তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-২১

0
359

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-২১

আর্শিকাকে দেখে রাদাফও যেনো চরম অবাক হয়েছে।এই মুহুর্তে এমন সময় আর্শিকাকে রাদাফ আশাই করে নি।রাদাফ আসার সময়ই তার বাবা বলেছিলো তার জন্মদিনে এমন গিফট দিবে যে রাদাফ চমকে যাবে তাহলে এ’কি সেই গিফট? রাদাফের মাথায় প্রশ্নের জট এসে জড়ো হচ্ছে।

“আর্শিকা এখানে কি করে এলো?বাবাকে আর্শিকা চিনলোই বাহ কি করে?তবে কি আর্শিকা আমাকে মেনে নিয়েছে?আর এটাই কি বাবার সেই গিফট?”

রাদাফের ভাবনার মাঝেই ডাক্তার আংকেল বলে উঠে।

“রাদাফ মিট মাই প্রিন্সেস আর্শিকা।৬ বছর আগে তোমার রিকুয়েষ্ট যার অপারেশন করিয়েছিলাম।”

কথাটা শোনা মাত্রই আর্শিকা যেনো ১০ তালা বিল্ডিং থেকে লাভ দিলো, মাথায় যেনো বাজ ভেঙে পড়লো। আর্শিকা অবাজ হয়ে প্রশ্ন করে,

“মানে আংকেল?”

“আসলে সেদিন অন্য ডাক্তারদের মতো আমিও স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম এমন রুগী তো দিন দিন আসেই তাইয়ার সাহায্য করবো না কারণ এতে কোনো লাভই নেই।ঠিক সেই মুহুর্তে আমার গুণধর পুত্রের ফোন আসে।মূলত তুমি যেমন আমার কাছে ঋনী তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য,আমি তেমন আমার ছেলের কাছে ঋণী আমাকে দিয়ে একটা ভালো কাজ করানোর জন্য,আমাকে সৎ পথে থাকার জন্য। সেদিন যদি ও অনুরোধ না করতো তাহলে আমি হয়তো তোমার কোন সাহায্যই করতাম না।”

আর্শিকা ডাক্তার আংকেলের কথায় থ মেরে বসে পড়ে।বুকের মাঝে চিন চিন ব্যাথা শুরু হয়। এ’কি মা হারানোর সেই ব্যাথাটা?না ব্যাথাটা বেশ প্রকোপ হচ্ছে।আর্শিকা আর কিছু ভাবার আগেই অজ্ঞান হয়ে যায়।

আর্শিকা জ্ঞান আসতেই নিজেকে এক অচেনা ঘরে দেখতে পায়।ঘরটা পুরো অন্ধকার যার দরুন কিছু দেখা যাচ্ছে না।অন্ধকার ঘর দেখতেই আর্শিকার সেই ঘরবন্দী থাকার কথাটা মনে পড়ে। আর্শিকার ভয়ে হাত পা কাঁপাতে শুরু করেছে। আর্শিকা কিছু বলার আগেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো এতে আর্শিকা একটু শান্তির নিশ্বাস ফেলে।

আর্শিকা দরজার দিকে তাকাতেই রাদাফকে দেখতে পায়। রাদাফের পাশেই ডাক্তার আংকেলও রয়েছে ডাক্তার আংকেল আর্শিকার পাশে বসে বলে,

“খাওয়া দাওয়ায় কবে থেকে অনিয়ম করছো?”

“জ্বি মানে?”

“আজ সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে?”

আর্শিকা মাথা নিচু করে বলে,”জ্বি নাহ।”

“নিশ্চয়ই কাল রাতেও না খেয়ে থেকেছো?”

আর্শিকা মাথা নিচু করে থাকে।ডাক্তার আংকেল আর্শিকার মুখ দেখেই সব বুঝে ফেলে।রাদাফকে ইশারায় খাবার আনতে বলে।রাদাফও বাবার নির্দেশ মেনে খাবার আনতে যায়।ডাক্তার আংকেল আর্শিকাকে বলে,

“তোমার শরীর খুব দুর্বল। না খাওয়ার ফলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে।পরে রাদাফ তোমাকে এখানে নিয়ে আসে।”

“এটা কার বাসা?”

