তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০৫

0
4

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
কিন্তু অর্ণবের কাছে প্রত্যেক্ টা দিন এবার কেমন বদ্ধ গুমোট হয়ে আসছে। নিউ ইয়র্কে এত বড় অফিস, ফ্ল্যাট, নতুন কাজ, নতুন জীবন কিছুই যেন আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কোথাও কি খুব বড় ভুল করলো! অফিসকে বুঝিয়ে আর একটা সপ্তাহ কি অপেক্ষা করা যেত না অস্মিতার! মেয়েটা নিশ্চয়ই ফিরে পাড়ার কারোর মুখে শুনবে অর্ণব বিদেশ চলে গেছে। তারপর অস্মিতা কি ওকে খুব খারাপ ভাববে! স্বার্থপর মনে করবে! চিন্তাগুলো যেন তাড়া করে বেড়াতো অর্ণবকে। তারপর নিজেই নিজের মনকে বোঝাতো, যদি অস্মিতা ভুল ভেবেও থাকে তাহলেও যেদিন অর্ণব কলকাতা ফিরে ওদের বাড়ি যাবে বিয়ের কথা বলতে, সেদিন অস্মিতার সমস্ত ভুল ভেঙ্গে যাবে। আর অর্ণবকে দেখে ও আর নিজেকে দূরেও সরিয়ে রাখতে পারবে না। এইরকম এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই নিজের মনকে শান্ত করতো ছেলেটা। আর হারিয়ে যেত কাজে। মনে হতো এতগুলো মাসে কত কথা জমে আছে দুজনের। কত কিছু বলার আছে অর্ণবের! ওর স্ট্রাগল, রোজের ঘটনা, চাকরির ইন্টারভিউর দিনের ঘটনা, এই নিউ ইয়র্কে থাকার কত কত এক্সপিরিয়েন্স! কত কি বলতে হবে অস্মিতাকে। কথাগুলো ভেবেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। এই ব্যাস্ত সময়ের মাঝে যে টুকু খালি সময় আছে, সেখানে কলকাতায় থাকা সেই মেয়েটার কথা ভেবে মনটা হু হু করে অর্ণবের। ভালোবাসতে মন চায় ভীষণ।
এইভাবেই অবশেষে ন মাসের নির্বাসন কাটিয়ে ছেলেটা আর একটা কলকাতা ফেরার টিকিট হাতে পেয়েছিল। সেদিন টিকিট দেখে মনে হয়েছিল অস্মিতাকে পাওয়ার চাবিকাঠি এটা। এরপর জোর কদমে প্যাকিং করে নিউ ইয়র্কের অফিসের পার্ট চুকিয়ে সেই সপ্তাহের শেষে অর্ণব কলকাতার জন্য ফ্লাইটে উঠে বসেছিল। এরপর প্রায় চোদ্দ ঘন্টার জার্নি পেরিয়ে ছেলেটা ফিরেছিল নিজের দেশে, নিজের শহরে। সেই সময় ঘরিতে রাত একটা। সময়টা এত রাত না হলে অর্ণব মনে হয় সেই মুহূর্তেই ব্যাগপত্তর হাতে পৌঁছে যেত অস্মিতাদের বাড়ি। কিন্তু এই মাঝরাতে নিরুপায় হয়ে বাড়িই ফিরতে হয়েছিল। তবে পরেরদিন সকাল দশটার সময় সমস্ত জেট ল্যাক উপেক্ষা করে অর্ণব সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা, নিজের মার্কশিট, নিজের কনফার্মেশন লেটার নিয়ে পৌঁছেছিল অস্মিতাদের বাড়ি। তারপর নিজেকে শান্ত করে বাজিয়েছিল কলিংবেল।
সেদিন রবিবার ছিল। তাই অস্মিতাদের বাড়িতে কারোরই অফিস নেই। অস্মিতাও এখন আসলে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে কাজ করে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো বেশ ব্যাস্তই থাকে তাই। যাইহোক, অয়নবাবু এই কলিংবেলের আওয়াজ শুনে খবরের কাগজ রেখে আলতো স্বরে দরজা খুলেছিল। তবে এরপর স্থির হয়ে গিয়েছিলেন উনি হঠাৎ অর্ণবকে দেখে। মুখটা চেনা হলেও বাকি সবই অচেনা। আর সেই অযত্নের ছাপ নেই চেহারায়। কোর্ট প্যান্ট পড়া কোন নামি দামি লোক দাঁড়িয়ে আছে সামনে মনে হলো। চোখে দামি ফ্রেমের চশমা, হাতে ব্র্যান্ডেড ঘড়ি, ব্র্যান্ডেড জুতো, সবটা মিলিয়ে অয়নবাবু কেমন কথা হারালেন যেন। সেই মুহূর্তে অর্ণবই বলে উঠলো,
——“ ভিতরে আসতে পারি?”
