তোমার আমার প্রেম পর্ব-০১

0
918

#তোমার_আমার_প্রেম (কপি নিষিদ্ধ)
#পর্ব_১ ও বর্ধিতাংশ
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি বিষ খাইয়ে মারবে বললেও ভালোবাসি।”

এটা টুসুর ফেসবুক একাউন্টের নাম। অনেক কষ্ট সে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে। ক্লাস এইটে পড়ে সে। নতুন মোবাইল হাতে পেয়ে দারুণ উত্তেজিত। কিন্তু ফেসবুকের অ-আ-ক-খ তার জানা ছিল না। তাই পরামর্শই নিতে হলো বিবেক ভাইয়ের কাছ থেকে। বিবেক ভাই তাকে শিখিয়ে দিল কিভাবে ফেসবুক আইডি খুলতে হয়।

একসময় আইডি খুলে ফেললো। আইডি খুললেও কীভাবে লিংক পাঠাতে হয়, সেটা টুসুর জানা ছিল না। বিবেক ভাই ফেসবুক লিংক চেয়েছিল। সাহায্যের জন্য ছুটতে হলো তার ছোট বোন পায়েলের কাছে। পায়েল ধৈর্য ধরে শিখিয়ে দিল। কাজটা বুঝে নিতেই টুসু তার ফেসবুক আইডির লিংক পাঠিয়ে দিল বিবেক ভাইয়ের ইমোতে।

ঝাঁকড়াচুলো, গজদাঁতওয়ালা যে ছেলেটা হাসিমুখে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ইমোর প্রোফাইল পিকচারে সে টুসুর বিবেক ভাই, “বিবেক আহসান।”

যেমন নাম তেমন কাম। আবেগ কম বিবেক বেশি। কেউ মরে গেলেও বিবেক ভাইয়ের চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়ায় না। টুসু আজ পর্যন্ত কোনোদিন এমন বিরল দৃশ্য দেখেনি।

টুসু দেখলো বিবেক ভাই তার লিংকে লাভ রিয়েক্ট না দিয়ে একটা লাইক দিয়েছে। এরপর আর কোনো শব্দ নেই। টুসু বারবার নোটিফিকেশন চেক করছে, কিন্তু কিছুই আসছে না।

তিন ঘণ্টা পর মেসেজের নোটিফিকেশন এল। মেসেজে লেখা,”আমি বাড়ি ফিরি তারপর তোর ভালোবাসা বের করছি।”

টুসু অবাক হয়ে ফটাফট জবাব দিল, “আমি কি করেছি?”

বিবেক ভাই ফিরতি মেসেজ পাঠালো,
“আইডিতে এসব লিখেছিস? এসবের মানে কি?”

টুসু থমকে গেল। পার্সোনাল কথা সে কেন বিবেক ভাইকে বলবে? ফেসবুক আইডি তো সে খুলেছে মজার ছলেই। বায়োতে লিখেছিল, “Ami tomake valobashi, tumi bish kaiye marbe bolle o valobashi.”

কিন্তু সেটাই যে আইডির নাম হয়ে যাবে, তা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি! নিজের ভুলটা হঠাৎ বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। দ্রুত লিখলো,
“আমি তো ওটা বায়োতে লিখেছিলাম। আইডির নাম কীভাবে হয়ে গেল বুঝতে পারছি না!”

বিবেক ভাই তখন এংরি রিয়েক্ট দিল মেসেজে। কিন্তু কিছু বললো না।

টুসু বিবেক ভাইয়ের এংরি রিয়েক্ট দেখে শিউরে উঠলো। ভেতরে ভেতরে গুনগুন করে বলতে লাগলো, “এই রে কেস খেয়ে গেলাম?”

বিকেলে বিবেক ভাই হাজির হলো মোটা একটা বাঁশের বেত হাতে। টুসু প্রথমে ভেবেছিল বিবেক ভাই নিশ্চয় তার টিউশনের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এনেছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে অন্য কিছু, তা বোঝা গেল মুহূর্তেই।

টুসু তখন সোফায় বসে নিজের পায়ে আলতা পড়ছিল। নতুন ফেসবুক প্রোফাইলের জন্য ছবি তুলবে বলে ভাবছিল। বিবেক ভাই এসে বেত দিয়ে প্রথমেই মারলো। তারপর আলতার শিশিটা কেড়ে নিয়ে ঢেলে দিল টুসুর মাথায়!