“এটা রাদাফের ফ্ল্যাট। এখানে রাদাফ মাঝে মাঝে থাকে।”

“ওহহ।”

আর্শিকার কথার মাঝেই রাদাফ খাবার নিয়ে হাজির।খাবার দেখে আর্শিকা ডাক্তার আংকেলকে বলে,

“আংকেল আমি বাড়ি গিয়ে খাবো।এখন উঠি।”

“একদম না তোমার শরীর খুব দূর্বল, খেয়ে যাবে আগে।”

“না আংকেল আমি উঠি।”

আর্শিকার কথার মাঝে রাদাফ ডাক্তার আংকেলের উদ্দেশ্য বলে,

“বাবা তোমার অতিথিকে বলে দেও বাড়িতে কেউ এলে আমরা তাকে না খাইয়ে ছাড়ি না।”

ডাক্তার আংকেল রাদাফের কথায় সায় দিয়ে বলে,”দেখছো রাদাফও বলছে খেতে।এবার খেয়ে নেও মামনি।”

আর্শিকা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।ডাক্তার আংকেল আর্শিকাকে রেখে চলে যায়।ডাক্তার আংকেল যাওয়ার সাথে সাথে রাদাফ দুই হাত ভাজ করে কড়া গলায় আর্শিকাকে অর্ডার দেয়।

“চুপচাপ খাবারগুলো খেয়ে নেও।”

“আপনার কথা আমার শুনতে বয়েই গেছে।আমি খাবো না।”

রাদাফ ডেভিল হাসি দিয়ে বলে,”আমাকে খাইয়ে দিতে হবে এটা বললেই হলো। আমি আমার ক্রেজি কুইনের সেবা করার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত।”

“এই আপনি এতো অসভ্য কেনো বলুম তো?”

“অসভ্যতামি কিছু না করতেই অসভ্য উপাধি পেয়ে গেলাম তাহলে অসভ্যতামি একটু করি?”

রাদাফ কাছে আগাতেই আর্শিকা খাবারের পাশে ছুড়িটা নিয়ে রাদাফের দিকে তাক করে।

“আমি হচ্ছি জ্বলন্ত শিখা যেখানে হাত দিলে শুধু জ্বলবেনই তো বেটার এটাই আমার থেকে দূরে থাকুন।”

“আমি তো জ্বলতেই চাই মাই ক্রেজি কুইন।”

এমন সময় ডাক্তার আংকেলকে দেখে রাদাফ নিজেকে সামলে নেয়।আর্শিকাও নিজের রাগ দমন করে।আংকেল এসে আর্শিকাকে খেতে না দেখে বলে,

“এ’কি মামনি এখনো খাও নি যে?”

রাদাফ তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়,”আসলে বাবা উনার হাতে ব্যাথা তাই খেতে পারছে না।”

“ওহ তাহলে আমি খাইয়ে দেই?”

“আরে বাবা তোমার না কাজ আছে তুমি যাও আমি উনাকে খাইয়ে দিচ্ছি।”

আর্শিকা রাদাফের কথা শুনে চোখ দুটো’ বড় বড় করে বলে,”আরে না না আমার কোনো সমস্যা নেই আমি নিজেই খেতে পারবো।”

“নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ম্যাম আমার হাতে কোনো ব্যাকটেরিয়া নেই মাত্রই হাত ধুয়ে এসেছি।”

আর্শিকা আড়চোখে রাদাফকে কিছু বলতে নিলেই আংকেল বলে,”আরে সুইটহার্ট,আমার ছেলেই তোমাকে খাইয়ে দিক যেহেতু তোমার হাতে ব্যাথা।”

আংকেলের মুখে সুইটহার্ট কথা শুনে আর্শিকা চক্ষু চড়কগাছ। এত্তোক্ষণে আংকেলের সাথে কথা বলে আর্শিকা এইটুকু বুঝে গেছে যৌবন বয়সে আংকেল সেই লেভেলের ফ্ল্যাটবাজ ছিলো।আর্শিকার মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো,

“যেমন ছেলে তেমন তার বাবা।দুজনেই পটাচ্ছে হায় কপাল?”

