তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-১১

0
361

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-১১

“এসব কি আর্শিকা?হোয়াইট বোর্ডে তুমিই এসব করেছো তাই নাহ?”

“আজব কোনো প্রমাণ ছাড়া আপনি আমার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না।”

“তুমি ছাড়া এসব কেউ করতে পারে না।”

“আমি যে এসব লিখেছি তার কি কোন যুক্তিগত প্রমাণ আছে আপনার কাছে?বাহ আমাকে কি কেউ দেখেছে এসব লিখতে।”

“আমার মুখের উপর কথা বলছো? গেট আউট অফ মাই ক্লাস।”

“আপনার তো খালি ওইটুকুই ক্ষমতা আছে,ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার,আমারও কোনো ইচ্ছা নেই কোন ফালতু ক্লাস করার।যতসব।”

বলেই আর্শিকা ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়।এদিকে রাদাফ সহ উপস্থিত সবাই আর্শিকা এহেন আচরণে অবাক।আর্শিকা আর যাই করুক না কেনো কোন শিক্ষককে অসম্মান করে না সেখানে আর্শিকা কি না রাদাফের ক্লাসকে ফালতু বলে ক্লাস থেকেই বেরিয়ে গেলো।

আসলে সকালে রাদাফ ক্লাসে আসার সাথে সাথে হোয়াইট বোর্ডে পার্মানেন্ট মার্কারে কিছু লেখা দেখতে পায়। যেখানে লেখা ছিল”মি.কির্শফ চৌধুরী রাদাফ আপনাকে আমি সেই প্রথম দিন থেকে যেমন ঘৃণাও করি তেমন ভালোও বাসি।আপনি আমার ঘৃণাক্ত ভালোবাসা।”

কথাটা দেখা মাত্রই রাদাফের প্রচন্ড রাগ উঠে যায়। আর্শিকার ব্যক্তিগত সমস্যা আর্শিকা ব্যক্তিগতভাবে বুঝাতে পারতো তা না করে আর্শিকা রঙ্গমঞ্চসালা বানিয়ে ফেলবে তা রাদাফ ভাবতেও পারে নি।তখনই আর্শিকা ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলেই রাদাফ আর আর্শিকার ঝগড়া শুরু হয়।আর আর্শিকাও রেগে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আর্শিকা বের হওয়ার সাথে সাথে জয়া পিহু আর নয়না দাঁড়িয়ে পড়ে।জয়া ভয়ে ভয়ে বলে,

“স্যার আর্শিকা এসব করে নি।আপনি শুধু শুধু ওকে বকেছেন।”

“যে যে’টার যোগ্য তার সাথে আমি তেমনই ব্যবহার করেছি।”

পিহু রেগে বলে,”ভুল বললেন স্যার।আর্শিকা মোটেও এই ব্যবহারের যোগ্য নয় আর তার চেয়েও বড় কথা ও তো সবে মাত্র ক্লাসে ঢুকলো ও কি করে এসব লিখতে পারে স্যার?”

রাদাফ লেখাটা পড়ে এতো বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে তার আর্শিকার আসার কথা মনেও ছিলো না।রাদাফ যখন এসবে মগ্ন তখন রাদাফের কথার মাঝেই নয়না বলে,

“ক্ষমা করবেন স্যার।আমরাও ক্লাস করতে পারবো না।”

পিহু জয়া নয়না রাদাফের মতামত না নিয়ে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যায়।রাদাফের এখন খুব খারাপ লাগছে আর্শিকার সাথে এমন আচরণের জন্য। শেষ পর্যন্ত রাদাফ নিজেই ক্লাস না নিয়ে বেরিয়ে আসে।

✨✨

আর্শিকা ক্যান্টিনে এসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে আর কফি খাচ্ছে। একেই তো রাদাফকে দেখলেই তার মাথা গরম হয়ে যায় তার উপর রাদাফ তার নামে এমন অপবাদ এ যেনো আর্শিকা সহ্যই করতে পারছে না।

আর্শিকার সামনে পুনরায় জয়া, পিহু আর নয়না বসে আসে।সবার দৃষ্টি খুবই শান্ত কিন্তু আর্শিকা দৃষ্টি দিয়ে যেনো আগুনের ফুলকি ঝরছে।আর্শিকা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে,

“তোরা কেনো চলে এলি ওই ছাগলের চামচিকার ক্লাস থেকে।ভালোই তো পড়ায়, পিহুর ক্রাস যা না পিহু গিয়ে ক্লাস কর।আর নয়না তুই তো খুব ভালো টিকটিকির দাদাটার ক্লাস ভালো বলে বলিস তো এখন এখানে সং সেজে বসে আছিস কেনো?আর আমাদের মিস.জয়া সে তো সবসময় সত্যবাদী ছাগলের চার নম্বর বাচ্চাটার নামে কোন কথাই শুনতে পারে না তা এখান্ব আমার সামনে আপনাদের বসে থাকার অর্থ কি?”

