তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-১২

0
303

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-১২

রাদাফ ভার্সিটিতে এসেই ঠিক করেছে এখন থেকে সে আর কিছুতেই আর্শিকার সাথে খারাপ আচরণ করবে না।বরং ভালোবাসা দিয়ে আর্শিকাকে আপন করে নিবে।পরিকল্পনা মাফিক রাদাফ আর্শিকাদের ক্লাস নিতে এসে দেখে আর্শিকা ক্লাসেই নেই। ইভেন আর্শিকা চার বান্ধুবী তারাও নেই।রাদাফ একটু অবাক হয় ঠিকই কিন্তু মানিয়ে নেয়।

✨✨

আর্শিকা চটজলদি পায়ে ভার্সিটির দিকে দৌড়াচ্ছে।কাল রাতে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমানোর ফলস্বরুপ আর্শিকার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। আর যার ফলে ভার্সিটিতে পৌছাতেও তার বিরাট দেরি হয়ে গেছে।আর্শিকা একবার ঘড়ির দিকে আরেকবার গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে শুধু দৌড়াচ্ছে।ভার্সিটিতে পৌছাবে ঠিক সেই মুহুর্তে একটা কালো গাড়ি আর্শিকাকে কাঁদা ছিটিয়ে চলে যায়।একেই আর্শিকার দেরি হয়েছে তার উপর এভাবে কাঁদা ছিটানোর ফলে আর্শিকার মনে বিরুপ মনোভাব ধারণ করেছে।আর্শিকা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,

“ওহে লাটসাহেব, চোখে কি দেখেন না নাকি?নাকি অন্ধ হয়ে গাড়ি চালান। রাস্তার আশেপাশে যে মানুষ আছে তাদের কি মানুষ বলে গণ্য করেন না।যতসব বড়লোকি কারসাজি।আমার জামাটাই নষ্ট করে দিলো।”

বলেই আর্শিকা জামা পরিষ্কার করতে লাগলো।কিছু কাঁদা আর্শিকার গালে আর কপালেও লেগেছে।আর্শিকা খেয়াল করলো গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে থেমেছে। আর্শিকা ক্ষিপ্ত হয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির কাঁচে নক করলো।

“কি লাটসাহেব, মানুষকে মানুষ মনে হয় না?আজ আপনাদের জন্য আমার ভার্সিটি যেতে লেট হবে।আপনার নামে তো কে…..”

আর কিছু বলাএ আগেই গাড়ি থেকে কাঁচ নামিয়ে ফেলা হলো মুহুর্তে আর্শিকার ক্ষিপ্ত মুখে আগুনের ন্যায় ফুলে উঠলো।গাড়ির ভিতর থাকা ব্যক্তিকে দেখে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো কারণ গাড়িতে বসে আছে তার জন্মধাত্রী পিতা মো.আজমল চৌধুরী। আজমল চৌধুরী আর্শিকার দিকে নজর দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলে,

” আমায় ক্ষমা করে মা। ড্রাইভার তোমাকে খেয়ালই করে নি তাই কাঁদা লেগে গেছে।তুমি আমার সাথে চল আমি তোমাকে নতুন জামা আরও যা যা লাগে সব কিনে দিচ্ছি।”

আর্শিকা তুচ্ছ হেসে বলে,”বড়লোকি গিরি আমি দেখাই না স্যার।আমি সাধারণ তুচ্ছ মেয়ে তাই বিলাসবহুল জীবন আমি আশাও করি না।একবার তো বিলাসবহুল জীবন কাটিয়ে নিজের সব হারিয়েছি এখন যদিও হারানোর কিছুই নেই তবুও সেই বিলাসবহুল জীবন আমি আর চাই না।”

“কিন্তু তোমার গায়ে তো কাঁদা লেগে মামনি।এভাবে যাওয়া ভার্সিটিতে অনুচিত। তুমি আমার সাথে চলো।”

“বললাম না বড়লোকি গিরি আমি দেখাই না।না আমার অর্থের প্রতি কোন মোহ আছে না আছে ভালোবাসা।তাই আমার কাছে এই তুচ্ছ জামাই সুন্দর। আর কাঁদা লেগে গেছে তো সেটা ওয়াস করলেই চলে যাবে।বরং আপনার সাথে গেলে আমার নিজেকে ছোট মনে হবে। বার বার মনে হবে আমি আমার মায়ের খুনীর সাথে চলছি।”

