তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-১৩+১৪

0
2

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৩.
আড়ম্বরপূর্ণ শহর। শীতল আবহাওয়ায় আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলোয় আলোকিত ভুবন। দূর থেকে ক্ষীণ গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে এলোও ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতায় ডুবে যাচ্ছে রাতের শহর। শীতের প্রভাব বেড়েছে আগের ন্যায় আরো কিছুটা। তাঁরা ভরপুর আকাশ। রাহার তন্নিষ্ঠ আকাশ দেখতে। হন্তদন্ত হয়ে আরান ছাদে ছুটে এলো। ডানে-বামে তাকিয়ে ছাদে এক কোণায় কার্নিশ ঘেষে শাল মুড়িয়ে দাঁড়ান ছিল রাহা। আরান ছুটে এলো পাশে। কারো পায়ের শব্দে রাহার চৈতন্য ফিরলো, তবে ঘুরে তাকাল না। আরান পাশে এসে দাঁড়তেই রাহা নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘এত রাতে না আসলে হতো না?’
যত স্বাভাবিক ভাবে কথাটা আরানের কাছে উপস্থাপনা করেছে, এতটাও স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি আরান। কলে রাহার ওসব কথা শুনে ‘আসছি’ বলেই কল রেখে দেয়। সব কিছু সামনা সামনি শুনবে বলেই এত দূর ছুটে আসা। এখন সে এতটা স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টি নিলেও আরান খুব সিরিয়াস! মন মস্তিষ্ক অস্থিরচিত্ত তার।
খুব উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘জানতে চাই।’
রাহা আগের ন্যায় আকাশের পানে নজর রেখে শান্ত ভাবে বলল,
‘শুধু জানতেই এসেছিস?’
‘তোমাকে আমার করতে হলে যা যা বলবে, আমি তাই করতে প্রস্তুত।’ জোর গলায় শুধালো আরান। রাহা এক পলক তাকাল আরানের দিকে। চোখমুখ কেমন শুঁকনো লাগছে তার। সকালের তুলনায় এখন কিছুটা অসুস্থ দেখাচ্ছে আরানকে। হয়তো ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনি। নজর সরালো না। পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল আরানের দিকে। আরানের চাহনি তখনো উৎসুক। কৌতূহল নিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ রেখেছে রাহার পানে। রাহা গায়ের শাল আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে কোমল গলায় শুধালো,
‘অ্যাক্সিডেন্টলি জোরপূর্বক আমার বিয়ে হয়েছিল পাঁচ বছর আগে…’
আরান মাঝপথে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘অ্যাক্সিডেন্টলি নাকি জোরপূর্বক?’
‘জোরপূর্বক।’
‘পারিবারিক?’
‘নাহ! এখন পর্যন্ত আমার আপন আমি সহ দু’জন বাদে আর কেউ জানে না।’
‘সম্পূর্ণ বলো।’ আগ্রহ বশত প্রশ্ন ছুঁড়ে আরান।
রাহা কার্নিশের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। এ বিয়ের মাঝে নিজেরও অপরাধ বোধ কাজ করে। যদি সে ফাজলামো করে সেখানে না যেতো, হয়তো বিয়ে হতো না। পাঁচ বছর আগের ঘটনা সম্পূর্ণ খুলে বলল আরানকে। প্রায় বিশ মিনিটে থেমে ধীরে ধীরে বিয়ের ঘটনাগুলো সব উল্লেখ করল। রাহা থামলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো। আরান স্তব্ধ। দৃষ্টি এখন তার নিচু। একটা মানুষের জীবনে এত বড়ো অজানা রহস্য লুকায়িত থাকতে পারে, ভাবতে পারছে না সে! সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকার পর রাহা অপরাধ বোধ নিয়ে বলল,
‘ভুল আমরাই ছিল।’
‘ছিল না।’ উঁচু গলায় বলল আরান। রাহা সরু নিশ্বাস ফেলে। আরান ফের ক্রোধ ঝাড়ল,
‘ভুল ছিল তার। তোমার জীবন সে নষ্ট করেছে। নাম বলো?’
