তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-১৪

0
295

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-১৪

আর্শিকা মৃত মায়ের দেহের সামনে তাকিয়ে পাথর হয়ে বসে আছে।আর্শিকার দুনিয়াটাই যে থেমে গেছে,মা নামক রত্নবান মূল্য হারিয়ে।এখন আগের মতো হা হা কার না থাকলেও নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে আর্শিকা কার্পন্য করছে না।একই সাথে আর্শিকা আজ তার মা আর তার একমাত্র নবজাতক ভাইকে হারালো।কিশোরী বয়সে আর্শিকা এ শোক যেনো চরম মাত্রার ধারণ করেছে।

হসপিটালের গেট দিয়ে হুমড়ি খেয়ে ঢুকে আজমল চৌধুরী।আজমল চৌধুরী আর্শিকা আর আর্শিকার মা’কে দেখে ড্রাইভারকে বলে,

“এসব কি করে হলো?আমি মাত্র জেনে তাড়াতাড়ি চলে এলাম।”

আজমল চৌধুরী তাড়াতাড়ি আর্শিকার মা’কে ছুঁতে এলেই আর্শিকার একটা আজমল চৌধুরীকে থামিয়ে দেয়।

“খবরদার আজমল চৌধুরী আমার মা’কে আপনি ছুঁবেন না।”

“আর্শিকা এসব তুমি কি বলছো?”

“কেনো ভুল বলেছি নাকি?”

“আর্শিকা এই মুহুর্তে তোমার মাথার ঠিক নেই তাই এসব বলছো দেখি আমাকে দেখতে দেয়।”

এই বলে আজমল চৌধুরী আর্শিকার মা’কে ছুঁতে এলেই আর্শিকা আগুনের বেগে এসে আজমল চৌধুরী হাত ছিটকে ফেলে দেয়।আজমল চৌধুরী রীতিমতো আর্শিকা কর্মকান্ডে অবাক।

“এক কথা কতবার বলা লাগবে আপনাকে?বলেছি না আমার মা’কে ছুঁবেন না।”

শেষের কথাটা আর্শিকা একটু জোরেই বললো।যার দরুন আজমল চৌধুরী হালকা কেঁপে উঠলো।এই আর্শিকা জানো তার কাছে অজানা এক আর্শিকা।যে আর্শিকা নিরবে সব কিছু সহ্য করে নেয় সেই আর্শিকা আজ কি না তার বাবার মুখের উপর কথা বলছে।একটা কথা আছে না,দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শান্ত মানুষও রাগী হয়ে যায় আর্শিকার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে।আজমল চৌধুরী একটু রেগে বলে,

“কি সমস্যা কি তোমার আর্শিকা?এই মহিলা যেমন তোমার মা ঠিক তেমনই আমার স্ত্রী।তোমার মা হারানোর কষ্ট হচ্ছে আমার স্ত্রী আর আমার সন্তান হারানোর কষ্ট হচ্ছে নাহ?”

আর্শিকা তুচ্ছ হেসে চোখের কোণে পানিগুলো মুছতে মুছতে বলে,
“স্ত্রী!হে স্ত্রী’ই তো,স্ত্রীর যত্ন না দিয়ে তার হাতে একগুচ্ছ টাকা তুলে দেওয়া স্বামী আপনি।স্ত্রীর কথা না শুনে টাকার কথা শুনা স্বামী আপনি।”

“আর্শিকা মুখ সামলে কথা বলো। আমি তোমার বাবা হই।”

“হে তো নামে মাত্র বাবা,কিন্তু আজ পর্যন্ত বাবার কোনো দায়িত্ব আপনি পালন করেন নি।ছোটবেলা থেকে আমার সব আবদার পূরণ করার বদলে আমার হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।আমার সাথে সময় কাটানোর বদলে টাকা দিয়ে লোক কিনে আমাকে দিয়েছেন।আমাকে বুঝার আগে আপনি টাকাকে বুঝেছেন।আমি শুকরিয়া আদায় করি আমার নবজাতক ভাই মারা গেছে নইলে তারও আমার মতো এই অবহেলা, এই কষ্টগুলো পেতে হতো।মুক্ত হয়ে গেছে সে।”

