তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-১১+১২

0
1

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১১.
খুলনায় পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায় রাহার। একাকী রাহাকে আসতে দেখে খালামনির প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়৷ রাহা তাকে সুন্দর ভাবে সব বুঝিয়ে বলে। এবংকি আরানের বিষয়ও খুলে বলতে দ্বিধাবোধ অনুভব করল না। তিনি সব শুনলেন। রাশভারি গলায় শুধালো,
‘সমস্যা কি ছিল? শুধু এক বছরের ছোট। এ আর কি সমস্যা?’
‘কোনো কথাই বলতে চাচ্ছি না এ বিষয়ে খালামনি।’
‘আজ না হয় কাল বিয়ে তো করতেই হবে। আরান যখন রাজি আছে, প্রেমের বিষয় বাদ দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আরো ভালো হয় বিষয়টি।’
রাহা কথা এড়িয়ে রুমে চলে এলো। এই প্রসংগে কথা বলার আগ্রহ মোটেও নেই তার। রাহার এমন আচরণে তিনি হতাশ হলেন। মেয়েটার বিয়ের বিষয়ে এত বিতৃষ্ণা কেন তার কাছে অজানা!
দশটার দিকে তন্নি ফিরে আসে বাড়িতে। সাইদ তাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে। রাহা ও তন্নি একে অপরের সাথে কথা বলে না তেমন। রাতের আহার সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় তারা।
.
এদিকে সারাদিন সেই বাড়িতে দিনযাপন করে রাতে মেশকাতের সঙ্গে এ বাড়িতে ফিরতে হয় তাদের। মেশকাত কিছুটা অসহায় বোধ অনুভব করছে। সে কোনো প্রকার চায় না তাদের কলহ সমূহ বাড়ির সকলের কান অব্ধি পৌঁছায়। ডিভোর্সের ব্যাপারটা ভুলেও না যায় এই বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে মেশকাত। তবে কতদিন? ফারিন আটঘাট বেঁধে তবেই মাঠে নেমেছে। রাতে ঘুমানোর সময় মেশকাতের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কাল কোর্টে যাব। জানিয়ে রাখলাম।’
মেশকাত করুণ চোখে তাকালো। ছেলে হয়েও নিজেকে এই মুহূর্তে কেন জানি অসহায়, নিরুপায় লাগছে। বিবাহিত বউ ডিভোর্সের কথা বলছে, তাকে মুখ বুঁজে শুনতে হচ্ছে। মেশকাত উঠে বসল বিছানায়। নিজেকে ধাতস্থ করে কোমল গলায় শুধালো,
‘এ ছাড়া আমায় অন্য কোনো শাস্তি দিতে পারো। মেনে নিবো।’
‘শাস্তি? তাও আপনাদের মতো পুরুষদের?’ ফিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল। মেশকাত এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। আদলে নেই তার রাগের আভাস। ফারিন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ফের বলল,
‘আপনার বন্ধু কোথায়? তার অসহায়ত্ব ফেইস দেখতে চাই আমি। যেদিন জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল রাহাকে। একটি বার বাঁধা দেবার চেষ্টা করেন নি। কেন? আপনি চাইলেই নিষেধ করতে পারতেন। মজা নিয়েছেন। মুখ বন্ধ করে রেখেছেন আমারও। এখন আবার নতুনে রাহার জীবন ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছেন আমার জন্য। খোঁজ নিয়ে দেখুন অলরেডি ধ্বংস হয়েই গেছে রাহা। অবশিষ্ট আর মেয়েটার জীবনে কি-ই বা আছে?’ লাস্টেরটুকু বলে ফারিন মুখ সরিয়ে নিলো ঘৃণায়। ঈষৎ অনুতপ্ত বোধ অনুভব হলো তার হৃদয়ে। ফারিনের কথাগুলো বারংবার মনে আওড়িয়ে মুখ সরিয়ে নিতেই ফের সে কঠিন স্বরে বলল,
‘বিয়েটা আপনাদের কাছে ছেলেখেলা হলেও। মেয়েদের কাছে বড় কিছু। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। রাহা কি কখনো নতুন জীবন শুরু করতে পারবে অন্যকারো সাথে? কীভাবে করবে? একদিন না একদিন সত্যিটা সবার সামনে এসেই যাবে। তখন ওর কি হবে, একটি বার ভাবুন তো। আপনারও তো বোন আছে। ভেবে দেখেছেন। ওর সাথে যদি এমন হতো। কীভাবে মেনে নিতেন ভাই হয়ে? অথচ, রাহার ভাই হয়তো এখন অব্দি জানেই না তার বোন জোরপূর্বক বিবাহের শিকার হয়েছে।’ সম্পূর্ণ কথন শেষ হতেই ফারিনের গলা কান্নায় ধরে আসে। নিজেকে ধাতস্থ করে সে। আয়নায় তাকিয়ে চুল আঁচড়াতে আরম্ভ করে। মেশকাতের দৃষ্টি নিচু এবং অনুতাপের আভাস তাতে। এত বছর পর সে রাহার সাথে করা অন্যায় অনুভব করছে। সরস মুখ তুলে ভেজা কণ্ঠে শুধালো,
‘রাহার সাথে তোমার যোগাযোগ নেই?’
