তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-০১

0
128

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
#সূচনা_পর্ব
~সুমাইয়া মনি

‘কাজী রেডি, সাক্ষী রেডি, সব রেডি। এসে কবুল বললেই হবে। পরে যদি কথার একটুও নরচর হয়। মে’রে ফেলবো একদম, মা’র্ডা’র!’
গভীর রাতে এরূপ ধমন সরূপ টেক্সট দেখে কনকনে প্রবল শীতের মাঝেও লাফিয়ে উঠলো রাহা। নেত্রপল্লব বারংবার পিটপিট করে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ রাখল। পরপরই ফোন কম্বলে ঠেকিয়ে শূন্যে তাকিয়ে ভাবছে কত নাম্বার যুবক হবে, যে কি-না তাকে এরূপ ধমকি-ধামকির সরূপ টেক্সট পাঠিয়েছে। ভার্সিটির এক সপ্তাহের অতিক্রমের শেষের দিনে পাঁচটি প্রপোজাল পেয়েছিল। সেই যুবকদের নামও তার এখন মনে নেই ঠিক। এজন্য গভীর মনোযোগে ভাবছে কে হতে পারে? নাম্বারই বা কীভাবে হাতিয়েছে? টেক্সটটি আরো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে শুয়ে পড়ল। ঠিক তখনই অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো। যুবকটি উৎকণ্ঠিত গলায় নিজের নাম জপে তড়িঘড়ি জানাল,
‘জনি বলছি। কাল এগারোটায় কোর্টে পৌঁছে যাবে। আমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এড্রেস সেন্ড করছি। রাখছি।’
এতটুকু কথন বলেই ফোন রেখে দিলো জনি নামের ছেলেটি। বিস্মিত হয়ে ফের উঠে ফোনের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহা। হঠাৎ এমন একটি প্রস্তাব পেয়ে রায়া প্রথমেই অবাক হয়েছিল। পরপরই ফের একই অপ্রত্যাশিত ঘটনা তাকে দ্বিগুণ হতবাক করে দিয়েছে।
ভয় বা অস্বস্তি লাগছে না। তবে অচেনা নাম্বার থেকে এমন একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলা তার মধ্যে অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি জাগছে। প্রচুর কৌতূহল মনে। প্রস্তাবটি কেন বা কীভাবে এলো, সেটি নিয়ে সে খুব কৌতূহলী। সে জানতে চাইছে, প্রস্তাবদাতা কে এবং কীভাবে তার নাম্বার পেল। তবে এবার বিষয়টি সম্পূর্ণ হাস্যকর অনুভূতি সৃষ্টি করছে তার মনে। যদিও বিষয়টি তাকে খুব অযৌক্তিক বা মজার মনে হয়, তবে সে এখন মজা হিসেবে গ্রহণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে তার বান্ধবী ফারিনকে কল দিলো। উত্তেজিত হয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা বলার পর রাহা ক্ষেন্ত হয়। ধৈর্য সহকারে ফারিন সব কথা শুনে হাই টেনেটুনে বলল,
‘কি করবি?’
‘বিয়ে।’
নিমিষেই ঘুম যেন ফারিনকে ছেড়ে পালালো। বাঁ চোখ কচলিয়ে হতবাক সুরে বলল,
‘সত্যি?’
‘অবশ্যই সত্যি।’
‘এত রাতে বিনোদনের মুডে নেই আমি রাহা।’
‘এজন্য সত্যি কথা বলছি। এই লেখাপড়ার ঝামেলার থেকে বিয়ে করাই বেটার অপশন। বিয়ের শাড়ী, গহনা নিয়ে সকালে তোর বাড়ীতে দেখা হচ্ছে। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমা বাবু।’
‘রাহা মজা….’ লাইন বিচ্ছিন্ন করল রাহা। কপালে সজোরে চাপড় বসিয়ে ফারিন ভাবছে রাহার পাগলামি কথনগুলো। এই মেয়ে যে কাল ডাল-চাল ব্যাতীত বিনা ডেকে খিচুড়ি পাকাবে নিশ্চিত। অস্থির ও চিন্তিত ভাবনা ভঙ্গিতে নিদ্রায় ডুব দেয় ফারিন নিজেও।
.