রাহা ঘুরে তাকিয়ে কপট কণ্ঠে বলল,
‘আমি কোনো ঝামেলা চাচ্ছি না আরান।’
রেগে যায় আরান। তেতে উঠলো। বলে,
‘আমি জাস্ট নাম জানতে চাই।’
রাহা নরম চোখে তাকালো। করুণ স্বরে বলল,
‘আমার পাশে শত্রু হয়ে নয়, বন্ধু হয়ে থাকতে হবে। ঢাকা যাব। ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবো।’
‘যাব। তাঁকে সম্মুখে একবার দেখবোও।’ দাঁতে দাঁত পিষে বলল।
‘কথা দিতে হবে আমায়। কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়াতে পারবি না?’
আরান দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। নির্বোধ চোখে তাকাল। যার জন্য জীবন নষ্ট হয়েছে। তাকে কিছু না বলে বিনাকারণে কীভাবে ছেড়ে দিবে? আরান শান্ত হয়। বলে,
‘কথা দিলাম। কিন্তু ফারিন আপু কোথায়?’
ফারিনের কথা শুনে বক্ষে হালকা মোচড় দিয়ে উঠে তার। কারণ ব্যতীত ওর সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে সে। এতে ফারিন পীড়িত হলেও, তার হাতে কিছু ছিল না। নৈঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘যোগাযোগ নেই আমাদের।’
‘সে কি করেছে? তার সাথে কেন যোগাযোগ নেই তোমার?’
‘এলোমেলো ভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। মনমানসিকতা এতটাই ভেঙে পড়েছিল কি করছি, কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ফোন সহ নিজেকেই পরিবর্তন করে ফেললাম এ শহরে এসে।’
আরান চুপ থাকে বেশকিছুক্ষণ। রাহা নীরবতা সরিয়ে বলল,
‘কাল সকাল দশটায় রওয়ানা হবো। বাড়িতে যা। আমি গেলাম।’ বলেই রাহা ছাদ থেকে নেমে এলো। আরান সেকেন্ড কয়েক সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে রাহার পীড়িত পরিস্থিতি অনুভব করে।
__
সোফায় হেলান দিয়ে দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে বসে রয়েছে রায়ান। খুব ভাবনা তার মস্তিষ্কে এখন। সে যা করতে চলেছে কতটুকু সঠিক জানা নেই তার। বাবা-মা কীভাবে নিবে বিষয়টি এতে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। ড্রয়ার খুলে হাতের বেচটি বের করে আনলো। এটা যার তাকেই ফেরৎ দিবে, তবে সাথে আরো অনেক কিছু দিবে সে। হয়তো ভালো কিছু, নয়তো খারাপ!
.
‘সারাদিন কোথায় ছিলেন? আপনাকে বলা হয়েছে আমি কোর্টে যাব। তবুও আপনি ফোর ধরেন নি। বাড়িতে আসেন নি।’ কাঠকাঠ কণ্ঠে কথাগুলো বলল মেশকাতের উদ্দেশ্যে। সে তার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। ফারিন আরো ক্ষেপে গেল। একটু কাছে এগিয়ে এসে পুনরায় আগের স্বরে বলল,
‘আপনাকে কিছু বলছি আমি।’
মেশকাত ঘুরে তাকালো। ফারিনকে আপাদমস্তক মেপে কোমড় ধরে কাছে টেনে আনলো। আকস্মিক বিপর্যস্ত নজর ফেলল ফারিন। মেশকাতের এমন আরচণের আশাবাদী ছিল না সে। কেমন নেশালো চাহনিতে তাকিয়ে আছে । অস্বস্তি লাগছে ফারিনের। দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘কি করছেন আপনি? সরুন।’
মেশকাত আরো কাছে চেপে কোমল গলায় শুধালো,
‘ডিভোর্স যদি দিতে চাও, তবে এক রাত না হয় আমায় উপহার দেও।’
ফারিন রেগে উঠলো আরো। বুকে ধাক্কা দিয়ে ক্ষিপ্ত রাগ নিয়ে বলল,
‘আপনি এতটা অসভ্য, নিচু মনমানসিকতার আগে জানতাম না।’
‘তবে আরো কাছে মিশে জেনে নেও।’ কণ্ঠে তার নেশালো ভাব। অন্য হাত ফারিনের ঘাড় স্পর্শ করে পিঠের দিকে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। রাগের বশে নিজেকে উন্মুক্ত করতে মোচড়ামুচড়ি করছে সে।
‘ছাড়ুন আমায়।’
মেশকাতের কর্ণপাত হলো না তার কথণে। দু হাত এখন ফারিনের কোমড়ে। ফারিনের অতিরিক্ত মোচড়ানোর ফলে দু হাত পেছনে নিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরে। এখন কিছুটা কমেছে। তবুও স্থির নয় তেমন একটা। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর।
‘কথা কানে যাচ্ছে না। ছাড়ুন আমায়।’
মেশকাত নরম স্বরে তার গালের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
‘বলো রাজি আছো আমার প্রস্তাবে?’