‘নাহ!’ কড়া গলায় ছোট্ট করে উত্তর দিলো। মেশকাত ফোন নিয়ে রুম ত্যাগ করল। পেছনে এক পলক ফিরে ফারিন বড়ো শ্বাস ফেলে বিছানায় শুতে যায়। রাহার জন্য হৃদয় তার কাঁদছে। বিনাকারণে তার সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে চিরতরে। আদৌও রাহার মুখোমুখি হতে পারবে কি-না কখনো জানা নেই তার।
_
সকালেই ছুটি বাতিল করে কাজে ফিরে রাহা। আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে কর্মজীবনে। তবে কাজের ফাঁকে বারে বারে তার ডান হাতের পানে নজর ফেলেছে। তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আরানের কথা। ছেলেটাকে চড় দেবার অনুতপ্ত মনে মনে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। শুধুই ভালোবাসা প্রকাশ করেছিল। এতটুকুই দোষ ছিল তার? নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করে হাঁপিয়ে উঠছে সে। আরানের প্রতি তার কোনো প্রকার অনুভূতি নেই। তবে হৃদয়ের এক কোণায় সুপ্ত ভালোলাগা ঠিকিই রয়েছে। সেটা ভালোবাসার রূপ দেবার মতো নয়। কেবল ভালোলাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধতা। হঠাৎ একজন পিয়ন আসে। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। তাকে ইমিডিয়েটলি ম্যানেজারের চেম্বারে ডাকা হয়েছে। পিয়ন বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিয়ে সেও বেরিয়ে এলো। দু মিনিটের পথ অতিক্রম করেই ম্যানেজারের কেবিন। ভেতরে ম্যানেজার ব্যতীত আরেকজন পুরুষের কণ্ঠের স্বর কানে ভেসে আসছে। কেমন পরিচিত স্বর। পাত্তা না দিয়ে নক করে ভেতরে প্রবেশ করল রাহা। ম্যানেজারের অপজিট পাশে অচেনা পুরুষ বসা। উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসার ফলে মুখশ্রী দেখার উপায় নেই। তেমন আগ্রহ দেখাল না সে।
‘জি আমার ডেকেছেন স্যার?’ শান্ত ভাবে জানতে চাইলো রাহা। ম্যানেজার হাবিব হেলান ছেড়ে টেবিলে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, বোসো। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই একজন নতুন মানুষের সাথে।’
রাহা কৃত্রিম হাসি প্রধান করে সোজা হয়ে বসল। তার পাশেই অচেনা লোকটির বসেছে এজন্য কিছুটা বিব্রতবোধ অনুভব করে রাহা। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বসতে হয় তাকে। ম্যানেজার হাত উঁচু করে রাহার দিকে তাক করে পরিচয় দিলো,
‘আমাদের এডামজি টেক্সটাইল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রধান কর্মকর্তি রাহা মনি। আর এনি রেড ক্রিসেন্ট টেক্সটাইল কোম্পানির মালিকের দ্বিতীয় পুত্র আরান শেখ এবং নতুন এমডি। আমাদের কোম্পানি ঘুরে দেখতে এসেছেন তিনি।’