আজমল চৌধুরী ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,”আর্শিকায়ায়ায়ায়ায়া।”

“চিৎকার করলেই কি সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে মি.আজমল চৌধুরী। আপনার আর আপনার এই অর্থের জন্য আজ আমি মাতৃহীন। আপনার অবিশ্বাসের জন্য আজ আমি পিতৃহীন,পরিবার হীন। আর তার সাথে কি না আমি শপিং করতে যাবো এতোটা নিচু মন মানসিকতা আপনার থাকলেও আমার নেই।আপনাকে আমি ঘৃণা…. ”

আর কিছু বলার আগেই আর্শিকার গায়ে সজোরে চড় পড়লো।চড়টা বোধগম্য হতে আর্শিকার মিনিমাম ১০ সেকেন্ডের মতো সময় লেগেছে।আর্শিকার চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে, রাগে নাক মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আর্শিকাকে আরেকটা চড় মারতে এলেই আর্শিকা আজমল চৌধুরীর হাতটা ধরে নেয়।

“আপনি আমার গুরুজন আর গুরুজনদের সম্মান দিতে হয় তাই আপনার প্রথম চড়টা হজম করে নিলাম।কিন্তু একই ভুল বারবার হলে আমি ভুলতে বাধ্য হবো আপনি আমার গুরুজন।”

আর্শিকার ব্যবহারে আজমল চৌধুরী রীতিমতো অবাক না হয়ে পারছে না।আজমল চৌধুরীর মনে হাজারো প্রশ্ন দানা বাঁধছে।আর্শিকা সেই প্রশ্ন বুঝতে পেরে তুচ্ছ হেসে বলে,

“পুরোনো আর্শিকা বিশ্বাস হীনতার সাথে মারা গেছে আর আপনার সামনে যে আর্শিকা দাঁড়িয়ে আছে সেই আর্শিকা দহনে কয়লার রুপ ধারণ করেছে।”

বলেই আর্শিকা আজমল চৌধুরী হাতটা ছেড়ে দিয়ে সামনে যেতে নিলেই আজমল চৌধুরী একটা কথাই আর্শিকা থেমে যায়।

“আজ কিন্তু ২রা মার্চ আর্শিকা।”

২রা মার্চ কথাটা শোনা মাত্রই আর্শিকা পা দুটো’ অচল হয়ে যায়।আর্শিকা শরীরের বেগ ছেড়ে দেয়।আজ যে তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী তা তো আর্শিকা ভুলেই গিয়েছিল।রাগ, প্রতিশোধ কষ্টের নেশায় আজকের দিনটার কথা আর্শিকা ভুলেই গিয়েছিল।আজমল চৌধুরী আর্শিকাকে দেখে বলে,

“আজকের দিনেও কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”

“আজকের দিনে আমি পুনরায় আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম।”

আর্শিকা অগত্যা দু’চোখের পানি ফেলে ভার্সিটিতে প্রবেশ করে।ভার্সিটিতে প্রবেশ করার পর পরই আর্শিকা হাতঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখে রাদাফ স্যারের ক্লাস শেষের দিকে তাই আর ক্লাসে না গিয়ে ভার্সিটির মাঠের এক কোণায় বসে ফোন টিপতে থাকে। কিন্তু ফোন টিপলেও মনটা যে আজ আধারে ছেয়ে আছে।আর্শিকার ভার্সিটিতে ফোন আর টিকছে না তাই ভার্সিটি থেকে যাওয়ার জন্য উদ্দ্যত হলেই একটা ছেলে আর্শিকাকে ডাকে।

“আরে আর্শিকা নাহ?”