পিহু আমতা আমতা করে বলে,”আশু বেবি আসলে….”

“আসল নকল বাদ তোরা আবার কবে আমার দলে এলি বল তো?”

জয়া একটু রেগেই বলে,”দেখ আশু আমরা তোর ফ্রেন্ড তোর দলেই ওলয়েজ থাকি শুধু শুধু রাদাফ স্যারকে বকা দেওয়া বন্ধ কর।”

আর্শিকা টেবিলে সজোরে হাত রেখে জয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”কেন ওই উলুকুন্ডার চাচার জন্য তোর বুঝি খারাপ লাগছে?আর আমাকে যে বিনা দোষে সাজা পেতে হলো তার বেলা?তখন খারাপ লাগছে না?”

নয়না শান্ত গলায় বলে,”আশু প্লিজ থাম ইয়ার।”

“আজ আমি থামবো না। পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিবো তোরা আমার শত্রু।এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে কেউ নেই।”

বলেই ছিচকে কাঁদতে লাগলো। আর্শিকার এমন আচরণে সবাই হতবাক।পরক্ষণই আর্শিকা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে টেবিলে থাকা একটা গ্লাস নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।মুহুর্তেই গ্লাসট টুকরো টুকরো ভেঙে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।

“মি.ডেভিল কিং আপনাকে আমি ছাড়বো না।পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত বিষ দিয়ে আপনাকে আমি মেরে ফেলবো।”

আর্শিকার ভয়াবহ রুপ দেখে সবাই একটু ভীত হয়।আর্শিকা রাগে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়।জয়া আর্শিকার সব বিল মিটিয়ে দিয়ে ক্যান্টিন থেকে বাহিরে এসে হতবাক হয়ে যায়।সাথে সাথে তাদের সঙ্গে থাকা দুই রমনীর চোখ বেরিয়া আসা উপক্রম।

✨✨

ভার্সিটির সব কাজ শেষ করে সবে মাত্র রাদাফ ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে থমকে যায়।এটা কি আসলেই তার শখের গাড়ি?গাড়িটার অবস্থা নাজেহাল।গাড়ির একটা কাচঁও পূর্ণ নয় সবগুলো কাঁচ ভাঙা চোড়া সাথে গাড়িতে প্রচুর স্ক্রাচ।সামনের গাড়ির দু’টোর হ্যান্ডেল ভাঙা,গাড়ির ব্যাক গ্লাস উল্টে দেওয়া,ইতিমধ্যেই দুটো গ্লাসের একটা মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।রাদাফ গাড়ির সামনে যেতেই গাড়ির সামনে একটা ইট দিয়ে আটকানো চিরকুট দেখতে পায়।রাদাফ চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করে,

“কি মি.ডেভিল কিং আমাকে শায়েস্তা করতে এসেছিলেন নাহ?আমাকে দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দিতে এসেছিলেন তো?এখন দেখুন আপনার গাড়ির অবস্থা আমি সেটাকে গুড়িয়ে দিয়েছি।এক এক করে আপনার জীবনের সব প্রিয় জিনিসকে আমি গুড়িয়ে দিবো।সবে তো মাত্র ধ্বংসলীলা শুরু। পৃথিবীর বিষাক্ত বিষ দিয়ে আপনাকে মেরেও আমি ক্ষান্ত হবো না।”

রাদাফ চিরকুটটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসঁতে থাকে।যেখানে তার প্রিয় জিনিস নষ্ট করার ফলে তার রাগা উচিত সেখানে সে হাসছে।রাদাফ আনমনেই বলে,

“আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস যে তুমি, তা কি করে নষ্ট করবে তুমি?তুমি কি ভুলে গেলে,পৃথিবীর বিষাক্ত বিষ যা আমি তোমাতে আসক্ত হয়ে গেছি। বিষক্রিয়ায় আমি প্রতিনিয়ত ছটফট করছি তা কি আপনার নজর কাড়ছে না?আমাকে বিষক্রিয়া যেমন তুমি ঘটিয়েছো ঠিক বিষক্ষয়ও তুমিই করবে।আমি না’হয় ততদিন বিষক্রিয়ায় ছটফটই করলাম”

বলেই রাদাফ মুচকি হাসতে থাকে। এদিকে রাদাফের হাসি এক জোড়া চোখ দেখে রেগে ফেটে পড়ছে।তার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি ঝড়ছে।আর্শিকা রাদাফের হাসি দেখা মাত্রই রেগে গর্জে চলে যায়।আর্শিকা ভার্সিটি ছুটির পর এত্তোক্ষণ এই জন্যই ছিলো যাতে রাদাফ বুঝতে পারে প্রিয় জিনিস নষ্ট করলে ঠিক কতটা কষ্ট হয় কিন্তু রাদাফ যেনো বুঝতে নারাজ উপরন্তু সে তো হাসিতে মত্ত।

