তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-১৬

0
288

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-১৬

এক জগ পানির ছিটকায় আর্শিকার জ্ঞান ফিরে।এই দু’দিনে এই অন্ধকার ঘরকে ভয় পেয়ে আর্শিকা যে কতবার জ্ঞান হারিয়ে তা হিসাবহীন।এই দু’দিন আর্শিকা অনাহারে কাটিয়েছে।দু’দিন বললে ভুল অপহরণের দিনও আর্শিকা অনাহারেই ছিলো যার দরুন তিনদিন আর্শিকা অনাহারে দিন কাটিয়েছে।আর্শিকার শরীর এতোই বেশি ক্লান্ত যে চোখ খুলতেও কষ্ট হচ্ছে।

দু’দিন অন্ধকারে থাকার ফলে আলোটা আর্শিকার চোখ সহ্য করতে পারছে না।কির্শফ এখনো আর্শিকার সামনে মাস্ক পড়ে পুনরায় গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আসে।

“কি মেয়ে নিজের তেজ কমেছে?বুঝতে পেরেছে কত বড় ভুল তুমি করেছো?”

আর্শিকা তুচ্ছ হেসে বলে,”আমার জীবনটাই ভুলের সাগরে গড়া আর আমি বুঝবো না ভুল কি করেছি?আমার সবচেয়ে বড় ভুল আপনার সামনে নিজেকে তুচ্ছ মনে করা, ছোট ভাবা।”

“এখনো দেখি তেজ বিন্দুমাত্র কমে নি?”

“মেহেরজান চৌধুরী আর্শিকা আমি তেজ কি এতো সহজেই কমে?”

“তাই নাকি?কিন্তু এখন তোমার তেজ কমবে।”

বলেই কির্শফ তার বুকপকেট থেকে আর্শিকার মায়ের শেষ স্মৃতি সেই লকেটটা বের করে।আর্শিকা লকেটটা দেখা মাত্রই সমস্ত তেজ নিঃশেষ হয়ে যায়,সব দম থেমে যায়।আবেগ আপ্লুত হয়ে অনুরোধ করে,

“দয়া করে লকেটটা দিন। ওটা আমার মায়ের শেষ স্মৃতি।”

“তাই নাকি? খুব আবেগ এই লকেটটার প্রতি তাই নাহ?যাও একটা গেম খেলি।”

কির্শফের ইশারায় গার্ডরা আর্শিকার হাতের বাঁধন খুলে দেয়।দু’দিন বাঁধা থাকার ফলে আর্শিকা হাত নাড়ানোর শক্তি পর্যন্ত পাচ্ছে না।ফর্সা দেহে কালসেটে দাগ পড়ে গেছে।আর্শিকা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অবাক কন্ঠে বলে,

“কি গেম?”

“এই যে দেখছো এই লকেটটা। এই লকেটটা তুমি যদি আমার কাছ থেকে নিতে পারো তাহলে তুমি মুক্ত। তোমাকে কেউ কিচ্ছু বলবে না আর যদি না নিতে পারো তাহলে তুমি তোমার সব হারাবে।”

এই বলেই কির্শফ লকেটটা নিয়ে জানলার দিকে আগাতে শুরু করে।আর্শিকা কির্শফকে আটকাতে দাঁড়াতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।আর্শিকা কির্শফকে আটকানোর আগেই কির্শফ লকেটট বাহিরে দূরে ছুড়ে মারে।আর্শিকা এটা দেখে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

“আম্মুউউউউউউ, কেনো করলেন আপনি এটা?কেনো আমাএ কাছ থেকে আমার মূল্যবান জিনিস কেড়ে নিলেন?কি ক্ষতি করেছি আমি?আপনার সাথে আমার শত্রুতা তবে কেনো লকেটটা ফেলে দিলেন?কেনো আমার কথা শুনলেন নাহ?কেনো কেনো কেনোওঅঅঅঅ?”

