তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-১৫

0
363

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-১৫

আর্শিকা অসহায়ে চোখে পানি এসে পড়েছে।বার বার বাঁচার জন্য ছটফট করছে কিন্তু ফাহিমের শক্ত দেহের কাছে আর্শিকার দূর্বল দেহ জানো ক্রমশই হেরে যাচ্ছে।আর্শিকা নিস্তেজ হওয়ার আগেই পাশে থাকা টর্চ লাইট আর্শিকার চোখে পড়ে।আর্শিকা কোনো কিছু না ভেবে শেষ বারের মতো নিজের সম্মান বাঁচাতে টর্চ লাইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। মুহুর্তে ফাহিম চিৎকার করে আর্শিকাকে ছেড়ে দেয়।আর্শিকাও ফাহিমকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে কান্না করে বেরিয়ে আসে।ইতিমধ্যে ধস্তাধস্তির প্রভাবে আর্শিকার জামার কিছু অংশ ছিড়ে গেছে।

আর্শিকা বাহিরে আসতেই মামীকে চোখে পড়ে।আর্শিকা মামীকে দেখেই মামীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।মামী আর্শিকার এই কান্নার কারণ উদঘাটন করতে পারে না।মামী আর্শিকাকে দূরে ফেলে হা হা কার করতে করতে ফাহিমের দিকে ছুটে যায়।

“হায় হায় রে,আমার পোলাডার মাথা ফাইট্টা গেছে কেমনে?আল্লাহ গো কত্ত রক্ত পড়তাছে?”

ফাহিম নিরিহ মুখ করে বলে,”আম্মু মেহু আমাকে বদনাম করতে চেয়েছে আমি বাধা দিয়েছি বলে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।”

ফাহিমের কথা শুনে আর্শিকার চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়।এতো বড় মিথ্যা অপবাদ তার নামে দিলো।আর্শিকা সাথে সাথেই মামীকে বলে,

“না মামী,ফাহিম ভাইয়া……”

“চুপ একদম চুপ।একেই আমার ছেলেটার মাথা ফাঁটিয়েছিস আর এখন আবার আমার সামনে সাঁধু সাজছিস।লজ্জা করে না এসব করতে?”

“মামী তুমি আমায়…. ”

কিছু বলার আগেই ফাহিম আর্শিকার চুলের মুঠি ধরে বলে,” আমাকে বদনাম করা না বেরিয়ে যা আমাদের বাড়ি থেকে।আর এটাই আমাকে খুশি না করার তোর শাস্তি।”

প্রথম কথাটা জোরে বললো শেষের কথাটা আস্তে বলে ডেভিল হাসি দিয়ে আর্শিকাকে এক ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।আর্শিকার মুখের উওর দরজা বন্ধ করে দেয়।যেই মেয়ের গায়ে আজ পর্যন্ত কেউ হাত পর্যন্ত দেয় নি,কেউ কটুক্তি করে নি আজ সেই মেয়েকে চরিত্রহীনা বলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।উপরোক্ত বোনাস হিসেবে চড়ও খেতে হয়েছে।আর্শিকা নিরবে দু’ফোটা পানি ফেলে বলে,

“শুনেছিলাম মা ছাড়া জীবন মরুভূমি কিন্তু তা যে হারে হারে সত্য তা উপলদ্ধি করতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি।মা ছাড়া আমার অস্তিত্ব যে বিলীন তা বুঝতে পারি নি।”

আর্শিকা মামার দু’য়ারে মুচকি হাসি দিয়ে বিনা হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।না আছে তার কাছে কোনো টাকা,না আছে কোন মূল্যবান সম্পদ।আছে শুধু এক বুক হতাশা আর হা হা কার। ছোট কিশোরী মন মুহুর্তেই যুবতীর মনে পরিবিশিষ্ট হয়েছে।আর্শিকা মনে মনে ভাবছে,

“হায়রে দুনিয়া,আমার বাবা কোটি কোটি টাকার মালিক কিন্তু তার মেয়ে হয়ে আমি আজ পথের ফকির।একেই মনে হয় বলে ভাগ্যের লিখন।”

আর্শিকা কিছু না ভেবেই ঢাকার উদ্দেশ্য একটা বাসে উঠে পড়ে।উদ্দেশ্য বাবার বাড়ি যাওয়া এছাড়াই বাহ আর কোথায় তার ঠিকানা রয়েছে?আর্শিকা ভেবে নিয়েছে বাবার সাথে সমস্ত ঝামেলা শেষ করে নিবে।আর্শিকা জানলার পাশে বসে আছে।আজ যেনো তার অশ্রুধারা থামছেই না।কাঁদতে কাঁদতে আর্শিকা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার হুস নেই।