আর্শিকা পিছনে ফিরলেই ভার্সিটির বড় ভাই ইমন ভাইয়াকে দেখতে পায়।ইমন পিহুর ১০৩ নাম্বার ক্রাস ছিলো।ভার্সিটিতে আসতে না আসতেই পিহু ইমনের উপর ক্রাস খেয়ে বসে থাকে পরে যখন জানে ইমনের গার্লফ্রেন্ড আছে তখন বেচারী বিনা প্রেমে ছ্যাঁকা খায়। ইমন আর্শিকার কাছে এসে বলে,

“আর্শিকা অনেক দিন পরে দেখলাম ভার্সিটিতে কি ঠিক মতো আসো না নাকি?”

“না ভাইয়া একটু প্রবলেমে ছিলাম তো তাই আরকি।”

“কোনো সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলতে পারো?”

“না ভাইয়া তেমন জরুরি না।”

“আর্শিকা তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো না করবে না তো?”

আর্শিকা মুচকি হেসে বলে,”আমার কাছে?আচ্ছা ভাইয়া কি এমন চাইবেন আপনি শুনি?”

ইমন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”আমি না তোমার এক বান্ধুবীকে পছন্দ করি।”

আর্শিকা ডাগর ডাগর চোখে বলে,”কিইইইই?সত্যিইইই?”

“হুম।”

ইমন আর্শিকার হাত ধরে বলে,”প্লিজ আর্শিকা পিহুকে পটাতে আমাকে সাহায্য করো।”

ইমনের মুখে পিহুর কথা শুনে আর্শিকা একটু অবাকই হয়।কারণ একসময় পিহুর ক্রাস ইমন ছিলো আর আজ কি না সেই ছেলেই পিহুকে পটাতে চাচ্ছে। সত্যিইই ভাগ্যে চাইলে কি কি ই না হয়।আর্শিকা একটু ইতস্তত বোধ করে বলে,

“না মানে আপনার প্রাক্তনের কি হলো?”

“সে আমাকে ঠকিয়েছে আর্শিকা।”

ইমনের কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে আর্শিকার বেশ মায়া হলো।কিন্তু পিহু তো একজন অন্য একজনের প্রতি আকর্ষিত এটা ইমনকে সে কি করে বুঝাবে?আর্শিকা হাত ছাড়াতে চাইলে ইমন হাত ছাড়ছে না।আর্শিকা দুঃখী মুখ করে বলে,

“আমি ক্ষমা প্রার্থী ভাইয়া পিহু অন্য একজনকে পছন্দ করে।”

“তাহলে তোমার অন্য কোন বান্ধুবীকে দেও।”

ইমনের মুখে এ কথা শুনে আর্শিকা তাজ্জব বনে যায়।আর্শিকা মনে মনে বলে,

“আরে আমি তো ভাবতাম পিহুই খালি লু/চ্চা/মি করে কিন্তু এই ছেলেও দেখছি লু/ই/চ্চা।না না একে আমার কোন বান্ধুবীকেই দেওয়া যাবে না।”

আর্শিকা পুনরায় মুচকি হেসে বলে,”ভাইয়া ওরা সবাই মিঙ্গেল।”

এবার ইমন হতাশা হয়ে আর্শিকার হাত ছেড়ে দেয়।ইমনের অবস্থা দেখে আর্শিকা মুচকি মুচকি হেসেই চলছে।ইমন হতাশ হয়ে বলে,

“আমার আর মিঙ্গেল হওয়া হলো না।” (খালি গল্পেরই মিল করাই নিজের মনের মিল আর হলো না)

ইমনের কথায় আর্শিকা এবার অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ে।কিন্তু আর্শিকার হাসি খুব একটা দীর্ঘ স্থায়ী হয় না।সপাটে আর্শিকার গালে চড় পড়ে।চড়ের মাত্রা এতোটাই জোরে ছিলো যে আর্শিকা ছিটকে ইমনের গায়ের উপর পড়ে। এমন মুহুর্তে আর্শিকাকে কে চড় মেরেছে তা দেখার জন্য মাথা তুললেই মুহুর্তে মাথাটা গরম হয়ে যায়।রাদাফ তার সামনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে মা/রার?”

“ভার্সিটিতে এসে ভার্সিটির ক্লাস না করে এখানে ছেলেদের সাথে হাসাহাসি করতে এসেছো তো তোমাকে কি আমি আদর করবো?”