রাহা ঘুরে তাকিয়ে আরানকে দেখে যতোটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হতবাক সে খুলনার বৃহত্তম কোম্পানির মালিকের দ্বিতীয় ছেলে শুনে। আরান কাঠিন্য আদলে রাহাকে ‘হাই’ জানালো। রাহা মুখচোখ স্বাভাবিক করে মৃদু স্বরে অপরিচিতের বান ধরে বলল,’হ্যালো’। আরান তাকে তার যোগ্যতা দেখানোর জন্যই হয়তো এখানে উপস্থিত হয়েছে। সে তো কখনো তাকে ছোট চোখে দেখেনি। না সে তার পরিচয় জানতে চেয়েছে। ভাড়াটে হিসেবে চেনাজানা ছিল। পরিচয়ও তেমন জানা ছিল না। তাহলে কি পরিচয় গোপন করে ভাড়া থাকতো? এর মুল রহস্য কী ছিল? রাহাকে এত ভাবতে দেখে ম্যানেজার ফের তার উদ্দেশ্য বলল,
‘রেড ক্রিসেন্ট টেক্সটাইল কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত টেক্সটাইল মিল। তাদের মিল বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সাধারণত গার্মেন্টস এবং ফ্যাব্রিক উৎপাদন করে এবং বিশ্বব্যাপী রপ্তানির জন্য পণ্য সরবরাহ করে। ঠিক আমাদের মিলের মতো। তবে অন্যান্য টেক্সটাইল কোম্পানির মতো, বাজারে পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। উৎপাদন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আরও উন্নত করতে কাজ করে থাকে, আমাদের মিল থেকেও এগিয়েও কয়েক দাপ।’
রাহা সব কথন শুনলো, হাসিমুখে বলল,
‘আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি তাঁকে?’
‘আমাদের মিল ঘুরিয়ে দেখাবে তাকে। সঙ্গে সিনিয়র অপারেটর ফয়েজকে নিবে।’
রাহার অস্বস্তি অনুভব হয় এখন। তাঁকেই কেন? আরো তো অনেক কর্মকর্তা রয়েছে। কীভাবে এখন আরানের সম্মুখীন হবে? নতুনে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে? ভেবেই কুলহারা সে!৷ আরানের ভাবমূর্তি তখনো কঠোর। রাহার পানে না তাকিয়ে তার অস্বস্তি অনুভব করতে পারছে পাশে বসেই। রাহা মলিন কণ্ঠে বিনয়ী স্বরে বলল,
‘স্যার, আমি বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম। শরীর অসুস্থ অনুভব হচ্ছে। যদি আমার এই দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতেন ভালো হতো।’
আরানের মুখ এবার কাঠিন্য ভাব সরে গিয়ে ক্ষুব্ধ আভাসের দেখা মিলল। ম্যানেজার সম্মতি জানিয়ে বললেন,
‘শিওর! তুমি যেতে পারো। আমি নিজেই দায়িত্ব নিচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ এরপর আরানের পানে চেয়ে সৌজন্যবোধ বজায় রেখে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘স্যরি মি.আরান শেখ।’ বলেই উঠে ত্যাগ করল কেবিন। বাহিরে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত কেবিনে এসে সাইড ব্যাগ নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। এক প্রকার পালিয়ে এসেছে যেন মিলের ভেতর থেকে।
তবে তার মনে রয়েছে আরানকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন। যার উত্তর কেবল আরানের কাছেই মিলবে।
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১২.
