হঠাৎ! এই সময় অর্ণব বুঝলো তাহলে এই দীর্ঘ সাত মাস অস্মিতার ঠিক কেমন লেগেছিল! এতদিন যখন অর্ণব ওর ফোন ধরেনি, মেসেজের রিপ্লাই দেয়নি, এমনকি দেখা হয়ার পরেও কোন রকম কথা না বলে চলে গেছিল, তখন ঠিক কতটা দম বন্ধ হয়ে এসেছিল অস্মিতার!
আজ যেন নিজেকে ভীষণ ভুল আর স্বার্থপর মনে হচ্ছে ওর। এতদিন শুধু নিজের জেদের কথাই ভেবে গেল। নিজের অপমান, নিজের আত্মসম্মান। কিন্তু অস্মিতার কথাটা তো ভাবলোই না! ওর যে এই জোর করে তৈরি করা দূরত্বগুলোকে মানতে কষ্ট হবে, সেই কথা তো ভেবে দেখেনি অর্ণব! এই এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই এরপর দুটো দিন কাটলো। এই সময় হঠাৎ অর্ণবের মনে হলো তাহলে কি অস্মিতা নিজের ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে! যেই নম্বর অর্ণব জানে না। কথাটা ভেবেই অস্মিতার যেই দুজন বন্ধুর বাড়ি ও পড়াতে যেত, তাদের সাথে যোগাযোগ করে অর্ণব নাম্বার পাওয়ার চেষ্টা করলো মেয়েটার। কিন্তু সেখানেও ‘না’ ই শুনতে হল ওকে। সেই দুজন বন্ধুই বললো যে চার মাস আগে মাস্টার্স শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অস্মিতার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই ওদের। তাই নতুন ফোন নাম্বারের ব্যাপারে কিছুই জানে না।
তবে কথাগুলো শুনে অর্ণবের সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিল না নিউ ইয়র্ক যাওয়ার আগে কিভাবে সব কিছু জানাবে অস্মিতাকে। পাড়ার কজন চেনা বন্ধু ছিল ওদের দুজনেরই। তাদেরও অস্মিতার নতুন নাম্বারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল অর্ণব। কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারেনি। এইসব শুনে অর্ণবের হঠাৎ মনে হয়েছিল তাহলে কি একবার কথা বলারও কোন সুযোগ পাবে না অর্ণব! কথাটা ভেবেই শেষে একটা মেল করেছিল ও অস্মিতাকে। যদিও এই পুরনো মেল বক্স আর চেক করে না অস্মিতা। তাই মেলটা যেমনকার সেরকম পড়েই রইলো অদেখা হয়ে। আর অবশেষে অর্ণবকে উত্তরহীন হয়েই চলে যেতে হল নিউ ইয়র্ক নিঃস্তব্ধে।
তবে এরপর অস্মিতার মনের ক্ষতটা আরো বেশি গভীর হতে শুরু করেছিল। এখন মনে হয় অর্ণব কোনদিন ওকে ভালোইবাসেনি। সবটা মিথ্যে। আসলে অর্ণবদের পাশের বাড়ির এক কাকুর মুখে শুনেছিল অর্ণব নিউ ইয়র্ক চলে গেছে। একই পাড়া বলে খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। কথাটা শুনে অস্মিতা স্থির হয়ে ছিল যেন কয়েক সেকেন্ড পাথরের মতন। এতটা দামহীন অপ্রয়োজনীয় ও অর্ণবের জীবনে! ছেলেটা দেশ ছেড়ে চলে গেল, কিন্তু তাও ওর সাথে কোন যোগাযোগ করলো না! কথাটা ভেবেই চোখের জলে চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কেমন। আর মনটা পাথরের মতন কঠিন। সত্যি, যে ওর কথা ভাবেই না, তাকে নিয়ে অস্মিতাও আর ভাববে না। আর একতরফা কষ্ট পাবে না। ভালোবাসার দ্বায় তো শুধু ওর ছিল না! তাহলে কষ্ট পাবার দ্বায় একা ওর কেন হবে! কথাগুলো ভেবেই ধীরে ধীরে নিজের মনের জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল অস্মিতা এক এক করে। কাউকে ভালোবেসে এতটা কষ্ট না পেলে বোধ হয় সেই মানুষটার নামও ভুলে যেতে ইচ্ছে করে না। পুরনো স্মৃতিগুলোকে জোর করে বালি চাপা দিয়ে দেয় না মন।
চলবে।