আর্শিকা মিনমিনিয়ে কথা রাদাফের কান পর্যন্ত যায় না।রাদাফ আর্শিকা ক্ষেপাতে বলে,

“নিন সুইটহার্ট হা করুন আপনাকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

আর্শিকাও উপায় না পেয়ে রাদাফের হাতেই খেতে শুরু করে।আর ডাক্তার আংকেলও সামনে দাঁড়িয়ে আছে যার দরুন আর্শিকা রাদাফকে কিছু বলতেও পারছে না।আর্শিকাকে আরেকটু জ্বালাতে রাদাফ আংকেলের চোখের আড়ালে আর্শিকাকে চোখ টিপ মারে।বেচারী আর্শিকা রাদাফের কার্যক্রমে বেশম খেয়ে যায় এতো বেশিই বেশম খায় যে পানি খেয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না কাঁশতেই থাকে।

অনেকক্ষণ পরে আর্শিকা কিছুটা সুস্থ হয়।আর্শিকা সুস্থ হতেই আংকেল বলে,

“কি ব্যাপার প্রিন্সেস?খাবারে কি ঝাল বেশি হয়েছে? বেশম খেলে যে?”

“না না আংকেল ঠিক আছে।”

রাদাফ কথা ফোড়ন কেটে বলে,”আসলে কি বলো তো বাবা, বেশি রাগি মানুষদের না অল্পতেই ঝাল লাগে তারা নিজেরাও ঝাল কি নাহ তাই।”

কথাটা আংকেল বুঝতে না পারলেও আর্শিকা ঠিকই বুঝে। আংকেল আর্শিকার জন্য পানি আনতে গেলেই রাদাফ আর্শিকাকে বলে,

“এতো সুইটলি কেউ কিস করতে পারে তা তোমাকে না দেখলে জানতাম না মিস.সুইটহার্ট সর‍্যি মিসেস.সুইটহার্ট।”

“মানে?”

“এই যে আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছিলাম আর তুমি তোমার গোলাপের ন্যায় ওষ্ঠ আমারে হাতে ছোঁয়াচ্ছিলে। উফফ ট্রাস্ট মি সেই ফিলিংস হচ্ছিলো।”

আর্শিকা আড়চোখে রাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ষ্টুপিড একটা।”

বলেই নিজের মুখ ধুয়ে আংকেলের কাছে গিয়ে বলে,”আংকেল এবার বরং আমি যাই।”

“যাবে মানে?সময় দেখেছো?কয়টা বাজে?”

আর্শিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১০ টা বেজে গেছে।আর্শিকা অবাক চোখে আংকেলের দিকে তাকাতেই আংকেল বলে,

“তোমার শরীর অনেক দূর্বল ছিলো যার দরুন স্যালাইন সাথে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে তাই তুমি এত্তোক্ষণ ঘুমিয়েছো আর এতো রাত হয়েছে।তুমি বরং আজ এখানেই থেকে যাও।”

“না না সমস্যা নেই।আমি অটোতে চলে যাবো।”

“কোনো দরকার নেই।অনেক রাত হয়েছে।এই রাতে আমি তোমায় একা ছাড়তে পারবো না আম্মু।আর এমনিতেও আমার এই অলস ছেলে এখন তোমায় ছেড়ে আসতেও যাবে না আমি জানি তাই আজ এখানেই থেকে যাও।নাকি এই গরীব ঘরে থাকার তোমার অভ্যাস নেই?”

আংকেলের প্রশ্নে আর্শিকা মুচকি হেসে বলে,”সোনার চামচ নিয়ে জন্মালেও সোনার চামচটা আমার বহুদিন আগেই হারিয়েছে আংকেল।তা তো আপনার অজানা নয়?”

