#তোমার_আমার_প্রেম (কপি নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
দাদীর মৃত্যুর পর টুসুর সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। কে কোথায় গেল টুসু জানেনা। গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো তার। এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে কুলখানির দিনও সে বিছানার সঙ্গে লেপ্টে ছিল।
জ্বর তার পিছু ছাড়লো প্রায় একমাস পর। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে টুসু জানতে পারলো আপার বিয়ের জন্য চাপ আসছে। পাত্রপক্ষ নাকি বারবার তাগাদা দিচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে সেরে ফেলতে। কারণ জামাই এক মাস পর লন্ডন চলে যাবে। তারা কোনোভাবেই সময় নষ্ট করতে চায় না।
বাবা আর জ্যাঠারা হঠাৎ করেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিয়ের আয়োজনে যেন কোনো খুঁত না থাকে, সেদিকে তাদের বিশেষ নজর। পাত্রপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, বড় কোনো আয়োজনের দরকার নেই।
বাবা এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া করার কথা ভাবতেও পারেন না।
বিবেক ভাই অবশ্য নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে কুলখানি শেষ করেই আবার চলে গেছে। তবে বলে গেছে, সময় পেলে আসবে।
দাদীমার মৃত্যুর পর আপার বিয়ের কথাবার্তা সাময়িকভাবে থেমে গিয়েছিল। এই অবকাশে আপা একটু হাসিখুশি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা আর জেঠুর ব্যস্ততা দেখে আপা চুপসে গেল। টুসুকে ডেকে বলল,
“তোর সাথে বিবেক ভাইয়ের কথা হয়?”
টুসু আপার ক্লান্ত, মলিন চেহারা দেখে থমকে গেল। বলল, “না, কেন?”
আপা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। টুসু চেয়ে রইল আপার গমনপথে। তার মনে হল, আপা একটুও ভালো নেই।
সেই সময় পায়েল আপা এসে বলল, “বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়া চুপ আছে তাই আমাদেরও চুপ থাকা উচিত। আর তোরও এটা নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই।”
টুসু চুপ করে রইল। সে কোনোদিনই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। কেন এমন হচ্ছে? বিবেক ভাই কেন কিছু বলেনা।
সেদিন সন্ধ্যায় টুসু অনেকদিন পর তার পুরনো সোশ্যাল মিডিয়া আইডিতে লগইন করলো। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বিবেক ভাইকে মেসেজ লিখল,
“আপার বিয়ে আগামী সপ্তাহে। তোমার মায়া হচ্ছে না আমার আপার জন্য? তুমি এমন কেন? তোমার মনটা কি পাথরের? দাদী মারা গেল, তোমার চোখে জল পড়ল না। আপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোমার বুক কাঁপছে না। তোমার জীবনে কি আবেগের কোনো জায়গা নেই? এটা কেমন অবিচার আমার আপার সাথে? ও কিভাবে অপছন্দের একজন মানুষের সাথে সংসার করবে বলো?”
মেসেজটা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখল বিবেক ভাই অনলাইনে। মেসেজও সিন করল। কিন্তু কোনো রিপ্লাই দিল না।
টুসুর ভেতরে আগুন ধরে গেল। চোখের কোণে জল টলমল করতে লাগল। তার আপার দুঃখের কোনো মূল্য নেই বিবেক ভাইয়ের কাছে?
যদি তার নিজের সাথে এমন কিছু ঘটে? বাবা যদি অন্য কারও সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে আর অভিনব যদি এভাবে চুপচাপ থাকে? তার কি হবে? আপা তবু নিঃশ্বাস নিতে পারছে, কিন্তু সে তো দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে।
বিবেক ভাই এমন কেন? আল্লাহ কি তার হৃদয়ে একটুও মায়া আর ভালোবাসা দেননি? তাহলে কেন সে তার আপাকে স্বপ্ন দেখাল? কেন?
টুসু তার আইডিটা লগআউট করে রাগিনী আইডিতে ঢুকল।
অভিনব লিখেছে, “সরি, বিজি ছিলাম।”
টুসু ছোট্ট করে জবাব দিল, “ওকে।”
অভিনব মেসেজ পাঠাল, “একটা কথা বলি?”
টুসু কৌতূহল নিয়ে লিখল, “হুম।”
“আমি যদি তোমার সামনে হুট করে চলে আসি তাহলে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?”