আর্শিকা কান্না দেখে কির্শফ আর্শিকার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর আর্শিকার লকেটটা বের করে দেয়।আর্শিকা কির্শফের হাতে লকেটটা দেখা মাত্রই ছো মেরে লকেটটা নিয়ে বুকে আকঁড়ে ধরে।মনে হচ্ছে লকেটটা ছেড়ে দিলেই কোথাও হারিয়ে যাবে।সে যে তার মহামূল্যবান রত্ন পেয়েছে তা কি কেউ জানে?

কির্শফ আর্শিকার প্রশান্তির মুখ দেখে আপনা আপনিই বলে উঠে,
“আমি পারলাম না পাষাণ হতে,পারলাম না তোমার মতো অন্যের প্রিয় জিনিস কেড়ে নিতে।তোমার মলিন চেহারার কাছে হেরে গেলাম ঠিকই কিন্তু এর শাস্তি তোমায় পেতে হবে।”

আর্শিকা মুচকি হেসে বলে,”যে দোষ আমি করি নি তার শাস্তি নিয়ে আমার ভয় নেই। কিন্তু একদিন আপনি দগ্ধ হবেন অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হবেন।”

আর্শিকার কথায় কির্শফ রেগে চলে যায়।কেনো জানি না এই মেয়ের তেজ আসলেই কির্শফ দগ্ধ করছে।আর্শিকা কিচ্ছুক্ষণ ওভাবেই লকেটটা আগলে বসে থাকে।কিচ্ছুক্ষণ পর দরজা লাগানোর শব্দে আর্শিকার হুস ফিরে।আর্শিকা একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। প্রতিবারের মতো আবারও তাকে ঘর বন্দী করা হয়েছে। তবে আগের বারের মতো অন্ধকার না বরং আলোকিত।আর্শিকা কোন মতে উঠে দাড়াতেই সামনে মধ্য বয়স্ক একটা লোককে দেখতে পায়।

আর্শিকা লোকটার দিকে তাকাতেই চমকে যায়।লোকটা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যে দৃষ্টির ভাষা পড়তে আর্শিকা অবগত।এমন কু নজরের দৃষ্টিতেই তো ফাহিম তাকে দেখেছিলো তাহলে কি আজ ফাহিমের মতো এই লোকটাও?না না আর ভাবতে পারছে না আর্শিকা।ভয়ে আর্শিকার শরীর হিমশীতল হয়ে এসেছে।আর্শিকা আমতা আমতা করে বলে,

“কি হলো কাকা?আপনি এখনো যান নি কেনো?”

লোকটা কোনো উত্তর দেয় না বরং আর্শিকার দিকে আগাতে থাকে। আর্শিকে এতে আরও ভয় পেয়ে যায়।আর্শিকা পুনরায় প্রশ্ন করে,

“কাকা কি হয়েছে?আগাচ্ছেন কেনো?”

লোকটা কোন কথা না শুনে আর্শিকার হাত চেঁপে ধরে বলে,”আরে মামনি কাকা বলে আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়ো না গো?বরং আজ রাতে আমাকে তুমি আনন্দ দেও।”

আর্শিকা হাত মোচড়া মুচড়ি করতে করতে বলে,”ছিঃ কাকা আপনার লজ্জা লাগা উচিত।কি বলছেন এসব আমাকে?আমি আপনার মেয়ের বয়সী।ছাড়ুন আমাকে।”

“আরে রাখো মেয়ে বরং এখন আমাকে আনন্দ পেতে দেও।”

“আমি কিন্তু চিৎকার করবো কাকা।”

“এই ঘরের বাহিরে তোমার আওয়াজ যাইবো না।তাই যতখুশি চিৎকার করো।গলা কাঁটা মুরগীর মতো চিৎকার করো তাইলেই তো আমার মজা।”

আর্শিকা বুঝতে পারছে না কি করবে?তাহলে কি এবার আর তার নিস্তার নেই।শ/কুনের থাবায়ই তাকে পরিণত হতে হবে?