‘নাহ!’
‘নাহ!’
‘কি নাহ? ছাড়ুন আমায়।’
ফারিনের শরীর দুলে উঠছে মেশকাতের ঠোঁটের স্পর্শে। তবে সে তা বুঝতে না দিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করতে ব্যস্ত।
‘তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি না হও। তাহলে ডিভোর্সের কথা ভুলে যাও।’
‘একদম না।’ ঝাড়ি দিয়ে গাল সরিয়ে নিয়ে বলল।
মেশকাত চোখ তুলে তাকাল। বলল,
‘মনে রেখো। এখন তুমি আমার কাছে বন্দী। যে কোনো কিছু করতে পারি আমি তোমার সাথে। কজ, তুমি আমায় ওয়াইফ।’
ফারিন দমে এলো যেন কিছুটা। ভেতরে ভেতরে ভয় অনুভব করছে তার। তবুও একাধারে মোচড়াচ্ছে সে। মেশকাতের চাহনিতে তাকে কাছে টানার আক্ষেপটা দেখা মিলছে। মুখ ফুটে বলতে পারছে না, আবার হ্যাঁ বলারও ওয়ে নেই। সে নিরুপায়! মেশকাত ধীরে ধীরে আরো কাছে মিশে যাচ্ছে তার। ফারিন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দ্রুত গতিতে বলল,
‘বলব না, ছাড়ুন।’
মেশকাত মনে মনে খুশি হলো। ফারিনকে ছেড়ে দিয়ে আগের ন্যায় শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে শিষ বাজাতে লাগলো। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে রোমাঞ্চে ভরপুর আহত ছিল সে। ফারিন গড়গড় হেঁটে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। শীতের প্রভাব তার শরীর স্পর্শ করছে না। গরম এসে ঝাপটে ধরেছে তাকে। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে একটু আগের ঘটনা পুনরাবৃত্তিতে ভাবছে। শরীরে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। একটু পর পর লোহার রেলিঙ হাতের মুঠোয় চেপে ধরছে। এই স্পর্শ তার জীবনের প্রথম। নিজেকে ধাতস্থ করছে সম্পূর্ণভাবে। কাটিয়ে উঠতে চায় এই অনুভূতি থেকে।
.
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৪.
‘আজ এসেছেন বলে আজই ডিভোর্স হয়ে যাবে এমনটা নয়। দুই তিনদিন সময় লাগবে।’ মধ্যবয়স্ক এক লোক রাহা ও আরানের উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল। রাহা কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
‘আমি কালকের মধ্যে চাই। টাকা যা লাগে আমি দিতে প্রস্তুত আছি।’
‘দেখো, তোমার বিয়ের কাগজ হাতে নেই। আমায় খুঁজে বের করতে সময় লেগেছে কম্পিউটারে। আর কিছুদিন আগে তোমার হাসবেন্ড কাগজ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে তাকেও নোটিশ পাঠাতে হবে।’
‘আমি কোনোভাবে চাচ্ছি না সে জানুক বা এখানে আসুক। পেপারে সাইন করে তাকে পাঠিয়ে দিবো।’
‘তার ঠিকানা জানো নিশ্চয়?’