✨✨

চোখ খুলতেই আর্শিকা নিজেকে বদ্ধ অন্ধকার রুমে আবদ্ধ দেখতে পায়।আর্শিকা অন্ধকারে ফোবিয়া রয়েছে যার দরুন প্রচন্ডমাত্রা ভয় পেয়ে যায়।আর্শিকা বুঝতে পারছে না বাসে ঘুমমত থাকা অবস্থা থেকে এই অন্ধকার রুমে কি করে এলো?তবে কি বাস ড্রাইভার ওকে ভোগ করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে।এসব ভাবতেই আর্শিকার ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“কে…উ আছেন?কেউ কি আ….ছেন এখানে?থাকলে দয়া করে জবাব দিন।”

আর্শিকা হাত পা নাড়াতে গিয়েও পারছে না।বুঝতে আর বাকি রইলো না কেউ শক্ত করে আর্শিকাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে।পরিস্থিতি অনুকূলে দেখে আর্শিকা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না, হু হু করে কেঁদে দিলো।কাঁদতে কাঁদতে যখন আর্শিকার হিচকি উঠে গেছে তখনই একগুচ্ছ আলোক রশ্নি আর্শিকার মুখের উপর পড়লো।

আর্শিকা কান্না থামিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সেদিকে তাকাতেই এক বিশাল আকারের দেহের অবয়ব তার চোখে ধরা দেয়।আর্শিকা ভীত গলায় সেই অবয়বকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ক….কে আপনি? আ..মাকে এখানে কেনো ধরে এনেছেন?আমার অপরাধ কি?”

অবয়বটি আর্শিকার কিছুটা কাছে এলে আর্শিকা অবয়বের ব্যক্তিটিকে দেখতে পারে। কালো শার্ট, প্যান্ট হাতে ব্যান্ডের ঘড়ি, মুখে কালো মাস্ক, চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। এ যেনো মানুষ নাহ বরং কালোর রাজ্যে অস্তিত্ব কোনো প্রাণী।আর্শিকার কাছে সব থেকে বেশি ভয়ংকর লাগছে চোখগুলো।চোখগুলো কেমন ফোলা আর লাল হয়ে আছে আর কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই না আর্শিকার দিকে তাকিয়ে আছে।এভাবে তাকিয়ে থাকলে এই দৃষ্টি তীরে কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই আর্শিকা নিহত হতে বাধ্য।আর্শিকা ভীত দৃষ্টিতে ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকলে ব্যক্তিটিকে কাউকে ইশারা করে গম্ভীর দৃষ্টিতে বলে,

“জ্যাব, দিস ইজ দ্য গার্ল হু ওস কিল মাই ফ্রেন্ড?”

“ই…ইয়েস স্যার।”

“বাট সি ওস লুকিং টু লিটল বেবি।”

“বাট স্যার…..”

জ্যাবের কথার আগেই আর্শিকা চিৎকার করে বলে উঠে,” দেখুন আমি বেবি নাহ?আর কারা আপনারা?কেনো ধরে এনেছেন এখানে?”

আর্শিকার আওয়াজে ব্যক্তিটি ভীষণ রেগে আর্শিকাকে ধমক মারে।

“এই চুপ,তোকে যে এত্তোক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছি তা তোর সাত জন্মের ভাগ্য।”

আর্শিকা প্রথমে ইংলিশ কথা শুনে বিদেশি লোক ভেবেছিলো কিন্তু পরে বাংলা শুনে সাত আসমান থেকে পড়েছে।আর্শিকা অবাক কন্ঠে বলে,

“আপনি দেশি?”

ব্যক্তিটা কোনো কথা বলল না বরং সামনে থাকা একটা চেয়ার নিয়ে আর্শিকার সামনে বসে।ব্যক্তিটার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি ঝড়ছে।এই দৃষ্টি আর্শিকাকে সেরেই ফেলবে।ব্যক্তিটা আর্শিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“কতগুলো ছেলেকে এভাবে ঠকিয়েছিলে?”

আর্শিকা অবাকের চূড়ান্ত সীমায় চলে গেছে। অবাক কন্ঠেই বলে,

“আমি ছেলে ঠকাবো মানে?বরং আমি এখানে এলাম কি করে?”

“বাস থেকে কিডন্যাপ করে এনেছি।”

“কিইইইই কিন্তু কেনো?”

ব্যক্তিটা চোখ দেখে বুঝা গেলো যে হাসছে।ব্যক্তিটা মুচকি হেসেই বলে,”তোমার এই ইনোসেন্ট কথা আর ইনোসেন্ট ফেস দেখেই তো আমার বন্ধু তোমার প্রেমে পড়েছিলো আর তুমি কি না ওর জীবনটাই নিয়ে নিলে?কি করে পারলে এতো পাষাণ হতে।”

বলেই চেয়ারে এক বারি মেরে উঠে দাঁড়াও। বারিটা এতোই জোরে ছিলো যে ঘরের প্রত্যেকটা মানুষ কেঁপে উঠেছে। আর্শিকা ভয়ে ভয়ে বলে,

“কে আপনার বন্ধু?আমি কাউকে ঠকাই নি?কাউকে মারি নি?”