টুসু চমকে উঠে তাকালো। মাথার চুল বেয়ে লাল রঙ গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। টুসুর চোখে রাগে দুঃখে অপমানে কান্না জমে উঠলো। এত জোরে কেউ বেত দিয়ে মারে?

কিন্তু বিবেক ভাই একটুও দুঃখিত হলো না। বরং ভরাট গলায় ধমকে বলল,

“তোর আবেগে হাত দিল কে? আইডিতে ওটা কি নাম দিয়েছিস?”

টুসু চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে বলল,
“আমি তো নাম চেঞ্জ করে দিয়েছি। এখন দেখো।”

বিবেক ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে টুসুর আইডি খুললো। টুসুর আইডির নতুন নাম,
“Dube dube valobashi, valobeshe kelam fashi.”

নতুন নাম দেখে তার চোয়াল পুনরায় শক্ত হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা নেই। রাগে নাকের পাটা ফুলতে শুরু করেছে। টুসু তখনও বুঝতে পারছে না তার ফেসবুকের নাম নিয়ে বাঁদরমুখোর এত মাথাব্যথা কেন?

এদিকে বিবেক ভাইয়ের মা এসে রুমাল দিয়ে টুসুর মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“বিবো তোর কাণ্ডজ্ঞান কবে হবে বলতো? ওর মাথায় এভাবে আলতা ঢেলে দিলি?”

টুসু প্রতিবাদ করে উঠে তার জেম্মাকে বলল,”আর মাইর যে দিল। সেটার বিচার কে করবে?”

জেম্মা বলল,”সারাদিনই তো মারই খাস তুই। কখনো তোর মায়ের, কখনো বাপের, কখনো দিদির। ও তোর শিক্ষক হিসেবে তোকে মার দিতেই পারে। পরশু দিন তো স্কুলেও নাকি মাইর খেলি। প্রাইভেটে রোজ খাস। তুই মাইর খাস না কোনদিন?”

সবসময় ছেলের সাইড টেনে কথা বলা এই মহিলা টুসুর চক্ষুশূল।

“এই শোন! আইডির নামটা পাল্টা।”

টুুসু বিবেক ভাইয়ের কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ব্যাথায় কাঁধে চেপে ধরে বলল,”৬০ দিন পর পাল্টানো যাবে।”

বিবেকের ভ্রু কুঁচকে গেল।”আজ কিভাবে পাল্টেছিস?”

“কিভাবে পেরেছি তা জানিনা।”

বিবেক হুমকি দিয়ে বলল,

“তোকে দুদিন সময় দিলাম। তারমধ্যে আইডির নাম পাল্টা। নইলে আইডি হ্যাক করে উড়িয়ে দেব আমি।”

টুসু জেদ দেখিয়ে বলল,”আপনি কে আমার আইডি হ্যাক করার?”

বিবেক ভাইয়ের চোখের রঙ পাল্টে গেল। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,”আমি কে তুই দেখতে চাস?”

টুসু সোফা থেকে নেমে দৌড়ে ঘরে চলে গেল।

___

ঘরে যাওয়ার পথে মা টুসুকে থামিয়ে চোখ কপালে তুলে বলল,”মাথায় এসব কি রে টুসু?”

টুসু বিরক্ত মুখে মাকে পাশ কাটিয়ে গেল। আলতা পরা পায়ের ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার দিল। বেশ ভালো ছবি উঠেছে।

কাল রাতে পঞ্চান্নজন টুসুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে। তাদের প্রায় সবাই টুসুর ছবিতে কমেন্ট করেছে,

“ওয়াও! নাইস! বিউটিফুল! ফাটাফাটি!”

দু’একজন একটু ভিন্নধর্মী মন্তব্যও করেছে।

সুহাস মজুমদার লিখলো, “রূপসী।”

রওশন জামিল লিখলো,”লাল বউ।”

টুসু সেখানে ঝটপট লাভ রিয়েক্ট দিল।

অভিনব শারাফ লিখলো,”আলতা বউ মঞ্জুলিকা।”

আলতা বউ দেখে ভালো লাগলেও মঞ্জুলিকা বলায় টুসু এংরি রিয়েক্ট দিল।

তৃতীয় জন কমেন্ট করল, “এটা সরা।”

কমেন্টটা দেখামাত্রই টুসুর শরীরটা কেঁপে উঠলো।বাঁদরমুখোটা তার প্রেস্টিজ পাঞ্চার করে ছাড়বে দেখছি! সে এংরি রিয়েক্ট দিয়ে রিপ্লাই করলো,”সবার কমেন্ট করা শেষ হলে সরাবো। এখনো অনেকে কমেন্ট করেনি।”

বাঁদরমুখোর পরে যে কমেন্ট করলো সে মেয়ে। তার নাম রাইমা আহসান। টুসুর মুখে হাসি ফুটলো। তার আপু কমেন্ট করেছে,”এই ছবি কে তুলেছে?”