টুসু এই প্রশ্নে থমকে গেল। কল্পনা করার চেষ্টা করল সেই মুহূর্তটা কিন্তু ভাবতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে লিখল, “এক্কেবারে মরে যাব।”
অভিনব হাসতে হাসতে রিয়েক্ট দিয়ে বলল, “তোমাকে মারতে হবে দেখছি।”
টুসুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। জানতে চাইলো,
“তোমার বুকের ব্যাথা সেড়েছে।”
“হ্যাঁ অনেকটা।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ।”
অভিনব লিখলো,”কিন্তু এখন মনব্যাথা।”
টুসু হেসে ফেলে বলল,”তুমি একটা অসভ্য।”
আবারও হা হা রিয়েক্ট দিল অভিনব। কিছুক্ষণের জন্য টুসুর সব দুঃখ যেন কোথাও মিলিয়ে গেল।
কথা বলা শেষে সে দাদীমার ঘরে গেল। বিছানায় শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। দাদীমার গায়ের গন্ধ, জর্দার ঘ্রাণ এখনো বিছানার চাদরে লেগে আছে।
টুসুর চোখ জ্বালা করে উঠল। অশ্রু গড়িয়ে এল বালিশ ভিজিয়ে। মানুষ এভাবে চলে যায় বুঝি?
____
বিকেলে মন ভালো করার জন্য টুসু একটু সেজে নিল। কানের পাশে গাঁদা ফুল গুঁজল। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ছোঁয়াল। তারপর অভিনবকে মেসেজ পাঠাল,
“জানো, আমি আজ খুব সেজেছি। একেবারে ভূতের মতো!”
অভিনবের দ্রুত উত্তর এল, “সাজলে মেয়েদের ভূতের মতোই লাগে। না সাজলে ভালো লাগে।”
টুসু লিখল, “মোটেও না! আমাকে না সাজলে ভালো লাগে না। সাজগোছ আমার খুব ভালো লাগে।”
অভিনব লিখল, “আমি কিন্তু তোমার সামনে এমনভাবে উপস্থিত হবো যে তুমি সাজার সময়টুকুও পাবেনা।”
টুসু মজা করে লিখল, “তাহলে আমি পালিয়ে যাব।”
অভিনব হেসে জবাব দিল, “আমি খপ করে ধরে কাঁধে তুলে নিয়ে যাব।”
টুসু দ্রুত লিখল, “ছিঃ!”
অভিনব একটা হেসে ওঠার ইমোজি পাঠাল। টুসু তখন আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে একটুখানি হাসল। ছেলেটা ভীষণ পাজি হবে।
ভাবতেই টুসু হাসলো। কিন্তু ছাদে আসার পর সেই হাসি দ্রুতই ম্লান হয়ে গেল আকাশের দিকে তাকিয়ে। কয়েকদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশে মেঘ জমে থাকলেও রোদ উঠছিল না। টুসুর এসব একদম পছন্দ নয়।হয় ঝড় হোক, নাহয় পরিষ্কার রোদ উঠুক। এমন ঘন মেঘের দিনে তার মন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
আকাশের দিকে মুখ তুলে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল টুসু। কাল রাতে আপার বিয়ের পাকাকথা হবে। কিন্তু বিবেক ভাই কি আসবে? যদি না আসে? যদি আপার বিয়ে হয়ে যায়? আপা কি সত্যিই সুখী হবে এই বিয়েতে? না কি সারা জীবন তার মনের অতৃপ্তি বয়ে বেড়াবে?
______________________
“কোন শাড়িটা পরবি? কিছু তো বল। আমি কি কাকিয়াকে ডাকবো?”
পায়েল আপা আপাকে তাড়া দিচ্ছিল শাড়ির জন্য। কিন্তু আপা চুপচাপ বসে রইল পাথরের মতো। টুসু বুঝতে পারছিল আপার মন খারাপ। তবুও সে বাসন্তী রঙের শাড়িটা তুলে এনে বলল,
“আপার গায়ের রঙের সাথে এই শাড়িটা ভালো মানাবে বড় আপা।”
বড় আপা শাড়িটা তুলে নিয়ে আপার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস।”
আপার মুখে কোনো কথা নেই। টুসু সাহস করে আপার পাশে বসে লাল চুড়িগুলো হাতে পরিয়ে দিল। তারপর তাকিয়ে দেখলো খোলা চুলে, অলংকারহীন, বাসন্তী রঙের শাড়ি আর লাল চুড়িতে তার আপাকে যেন কোনো রূপকথার পরীর মতো লাগছে।
এই সাজেই তো অভিনব শারাফ তাকে দেখতে চেয়েছিল। এই শাড়ি আর চুড়িগুলো আপার বিয়ের পর সে নিজের কাছে রেখে দেবে। যদি কোনোদিন অভিনবের সঙ্গে দেখা হয়, তবে এই শাড়িটাই পরে যাবে। কিন্তু শাড়িটা তাকে মানাবে তো?
