তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো পর্ব-০৬

0
4

#তোমায়_হৃদমাঝারে_রাখিবো ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
< ৬ >
কথাগুলো শুনে অয়নবাবু কিরকম চুপ করে গেছিলেন যেন। বুঝেছিলেন ওনার সেদিনের সেই গঙ্গার ঘাটের ব্যাবহারটা কতটা ভুল ছিল। একজন সৎ ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারেননি উনি। তার শাস্তি হিসেবেই হয়তো নিজের মেয়ে আজ কাছে থেকেও দূরে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই উনি নিজের চোখ দুটো নামিয়ে বলেছিলেন,
———“ তুমি সত্যি আজ আমাকে একটা বড় শিক্ষা দিলে বাবা। কাউকে প্রথমবার দেখে বিচার করতে নেই। আমি সত্যিই সেদিন ভুল ছিলাম। আর তোমার মতন ছেলে যদি একটা মেয়ের জীবনে আসে তাহলে পৃথিবীর কোন বাবারই কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। আমারও নেই। “
কথাগুলো শুনে অর্ণবের মুখে হাসি। তার মানে এতদিন ধরে যেটা প্রমাণ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছিল, আজ অবশেষে সেটা প্রমাণ করতে পেরেছে। অস্মিতার প্রতি ভালোবাসায় যে ওর কোন স্বার্থ ছিল না, সেটা প্রমাণ করতে পেরেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অয়নবাবু বলেছিলেন,
——–“ তোমার নিশ্চয়ই অস্মিতার সাথে অনেকদিনের অনেক কথা জমে আছে। তোমরা ওপরে দোতলায় যাও। আলাদা করে কথা বলো গিয়ে।“
কথাগুলো অয়নবাবু শান্ত গলায়ই বলেছিলেন। অর্ণব সেটা শুনে সাথে সাথেই দু পা বাড়িয়েছিল অস্মিতার দিকে। কিন্তু অস্মিতা এই মুহূর্তে হঠাৎ বলে উঠলো,
———“ দাঁড়াও। আর আসার দরকার নেই, কারণ আমার তোমার সাথে আলাদা করে আর কোন কথা নেই। এই দেড় বছরে আমিও অনেক কিছু বুঝেছি। সেই জন্য এই বিয়েটা সম্ভব না। প্লিজ তুমি এসো। এন্ড অল দ্যা বেস্ট ফর ইওর নিউ লাইফ। “
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অস্মিতা জোরে পা চালিয়ে চলে গেছিল সেদিন ড্রইং রুম থেকে। কিন্তু অর্ণবের চারিদিকটা যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। অয়নবাবু এই সময় বুঝতে পারেনি মেয়ে কেন না বলল এইভাবে! এতদিন যে এই ছেলেটাকে ছাড়া গুমরে গুমরে ছিল! সেটা তো অয়নবাবু নিজেও খেয়াল করেছে। তাহলে আজ যখন অর্ণব ফিরে এলো তখন অস্মিতা এইভাবে সবটা ভেঙ্গে কেন দিল! কথাগুলো ভেবেই উনি অর্ণবের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘
——–“ তুমি ওপরে ওর ঘরে গিয়ে কথা বল মেয়েটার সাথে। হতে পারে ওর অভিমান হয়েছে! তুমি গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।“
কথাগুলো শুনে অর্ণব যেন বুকে বল পেল একটু। তারপর অস্থির মনে গেল অস্মিতার ঘরে। এই সময় অস্মিতা ওর খাটে চুপ করে বসে ছিল। যেন একটা বিরাট ঝড় চলছে মনে। কিন্তু অর্ণব সেই ঝড়ের মাঝেই উদ্ভ্রান্তের মতন এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। দুটো ব্যাকুল চোখে ওকে যেন কত কি বোঝাতে চাইলো! অস্মিতা তবে বেশ অবাক হয়েই বলে উঠলো,
” তুমি এখানে? তোমাকে তো যেটা বলার সেটা বলেই দিয়েছিলাম নিচে। তাহলে আবার কেন এসেছো? কোন কথা নেই তোমার সাথে আমার। ”
কথাগুলো বেশ জোর দেখিয়ে বললো অস্মিতা। কিন্তু অর্ণব এবার ওর হাত দুটো ধরে বাচ্চাদের মতন কেঁদে ফেললো কেমন। তারপর আধো স্বরে বললো,