রাহা নিরুত্তর। রায়ান মির্জা এই নাম ব্যতীত সে আর কিছুই জানে না তার সম্পর্কে। রাহা তবুও জানতে চাইলো তার কাছে,
‘সে যখন এসেছিল, তখন কি কোনো এড্রেস দিয়েছিল বা নাম্বার?’
‘ক্লাইন্টের কাছে চাওয়া ব্যতীত সেচ্ছায় কেউ কখনো নাম্বার বা বাড়ির এড্রেস দিবে না। আমি চাই নি, সেও দেয় নি।’ সোজাসাপ্টা উত্তর তার।
‘কোনো ইমেইল?’
‘তার ইমেইল এড্রেস আমার কাছে রয়েছে। প্রথমে কাগজ তার ইমেইলের মাধ্যমে পাঠিয়েছি। তারপর হাতে দিয়েছি।’
‘তাহলে সেখানেই সাইন সহ সাবমিট করে দিন। আর সাইনের এক কপি বের করে রাখবেন। উনি যখন আসবেন। তাকে সাইন করে দিতে বলবেন। তারপর আপনি আমার ইমেইলে পাঠিয়ে দিবেন।’
‘তুমি যেভাবে বলছো সবই করলাম। কিন্তু ডিভোর্সের কিছু রুলস আছে। যেখানে হাসবেন্ডেরও মতামতের প্রয়োজন।’
‘কোনো প্রয়োজন নেই। আপনাকে যেভাবে বলেছে। সেভাবেই কাজ করুন। কত পেমেন্ট লাগবে শুধু বলবেন।’ কিছুটা রাশভারি কণ্ঠে বলল আরান।
‘পাঁচ বছরের সংসার এত সহজে শেষ করতে চাইছেন। বিয়ে সম্পর্কে আদৌও তোমার ধারণা আছে?’ আরানের নিকটে প্রশ্ন রাখলো সে।
‘মিথ্যে বিয়ের কোনো ধারণা লাগে না। কীভাবে ডিভোর্স করাতে হবে, এতটুকু ধারণা রাখা উচিত।’ কপট কণ্ঠে বলল আরান। তিনি আরানকে আপাদমস্তক মেপে রাহার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
‘উনি কে হয় আপনার?’
রাহা মুখ খোলার পূর্বে আরান চটপট উত্তর দিলো,
‘হবু হাসবেন্ড আরান শেখ।’
তিনি কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন এবং অবাকও হলেন। ডিভোর্সের বিষয় কথা বলতে হবু হাসবেন্ডকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। দিনকাল এখন কতটা পরিবর্তন হয়েছে। তিনি একটি কাগজে রাহার সাইন নিয়ে পরশুদিন আসতে বলল। তারা দু’জন বের হয়ে এলো ভেতর থেকে।
রাহা মুখ মলিন করে প্রশ্ন করল,
‘প্রয়োজন কি ছিল হবু হাসবেন্ড বলার?’