টুসু নিজেকে মেনশন দিয়ে বলল,”এই গুণী মহিলা।”

_____

টুসু বিকেলে ছাদের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে আচার খাচ্ছিল। আকাশটা তখন কমলা রঙে রঙিন। তার একহাতে আচার, অন্য হাতে ফোন। নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ মেসেঞ্জারে একটি নোটিফিকেশন টুং করে উঠলো। জীবনের প্রথম মেসেজ!

টুসুর বুকটা ধক করে উঠলো। উত্তেজনা আর কৌতূহল মিশে ধমনীতে নতুন স্রোত বইতে লাগলো। দ্রুত আঙুল চালিয়ে সে মেসেজটা খুললো।

“হাই!”

মাথার ভেতর কিছুক্ষণ শব্দগুলো গুঞ্জন তুললো। কী উত্তর দেবে? একটু থেমে সে লিখলো,

“হ্যালো।”

মুহূর্তের মধ্যে আবার রিপ্লাই এল।
“আমরা কি পরিচিত হতে পারি?”

টুসুর বুক ধকধক করতে লাগলো। নড়বড়ে আঙুলে টাইপ করলো,”হ্যাঁ।”

ওপাশ থেকে দ্রুতই মেসেজ এলো, “তোমার পরিচয় দাও।”

টুসু নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলো। পরীক্ষার খাতায় মাইসেল্ফ প্যারাগ্রাফ যেভাবে লিখে ঠিক সেভাবে বললো।

“আমার নাম রাইদা আহসান। আমার বাবা ডাকে রাইদারাণী। আমার বাবার নাম রাজিব আহসান। মায়ের নাম সাবিলা বেগম। আমার আপার নাম রাইমা আহসান। আমাকে বাড়িতে সবাই টুসু বলে ডাকে। আমরা চট্টগ্রাম থাকি।”

জবাব পাঠিয়েই সে নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই মেসেঞ্জারে টুং করে উঠলো।
“আমি সুহাস মজুমদার। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”

টুসুর হাত থমকে গেল। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ আরও জোরে শোনা যেতে লাগলো। এটা কি সত্যি? সে চোখ কচলিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো।
সত্যি তাই তো লেখা আছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব?

সে শেষমেশ টাইপ করলো,
“এটা কি রসিকতা?”

সাথে সাথেই রিপ্লাই এল।
“সত্যি। আমি সিরিয়াস।”

টুসু একটু থেমে লিখলো,
“আমি আপনাকে চিনিই না এখনো।”

অন্যপাশ থেকে যেন অপেক্ষায় ছিল। মুহূর্তেই উত্তর এলো,”তুমি আমার কমেন্টে লাভ রিয়েক্ট দিয়েছিলে। তাই ভাবলাম মেসেজ করি। আই লাভ ইউ।”

টুসু থতমত খেয়ে গেল। ফোনটা রেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এভাবে কেউ কাউকে বলে? এতটা সরাসরি?

নিজেকে সামলে নিয়ে সে ধীরে ফোন তুলে আবার টাইপ করলো,”আই লাভ ইউ ঠু। কিন্তু সেটা বিয়ের পর।”

লিখে টুসু দৌড়ে দৌড়ে নীচে চলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ধপাস করে বিছানায় পড়েই গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো কী রিপ্লাই আসবে এটা ভেবে। উত্তেজনায় বুকটা ফেটে যাবে আরেকটু পর। ইশশ! এরকম অনুভূতি তার কখনো হয়নি। কিন্তু ঠিক তখনই বাইরে থেকে বিবেক ভাইয়ের হুংকার ভেসে এল,

“এই গাধারাণী! এক্ষুণি ঘরে আয়। তোর বিয়ে করা বের করছি আমি।”

টুসু থমকে গেল। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এই রে আবারও কেস খেল?

সে ভুলেই গিয়েছিল তার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড বিবেক ভাইয়ের কাছে রয়ে গেছে। তাড়াহুড়োয় পাসওয়ার্ড পাল্টাতেও ভুলে গিয়েছিল। মাথায় যেন বাজ পড়লো। এখন কী হবে?

চলমান…