#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৫.
‘ব্ল্যাকমেইল করে আপনি আমাকে থামিয়ে রাখতে পারবেন না। আমি আপনাকে ডিভোর্স দেবোই। আজ না হয় কাল, নয়তো পরশু।’ ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধালো ফারিন। মেশকাত সোফায় বসে ল্যাপটপ ঘাটছিল। সারাদিন পর সবে মাত্র বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসেছে। এর মধ্যে ফারিনের ঝাঁঝালো কণ্ঠের স্বর তাকে বিরক্ত করে দিয়েছে খুব। ক্ষুব্ধ দৃষ্টি ফেলে বলল,
‘একটা কথা পরিষ্কার শুনে রাখো। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো না। এক তরফা কখনো ডিভোর্স হয় না।’
‘আপনি কি করবেন। সেটা আপনার ব্যাপার। আমি ডিভোর্স পেপার হাতে পেলে সাইন করব।’
‘ছয়মাস ব্যতীত ডিভোর্স হবে না৷’
‘এই ছয়মাস আমি আপনার সঙ্গে থাকবো না। কালই চলে যাব আমাদের বাড়ি।’
‘সীমা অতিক্রম করো না ফারিন।’ ক্রোধ কণ্ঠে বলল।
‘আপনি তো সীমাবদ্ধ ব্যক্তি, তাই নয় কি?’ তাচ্ছিল্য হেসে বলল।
‘ডিভোর্স ছাড়া তোমার মুখে আর কোনো কথা আদৌও কি রয়েছে? তুমি বলেছিলে না। এই বিষয়ে কথা বলবে না।’
‘নেই। ম রে গেছে। আর সেটা তখনকার জন্য বলেছি।’
‘জাগিয়ে তুলতে পারি আমি। সাহায্য করব?’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে।
ফারিন মেশকাতের কথার ধরনে আলাদা গন্ধ পাচ্ছে। আর সেই গন্ধের সূত্রপাত কি। সে জানে। নিরুত্তর থেকে সেখান থেকে সরে বিছানায় এসে বসল। রাগে শরীর জ্বলছে। মেশকাত ফারিনকে শান্ত হতে দেখে ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো। এখন পুরো রুম জুড়ে নিরবতা বিরাজমান।
তখনই তার ফোনটি বেজে উঠলো। স্ক্রিনের পানে তাকিয়ে রায়ানের নাম দেখে ল্যাপটপ বন্ধ করে বেলকনিতে এলো।
‘হুম বল।’
‘রাহা ঢাকা এসেছে।’
‘হোয়াট? আর ইউ শিওর?’ বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো।
‘ইয়েস।’
‘হোয়াই?’
‘ডিভোর্সের জন্য।’
‘আমি পাগল হয়ে যাব ডিভোর্স শুনতে শুনতে।’
‘রাহা আমাকে ডিভোর্স দেবার জন্য এসেছে।’
‘আর তুই?’
‘ক্ষতিপূরণ দিবো।’
‘কীভাবে?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়।
__
রাহা তার ডায়েরি ঘেটে তার এবং ফারিনের পুরনো একটি ছবি দেখতে পায়। সযত্নে ছবির উপর হাত বুলায়। পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের পাতায় ভাসছে। নজর পড়ে নিচের দিকে। সেই ছবির নিচে ফারিনের ফোন নাম্বার লেখা ছিল। আদৌও এই নাম্বার ফারিন ব্যবহার করে কিনা জানা নেই তার। ফোন হাতে তুলে নাম্বার ডায়াল লিস্টে উঠিয়ে দ্বিধাবোধ ফেলে কল দেয়। রিং হতে আরম্ভ করে। রাহা স্বস্তি পায় নাম্বারটি চলমান দেখে। প্রথম বারের শেষের দিকে কল রিসিভ হলো। রাত তখন এগারোটা ত্রিশ মিনিট। এত রাতে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসার ফলে ফারিনের মনে খটকা নিয়ে কল রিসিভ করল। মেশকাত তখনো বারান্দায় কথপোকথন ব্যস্ত ছিল ফোনালাপে। বিনয়ী স্বরে সালাম দিলো ফারিন। অপরপ্রান্ত থেকে রাহা ফারিনের কণ্ঠে স্বর শুনে খুশি হয়ে মনে মনে উত্তর নেয়। এরপর বলে,
‘আমি রাহা।’
সজোরে উঠে দাঁড়ালো ফারিন। কান থেকে ফোন সরিয়ে হতভম্বের ন্যায় সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে তাকে। কণ্ঠ তার পরিচিত। ফের কানে দিয়ে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
‘এত বছর পর? এটা কি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন?’
রাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘সত্যি। কেমন আছিস?’
‘এই প্রশ্নটা করতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিস রাহা। আমি যদি একই প্রশ্ন তোকে করি। উত্তর দিতে পারবি?’
‘ভালো আছি আমি।’
‘সত্যি ভালো আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
ফারিন নৈঃশব্দে বড়ো নিশ্বাস ফেলল। জানতে চাইলো,
‘আমার কি অপরাধ রাহা?’
‘অপরাধ ভাগ্যের। যার ফলে এখনো আমি মানসিক ভাবে সুস্থ হতে পারিনি।’
‘আর আমি? ভেবেছিস তোকে এবং সব ভুলে সুখে আছি?’
‘এরকম কখনো ভেবে দেখেনি। ভাবলেও বা দোষ কি? আমার জন্য তুই কেন অসুখী থাকবি? বান্ধবী হয়ে এটা মেনে নেয়া কঠিন।’
‘আমার বিয়ে হয়েছে রায়ানের বন্ধু মেশকাতের সাথে।’
রাহা বিস্মিত! কপালে ভাজ দেখা গেল তার। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল,
‘মেশকাত? কীভাবে?’
‘আমি নিজেই তাকে বিয়ে করেছি।’
‘মানে…’
‘কার সাথে কথা বলছো?’ তেজি কণ্ঠে শুধালো মেশকাত। রাহা পুরুষালী কণ্ঠের স্বর শুনে বাকি প্রশ্ন করতে পারেনি। ফারিনও দ্রুত ফোন রেখে দিলো। থতমত খেয়ে গেলেও বিষয়টি সামলে নিলে সেও তেজি কণ্ঠে জানতে চাইলো,
‘আপনি যে একটু আগে কথা বলার জন্য বেলকনিতে গিয়েছিলেন। একবারও জানতে চেয়েছি কে? কার সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘তর্ক করবে না। সোজা উত্তর চাইছি।’
ফারিন বিনাবাক্য কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লো ফোন লক করে। মেশকাত চোয়াল শক্ত করে তার পানে তাকিয়ে রইলো। দিন দিন অবাধ্যের শেষ চুড়ায় পৌঁচ্ছে যাচ্ছে।
.
রাহা পুনরায় কল দেবার দুঃসাহস দেখাল না। এতে ফারিনের সমস্যা হতে পারে। তবে মাথায় এখন তার কথাটি ভনভন ঘোরপ্যাঁচ খাচ্ছে। ফারিন কেন রায়ানের বন্ধু মেশকাতকে বিয়ে করেছে? কি উদ্দেশ্য তার? তার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেয় নি তো মেয়েটা? সে অস্থির হয়ে পড়ে।
পুরো রাত অস্থিরতায় নির্ঘুম কাটে তার। শেষ রাতের দিকে ঘুমানোর পর সকালে আটটার এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসে। অলরেডি সব নাস্তা তৈরী করা হয়েগেছে তার মায়ের। সোফায় বসে পেপারে নজর বুলাচ্ছিলেন মুহিদুল ইসলাম। ভাইয়ার দেখা মিলল না ড্রইংরুমে। আরানকেও দেখা গেল না। বাবার পাশে এসে বসলেন। পেপার সরিয়ে তিনি বললেন,
‘রুবেল আরানকে নিয়ে বাহিরে হাঁটতে বেরিয়েছে। এই ফিরলো বলে।’
আরানের কথা জানতে চাবার পূর্বেই বাবার আগ বাড়িয়ে বলাতে উনি ভেবেছেন আরানকে খুঁজছে রাহা। নিরুত্তর থেকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘বাবা এখন তোমারও রোজ হাঁটা উচিত।’
‘হ্যাঁ, রুবেলও বলেছে বিষয়টা। ভাবছি শীঘ্রই হাঁটা শুরু করব।’
‘আম্মুকেও সঙ্গে নিও।’
‘সে গেলে আমার অসুবিধা নেই।’
ততক্ষণে রাহিলা বানু এসে পাশে বসলেন। বললেন,
‘আমি যাব। তোর আব্বু নিবে কিনা আগে সেটা জিজ্ঞেস কর।’
‘জিজ্ঞেস করতে হবে না। তোমরা দু’জন একত্রে যাবে।’
‘আচ্ছা। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘বলার কি প্রয়োজন আব্বু। বলো?’