‘ওনার মুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল। সমস্যা কোথায়? ডিভোর্সের পর তুমি আমার ওয়াইফ হবে। এটা সত্যি নয় কি?’ বলেই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। রাহা বিনাবাক্যে গাড়িতে উঠে বসল। আরান মৃদু হেসে অপরপাশে উঠে পাশাপাশি বসল। বাসের পরিবর্তনে আরাম গাড়ি নিয়ে এসেছে। এখন ঘড়িতে পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। রাহা ড্রাইভারকে বলে নিজের বাড়ির এড্রেস দিলো। সেখানেই আপাতত তাঁদের গন্তব্য।
পাঁচ বছর পর রাহা তার প্রিয় চিরচেনা শহরে পা রেখেছে। কত স্মৃতি, কত অতীত জড়িয়ে রয়েছে এই শহরে। বাল্যকাল তার এখানেই কেটেছে। জানালায় উঁকি দিয়ে প্রাণ ভরে শহরটিকে দেখছে। কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, আবার কিছুটা আগের মতোও রয়েছে। নানানরকম স্মৃতি হাতড়িয়ে নিজের বাসস্থানে এসে থামলো গাড়ি। ইসলামবাগের প্রথম গলিতে বড়ো সবুজ রঙের বিল্ডিং তাঁদের। নামার পরপরই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। অশ্রু চিকচিক করে তার চোখে। লুকায়িত করে ভেতরে এলো। কলিং বেল একবার বাজতেই হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে দিলো রাহিলা খাতুন। মেয়েকে এত বছর পর নিজের নিড়ে ফিরতে দেখ আবেগে বুকে জড়িয়ে নিল। দু গালে হাত রেখে জানতে চাইলো,
‘কেমন আছিস মা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?’
‘আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।’ বলতে বলতে আরানের পানে তাকালেন। তৎক্ষনাৎ আরান থাকে সালাম দিয়ে ‘কেমন আছেন আন্টি’ প্রশ্নটি করলেন। তিনি হাসিমুখে উত্তর নিয়ে মেয়ে সহ তাঁকেও ভেতরে নিয়ে এলেন।
‘আব্বু, ভাইয়া কোথায়?’
‘একটু পরই চলে আসবে। তোর জন্য আজকে তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছে বাড়িতে।’
বলতে বলতে তাঁদেরও আগমন হয়। বাবা, ভাইকে পেয়ে রাহা জড়িয়ে ধরলেন। তার যতো প্রিয় খাবার দু’হাত ভর্তি করে নিয়ে এসেছেন।
আরানের সঙ্গে রুবেল ও মুহিদুল ইসলাম কিছুক্ষণ আলাপের ব্যস্ত হলেন। রুমানা খাতুন আগে থেকেই আরানের বিষয় সব খুলে বলেছে। আরানকে মেয়ে জামাই হিসেবে তাঁদেরও পছন্দ হয়েছে।
সেকেন্ড কয়েক পর ফ্রেশ হবার জন্য তাঁদের রুমে পাঠান হয়।
পাঁচ বছর পর নিজের রুমে এসে আবেগী হয়ে পড়ে। হাজারো স্মৃতি রয়েছে এই রুমে তাঁর। ব্যাগ পাশে রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। নজর বুলিয়ে নেয় চারদিক। সব কিছু আগের মতো রয়েছে। শুধু নেই সে! আজ তাকে পেয়ে রুম যেন পরিপূর্ণতা ফিরে পেল। উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। বাবা-মা, ভাইয়ার সাথে তার অতীত শেয়ার করার সময় এসেছে। আজ এখনই করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন। সে বের হবার পূর্বেই আরান তার বড় ভাই রুবেলের সঙ্গে কথপোকথনে ব্যস্ততা দেখতে পেল। সন্ধ্যার নাস্তা খেয়েদেয়ে একত্রে ড্রইংরুমে বসেছেন তারা।
তখনই রাহা তার অতীত সম্পর্কে বলার প্রসংগে এলো।
___
ইমেইলে নোটিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে রায়ান চমকে উঠে কল দেয় সেই লইয়ার নিকট। এখন কোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। নয়তো সরাসরি এসে কথা বলতো। দু বার রিং হবার পর কল রিসিভ করল। তিনি সুকণ্ঠে সালাম দিলেন। রায়ান উত্তর নিয়ে দ্রুতই জানতে চাইলো,
‘এই ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলতে আপনার ওখানে কে এসেছিল?’
তিনি সরস কণ্ঠে শুধালো,
‘রাহা নিজে এবং তার হবু হাসবেন্ড আরান শেখ।’
আরান হতভম্ব। ভ্রুকুটি করে জানতে চাইলো,
‘কখন এসেছিল?’
‘এইতো পাঁচটার আগে।’
‘কি বলছে তারা?’