রাহা বাড়িতে ফিরার সঙ্গে সঙ্গে আরো অবাক হয়। কারণ অপরিচিত দু’জন ভদ্রমহিলা ও একজন লোক এসেছে। রুমানা খাতুন তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। তন্নি পাশের সোফা থেকে উঠে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমার একমাত্র খালাতো বোন রাহা।’
পরিচয় করিয়ে দেবার ফলে ইতস্তত বোধ অনুভব করছে রাহা। মুখ ফুটে কিছু বলছে না। ভদ্রমহিলা এক গাল হেসে এগিয়ে এলেন। রাহার এক হাত ধরে ‘এসো’ বলে টেনে পাশে বসালেন। এবার যেন আরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল রাহা। অপরিচিত দু’জন মানুষের সামনে এভাবে বসতে বেশ অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে তার। খালার কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না তারা কে? কি তাঁদের পরিচয়?
তিনি রাহার এক হাত ধরে তার পানে চেয়ে বলল,
‘আপা আপনার মেয়েকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। কিছু মনে না করলে আংটি পরিয়ে দিতে চাই।’
বিস্ময় হতবিহ্বল হয়ে গেল রাহা মহিলার কথা শুনে। কপাল কুঁচকে এলো। রুমানা খাতুন মৃদু হেসে বললেন,
‘কোনো অসুবিধা নেই আপা।’
রাহা দ্বিতীয় বার চমকাল। বিস্মিত স্বরে জানতে চাইলো,
‘খালামনি কি বলছো? হঠাৎ না জানিয়ে আংটি। আর উনারা কে?’
রুমানা খাতুন রাহার প্রশ্নে উদ্বিগ্নতার ভাব দেখা গেল তার আদলে। এবং কিছুটা লজ্জাবোধ অনুভব করল। তিনি মুখ খোলার পূর্বে অপরিচিত মহিলা বললেন,
‘আমরা আরানের আব্বু-আম্মু। তুমি নিশ্চয় আরানকে চিনো। ওই আমাদের পাঠিয়েছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। যেহেতু আমাদের তোমাকে পছন্দ হয়েছে। এজন্য আংটি পড়াতে চাই।’
রাহা চমকালো না এবার। আরান ঠিক প্লান করেই এভাবে সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। তবে এত দ্রুতই সব করবে জানা ছিল না তার। রাহা উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত দূরে এসে দাঁড়ায়। কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘আমার মতামত ব্যতীত আপনারা কীভাবে আংটি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন?’ কথাগুলো সকলের উদ্দেশ্য করে বলল রাহা। আরানের আব্বু-আম্মুর মুখশ্রীতে এক রাশ কালো মেঘের দেখা মিললো। রুমানা খাতুন রাহার হাত চেপে রাগান্বিত স্বরে বলল,
‘আমরা তোর গুরুজন। দায়িত্ব আমাদের রয়েছে।’
‘আমি প্রাপ্ত বয়সী নারী। আমার অনুমতি নেবার দায়িত্ব নিশ্চয় তোমার রয়েছে।’
‘মুখে মুখে তর্ক করবি না রাহা।’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি কিছুটা।
‘খালামনি জোর করে আমার উপর তোমার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারো না।’ সরস কণ্ঠে শুধালো রাহা।
আরানের আম্মু রুমানা খাতুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
‘আমি বলি কি। আপনি আগে রাহাকে স্বাভাবিক হতে দিন। হঠাৎ কর্মস্থান থেকে ফিরে আমাদের দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। আমরা বরং অপেক্ষা করি।’
রাহা মুখ ঘুরিয়ে তার পানে চেয়ে নরম স্বরে বলল,
‘আন্টি আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করব না এমনটা নয়। আমি মন থেকে আরানকে কখনো ভালোবাসার নজরে দেখেনি। সব সময় ছোট ভাই হিসেবে দেখেছি। ওর ভালোবাসার প্রপোজাল আমি রিজেক্ট করেছি কক্সবাজার থাকাকালীন। তবুও ও বুঝেনি। আপনাদের শুধু শুধু পাঠিয়েছে।’
আরানের আম্মু রাহার মাথায় হাত রাখলো। তার মুখ মলিন। খুবই বিনয়ী ভাবে বলল,