আর্শিকার কথার অর্থ আংকেল ঠিকই বুঝতে পারে।আর্শিকা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,”ঠিক আছে আজ আমি এখানেই থেকে যাচ্ছি।আমার কোনো আপত্তি নেই।”

আর্শিকা নিজের ঘরে গিয়ে দেখে রাদাফ তার বিছানায় সটাৎ হয়ে শুয়ে আছে। রাদাফকে দেখেই আর্শিকার মাথায় আগুন ধরে যায়।রাগান্বিত স্বরে বলে,

“আপনি এই বিছানায় কি করছেন?উঠুন এখুনি।”

“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন এটা আমার বাসা আর তুমি গেস্ট।আর আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ঘুমাতে পারি।”

“তার মানে আপনি কি আমার সাথে ঘুমাবেন নাকি?”

রাদাফ দুষ্টুমি করে চোখ টিপ মে/রে বলে,”প্রবলেম আছে।দু’দিন আগে হোক আর পরে আমি তো তোমার…. ”

কথা বলার আগেই আর্শিকা একটা বালিশ রাদাফের দিকে ছুড়ে মে/রে বলে,

“আমি এই ঘরেই থাকবো না।”

বলেই আর্শিকা আংকেলের পারমিশন নিয়ে ছাদের দিকে রওনা হয়।আর্শিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরোনো সব কথা ভাবতে থাকে। তখনই পুরুষালি কন্ঠস্বর আর্শিকার কানে ভেসে আসে।

“তোমার এক বিন্দু ভালোবাসার জন্য মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে আমার হৃদয়।আমি কি খুব অপরাধী?”

আর্শিকা কন্ঠস্বর শুনে যেতে নিলেই রাদাফ আর্শিকার হাত ধরে বলে,

“প্লিজ আর্শিকা আজকের রাতটা আমায় দিবে?অনেক কথা যে জমে আছে।”

“আপনার মতো নির্দয় ছেলেকে এক রাত কেনো এক সেকেন্ড দেওয়ার ইচ্ছাও আমার নেই।”

“আমি কি খুব অপরাধী?”

“হ্যা। কেনো আপনি আমাকে সেই তিনদিন আটকে রেখেছিলেন?কিছু না জেনে আমার উপর অত্যাচার করেছেন।খাবার,পানি তো দূর আমাকে আলোও দিন নি।এমনকি সেই লোকটাকে…”

আর কিছু বলার আগেই আর্শিকা কেঁদে দেয়। রাদাফ আর্শিকার দিকে তাকিয়ে বলে,

“তোমাকে কষ্ট দেওয়ার আমার উদ্দেশ্য ছিলো কারণ আমি জানতাম তুমি আমার ফ্রেন্ডের মৃত্যুর জন্য দায়ী কিন্তু তোমার সব কিছু নষ্ট করা, তোমার পরিবার থেকে দূরে রাখা আমার উদ্দেশ্য নয়।”

“ভাগ্যিস উদ্দেশ্য ছিলো না নইলে আমার কোন উপকার যে আপনি আবার করেন আল্লাহ জানতো।”

“প্লিজ আর্শিকা শুনো….”

” আমি চাইলেও কখনো আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না।কারণ আপনি আমার বিষাক্ত অতীতের সাক্ষী।”

বলেই আর্শিকা কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ভীষণ খারাপ লাগছে আর্শিকার, মনে হচ্ছে কেউ ছুড়ি দিয়ে তার কলিজা ছিদ্র করে দিচ্ছে।আর্শিকা চাইলেও রাদাফকে ভুলতে পারে না আবার মনে রাখতেও চায় না।আর্শিকা কাঁদতে কাঁদতে নিজেকেই বলে,

“এ কেমন অনুভুতি হচ্ছে আমার?আমি চাইলেও তাকে ভুলতে পারছি না আর মনে রাখলে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।ক্ষমা করতেও চাইলেও পারছি না।মেহেরজান মেহের আর্শিকা সর্বদা কঠোর থাকে তাহলে এ কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে আমার?”

#চলবে