———” অস্মিতা প্লিজ। প্লিজ এইভাবে বোলো না। আমি জানি আমি এতদিন তোমার সাথে কোন কনট্যাক্ট রাখিনি। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরিভাবে পাওয়ার জন্যই এইসব! ”
না, কথাগুলোকে অর্ণবের শেষ হতে না দিয়েই অস্মিতা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল,
———” প্লিজ থাক। তোমার কারণ, তোমার লজিক কিছুই জানার আমার দরকার নেই। কারণ তুমি এইসব কিছু আমাকে জিজ্ঞেস করে করোনি। তোমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে তুমি সেটা করেছো। আর আজ আমার যেটা ঠিক মনে হবে আমি সেটা করবো। তুমি বাবার কাছে যদিও একটা বিশাল মাইনের চাকরি দেখিয়ে নিজের দামটা বাড়িয়ে নিতে পারো, কিন্তু আমার কাছে মানুষ বিচারের মাপকাঠি টাকা নয়। সেটা হলে দেড় বছর আগে তোমাকে ভালোবাসতাম না। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে অস্মিতা থামলো এবার। আসলে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। গলাটা ধরে আসছিল তাই। তবে এই মুহূর্তে নিজেকে সামলে অস্মিতা আবার বলে উঠলো,
———” আমি আসলে কিছু জিনিস খুব ভুল ভাবতাম তোমাকে নিয়ে। আমি ভাবতাম যে আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না। আমি তোমার লাইফে খুব ইম্পর্টেন্ট। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এই দেড় বছর আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমার থাকা না থাকায় তোমার বিশেষ কিছু যায় আসে না। বরং তুমি খুব ভালোই থাকো। নিজেকে খুব সহজে দূরে সরিয়েও রাখতে পারো। একটা ভিড় রাস্তায় না চিনে থাকতে পারো। কিন্তু কাউকে ভালোবাসলে এটা সম্ভব না। তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে তাহলে এই মাঝের দেড় বছর আমাদের জীবনে কোনদিন আসতো না। ”
কথাগুলো ভীষণ হিমশীতল গলায় বললো অস্মিতা। কিন্তু অর্ণব এবার নিজেকে বোঝানোর মরিয়া চেষ্টা করে বললো,
———” ভুল ভাবছো তুমি। আমি এই দেড় বছর ভালো ছিলাম না। আমি শুধু চেষ্টা করে গেছি ভালোভাবে পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি পাওয়ার। আমি যা করেছি শুধু তোমাকে পাওয়ার জন্যই! ”
না, কথাগুলোকে অর্ণবের শেষ হতে না দিয়েই অস্মিতা বলে উঠলো,
———” একদম না। যা করেছো আমার জন্য কিছু করোনি। কারণ আমার তোমার জীবনে কোন অস্তিত্বই নেই। যদি থাকতো তাহলে সেদিন ওই বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় যখন দেখা হয়েছিল, একবার কথা বলতে। অন্তত কেমন আছি টুকু জানতে চাইতে। এমনকি তুমি তো নিউ ইয়র্ক যাওয়ার আগেও আমাকে কিছু বলোনি। ”
কথাগুলো শুনে অর্ণব সাথে সাথেই বলে উঠলো,
———-” নিউ ইয়র্ক যাওয়ার আগে আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি! ”
না, আবারও অর্ণবের কথাটাকে শেষ হতে না দিয়েই অস্মিতা বলে উঠলো,
———“‘ আমি আর কিছুই শুনতে চাই না। আসলে তোমার সাথে আমার কোন কথাই আর বাকি নেই। সবই শেষ। দেড় বছর আগে তুমি ঠিক করেছিলে তুমি আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না। আর দেড় বছর পর আজ আমি ঠিক করছি আমি তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবো না। হিসাবটা সমান হয়ে গেল। প্লিজ এবার এসো। আমার সত্যিই নতুন করে কিছু শোনার নেই। ”
কথাগুলো কিরকম কঠিন স্বরে বলেছিল অস্মিতা। অর্ণব এরপর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না ঠিক। মনে হচ্ছিল কিছু একটা শেষ করে ফেলেছে ও। নিজের অজান্তে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে।