‘ডিভোর্সের জন্য এসেছেন।’
‘আপনি কি বলেছেন তাঁদের?’
‘আমি পরশুদিন আসতে বলেছি। এর আগে কাগজ পত্র রেডি করে ফেলবো।’
‘কাগজ রেডি করবেন। তবে সেটা ডিভোর্সের নয়।’ দৃঢ় গলায় বলল রায়ান
‘তবে?’ তিনিও কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন।
__
থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ড্রইংরুমের আনাচে-কানাচেতে নীরবতা বিরাজমান। তার মেয়ের সঙ্গে এত বড়ো ঘটনা ঘটেছে, অথচ তিল পরিমাণও জানতো না কেউ! রুবেলের মুখশ্রী এখন শক্তপোক্ত। বললেন,
‘পরিবারের সদস্য হিসেবে কিচ্ছুটি জানার অধিকার নেই আমাদের?’
‘কি বলতাম ভাইয়া? এখানে ভুলত্রুটি আমারও ছিল।’ নরম স্বরে বলল।
‘চুপ! সঠিক, ভুল সেটা আমরা বুঝতাম। তুই কেন এত বড় বিষয় লুকিয়েছিস?’ মুহিদুল ইসলাম রাগ ঝেড়ে বললেন।
‘তোমরা বুঝতে পারছো? তোমার মেয়ে কী আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে? একবার ভেবে দেখো।’ রুবেলের কণ্ঠে এখনো রাগের আভাস। রাহা মাথা নত করে শুনছে। রাহিলা বানু নৈঃশব্দের মেয়ের পানে তাকিয়ে শাড়ির আচল দ্বারা চোখ মুছছেন। মেয়ের কষ্টে তিনি নির্বোধ হয়ে গেছেন। কি বলবে বুঝতে পারছেন না।
আরান এবার মুখ খুললেন,
‘আঙ্কেল, ভাইয়া আপনারা হয়তো রাহাকে দোষী ভাবছেন। মানলাম তার দোষ রয়েছে। কিন্তু এত বছরের অতীত নিয়ে সার্ভাইব করা তার জন্য সহজ ছিল না। আপাতত তার বিষয়টি আপনারা দেখবেন। কীভাবে তাকে অতীত থেকে বের করা যায় সেবিষয়ে আপনাদের ভাবা উচিত।’
‘সেসব না হয় ভুলে যাব। কিন্তু ঐ ছেলের ঠিকানা আমরা জানি না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কীভাবে করব? তাঁকে চরম শিক্ষা দিতে চাই।’ মুহিদুল ইসলাম আক্ষেপহীন কণ্ঠে বললেন।
‘কেস কাচারিতে যাবেন না। এতে আপনাদের মানসম্মান জড়িত রয়েছে আমি তা বলব না। সবার পূর্বে আপনাদের মেয়ের ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে হবে।’
‘কোর্ট থেকে কি বলেছে?’ রুবেল জানতে চাইলো।
‘পরশু যেতে বলেছে।’
‘আমিও যাব তোমাদের সাথে। ছোট্ট বোনের পাশে ভাই হয়ে আমি আছি সব সময়।’ রাহা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকাল।
মুহিদুল ইসলাম তার মেয়ে মাথা কাঁধে রেখে হাত বুলিয়ে দিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,
‘এত বড়ো বিষয় কীভাবে নিজের কাছে রেখেছিস? একবার জানিয়ে দেখতে পারতি? আমি কি তোকে দূরে সরিয়ে দিতাম?’
তার পরিবারের এত ভালোবাসা পাবে সব জানার পরও আশা করেনি। সে আজ গর্ভিত এত সুন্দর একটি পরিবার পেয়ে। মেয়ে হিসেবে নিজেকে এখন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। সর্বশেষ আরান। ওর জন্য সাহস সঞ্চয় করে তাঁদের সামনে বিষয়টি খোলাসা করতে পেরেছে। আরানের প্রতিও তার অশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে এই মুহূর্তে।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।