‘তুই কি আরানকে বিয়ে করতে রাজি আছিস?’
বাবার প্রশ্ন শুনে তার মুখশ্রীর পানে চেয়ে রইলো। তাঁদের দু’জনের চাহনি এখন উৎসুক রাহার পানে। রাহা কোমল গলায় বলল,
‘আমার জীবন নিয়ে আমি বিরক্ত। এ জীবনে ভালো কিছু হবার আশা রাখি না। তোমরা আমার জন্য যেই সিদ্ধান্ত নিবে। আমি সহমত পোষণ করব।’
‘জীবন নিয়ে হতাশায় অনেকেই ভোগে। তুই যদি নিজ থেকে চেষ্টা না করিস সুন্দর করে বাঁচার। কারো সাধ্য নেই তোর জীবন সুন্দর করে সম্পূর্ণ ভাবে গড়ে দিবে। নিজের ইচ্ছেশক্তি সামান্য হলেও বাড়াতে হবে। আশাহত হওয়া যাবে না কোনো কিছু নিয়ে।’ বাবার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। বলল,
‘ইনশাআল্লাহ! আমি চেষ্টা করব।’
‘তোর সাথে ফারিনের যোগাযোগ আছে?’ মায়ের প্রশ্নে তার পানে তাকাল। বলল,
‘ছিল না যোগাযোগ পাঁচ বছর পর্যন্ত। কাল রাতে কল দিয়েছিলাম। ওর বিয়ে হয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা ওর বিয়ে হয়েছে রায়ান মির্জার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেশকাতের সঙ্গে।’
আশ্চর্য হলেন দু’জন। মুহিদুল বলল,
‘বলিস কি? এটা কি ফারিনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে?’
‘না। ফারিনের ইচ্ছায় হয়েছে।’
আগমন ঘটে তখন রুবেল ও আরানের। ফারিনের প্রসংগ শুনে তারাও আগ্রহ নিয়ে বসল জানতে। সম্পূর্ণ কথা শুনে আরান বলল,
‘নিশ্চয় ফারিন আপু তোমার জন্যই বিয়েটা করেছে অনুমান করা যায়। বাকিটা তুমি নিজ থেকে তার কাছে জেনে নিও।’
রাহা নিরুত্তর থেকে ‘হুম’ বলল। রুবেল প্রসংগ পাল্টে বলল,
‘আমার সঙ্গে একটু পর মার্কেটে যাবি তুই। অনেকদিন হয়েছে মনমতো তোকে কিছু কিনে দেই না।’
ভাইয়ের কথা শুনে রাহা মৃদু হাসলো। বলল,
‘কোনো আপত্তি নেই।’
.
মেশকাত ফারিনের অনুপস্থিতে ফোন আনলক করার চেষ্টা করে। তবে ব্যর্থ হয়। সে জানেনা ফারিনের ফোনের পাসওয়ার্ড। ফারিনকে রুমে আসতে দেখে মেশকাত ফোন রেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। যাতে ফোনের বিষয় ও ডিভোর্সের ব্যাপারে কোনো কথা না তুলতে পারে। ফারিন চেষ্টা করেও পারে না কথা বলতে। মেশকাত তাকে এক প্রকার ইগনোর করে চলে গেছে। আজকে তাঁদের বাড়িতে যাবে এটাও বলা হলো না।
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৬.
শীতের প্রভাব আরো বাড়তে বাড়তে খুশির আমেজও যেন বেড়েছে রাহাদের বাড়িতে। সকলে শপিং শেষে বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার আগে আগে। দুপুরের আহার বাহিরে করেছে তারা। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো ফোনে ক্যাপচার করে তন্নিকে পাঠায় রাহা। এখনো তন্নি রাহার উপর অভিমান পুষে রেখেছিল। তবে আজকের ছবিগুলো দেখে নিজ থেকেই ভিডিও কলের মাধ্যমে সবার সঙ্গে কথা বলে হাসিমুখে। অবশেষে রাহা তার জীবন নতুন ভাবে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। এটা ভেবে তন্নি অভিমান মুছে ফেলে মন থেকে। খুব টায়ার্ড হয়ে রাহা রুমে প্রবেশ করেই মুখ মলিন করে ফেলে। কালকের জন্য অধিক পরিমাণ টেনশন হচ্ছে তার। আদৌও সব ঠিকঠাক মতো ডিভোর্স হবে? সত্যি কি পারবে অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে? এই হাসিখুশি পরিবার কি এভাবেই থাকবে? নাকি পুনরায় কোনো ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে?