আর্শিকার আর রাদাফের মুখের উপর তর্ক করতে ইচ্ছে হলো না।বরং রাদাফকে দেখলে এই মুহুর্তে আর্শিকার বিষাক্ত অতীতের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু রাদাফ রাগান্বিত হয়ে আর্শিকাকে বলে,

“এই মেয়ে এখন কথা বলছো না কেনো?নাকি সত্যিটা বলে ফেলেছি দেখে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।”

আর্শিকা দাঁতে দাঁত চেঁপে সব সহ্য করে চলেছে।আর্শিকার নিশ্চুপতা রাদাফের রাগকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে।

“এই মেয়ে কথা বলো।ভার্সিটির ক্লাস না করে তুমি এখানে ফুর্তি করো এটা কি ফুর্তির করার জায়গা?”

“আপনি তো আমার জীবনটা নিয়ে কম ফুর্তি করেন নি মি.কির্শফ ইসলাম রাদাফ?”

কথাটা বলেই আর্শিকা গট গট করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।ভার্সিটির সবার সামনে রাদাফের চড়টা আর্শিকার ঠিক হজম হচ্ছে না।এদিকে আর্শিকার কথা বুঝতে রাদাফের ঠিক ২ মিনিট লেগেছে।মুহুর্তেই রাদাফের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।রাদাফও যেতে যেতে বলে,

“না ভেবেছিলাম এই মেয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবো কিন্তু এই মেয়ে মিষ্টি কথার যোগ্যই না।একে সোজা করার জন্য আমার পুরোনো কির্শফে পরিণত হতে হবে।”

বলেই রাদাফ ডেভিল হাসি দিয়ে চলে যায় নিজ কক্ষে।

✨✨

রাদাফ নিজ অফিস কক্ষে কিছু ফাইল ঘাটছে।মূলত রাদাফও আর্শিকাকে নিয়েই অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে বিনা অনুমতিতে জয়া রাদাফের কক্ষে প্রবেশ করে।

“স্যার আপনি আর্শিকার সাথে কি করেছেন?”

রাদাফ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,”আজ সকালে তুমি কোথায় ছিলে?”

“আমাকে প্রিন্সিপাল স্যার ডেকেছিলো তাই ক্লাস করতে পারি নি কিন্তু আপনি আর্শিকার সাথে কি করেছেন?সারা ভার্সিটিতে এসব কি শুনছি আমি?”

“তোমার বান্ধুবী ক্লাস না করে ভার্সিটিতে ছেলেদের সাথে আড্ডায় মত্ত ছিলো তাই তোমার বান্ধুবীকে তার উচিত জবাব দিয়েছি।”

“স্যার আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি আর্শিকাকে নিয়ে বেশি ভাবছেন?”

“সেটা তোমার না বুঝলেও চলবে।”

“বাই এনি চান্স স্যার আপনি কি আর্শিকাকে পছন্দ করেন?”

জয়ার এমন প্রশ্নে রাদাফ জয়ার দিকে তাকাতেই জয়া মাথা নিচু করে ফেলে।রাদাফ মুচকি হেসে বলে,

“যাক আমার এক শালী তো বুঝলো তা।”

রাদাফের উত্তরে জয়া থম মেরে গেছে।কারণ আজ পর্যন্ত রাদাফ বাহ আর্শিকা কেউ কারোর সাথে মিষ্ট ভাবে কথা তো দূরে থাক স্বাভাবিক কথা পর্যন্ত বলে না। সেখানে রাদাফ আর্শিকাকে পছন্দ করে এটা ভাবতেই জয়া শিউরে উঠছে।জয়া বলে,

“স্যার আপনি ওকে আজ যে অসম্মান করলেন তা একদমই ঠিক করেন নি।আপনি ওর বিষয়ে কিছুই জানেন না।তার উপর আজকের দিন….”

আর বলতে পারলো না তার আগেই জয়া কান্নায় নিবেশিত হলো।জয়ার কান্নার কোন কারণ না বুঝতে পারছে না রাদাফ। রাদাফ জয়াকে আসস্ত করে বলে,

” জয়া কি হয়েছে আজকে?আজ এমন কি দিন?আমাকে খুলে বলো?নিজের ভাই মনে করে আমাকে বলো।”

“স্যার আজ আর্শিকার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।”

#চলবে