✨✨

কির্শফ তার ঘরে বসে আর্শিকার কথা ভাবছে। কি করে একটা মেয়ে এতো বড় অন্যায় করেও তেজ থাকতে পারে।হে কির্শফের ভাষ্যমতে আর্শিকা তার বন্ধুকে প্রেমের জআলে ফাঁসিয়ে তাকে ইউজ করেছে।তার বন্ধুকে হাজার স্বপ্ন দেখিয়েছে কিন্তু যখনই তার বন্ধু আর্শিকার কাছে প্রণয়ের আবেদন জানিয়েছে তখন সবার সামনে সেই মেয়েটি তার বন্ধুকে হাসির পাত্র বানিয়েছে।যুবক বয়সের প্রণয় প্রত্যাখান সাথে এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তার বন্ধুর আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়।কির্শফ হারায় তার সব থেকে প্রিয় বন্ধু এই জন্য প্রতিশোধের তাড়নায় কির্শফ আর্শিকাকে তুলে আনে।

কির্শফের ভাবনার মাঝেই জ্যাব হুমড়ি খেয়ে কির্শফের ঘরে প্রবেশ করে।ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায় কির্শফ রাগ হয়ে জ্যাবকে বলে,

“জ্যাব তোমার সমস্যা কোথায়?নক করে ঘরে ঢুকতে পারো না?”

“সর‍্যি স্যার ইটস আর্জেন্ট।”

“কি হয়েছে বলো।”

“স্যার আমরা যেই মেয়েটাকে তুলে এনেছি,সেই মেয়েটা ভুল মেয়ে।বরং আপনার বন্ধুর প্রাক্তন সেদিন বাস স্ট্যান্ডে আসেই নি।আর আমরা এই মেয়েটাকে আপনার বন্ধুর প্রাক্তন ভেবে তুলে এনেছি।”

জ্যাবের কথা শুনে কির্শফের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। কির্শফ অবাক হয়ে বলে,

“মানে?”

“স্যার এই দেখুন আপনার বন্ধুর প্রাক্তনের ছবি।”

কির্শফ ছো মেরে মেয়েটার ছবি দেখে।কির্শফের এখন বেশ রাগ লাগছে।কি করে পারলো না জেনে না শুনে একটা মেয়েকে এভাবে অত্যাচার করতে।কির্শফ রাগ হয়ে বলে,

“ইডিয়েট এই ছবিটা আগে দেখাতে পারো নি?”

“সর‍্যি স্যার আমিই মাত্র পেয়েছি।”

কির্শফ দৌড়ে আর্শিকার ঘরের দিকে যায়।কিন্তু গিয়ে কির্শফ আর জ্যাব দুজনেই অবাক।কারণ ঘরে তো আর্শিকা ছিলোই না বরং সেই লোকটা গলা আটকে বসে ছিলো আর গলা দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে।কির্শফ লোকটাকে দেখে তাড়াতাড়ি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।আর সাথে সাথেই সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে আসলে হয়েছিলো টা কি তা জানতে।

লোকটা যখন আর্শিকার খুব কাছে এসে আর্শিকাকে উপভোগ করতে চাইছিলো,আর্শিকা যেনো নিজের সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলো।মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে আর্শিকার লকেটটার দিকে চোখ পড়ে। আর্শিকার তার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে।

“এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কেউ কারোর জন্য নয়।নিজের বিপদে নিজের ঢাল হয়ে দাড়াতে হয়।নিজের কষ্ট নিজেরই মোচন করতে হয়।”

আর্শিকা কিচ্ছু না ভেবে নিজের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে লোকটার দু’চোখে ঢুকিয়ে দেয়।তারপর লকেটটার প্রান্ত ভাগ দিয়ে সোজা লোকটার গলা কেটে এখান থেকে পালিয়ে যায়।

এত্তোক্ষণ কির্শফ আর জ্যাব সিসিটিভিতে আর্শিকার কাজ দেখছিলো আপনা আপনিই কির্শফের মুখ দিয়ে ক্রেজি কুইন শব্দটা বেরিয়ে যায়।জ্যাব ভয় পেয়ে বলে,

“স্যার দিস গার্ল ইজ টু ডেঞ্জারাস।”

“নো জ্যাব বরং দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শান্ত মানুষও ক্ষিপ্ত বাঘিনী হয়ে যায়।আই নিড দিস গার্ল জ্যাব এট এনি হাও।”

✨✨

বহু বাধা পেরিয়ে আর্শিকা নিজ গৃহের সামনে এসে দাঁড়ায়।নিজ বাড়ির দেখে আর্শিকা চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।লকেটটার দিকে তাকিয়ে আপনা আপনিই বলে,

“আম্মু আমি পেরেছি।তোমার আর্শিকা পেরেছে নিজেকে রক্ষা করতে।পেরেছে নিজেকে শক্ত করতে।”

আর্শিকা চোখ মুছ দরজার কাছে যেতেই চমকে যায়। তবে কি আর্শিকা জিতেও হেরে গেলো?