আর্শিকা কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলল।কিন্তু আর্শিকার কথা শেষ হতেই শক্ত বলিষ্ট হাত সজোরে আর্শিকা নরম গালে পড়ল।চড়ের মাত্রা এতোটাই বেশি ছিলো যে আর্শিকা মাটিতে ছিটকে পড়ল, ঠোঁট কেটে রক্তও বের হতে লাগল।আজমল চৌধুরী আর্শিকা উদ্দেশ্য করে বলে,

“তোমার সাহস হলো কি করে এসব বলার?আমি তোমাদের জন্যই টাকা ইনকাম করি আর তোমরা কি না আমার এই প্রতিদান দিলে?”

আর্শিকা পুনরায় তুচ্ছ হেসে বলে,”আমরা তো একবারও বলি নি আমাদের জন্য টাকা ইনকাম করতে?আপনি টাকা আপনার সব সম্পত্তি নিজের জন্য ইনকাম করেছেন আমাদের জন্য আপনার একটু সময়ই দরকার ছিলো যা আমরা পাই নি।এমনকি মৃত্যু পথযাত্রী আমার মা’ও পায় নি।”

এবার আজমল চৌধুরীর গলা নরম হয়।আজমল চৌধুরী ব্যর্থ স্বরে বলে,”আমি তোমার জন্মদাত্রী পিতা হই আর্শিকা, বাবার প্রতি এতো অভিমান ওকে আমি সব অভিমান ভেঙে দিবো একবার তোমার মা’কে আমায় ছুঁতে দেও।”

“না।”

আর্শিকার নির্লিপ্ত জবাবে আজমল চৌধুরী আবার আর্শিকাকে মারার জন্য উদ্যত হলেই সেই ডাক্তার এসে আজমল চৌধুরীকে আটকায়।আর্শিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় কিন্তু গাল গরম না হতেই চোখ খুলে দেখে ডাক্তার সাহেবের হাতে আজমল চৌধুরী হাত বন্দী।ডাক্তার সাহেবের চোখ দিয়ে আগুনের ন্যায় ফুলকি ঝ্রছে আর আজমল চৌধুরী চোখে বিস্ময়।ডাক্তার সাহেব হাতটা ঝাড়া মেরে বলে,

“লজ্জা করে না নিজ দায়িত্বে অবহেলা করে এইটুকু মেয়ের গায়ে হাত তুলতে?”

“আপনি কে?আমার মেয়েকে আমি মারবো তাতে আপনার কি যায় আসে?”

“এটা আপনার ব্যক্তিগত কোন সম্পত্তি বাহ প্রতিষ্ঠান নাহ যে এখানে আপনি আপনার মেয়েকে মারবেন।এটা আমার হসপিটাল এখানে সব কিছু আমার ইচ্ছায় হবে।”

“আপনি জানেন আমি কে?আপনার এই হসপিটালের মতো ১০ টা হসপিটাল কিনার সামর্থ্য রাখি আমি।”

“আপনার হয়তো অনেক টাকা কিন্তু সেই টাকাই আপনার কাছ থেকে আপনার মেয়ে আর আপনার স্ত্রীকে কেড়ে নিয়েছে।আরে সামর্থ্যের কথা বলছেন কই নিজের স্ত্রীর কঠিন সময়ে পাশে থাকার সামর্থ্য ছিল না বরং পাশে ছিলো এই বাচ্চা মেয়েটা আর আপনি তাকে মারছেন?বেরিয়ে যান এই হসপিটাল থেকে নইলে আমি দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হবো।”

“ডাক্তার সাহেব দয়া করে আমার স্ত্রীকে দেখতে দিন।”

আর্শিকা এবার মুখ খুলে বলে,”সেই অধিকার আপনি হারিয়েছেন আপনি এবার আসতে পারেন।”

“আর্শিকা মামনি প্লিজ তোমার মা’কে…..”