এই কথায় অয়নবাবু তুতলে বললেন,
——-“ তু তু তুমি! এখানে?”
কথাটায় অর্ণব বেশ শান্ত গলায় বললো,
——-“ কথা আছে কিছু। আসলে কিছু উত্তর দেয়ার বাকি ছিল। তাই এসেছি নিউ ইয়র্ক থেকে আপনার কাছে। “
কথাগুলো শুনে অয়নবাবুর পাড়ার লোকের কথা মনে পড়ে গেল। শুনেছিল বেশ কয়েকবার অর্ণব বিদেশ গেছে না কি! তার মানে কথাটা সত্যি। কথাগুলো ভেবেই অয়নবাবু আর কোন কথা না বাড়িয়ে সরে দাঁড়ালেন দরজা থেকে। অর্ণবের সেই সময়ে স্থির পায়ে বাড়িতে ঢুকেই চোখ পড়ে গেছিল দূরে ডায়নিং টেবিলে বসে থাকা অস্মিতার দিকে। কত যুগ পরে দেখছে মনে হল! এই দু বছরে একটা কালো ফ্রেমের চশমা জুড়েছে মুখে। বাকি সব একই আছে। সেই নিস্পাপ মিষ্টি মুখশ্রী। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অস্মিতা আনমনে কফির কাপ হাতে পেপারে চোখ রেখেই বলে উঠলো,
——-“ কে এসেছে বাবা? এতক্ষণ ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে কি করছো?”
কথাগুলো বলে আনমনে চোখ তুলতেই থমকে গেছিল অস্মিতা। অর্ণব! এতদিন বাদে ওর বাড়িতে! কেমন যেন পাথরের মূর্তির মতন হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। বুকটা শুকিয়ে এসেছিল ওর অর্ণবকে দেখে। মনে হচ্ছিল দেড় বছর বাদে কেন এসেছে ছেলেটা! যখন সব শেষ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করেছিল অর্ণব কেমন নিস্পলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। অর্ণবের আসলে এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে অস্মিতাকে আঁকড়ে ধরতে ভীষণভাবে। কিন্তু না, আর একটু অপেক্ষা ওকে করতেই হবে। অয়নবাবুকে সেইদিনের উত্তর দেয়ার পরই অস্মিতার কাছে যাবে অর্ণব। কথাগুলো ভেবেই ও পঞ্চাশ হাজার টাকা বার করে ড্রইং রুমের সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর অয়নবাবুর কাছে গিয়ে নিজের মার্কসশিট আর চাকরির কনফার্মেশন লেটার দিয়ে বলেছিল,
——–“ দেড় বছর আগে আপনি আমাকে ভুল বুঝেছিলেন। আমি অস্মিতার কাছ থেকে টাকাটা নিরুপায় হয়েই নিয়েছিলাম। এম বি এর ফাইনাল সেমিস্টারটা নইলে দিতে পারতাম না। টাকাটা আমি ফিরিয়ে দিলাম। আর এটা আমার এম বি এর মার্কসশিট আর চাকরির কনফার্মেশন লেটার। স্যালারি পার এনাম এইটিন ল্যাকস। মনে হয় এখন আপনার কোন আপত্তি থাকবে না যদি আমি আপনার মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখি! আসলে আমার মা বাবা কেউ নেই। তাই আমি নিজেই বলছি, আমি অস্মিতাকে বিয়ে করতে চাই। আর আপনাদের ইচ্ছা থাকলেই সেটা হবে। জোর করে আমি কিছুই করবো না। সেই জন্য এতগুলো দিন আমি ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। “
চলবে।