তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-১০

0
2

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১০.
রিসিপশন শেষে মেশকাতকে ফারিনদের বাড়িতে আসতে হয় শহিদ নগর। পাঁচ বছর আগে যেই স্থানে অচেনা মেয়েকে রেখে গিয়েছিল। কে-বা জানতো সময়ের ব্যবধানে আজ তাকেই এই এলাকার পরিচিত জামাই হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। ফারিন তার বোনদের নিষেধ করেছিল রুম যেন না সাজানো হয়। তবুও রুমে প্রবেশ করার পূর্বে ফুলের গন্ধ পেয়েই বুঝে ফেলে সাজানো হয়েছে। রেগেমেগে দরজায় নক করলে ভেতরে বোন সহ কাজিনদের উপস্থিতি টের পায়। যারা দুলাভাইয়ের থেকে টাকা নেবার বাহানা ধরে দরজা লক করে রেখেছে। মেশকাতকে তখন ড্রইংরুমের সোফায় জামাই আদর করে বসতে দেয়া হয়েছে। সামনে রয়েছে বিভিন্ন রকমের পিঠা। তাঁকে খেতে বলছে ফারিনের নানী, দাদীরা। ফারিনের ছোট বোন দরজা খুলে দিলেই রেগেমেগে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে সে। ফারাহকে শাসিয়ে বলল,
‘নিষেধ করার পরও কেন বাসর সাজিয়েছিস। কার অনুমতি নিয়ে?’
‘তাতে কি হয়েছে আপু? এটা তো নিয়ম।’ স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো ফারাহ।
‘ফালতু নিয়মের অজুহাত দিচ্ছিস? যেটা আমি মানি না মানতে চাই না। টাকা লাগবে তোদের তাই না? কত লাগবে বল? বল? আমি দিচ্ছি।’ বলেই তার হাতে থাকা পার্স ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার পাঁচটি নোট বের করে হাতে তুলে দেয়। হঠাৎ এভাবে ফারিনকে তাদের উপর গর্জে উঠতে দেখে ফারাহ সহ বাকিরাও ভড়কেছে। তার আচরণ এত কঠিন কেন বুঝতে পারছে না কেউ। ফারাহর চোখ ছলছল করে উঠে। কান্নারত কণ্ঠে বলল,
‘ভুল হয়েছে। টাকা লাগবে না আপু। আমি সব ফুল খুলে দিচ্ছি।’
‘জলদিই।’ একটা ফুলও যেন এ রুমে না থাকে। এটা বলতে বলতে জামা নিয়ে বেরিয়ে পাশের রুমে প্রবেশ করল। ফারাহ মনঃক্ষুণ্ন করে কাজিনদের নিয়ে ফুলগুলো খুলতে লাগলো। বাহিরে বসে সবই মেশকাত শুনছিল। তবে এটা সবাইকে বুঝতে দেয়নি। তাঁর ওপর রাগের তেজ শেষে বোনের উপর বর্ষণ করল ফারিন। এটা ভেবে তার রাগ অনুভব হলেও সে শান্ত থাকার চেষ্টা করে।
ফারিন ড্রেস পাল্টে সেলোয়ার-কামিজ পড়ে মেকআপ তুলে বেরিয়ে এলো। তার নানী তাকে ডাক দিলে সে কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল। তাকে কড়া ভাবে ইনগোর করেছে তা বুঝতে পেরে নিজেকে এবারও দমিয়ে রাখছে মেশকাত। রায়ানের শাসানোতে তেমন কাজে দেয়নি। ঘাড়ের রগ এখনো ত্যাড়া রয়েছে তা সে বুঝতে পারে।
_
‘আরান কেন চলে গেল? কি বলেছিস তুই আরানকে? কথা বল রাহা।’ খেঁকিয়ে জানতে চাইলো তন্নি। পাশে দাঁড়ান সাইদ। তার ফোনে একটি টেক্সট করে আরান কক্সবাজার ছেড়েছে। এটা তন্নি জানতে পেরে হোটেলে এসে জেরা করছে পুলিশদের মতো। রাহা শান্তশিষ্ট ভাবেই বসে ছিল। তার মধ্যে এখন আর অনুতপ্তের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। তন্নি ফের গর্জে উঠে,
‘রাহা আমি জানতে চেয়েছি।’
‘আমি চলে যেতে বলেছি।’ শূন্যে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল রাহা।
‘কেন?’