<৭>
সেদিন অর্ণব এরপর ভীষণ ভাঙাচোরা মন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। অস্মিতা যে ওকে এত বড় শাস্তি দেবে ভাবতে পারেনি আসলে। বুঝতে পারছে না যে দেয়ালটা ও নিজে হাতে তৈরি করেছে তাকে ভাঙবে কিভাবে! কিভাবে অস্মিতাকে বোঝাবে ওর জীবনে মেয়েটা কতটা দামি! এই দেড় বছরে ওই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্যই ওর এত লড়াই। আসলে অস্মিতাকে নিজের অজান্তেই ও অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। এই দেড় বছরের দূরত্ব অযত্ন অস্মিতার অর্ণবের প্রতি বিশ্বাসটাই শেষ করে দিয়েছে। অর্ণব যে ওকে ভালোবাসে এটা মেয়েটা আজ বিশ্বাস করে না। আর অর্ণব যদি সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে কোনদিনই অস্মিতা ওর কাছে ফিরবে না। কথাগুলো ভেবে নিজেকে স্থির করলো অর্ণব। আজ ও বুঝেছে ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যত্নের দরকার হয়। এটা বোঝানোর দরকার হয় যে ‘ ভালোবাসি ‘। তাই অর্ণব এরপর সেই চেষ্টাই করবে। অস্মিতাকে বাধ্য করবে ওকে নতুন করে ভালোবাসতে। এত সহজে তো সবটা শেষ হতে দেবে না অর্ণব!
সেদিন এই চিন্তার ভিড়েই রাতটা জেগেই কেটেছিল ছেলেটার। পরেরদিনের সকাল একটা নতুন শুরু নিয়ে এসেছিল জীবনে। অস্মিতা আজ রবিবার যেহেতু বাজারে যাচ্ছিল তাই সকাল সকাল। সেই সময় হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে কোথা থেকে এসে ওকে এক গোছা গোলাপ হাতে দিয়ে বললো,
———” এটা তোমার জন্য দিদি। ”
কথাটা শেষ হতেই অস্মিতা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
———” এসব কি? কে দিয়েছে এটা? ”
এই প্রশ্নে ছেলেটা আর কোন উত্তর না দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আর তখনই আরেকটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে ওর হাতে একটা গ্রিটিংস কার্ড ধরিয়ে বললো,
——–” এটা তোমার। ”
তবে এই বাচ্চাটা ওর কোন প্রশ্ন শুরুর আগেই দৌড়ে চলে গেল। কিন্তু অস্মিতা এইসবের কোন মানে যেন বুঝতে পারছিল না। এইসব কি! এই ফুল, এই কার্ড! কথাগুলো ভাবতেই আনমনে কার্ডের ওপরের লেখাটায় চোখ চলে গেল। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ সরি ‘। শব্দটা পড়েই অস্মিতার মুখের রংটা বদলে গেছিল কেমন। এইসব অর্ণব পাঠায়নি তো! কথাটা ভাবতেই এদিক ওদিক তাকাতে খেয়াল করলো দূরের চায়ের দোকানটায় অর্ণব দাঁড়িয়ে। অপরাধীর মতন মুখ করে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা। তবে দৃশ্যটা দেখে আজ আর মন ভিজলো না অস্মিতার। একটা সময় ও নিজেও এইভাবে রাস্তার মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করেছে। ওকে দু চোখ ভরে দেখেছে। কিন্তু সেদিন অর্ণব অচেনা থেকেছে ওর সামনে। আর আজ অস্মিতা অচেনা হয়ে থাকবে। কথাটা ভেবেই ওই এক গোছা গোলাপ আর কার্ডটা রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে অস্মিতা এগিয়ে গেল। আজ যেন ওর জীবনে অর্ণবের সত্যি কোন আর অস্তিত্ব নেই। তবে অর্ণব কেমন থমকে গেছিল যেন। মনে হচ্ছিল অস্মিতা ওকে মুছে ফেলেছে মন থেকে। আর আরেকবার কিভাবে এই মেয়েটার মনে নিজের জায়গা করবে, কিভাবে দূরত্বটা শেষ করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
চলবে।