ঢাকা শহরের শীতের সকাল মানেই এক অন্যরকম অনুভূতি। তবে এবার শীত আসতে বেশ দেরি হয়েছে যেন। সকালে শীতের প্রভাব বাড়লেও দুপুরে অনেকটা কম থাকে। রাতে আবার শীতের প্রভাব দুপুরের তুলনায় বেড়ে যায়৷ ঘুম ভাঙার পর চারদিকে কুয়াশার চাদর, রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চা, ভাপা পিঠার গন্ধ, আর মানুষের কোলাহল—সব মিলিয়ে শীতের সকালে এক অন্যরকম উষ্ণতা। তবে এবার যেন শীতের দেখা মিলেছে দেরিতে বললেই চলে।
ফুরফুরে মেজাজে দাঁত ব্রাশ সম্পূর্ণ করে বেলকনিতে বসে শীতের প্রভাব কতটা বেড়েছে তা দেখছিল। পেটে দানার অভাব অনুভব করে মায়ের কাছে ছুঁটলো রাহা। নাকেমুখে খাবার গুঁজে রেডি হয়ে নিলো। আলমারি থেকে মায়ের বিয়ের শাড়ী ও সামান্য কিছু গহনা নিয়ে ব্যাগে পুরে রওয়ানা হলো রাহা। ফারিনের বাড়ীতে পৌঁছে তড়িঘড়ি রেডি হতে লাগলো। কেবল মাত্র নাস্তা খাবার জন্য বসেছিল টেবিলে। বান্ধবীকে দেখে খুদা যে রাতের ঘুমের ন্যায় পালালো। কয়েক লোকমা মুখে তুলে রুমে এলো। অলরেডি শাড়ী পড়া শেষ রাহার। হালকা লিপস্টিক ব্যবহার করে গহনা পড়ে সে সম্পূর্ণ রেডি। ফারিন হাত ধরে রাগী মুখশ্রীতে বলল,
‘দেখ রাহা। এখন কিন্তু বেশি হচ্ছে।’
রাহা ফারিনের হাত ছাড়িয়ে দু বাহুতে হাত রেখে বলল,
‘লাইফে বিনোদনের খুব অভাব অনুভব করছিলাম। যেটা আজ আমি পেতে চলেছি। আরে চিল, আমি বিয়ে করছি না। আমি শুধু দেখতে চাই ঐ ছেলেগুলোর শেষ পর্যন্ত অবস্থা কি হয়।’
‘জাস্ট প্রাঙ্ক?’
‘ইয়েস বেবি।’
‘তাহলে রাজি।’
রাহা দুষ্টু হাসি প্রদান করে। কুবুদ্ধি বাসা বাঁধল যেন দু’জনেরই। একত্রে রেডি হয়ে বের হবার সময় ফারিনের আম্মুর প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও রাহা ম্যানেজ করে নেয়।
এগারোটার আগেই তারা পৌঁছাতে পারবে কোর্টে। এই উদ্দেশ্যে বের হলো তারা।
__
রোদের তাপমাত্রা স্নিগ্ধ হলেও কোর্টের আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বাড়ার ফলে কিঞ্চিৎ গরম অনুভব হচ্ছে। এরি মাঝে মেশকাত বিক্ষিপ্ত রাগ নিয়ে সজোরে জনির মাথায় গাঁট্টা মে’রে জানাল,
‘ষা’ড় গ’রু কোথাকার। এত বছরের প্রেমে নিজের প্রেমিকার নাম্বার ভুল করে। শোন, আমাদের নানাবাড়ি তিনটা গরু পালন করছি। সেখানের একটা গ’রু ছিল বলদ। ওরে আমরা খাবার পাত্রে দিলে খেতো না। মাটিতে দিলে ঠিকিই থেতো। ঐ গরুর বাচ্চাটি তুই, এক্কেবারে তুই। সিলেট থেকে ঢাকায় পয়দা হয়েছে কাকতালীয় ভাবে। আন্টি-আঙ্কেলের দোষ নেই। তুই ঐ গ’রুটার মতো অপদার্থ হয়েছিস।’
প্রাইভেট কারে হেলান দিয়ে বসা রায়ান ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বন্ধুর কথায় মৃদু হাসলো। দরজা খুলে পা দিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে ধরে রেখে সানগ্লাসটি চোখ থেকে পুরোপুরি নামিয়ে বলল,
‘মেয়েটিকে কল দিয়ে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং কথাটি জানা। বাই দ্যা ওয়ে, ফোন কার ছিল?’
‘আমার ছিল। ওর ফোনে কালই সব অফারের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য আমার ফোনটি দিয়েছিলাম। প্রেমিকার ভুল নাম্বার তুলে প্রথমে টেক্সট দিয়েছে। ফের কল দিয়ে বিয়ের কথা জানিয়ে এড্রেস পর্যন্ত সেন্ড করেছে।’
‘দ্যান?’