___
পায়েল আপা আপাকে সাজিয়ে ঘর থেকে বের হতেই বিবেক ভাই হঠাৎ বাড়িতে হাজির। বাড়ির সবার দৃষ্টি তার দিকে। এক মুহূর্তের জন্য সবার সব কাজ থেমে গেল।
বিবেক ভাইয়ের তার চোখেমুখে অদ্ভুত রুক্ষতা। গায়ে কুঁচকানো শার্ট, চুল উসকোখুসকো। তাকে দেখে মনে হলো বেশ কয়েক রাতের ঘুমহীন ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি এসেছে।
বাবা টেনশন নিয়ে তখন ফোন কানে কথা বলছিলেন, “বৃষ্টি আসার আগে পৌঁছে গেলে ভালো। কোনো অসুবিধা হলে জানাবেন।”
ফোনটা রেখে এবার বিবেক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি রে বিবেক, হঠাৎ তুই? না জানিয়ে এলি কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”
জেম্মা এগিয়ে এসে বলল, “তোর এই হাল কেন? গায়ে জ্বর টর কিছু হয়েছে? আহা চেহারাটার কি হাল।”
কাকিয়া তড়িঘড়ি করে বলল, “একটু বসুক আগে! আসামাত্র এত প্রশ্ন কেন?”
টুসুর মা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বললেন, “এসো বাবা। হাতে ওসব কি? কাজের কিছু নিয়ে এসেছ নাকি?”
বিবেক ভাই এবার কথা বলল, “টুসুর গাইড।”
টুসু একদৌড়ে এসে গাইডগুলো নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখে আনন্দের ঝলক। “আজ থেকে খুব পড়বো। উফ আমার গাইড! কত্তগুলো দেখেছ আম্মা? হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স, ব্যবসায় উদ্যোগ এনেছ?”
বিবেক ভাই কিছুটা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। ঘরে নিয়ে যা।”
টুসু এক মুহূর্তও নষ্ট না করে গাইডগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় সেগুলো মেলে রেখে একে একে খুলে দেখল। বইগুলোর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে তার নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকলো। নতুন বইয়ের মিষ্টি গন্ধটা তার খুব প্রিয়।
হঠাৎ খালাম্মার ফোন। টুসু রিসিভ করলো একদৌড়ে ফোনের কাছে গিয়ে। বলল,
“আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা।”
খালাম্মা কেঁদে কেঁদে বলল,”তুই আমি মরে গেলেও তো খোঁজ নিস না রে টুসু। এমন কেন তুই?”
টুসু কপাল কুঁচকে বলল,”কি হয়েছে?”
“কোমর ভেঙে গেছে রে। দাঁড়াতে পারছিনা। বাথরুমে পড়ে কোমর ভেঙেছি। তুই আয় মা। তোর খালু আমাকে সামলাতে পারছেনা। তোর ভাইরা তো সবাই চাকরিতে। ওরা সবাই চিন্তা করছে। ও আল্লাহ দেখ কেমন মড়মড় করছে কোমরটা।”
টুসু চিন্তিত হয়ে বলল,”কেমনে ভাঙলো? তুমিও আমার মতো এত ছটফটে কেন? উফ জ্বালা। কোনদিকে যাব আমি? আম্মা দেখো তোমার বড়বোন কি অঘটন ঘটিয়ে বসে আছে।”
মা টুসুর ডাকে দৌড়ে এল। ফোন কেড়ে নিয়ে কানে চেপে ধরে বলল,”কি হলো আপা?”
বোনের কষ্টের কথা শুনে আম্মা আবেগের বশে কথা দিয়ে ফেললেন।
“হ্যাঁ হ্যাঁ ও যাবে। আচ্ছা কাল সকালে ওকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা আপা। তুমিও না। বিয়ের পর থেকেই দুলাভাইকে জ্বালিয়ে মারছো। এই বয়সে তুমি তার সেবা করবে তা না। আচ্ছা রাখো।”
বইগুলো গোছানো আর হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ করে বাড়ির ভেতর গগনবিদারী চিৎকার ভেসে এল। তার সাথে আপার কান্নার শব্দ। টুসু আতঙ্কিত হয়ে উঠে ছুটে গেল খালি পায়ে। দেখল জেম্মা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিৎকার করে বলছে,
“দোহাই লাগে তোর। আর মারিস না। কি হয়েছে আমাকে বল! আল্লাহ, মরে যাবে! ও বিবেক। শোন আমার কথা।”
টুসু থমকে গেল। জমে গেল সে। এক পা-ও আগাতে পারলো না। কি হচ্ছে এসব? আপাকে মারছে কেন?