‘আরান আমাকে সব বলেছে। আমার ছেলে ছোট থেকে একটু জেদি। আমরা ওঁকে ডাক্তার হবার জন্য ফোর্স করলে আরান বাড়ি থেকে এ বাড়িতে ভাড়া থেকে ডিপ্লোমা টেক্সটাইল বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে। ওর ইচ্ছে বাবা, বড় ভাইয়ের মতো নিজেদের মিলে কাজ করবে। নিজের জেদ রেখেছে আমার ছেলেটা। এখানে এসে তোমায় প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলে। তুমি বড়ো এতে তার কোনো আপত্তি নেই। তোমার কথা আগে থেকেই আমায় বলেছে। আমাদেরও আপত্তি নেই। আমার ছেলের ভালোবাসার জেদ ধরেই তোমায় বিয়ে করবে এমনটা নয়। আরান তোমায় সত্যি খুব ভালোবাসে। এখন তোমার সম্মতি ছাড়া জোর করে বিয়ে সম্ভব না। যদি তোমার মত পরিবর্তন হয় আমাদের জানাবে। আজ আমরা আসি।’ তিনি সম্পূর্ণ কথা বলে বিদায় নিয়ে দরজার নিকট গেলেন। আরানের আব্বুর আদলে কিছুটা রাগের আভাস দেখা গেলেও তিনি পরিস্থিতি সামলে নিয়ে প্রস্থান করল। হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকালের আরানের আম্মু। রাহার পানে তাকালেন। তার নজরে ছিল একরান হতাশার ছোঁয়াছে ভাব। খুব নমনীয় ভাষায় শুধালো,
‘আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিও না মামনি। বড্ড আদরের ছেলেটা।’ বলেই তিনি জায়গা ছাড়লেন। রাহা পাথরের ন্যায় শূন্য স্থানে তাকিয়ে রয়েছেন। তন্নি দরজা লাগিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে ভারী কণ্ঠে জানাল,
‘যে যার ইচ্ছে মতো বিয়ে করতে পারে। তুমি চাপিয়ে দেবার কে আম্মু? মনে রেখো তুমি রাহার খালা।’ কথাটা রাহাকে আঘাত করে বক্ষে। তন্নি রুমে চলে গেল। রুমানা খাতুন বড়ো নিশ্বাস টেনে রাহাকে বলল,
‘কিছু মনে করিস না। তোর জন্য চিন্তা আমাদের হয়। চাপিয়ে দেয়া হবে না তোর উপর কিচ্ছু। নিশ্চিতে থাক।’ এবার তিনি প্রস্থান করলেন। নির্বোধ হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে রাহা। নিজেকে এই মুহূর্তে করুণ ভাবে অসহায় অনুভব করছে। আজ তার পাশে যেন থেকেও কেউ নেই। তার পরিস্থিতি বোঝানোর মতো কাউকে আজ পাশে পাবে না। অযথা ভুল বুঝে সবাই যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মন মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেছে। ক্ষমতা নেই কাউকে বোঝানোর। ধৈর্য শক্তি যেন হারাতে বসেছে। এতটাই শক্ত হয়েগেছে মন অশ্রু বিহীন ছটফট করছে আঁখিযুগল।
__
রাতে বেরিয়ে যাবার পর বারোটার দিকে বাড়িতে ফিরে মেশকাত। ফারিন ঘুমে কাতর ছিল। তার জন্য যে অপেক্ষা করবে না এটা নিরাশাজনক নয়। সোফায় কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। মাথায় ফারিনের টেনশন। যার ফলে শুয়ে পড়লেও ঘুম আর ধরা দেয় নি। সকালে ফারিন তাকে ডেকে তুলেছে। নাস্তা করে সেই যে দোকানে গিয়েছে আর ফিরেনি বাড়িতে। ফারিন কোর্টে যাবার জন্য কল দিলেও ফোন ধরে নি সে। নতুন বধু বিয়ের তৃতীয় দিন বাড়ির বাহিরে যাবে একাকী, এটা স্বাভাবিক বিষয় না। মেশকাত এজন্য সারাদুপুর এড়িয়ে চলে তাকে। মেশকাত লাঞ্চের জন্য রেস্তোরাঁয় আসে। সেখানে রায়ানকেও আসতে বলে।
রায়ান একা আসে নি। জনিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। খারাব ছেড়ে মেশকাত টেনশনের চাপে উদ্বিগ্নতার স্বরে বলল,
‘রায়ান ফারিন তোর শাসানোতে দমে নি বিন্দুমাত্র। উল্টো আমায় রাহার ব্যাপারে বলে বলে ইমোশনাল করে দিয়েছে।’
জনি মুখ খুলে জানতে চাইলো,
‘যেমন?’