✨✨

পিহুর মনটা আজ ভীষণ খারাপ।আজকেও পুনরায় সে কায়ানকে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু বিনিময়ে প্রত্যাখান পেয়েছে।তবে সবথেকে বড় সত্য হচ্ছে যার জন্য সে এতোদিন নিজেকে সাজিয়েছে,পাগলের মতো তার পিছনে ঘুরেছে অথচ সেই ব্যক্তি কি না অন্য নারীতে আসক্ত।ভাবতেই পিহুর বুকঁটা হু হু করে কেঁপে উঠে।চোখে দেখা যায় শ্রাবণ ধারা।ইতিমধ্যে পিহুর চোখ ফুলে উঠেছে, নাকটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

পিহু কোনো মতেই নিজেকে সামলিয়ে উঠতে পারছে না।যে মেয়েটা সবাইকে হাঁসাতে ব্যস্ত থাকে আজ সেই মেয়েটা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।শ্রাবণধারাও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।পিহু নিজের ফোনে কায়ানের সব ছবি ডিলিট করছে আর কাঁদছে।এতোদিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে কায়ানের এসব ছবি সে তুলেছিল কিন্তু আজ তা মূল্যহীন।পিহু কায়ানের শেষ ছবিটা ডিলিট করার আগেই একটা মেসেজ এলো,

“প্রস্ফুটিত কন্যার সাথে শ্রাবণধারা বড্ড বেমানান।প্রস্ফুটিত কন্যাকে উৎফুল্লতায়ই সাজে শ্রাবণধারা তা না’হয় আমাদের মতো ব্যর্থ প্রেমিকদের জন্য তোলা থাক।”

মেসেজটা পাওয়ার সাথে সাথে পিহুর মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠে।

✨✨

চন্দ্রের সাথে সাথে আজ চন্দ্রকন্যাও সেজেছে।মুখে তার বিরুপ মায়া,ঠোঁটে তার গোলাপ ছোঁয়া।দু’হাত ভর্তি সাদা কাঁচের চুড়ি আর পড়নে সাদা শাড়ি। এ যেনো চন্দ্র থেকে ভ্রমণ কৃত চন্দ্রকন্যা।রাদাফ তাকে দেখার জন্য কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সেই চন্দ্রকন্যার হাসির ঝলকার শুনতে পায়। রাদাফ এগিয়ে যেতেই হাসোজ্জল আর্শিকা দোলনায় দোল খেয়ে দেখতে পায়।রাদাফ এক দৃষ্টিতে অপরুপ আর্শিকাকে দেখতেই থাকে।আর্শিকা হাসতে হাসতে বলে,

“কি খুনী সাহেব।আমাকে খুন করতে বুঝি চলে এসেছেন?”

“তুমি তো বহু আগেই আমার মনটাকে খুন করেছো।তার দায় কে নিবে শুনি?”

আর্শিকা হাসি থামিয়ে রাদাফের কাছে এগিয়ে গিয়ে মলিন মুখে বলে,

“আমি তো আপনার মনটাকে খুন করেছি কিন্তু আপনি তো আমার পুরো দুনিয়াটাই খুন করে ফেলেছেন।আমাকে যে আমার অস্তিত্ব থেকে আলাদা করেছেন তার কি কোনো শাস্তিই হবে নাহ?”

আর্শিকার কথায় রাদাফ চুপ মেরে যায়।মুহুর্তে আর্শিকা রাগে মাথা চেঁপে বসে পড়ে বলে,”আপনার আর আপনার বন্ধুর জন্য বিনা দোষে আমি দোষী হয়েছি এর সাজা যে মৃত্যুর চেয়েও কঠোর।আমি মুক্তি চাই সবার থেকে বাঁচতে চাই ঠিক আপনার বন্ধুর মতো।”

কথাটা বলতে বলতেই আর্শিকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।রাদাফ চিৎকার করে আর্শিকা ডেকেই চোখ খুলে ফেলল।এসিরুমে থাকা সত্ত্বেও রাদাফ ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।চোখের সামনে সেই দুঃস্বপ্ন ভেসে উঠতেই রাদাফ যেনো শিউরে উঠছে।রাদাফ সামনের গ্লাসের থাকা পানিটুকু ঢক ঢক করে খেয়ে বারান্দায় চলে গেলো।না আজ আর তার ঘুম হবে না বরং ৬ বছর আগের করা কাজের অনুতাপে জ্বলবে।

#চলবে