আর কিছু বলার আগেই ডাক্তার দারোয়ান ডাক দিলো।আজমল চৌধুরী এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের স্ত্রীকে শেষবারের মতো দেখে চলে যায়।আর্শিকা পুনরায় মায়ের দেহটাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। এই প্রথম আর্শিকা নিজ বাবার মুখের উপর কথা বলেছে।তাকে কড়া আঘাত করেছে।আর্শিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আম্মু গো তুমি কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলে। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে যে আমি থাকতে পারছি না আমার যে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।আমি যে ধুকে ধুকে মরে যাচ্ছি।”

✨✨

মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সৎ মায়ের প্রবেশ এ যেনো আর্শিকার ছোট মস্তিস্ক কাটিয়ে উঠতে পারছে না।স্ত্রীর মৃত্যুর চল্লিশ দিন হতে না হতেই নতুন বউ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে আজমল চৌধুরী। নতুন বউ আর কেউ নয় বরং আর্শিকার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড সুমনা বেগম বর্তমানে আজমল চৌধুরী ম্র দ্বিতীয় স্ত্রী সুমনা চৌধুরী।

আর্শিকা মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আজমল চৌধুরীর সাথে ঠিক মতো কথা বলে না।খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।এমতাবস্থায় আজমল চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে আর্শিকার মাথায় ঠিক হানা দিয়ে উঠলো না।ড্রয়িং রুমে বসে মন ভালো করার জন্য কার্টুন দেখছিলো আর্শিকা।এখন এই মস্ত বাড়িতে সারাদিন আর্শিকার একাই কাটে।আর্শিকা সঙ্গ দেওয়ার মতো এই মস্ত বাড়িতে কেউ নেই।কার্টুন দেখার মধ্যেই আজমল চৌধুরী নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে হাজির।আর্শিকা অবাক চোখে একবার সুমনা চৌধুরী আরেকবার আজমল চৌধুরীর দিকে তাকাচ্ছে।আজমল চৌধুরী আর্শিকার চোখের ভাষা বুঝে বলে,

“আর্শিকা এ তোমার নতুন মা?”

নতুন মা কথাটা শুনেই আর্শিকার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে।অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,

“মা মা’ই হয় আব্বু নতুন বাহ পুরোনো হয় না।আর এই মহিলাকে কিছুতেই আমি আমার মায়ের স্থান দিতে পারবো না।”

“আর্শিকা মায়ের স্থান না দেও কিন্তু সম্মানটা মায়ের মতোই দেও।”

আর্শিকা ছল ছল চোখে বলে,”আব্বু মায়ের মৃত্যুর এখনো ৪০ দিনও হয় নি।আর তুমি ন..তুন বি…য়ে?”

কথাগুলো বলতে গিয়ে আর্শিকার গলা আটকে আসছে।আজমল চৌধুরী একটু গম্ভীর কন্ঠেই বলে,

“তোমার মা’কে স্বাগতম করে নেও।”

“যেই মহিলাকে আমি মা বলেই মানি না তাকে স্বাগতম করার কথাটা কি হাস্যকর নয়?”

“বড্ড বেশি কথা বলছো তুমি।যদি আমার মুখের উপর আর একটাও কথা বলো তাহলে তোমার জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা আছে চলে যেতে পারো।”

আর্শিকা কথাটা শোনামাত্রই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ফেলতে থাকে।আজমল চৌধুরী রেগে নিজের কক্ষে চলে যায়।সুমনা চৌধুরী আর্শিকার কাছে এসে বলে,

“কষ্ট পেয়ো না মামনি।তুমি বাবার মুখের উপর কথা বলেছো তাই একটু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে।বাবার কথা কি এতো ধরতে আসে।”

আর্শিকা চোখ মুছে তাচ্ছিল্যের হেসে বলে,”আমার বাবার কথা ধরে আমার বাবাকে বিয়ে না করলেও তো হতো?আর বিয়ে যদি করতেনই তাহলে আমার মায়ের মৃত্যুর অন্তত পক্ষে ৪০ দিন পরে করতেন। এতো তাড়াও তো ছিলো না তাই না আন্টি?”

আর্শিকার নির্লিপ্ত প্রশ্নে সুমনা চৌধুরী চুপ হয়ে যায়।আর্শিকা নিজ ঘরে গিয়ে নিজের সমস্ত জিনিস গোছগাছ করে কারোর কোনো কথা না শুনে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য মামা বাড়ি গিয়ে উঠার কারণ মামা ছাড়া সে আর কার কাছেই বাহ থাকবে?