মেশকাত জনির পানে এক পলক ফেলে দৃষ্টি নত রাখলো। হেলান দিয়ে বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
‘রাহার জীবন অলরেডি ধ্বংস। এতদিন পর আমি রিয়েলাইজ করলাম।’
‘সেম্পাতি?’ রায়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল।
‘নাহ! একটা মেয়ে আশাবাদী তার বিয়ে নিয়ে। এর পূর্বেই তুই রাহার জীবনে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনকে ধ্বংস হিসেবে লেপ্টে দিয়েছিস। আই নো, তোর প্রতিশোধ ছিল। যার মাশুল রাহা হয়তো এখনো দিচ্ছে, এখন আমি দিতে বসেছি ফারিনের কারণে। আমি কোনো ভাবেই চাই না ফারিনকে ডিভোর্স দিতে। এতে ও আমায় স্ত্রীর অধিকার দিক বা না দিক।’
‘এটা কি জাস্ট তোর বংশের নাম খারাপ হবার কারণে?’ জনি প্রশ্ন ছুঁড়ে।
মেশকাত ফের এক পলক তাকালো। বলল,
‘ডোন্ট নো। বাট আমি চাই না ডিভোর্স হোক।’
রায়ান সব শুনে তীর্যক নজরে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ধ্বংসের ক্ষতিপূরন দিতে প্রস্তত আমি।’
দুই বন্ধুর চাহনি এখন কেবল উৎসুক। প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু রায়ান। উত্তর তার নিকট, জানতে চাওয়া তাঁদের মন।
_
রাহা সারাদিন খুব ভাবে। ভীষণ ভাবে আরানকে নিয়ে। এখন রাত নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট। দুপুরে কোনোমতে গলা দিয়ে খাবার নামিয়েছিল। সন্ধ্যার নাস্তাও খাওয়া হয়নি। তন্নি তেমন কথা বলেছি রাহার সাথে। অভিমান নিয়েই সে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে রাহার থেকে। যার ক্যারিয়ার উজ্জ্বলের কথা ভেবে এতকিছু করতে প্রস্তুত ছিল, অথচ তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা ভালো ভেবে তন্নি এ বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়েই কথা বলার আগ্রহ দেখায় নি। রাহার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। তন্নি নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। খালামনি স্বাভাবিক থাকলেও, তার মুখশ্রী গম্ভীর তা ঢের বুঝতে পারে রাহা। বেলকনি থেকে রাহা খালুকে আসতে দেখে। সে হয়তো দুপুরের বিষয়টি খালামনির নিকট থেকে এখন শুনবে। হয়তো রুমে এসে তাকে বাবার ন্যায় সুন্দর ভাবে বোঝাবে। ভেবেই বড় শ্বাস নিলো। হাতের ফোনটি আনলক করে কল লিস্ট থেকে আরানের নাম্বার বের করে কল দিলো। প্রথম বার রিংটোন বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয় বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। তবে সে চুপ। আরানের নিরবতা টের পেয়ে রাহা সেকেন্ড কয়েক চুপ রইলো। এরপর নিরবতা নিজেই ভেঙে আদেশ স্বরে বলল,
‘আমার সাথে কাল ঢাকা যাবি?’
অপরপ্রান্ত থেকে আরান শুধু গুরুগম্ভীর গলায় শুধালো,
‘হোয়াই?’
রাহা ফের নিশ্বাস টেনে চটজলদি করে বলল,
‘তোকে বিয়ে করতে হলে আমায় আরেকজন পুরুষকে ডিভোর্স দিতে হবে, সেজন্য।’
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।