জেঠু এসে গর্জে উঠলেন,
“ওকে আজকে দেখতে আসবে! তুই করছিসটা কি? এই বিবেক!”
আপা প্রাণপণে বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু বিবেক ভাই আরেকটা বেতের বাড়ি ফেলল পিঠে। গলা ফেটে বেরিয়ে এল ভয়ানক শব্দ,
“আওয়াজ করবি না। তোর মতো লম্পট মেয়েমানুষ মরে গেলেও কিচ্ছু যায় আসে না আমার।”
টুসুর শরীর কেঁপে উঠলো। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। তার আপা!
আপা কাঁদছে চিৎকার করে। ছেড়ে দিতে আলছে। কিন্তু এইবার বিবেক ভাই আরেকটা ঝাঁঝালো চড় দিল, সম্ভবত মুখ বরাবর। এটা যে এত অসহনীয় তা আপার চিৎকারে বোঝা গেল।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কান্নামিশ্রিত ভারী কণ্ঠে টুসু বলল,
“আর না। আর মেরো না। বিবেক ভাই… আমার আপা মরে যাবে! পায়ে পড়ছি। মেরো না।”
আপা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধাক্কা দিয়ে আম্মা আর আব্বাকে ডাকতে লাগলো। আম্মা আব্বার কিছু করার নেই।
বিবেক ভাই আবারও গর্জে উঠে আপাকে টেনে ধরে আরও মারতে লাগলো বেত দিয়ে।
বাবা ধমক দিয়ে বললেন,
“বিবেক! তোর সাহস কত? কি হয়েছে তোর?”
আপা কাঁদতে কাঁদতে হয়তো বসে গেছে। বিবেক ভাই বলল,”মরে যা তুই। চরিত্রহীন, বেশরম।”
দীর্ঘ কিছুক্ষণ পর বিবেক ভাই দরজা খুলল। তার হাতে মোটা বাঁশের বেত। তার কপাল থেকে ঘামের দানা ঝরছে। চোখে ভীষণ রাগ। জেঠা কষে চড় বসিয়ে আরও একটা চড় বসাতে যাবে তখনি বিবেক ভাই বলল,”আগে এই বারোভাতারিকে সামলাও। লম্পট মেয়েমানুষ।”
বলেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে চলে গেল বিবেক ভাই। টুসু সবার সাথে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো আপা দেয়ালের সাথে লেগে বসে আছে। মুখটা নীচে ঝুঁকিয়ে। ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। কপাল ছিঁড়ে গেছে। গালের পাশে বেতের বাড়ি পড়ায় অদ্ভুত ক্ষত। হাত বাহু সবকিছুতে মারের দাগ। আপা সবাইকে ঢুকতে দেখে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো।
জেম্মা আপাকে ঘরে ঢুকে বুুকে জড়িয়ে ধরতেই আপা কেঁদে উঠে অস্ফুটস্বরে বলল,
“আমি..আমি কিছু করিনি। কিছু করিনি।”
আপা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। বাবা জেঠুকে বলল,”ওকে জবাব দিতে হবে সবকিছুর। সবকিছুর জবাব দিতে হবে।”
টুসু তার আপার হাত পা মালিশ করতে লাগলো। কেঁদে কেঁদে ডাকলো,”আপা ওঠো। আমি বিবেক ভাইকে ছাড়বো না জেম্মা। তোমার ছেলেকে কিছু বলো না কেন? নিজেকে কি মনে করে উনি? আমার আপার কিছু হলে মেরে ফেলবো আমি। বিবেক ভাই..
আম্মা কাঁদতে লাগলো আপার অবস্থা দেখে। টুসু রাগ সামলাতে না পেরে বিবেক ভাইয়ের ঘরে ছুটে এল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো বিবেক ভাই রকিং চেয়ারে বসে আছে। পায়ের কাছে বেতটা পড়ে আছে। কপাল হতে এখনো ঘামের দানা ঝড়ছে। চোখগুলো হিংস্র প্রাণীদের মতো।
বাইরে তুমুল ঝড় তবুও টুসুর মনের ভেতরের চাইতে বেশি নয়। টুসু একদৌড়ে গিয়ে বিবেককে ধাক্কা মেরে বলল,
“তুমি আমার আপাকে মারলে কোন সাহসে? কেন মারলে?”