‘পরে সকালে ওর প্রেমিকা ওরে কল দেয়। তখন এই গরু জানতে চায়, তুমি বের হইছো? অপ্রকাশিত হঠাৎ গাছ থেকে যেমন ফল পড়ে, তেমনি হত-বলদ হয়ে প্রেমিকা জানতে চাইলো, কোথায় বের হবো? তখনই গ’রুতে কুরবানি হওয়া থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে কথা বানিয়ে বিয়ের জন্য রেডি হয়ে বের হতে বলল।’
‘শীট! মিস্টেক বুঝতে পারেনি।’ রায়ান মজার ছলে দরজায় আলতো ঘুষি দিয়ে বলল।
জনির করুন অসহায় মুখশ্রী এবার কান্নায় রূপান্তরিত হবে যেন। নিচু স্বরে রায়ানের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল,
‘প্লিজ, হেল্প দোস্ত।’
‘ফোন দে।’ মেশকাতের কাছে চাইলো রায়ান।
‘আমারটা কেন?’ রায়ানের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল মেশকাত নিজেও।
‘যেহেতু মিস্টেক তোর ফোন দিয়ে হয়েছে। সমাধান এটা দিয়ে করতে হবে।’
মেশকাত ফের কিছু বলতে পারলো না। অনায়াসে ফোন দিয়ে দিলো। তবে আদলে ছিল এক রাশ রাগ জনির জন্যে। প্রথম বার রিংটোন বাজলে রাহা রিসিভ করে না। ফের কল দিয়ে রিসিভ হতেই রায়ান সৌজন্যবোধ বজায় রেখে বলল,
‘হ্যালো মিস, মিস্টেক…’
বাকিটুকু বলার সুযোগ দিলো না রাহা। তড়িঘড়ি বলল,
‘প্রাইভেট কারের সামনে আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন রাইট?’
রায়ান কপালে ভাজ ফেলে উৎসুক হয়ে ডানে-বামে তাকালো। পেছনে দিকে ঘাড় ঘুরাতেই লক্ষ্য করল একটি মেয়ে লাল বেনারসি শাড়ী পরিহিত কনে সাজে এগিয়ে আসছে। তেমন ভারী সাজসজ্জা বিহীন সিম্পল বিয়ের সাজে মেয়েটির আদল সাধারণত এক অনন্য স্নিগ্ধতা জড়াচ্ছে যেন। তার চেহারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল আকর্ষণ ফুটে উঠেছে। মেকআপের ভারহীন চেহারা, হালকা রঙের একটি শাড়ি—তাকে একটি শান্ত, সৌন্দর্যমণ্ডিত উপস্থিতি দিয়েছে। চুলগুলো বাঁধা।
অলংকার ন্যূনতম পরিমাণে রয়েছে। সাজসজ্জার অভাব থাকলেও রাহার চোখের উজ্জ্বলতা ও মুখের প্রাকৃতিক হাসি তার সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দেয়। যেন এটি এক ধরনের সরলতায় ভরা সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে রায়ান তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রাহা এগিয়ে এসে জনিকে পাঞ্জাবি পরিহিত দেখে ভেবেই নিল এটি তার বর। জনিকে দেখতে মোটামুটি ভদ্র ও মার্জিত লাগে রাহার কাছে। ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘আমাকে কেমন লাগছে জনি?’
মুখ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে এলো জনির। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। বন্ধুদের পানে তাকাতেই মেশকাত কিছু বলতে যাবে এরমধ্যে উপস্থিত হয় জনির প্রেমিকা নীলিমা ও তার ছোট বোন। রাহার পরনে বিয়ের বেনারসি দেখে রাগের আভা ফুটে উঠলো নীলিমার আদলে। কৌতূহলী উৎসুক চাহনি তার রাহার উপর। রাহা অনুমান করে নেয় এই মেয়েটি জনির আসল প্রেমিকা। নীলিমা আপাদমস্তক রাহাকে মেপে তেড়েফুঁড়ে জনিকে জিজ্ঞেস করল,
‘মেয়েটা কে? তোমায় কেন জিজ্ঞেস করছে, তাকে কেমন লাগছে?’ নিমিষেই মুখ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে এলো জনির। ভীতিকর চোখেমুখে শুঁকনো ঢোক গিলল। চিকন বাঁশের ফাটা স্থানে আঙুল পড়লে যেরূপ বেদনা অনুভব হয়। জনির ঠিক এরূপ বেদনা অনুভব হচ্ছে হৃদয়ে। সংমিশ্রণ রয়েছে ভয়ের আশংকা। কোনোভাবে যদি জানতে পারে জনিকে বিয়ে করার জন্য এই অচেনা মেয়েটি উপস্থিত হয়েছে। চল্লিশার দাওয়াত খুব শীঘ্রই মিলবে আপনাদের। মেয়েরা সব কিছুর ভাগ দিতে প্রস্তুত থাকলেও, প্রেমিক বা স্বামীর ভাগ দিতে প্রস্তুত নয়। এতে তাঁদের কঁড়া আপত্তি।
.
.
.
#চলবে?