✨✨

আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো আর্শিকা তার মামার বাড়ি।মামার বাড়িতে যে আর্শিকার খুব সুখে কাটছে এমন নয়।বরং মামী যখন বুঝতে পেরেছে আর্শিকা এখানে বেশ কয়েকদিনের জন্য থাকতে এসেছে ঠিক তখন থেকে আর্শিকাকে বিভিন্ন ধরনের কথার মাধ্যমে কষ্ট দিচ্ছে। তার উপর তার মামাতো ভাইয়ের কুনজর আর্শিকার উপর পড়েছে যা আর্শিকা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে।আর্শিকা ভেবেছিলো আজমল চৌধুরী আর্শিকাকে নিতে আসবে কিন্তু নিতে আসা তো দূরের থাক আর্শিকার একবারের জন্যও খোঁজ নেয় নি।এতে অবশ্য আর্শিকার মনটা বেশ ভারি হয়ে উঠেছে।

আর্শিকা গোসল করে মাত্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনেই চুল মুছছিলো ঠিক সেই সময়ে ঘরে দরজা লাগানোর আওয়াজে আর্শিকার ধ্যান ফিরে।আর্শিকা পিছনে ফিরে তারই মামাতো ভাই ফাহিমকে দেখতে পায়। ফাহিম আর্শিকার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যার অর্থ আর্শিকার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না।আর্শিকা বিচলিত হয়ে বলে,

“ফাহিম ভাইয়া আপনি এখানে?মা…মামী কি আমায় ডেকেছে?”

“মা বাসায় নেই মেহু।”

কথাটা শোনা মাত্র আর্শিকার বুকটা ধক করে উঠলো। আর্শিকা আমতা আমতা করে বলে,

“ও…ওহ আচ্ছা কোনো কি দরকার ছিলো নাকি মামী বাসায় নেই এটা বলতেই এসেছেন?”

ফাহিম আর্শিকার কাছে আসতে আসতে বলে,”কেনো তুই বুঝতে পারছিস না আমি কি জন্য এসেছি তোর কাছে?মেয়েদের তো এসবে ভালো জ্ঞান থাকে কিন্তু তুই তো দেখছি বড্ড বোকা।”

আর্শিকা পড়নের ওড়না ঠিক করতে করতে বলে,”দেখুন ফাহিম ভাইয়া একদম বাজে কথা বলবেন না।দেখি সরুন এখান থেকে।”

এটা বলে তেজ দেখিয়ে আর্শিকা বের হতে গেলে ফাহিম এক ছিটকায় আর্শিকাকে খাটে ছুড়ে মারে। আর্শিকা অবাক চোখে ফাহিমের দিকে তাকালেই ফাহিম পৈশ্চিক হাসি দিয়ে বলে,

“তোর মনে হয় তোর মিথ্যা তেজ দিয়ে তুই আমার হাত থেকে বাঁচবি?আর এমনিতেও তুই আমাদের বাসায়ই থাকবি সো যদি এমন একটা মেয়ে থাকতে ফুর্তি না করি তাহলে তো তোকে বাসায় রাখার কোনো মূল্যই নেই।আর এমনিতেও তোর এসবে অভ্যাস করে নেওয়া উচিত।কারণ এখন থেকে তোর সাথে রোজই এসব হবে।”

“কি বাজে বকছেন ফাহিম ভাইয়া। আমি আপনার বোন হই।প্লিজ আমার সাথে এমনটা করবেন না।আমি হাত জোর করে আপনার অনুরোধ করছি।”

আর্শিকা কান্না করলেও তা ফাহিমের মন মানছে না বরং সে তার শক্ত পোক্ত দেহ দিয়ে আর্শিকা আটকে রেখেছে। এক টানে আর্শিকার ওড়না দূরে ফেলে দিয়ে আর্শিকাকে বাজে ভাবে ছুঁতে থাকে।আর্শিকা অসহায়ে চোখে পানি এসে পড়েছে।বার বার বাঁচার জন্য ছটফট করছে কিন্তু ফাহিমের শক্ত দেহের কাছে আর্শিকার দূর্বল দেহ জানো ক্রমশই হেরে যাচ্ছে।

#চলবে