কথা বলতে বলতে টুসু বিবেক ভাইকে আরও ধাক্কা মারলো। বিবেক ভাই একচুল পরিমাণও নড়লেন না। বরং টুসুর গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। টুসু তেড়ে এসে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো বিবেককে। এই মারগুলো একজন ভাইয়ের উপর বোনের অধিকার বোধ থেকে আসে। কাঁদতে কাঁদতে টুসু বিবেকের বুকে কিল মেরে বলল,
“আমার আপা তোমাকে কত ভালোবাসে জানো? কেন মারলে? ভালো না বাসো। কিন্তু কেন মারলে? এভাবে কেউ কাউকে মারে? তুমি জানোয়ার? কেন মারলে বলো। উত্তর দাও।”
টুসু এবার মোক্ষম একটা কিল বসিয়ে দিল বুকের বাঁ-পাশে। যেটা সহ্য করতে না পেরে বিবেক ভাই টুসুকে আরেকটা চড় বসিয়ে দিয়ে বুক চেপে ধরে চোখ খিঁচিয়ে বসে পড়লো। টুসু ভড়কে গেল। এদিকওদিক তাকিয়ে জগের কাছে দৌড়ে গেল। গ্লাসে পানি ঢাললো। পানি নিয়ে এসে কাঁপা হাতে বিবেক ভাইকে পানি খাওয়ালো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কি হলো তোমার? বুকে কি হয়েছে? বলো আমাকে।”
বিবেকের চোখে এখনো আগুন দপদপ করছে। রাগ সামলানো দায়। এদিকে নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। পানি খাওয়া শেষ করে হাঁপাতে লাগলো। টুসু তার বুকে চেপে ধরা হাতটা সরিয়ে শার্টের একটুখানি সরাতেই চোখে পড়লো বহু পরিচিত একটা ক্ষতচিহ্ন। টুসুর আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো। সে একটান দিয়ে পুরো পুরো বুক উন্মুক্ত করে নির্লজ্জের মতো চেয়ে রইলো। পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠলো।
তারপর কিভাবে যেন দৌড়ে দৌড়ে ঘরে এসে ফোনটা খুঁজে নিয়ে সেই গোপন ছবিটা দেখলো। যেটার ক্ষত দেখে মন খারাপ হলেও লোমশ বুকটা দেখলে টুসুর আপাদমস্তক কেঁপে উঠতো লজ্জায়, কি এক অবিমিশ্র ভাবনায়।
ওই বুকে সে মাথা গুঁজে আকাশের চাঁদ দেখবে, বৃষ্টি দেখবে। ঘুমিয়ে পড়বে চড়ুইপাখির মতো। তারপর কতশত লজ্জাজনক ভাবনা, কল্পনা জল্পনা। ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিল, সে ওখানে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খাবে ভেবেছিল। ওটা তার আশ্রয়, তার সুখ দুঃখের গল্পঘর। এই যে দিনদিন সেলাই শুকিয়ে আসা একটু একটু করে। সবগুলোর ছবিই তো টুসুর কাছে আছে। টুসু ছবিটা টেনে টেনে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ঝাপসা চোখ মুছলো।
তারপর ফোনটা এককোণায় ছুঁড়ে মেরে বিবেক ভাইয়ের ঘরে ছুটে গেল। হোঁচট খেয়ে পড়লো মুখ থুবড়ে। আর উঠতে পারলো। সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে। অবশ লাগছে। টুসুর ঠোঁটের কোণা বেঁকে এল। কান্নায় দমটা বন্ধ হয়ে এল। ভেতর থেকে নিঃশ্বাসটা এল না। একটুকরো অক্সিজেন সে পাচ্ছে না। বুকের ভেতরটা ভাঙছে ক্রমশ। এত দুঃখ টুসু একজীবনে আর পায়নি। এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা। হায় খোদা এত লজ্জা এত ঘৃণা সে কোথায় রাখবে? সে আপা আর বিবেক ভাইকে মুখ দেখাবে কি করে? টুসু কাঁদতে লাগলো ওভাবে পড়ে থেকে। জলগুলো রক্ত হয়ে ঝরেনি এই বেশি।
সে দুঃখ নিয়ে আওড়ালো,”আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি না। অসম্ভব। আমি নিজেকে নিজের কাছে কি জবাব দেব?”
চলমান.