“কাকে চাই?এ বাড়ির সামনে এতো ঘুর ঘুর কিসের।”

“আপনি কে?নতুন দারোয়ান কাকা?পুরান দারোয়ান কাকা কোথায়?”

আর্শিকা দরজায় দাঁড়ানো মাত্রই একজন দারোয়ান এসে বলল।আর্শিকাও বিপরীতে কথাগুলোর প্রতিউত্তরে দারোয়ান বলে,

“এই বাসার দারোয়ান আরও ৪ দিন আগে পরিবর্তন হইছে কিন্তু তুমি কে মা?”

“আমি এই বাড়ির মালিকের মেয়ে।”

কথাটা শোনা মাত্র দারোয়ানটা যেনো বড় সড় শক খেলো।দারোয়ান কাকা অবাক হয়ে বলে,

“তারা তো সবাই কানাডায় চইলা গেছে।তুমি এহনো দেশে কে?”

কানাডায় যাওয়ার কথা শুনে আর্শিকা যেনো বিরাট বড় শক খেয়েছে।এতো কষ্ট করে সকল বিপদ অতিক্রম করে যাদের জন্য গৃহে এলো তারাই কি’না তাকে ছেড়ে চলে গেলো?আর্শিকা অবাক কন্ঠে বলে,

“কবে গেছে কাকা?”

“আরও ৩ দিন আগে চইলা গেছে কিন্তু তুমি এহনো যাও নি কে?”

“বাবা কি আমার জন্য কোন চিঠি বাহ মেসেজ রেখে গেছে?”

“না মামনি তেমন কিছু তো রাইখা যায় নাই।”

আর্শিকা যেনো রীতিমতো হতাশই হচ্ছে।কোনো মতে নিজেকে ধাতস্ত করে আর্শিকা বলল,

“কাকা বাবার নাম্বার আছে তোমার কাছে?”

“হ মা আছে। দাড়াও স্যাররে ফোন দেই কিন্তু ফোন ধরবো কি না সন্দেহ।”

“কাকা আমার কথা জিজ্ঞেস করলেও আমি এসেছি এটা বলবেন না।”

“আচ্ছা মামনি।”

দারোয়ান আজমল চৌধুরীকে বার বার ফোন দেওয়ার পর ৭/৮ বারের সময় আজমল চৌধুরী ফোনটা ধরে। আর্শিকা ইশারায় ফোনটা স্পিকারের দিতে বললে দারোয়ান কাকা তাই করে,

“বড় সাব, আপনি কি কাউরে কানাডায় নিতে ভুইল্লা গেছেন?”

“মানে রহিম তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

আর্শিকার ইশারায় দারোয়ান কাকা বলে,”বড় সাব লোকের মুখে শুনতাছি আপনার নাকি একটা মেয়ে ছিলো?”

“এই ফালতু কথা বলার জন্য ফোন দিলে ফোন রাখো।”

বলেই রাগ দেখিয়ে আজমল চৌধুরী ফোনটা কেটে দিলো।এবার আর্শিকা ফোন নিয়ে ফোন দেওয়া শুরু করলো।৩/৪ বার ফোন দেওয়ার পরে আজমল চৌধুরী ফোন ধরে। আজমল চৌধুরী রাগান্বিত স্বরে বলে,

“আমার মেয়েকে নিয়ে যদি আর একটা প্রশ্ন করেছো তো তোমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবো।”

“আমি বুঝি খুব বোঝা হয়ে গেছি মি.আজমল চৌধুরী?”

#চলবে