“মিথ্যা বলা বন্ধ কর।তোর জন্য শুধু মাত্র তোর জন্য আমি আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি।আমার হাসোজ্জল বন্ধু সে সুইসাইড করেছে শুধুমাত্র তোর জন্য।”

আর্শিকা ব্যক্তিটার কথা শুনে পুরোই অবাক। তার জন্য কি না একজন সুইসাইড করেছে?এ তো শোনা দূর আর্শিকা কল্পনাও করতে পারে না।আর্শিকা ভীত হয়ে বলে,

“কে আপনি?”

“কির্শফ।যা আজ তোর মৃত্যুর কারণ।”

আর্শিকা এই জীবনে কখনো কির্শফ নামের ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।আর্শিকা আবারও প্রশ্ন করে,

“আপনার বন্ধুর কি হয়েছে?”

“কি হয়েছে?মানে?তোর জন্য ও সুইসাইড করেছে শুধুমাত্র তোর জন্য। আরে ও তো তোকে বিশুদ্ধ ভাবে ভালোবেসেছে আর তুই কি না ওর ভালোবাসার প্রতারণা করলি?ওর ভালোবাসার মজা উড়ালি?তোর প্রতারণার ফলে আমার বন্ধু সুইসাইড করেছে।প্রথমে তো ভেবেছিলাম আমার বন্ধুর দোষ কিন্তু না তোর তো আবার একজনে চলে না,চরিত্রহীনা নারী।”

আর্শিকা এবার প্রচন্ড রেগে যায়।রেগে গিয়ে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে,”এই যে শুনুন, কি জানেন আমার বিষয়ে?আমি আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের সাথে কথাই বলি নি সেখানে আপনার বন্ধুকে প্রেমে জালে ফেলে মেরেও ফেলেছি। বাহ ভাই বাহ কাহিনি বানানোরও একটা লিমিট থাকে।আর হে সেই মেয়ে যদি চরিত্রহীনাই হয় তাহলে আপনার বন্ধু কত ভালো যে একটা চরিত্রহীনা মেয়ের সাথে প্রনয়ের সম্পর্কে জড়াতে পারল?”

“একদম আমার বন্ধুর সম্পর্কে কিচ্ছু বলবে না। নইলে জানে মে/রে ফেলতে দু’বারও ভাববো না।”

“কেনো সত্যিটা বললাম দেখে গায়ে লাগলো বুঝি?”

কির্শফ প্রচন্ড মাত্রা রেগে গিয়ে জ্যাবকে ডাকে।আর্শিকার দিকে তাকিয়ে জ্যাবকে নির্দেশ দেয়।

“এই মেয়ের খুব তেজ তাই নাহ?এই মেয়ে বুঝতেই পারছে না কি দোষ তার।এই মেয়েকে আমি তিলে তিলে মারবো।দু’দিন ওকে এই অন্ধকার ঘরে বিনা খাবার পানিতে রাখবে।ওকে যদি কেউ এক ফোঁটাও পানি দেয় তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

আর্শিকা অনুনয় সুরে বলে,”দয়া করে আমাকে অন্ধকার ঘরে রাখবেন না।আমার অন্ধকারে ফোবিয়া আছে।আমি কিছু করি নি সত্যি।বিশ্বাস করুন আমায়।”

“তোকে আর বিশ্বাস? তোর মতো ছলনাময়ী নারী আমি আর দু’টো দেখি নি।ও’মা ছলনা করে দেখি ছেলেদের কাছ থেকে দামী উপহারও নেস।”

কথাটা বলার মাঝেই কির্শফ আর্শিকার গলা থেকে তার মায়ের জন্মদিনে দেওয়া শেষ স্মৃতি লকেটটা টেনে নিয়ে নেয়।লকেটট টান দেওয়ার ফলে আর্শিকার গলা সামান্য কেটে যায়।আর্শিকা অনুরোধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ওটা আমার মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি দয়া করে দিয়ে দিন।”

“তোর কাছে তাও তো কোন স্মৃতি আছে আমার কাছে তো আক্ষেপ ছাড়া কিছুই নেই।”

বলেই কির্শফ চলে যায়।পিছন থেকে আর্শিকা গলা কাটা মুরগির মতো চিৎকার করে বলে,

“আমি কিছু করি নি।আমি কাউকে মারি নি,কাউকে ঠকায় নি।দয়া করে লকেটটা দিন।ওটা ছাড়া আমি বাঁচবো না।আমার যে নিশ্বাস ফুরিয়ে আসছে।”

কথাটা বলতে বলতে আর্শিকা পুনরায় জ্ঞান হারানোর রাজ্যে ফিরে যায়।

#চলবে