‘ও আমাকে প্রপোজ করেছে। থাপ্পড় দিয়েছি আমি। তারপর চিরতরে চলে যেতে বলেছি। আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি।’
‘পস্তাবি তুই একদিন।’
‘সেই সময় আসুক।’
‘আসবে।’ বলেই প্রস্থান করল তন্নি। সাইদও পিছু পিছু বেরিয়ে এলো।
রাহা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রাখলো। তার চোখে রাজ্যের ঘুম এসে যেন ধরা দিলো। নিদ্রায় কাবু হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
_
রাত একটার দিকে মেশকাত রুমে এলো। অবশ্য তাকে নিয়ে এসেছে ফারিনের নানী। ভেতরে দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এখন সম্পূর্ণ রুম ফুল মুক্ত। ফারিন কোনো প্রকার কথা না বলে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। মাজারি সোফায় ভরপুর কাপড়চোপড়। যেন সদ্য নামিয়ে রাখা হয়েছে সেগুলো। মেশকাত কোথায় ঘুমাবে বুঝে উঠতে পারছে না। তবে আজ সে ছেড়ে দিবে না। গায়ের কোট সোফার পাশে রেখে ফারিনকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বিছানার অপর পাশে গড়িয়ে ফেলে। তারপর সে সেখানেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। এহেম কাণ্ডে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ফারিন। সেকেন্ড কয়েক বুঝতে সময় নেয়। এরপর চেঁচিয়ে উঠলো,
‘এটা কি হলো? বিছানায় কেন ঘুমিয়েছেন?’
মেশকাত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভারী গলায় বলল,
‘ঘুমাব, এজন্য।’
‘নিচে ঘুমান।’ আঙুল দ্বারা ইশারা করে বলল ফারিন।
মেশকাত উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। পরনে তার এখনো মেরুর রঙের শার্ট এবং প্যান্ট। রাগে আরো ভ্রু কুঁচকে ফেললো ফারিন। বার বার একইভাবে নিচে নামতে বলছে। তোয়াক্কা করল না সে। চোখ বন্ধ করে ফারিনের কথাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে।
‘গায়ে কী গন্ডারের চামড়া লাগিয়েছেন? কথা শুনছেন না কেন?’
‘বাধ্য নই। বকবক না করে একটা গান ধরো, শুনে আমি ঘুমাই।’ সরস কণ্ঠে শুধালো।
এবার ফারিন বিক্ষিপ্তভাবে রেগে গেল। মেশকাতের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘এক্ষুণি নিচে নামেন। নয়তো….’
‘আমার গায়ে আর একবার হাত দিলে আমিও দিতে বাধ্য হবো তোমার গায়ে হাত। কোথায় দিবো সেটা আপাতত বলতে পারছি না।’ কাঠিন্য স্বরে কথাগুলো ছুঁড়লো মেশকাত। ফারিন কিছুটা দমে গেল। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কোলবালিশ মাঝখানে রেখে লাইট অন রেখেই শুনে পড়লো কম্বল মুড়িয়ে। মেশকাত পরিশেষে ফারিনকে দমাতে পেরেছে ভেবে মৃদু হাসলো।
.
সকাল সকাল খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো রাহা। বাসে উঠে বসল। কিছুক্ষণ বাদে তার পাশে একজন ছেলে এসে বসল। রাহা অস্বস্থি অনুভব করলেও পরমুহূর্তেই আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো বাহিরের দিকে। তার পাশাপাশি যে কোনো মেয়ে বসবে না এটা সে জানতো।
হঠাৎ তার নাম সহ কিছু কথা ভেসে এলো পাশের সিট বসা ছেলেটির মুখ থেকে। সে বলছে,
‘পাঁচ বছর পর দেখা। নিজের হাসবেন্ডকে চিনতে পারো নি রাহা?’
সজোরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ততক্ষণে রায়ান অপর সিটের সাথে হাত ঠেস দিয়ে ধরে কৃত্রিম হেসে তাকিয়ে ছিল তার পানে। রাহা রায়ানকে দেখে বক্ষে যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। ভয়ে একদম কর্ণাকে পিঠ ঘেঁষিয়ে বসে আহত নজরে তাকাল। হতভম্ব সে, ভীতিকর চোখমুখ তার। রাহার আদল দেখে রায়ান বেশ বিনোদন পাচ্ছে মনে মনে। বাসে এখনো তেমন যাত্রী উঠে নেই। সামনে হাতে গোনা কয়েকজন থাকলেও তারা ঘুমাতে ব্যস্ত। চিৎকার চেঁচামেচি করবে তারও কোনো ওয়ে নেই আপাতত। একে অপরের পানে সেভাবে তাকিয়ে আছে, যেন শুভ দৃষ্টি চলছে।
রাহা কম্পিত গলায় শুধালো,
‘আপনি এখানে কেন?’
‘তোমার টানে মন ছুটে এসেছে।’ ব্যাঙ্গ করে বলল সে।
‘আমি নামবো।’
‘আমি সাহায্য করছি।’ বলেই একটি রুমাল রাহার মুখশ্রীর পানে চেপে ধরল। রাহা হাত সরানোর চেষ্টা চালিয়েই মুহূর্তেই অচেতন হয়ে গেল।
রায়ান রুমাল পকেটে পুরে রাহাকে ধরে পাঁজরা কোলে তুলল। বাস থেকে নামতেই রায়ানের একজন লোক রাহার ব্যাগগুলো নিয়ে নামতে শুরু করল। রাহাকে নিজের প্রাইভেট কারে উঠিয়ে শুইয়ে দিলো। পাশে বসে সেই লোকটিকে নির্দেশ দিলো গাড়ি চালাতে। নির্দেশ অনুয়ায়ী গাড়ি ছুটিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। তাঁদেরকে কয়েকজন লোক এমতাবস্থায় দেখলেও তারা কিছু বলার সাহস দেখাল না। সেচ্ছায় যেতে দিলো। ঘুম থেকে লাফিয়ে জেগে উঠলো রাহা। রায়ানকে নিয়ে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছে সে। বাহিরে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। গলায়, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এত শীত বাহিরে, তবুও সে ঘামছে। রায়ানের প্রলেপ তার জীবনে কি ফের পড়তে চলেছে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে। পাশে ফিরে তন্নির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে লাইট জ্বালিয়ে নিচে নামল। ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে হোটেল ছাড়ল।

তন্নির ঘুম ভাঙর পর রাহাকে পাশে দেখতে না পেয়ে উঠে বসল। ফোন হাতে নিয়ে রাহার টেক্সট পেয়ে বুঝতে পারল খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। কিছুটা হতাশ হলো। এসেছিল তো খুশি মনে, পরিশেষে এমনটা না হলেও পারতো। কেন যে জীবনের মোড় কঠিন ভাবে মোড় নেয়!
.
সকালে বুকের উপর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায় মেশকাত। পিটপিট করে চোখ খুলে হালকা ভাবে কম্বল উঁচু করে তুলে দেখে ফারিনের মাথা এবং হাত তার বক্ষের উপর। খুব যত্নসহকারে তাকে আগলে ধরে ঘুমাচ্ছে। আজও চুলগুলো খোলা। মেশকাত মাথা তুলে কোলবালিশ খুঁজছে। একদম পায়ের কাছে দেখতে পেল। নিশ্চিত এটা এই মেয়েটার কাজ। রাতে ঝগড়া করেছে, এখন জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে অবুঝের মতো। ধীরে ধীরে বালিশে মাথা রেখে কোলবালিশ মাঝখানে দিয়ে দিলো। যাতে ঘুম থেকে উঠে তুলকালাম না করে বসে।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।