বেশ চিন্তিত সে! রায়ানের জন্য তার মনে কেবল ঘৃণা রয়েছে। আরানের জন্য তার ফিলিংস আছে বা তৈরী হচ্ছে এমনটা নয়। তবে সে বাবার কথা অনুযায়ী চেষ্টা করবে জীবন সুন্দর ভাবে আরানের সাথে গড়ে তোলার। একবার না হয় চেষ্টা করেই দেখি। কথাগুলো মনে মনে ভেবে ছোট্ট নিশ্বাস নিলো। ফোন হাতে নিতেই ফারিনের কল এলো। তবে এখন কথা বলার সময় নেই। বললেও রাতে। তখন যদি কথা না বলতে পারে এই ভেবে কল রিসিভ করল। হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইন বিচ্ছিন্ন করল ফারিন। বিস্ময় নিয়ে স্ক্রিনের পানে তাকিয়ে কল ব্যাক করল না।
রাত আরো জমজমাট ভাবে অতিবাহিত হয় তাঁদের। ভোর হয়েছে সেই কখন। বালিশে মাথা রেখে চোখ খোলা রেখে শূন্যে তাকিয়ে আছে। কেন জানি আজ মনটা কু-ডাকছে। বিছানা ত্যাগ করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও মায়ের ডাকে উঠতে হয়। একত্রে নাস্তা করে তিনজন বের হয় কোর্টের উদ্দেশ্যে। আরানের গাড়িতে করেই তারা কোর্টে এসেছে। এখানে পৌঁছেই একে একে গাড়ি থেকে নামল তারা। রুবেল ঘড়ির পানে চেয়ে দেখে দশটা একত্রিশ। ভেতরে এসে সেই পরিচিত লইয়ারের কেবিনে প্রবেশ করেই রাহার হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে রায়ানকে ও তার দু’জন বন্ধুকে দেখে। বক্ষে মোচড় দিয়ে উঠে। খপ করে রুবেলেন হাত চেপে ধরল রাহা। রুবেল রাহার হাত সহ মুখশ্রীর পাশে তাকাল। বোনকে এত ভীতিকর চোখেমুখে দেখে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না সামনে কারা রয়েছে! আরানও রাহার আদল দেখে বুঝতে পারে সর্বত্র। রুবেল রাহার হাত ছাড়িয়ে নিজ থেকেই রাহার হাত শক্ত ভাবে ধরে এগোয় সামনের দিকে। রায়ান রাহাকে দেখে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তীর্যক নজরে তাকাল। পাঁচ বছর পর রাহাকে সচক্ষে আজ সামনাসামনি দেখছে। মেয়েটা আগের চেয়ে শুখিয়ে গেছে অনেকটা। তবে তার মুখশ্রী এখনো মায়াবী ও সৌন্দর্যের কোন কমতি নেই বললেই চলে। আপাতত রাহার মুখশ্রী ভীতিগ্রস্ত দেখে ম্লান হাসে সে। এখনো মেয়েটা তাঁকে আগের ন্যায় ভয় পায়।
এক প্রান্তে তারা তিনজন বসেছে। অন্যপ্রান্তের তিনটি চেয়ার ফাঁকা রয়েছে। সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি তাঁদের দেখে আসন গ্রহণ করতে বললেন। ঠান্ডা মস্তিষ্কে তারা বসল। রাহা ছিল মাঝখানে। তার দৃষ্টি নত।
লোকটি তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ছেলেপক্ষ এবং মেয়েপক্ষ উভয়ের লোক এখানে রয়েছেন। এখন আপনারা সিদ্ধান্ত নিন ডিভোর্স হবে কি-না।’
রুবেল এক নিশ্বাসে কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘এই মুহূর্তে ডিভোর্স হবে। কোর্টের বিয়ে আমি মানি না।’
লোকটি বিনয়ী স্বরে বলল,
‘পাঁচ বছর ধরে বিবাহিত তারা দু’জন। আপনি না মানলে কিছুই করার নেই আমাদের।’
‘সংসার ব্যতীত কোনো বিয়েই টিকে থাকে না। যেখানে সংসারই হয়নি, সেটা কিসের বিয়ে?’ প্রশ্ন রাখল ফের রুবেল।
‘আপনি কি রাহার ভাই?’
লইয়ারের প্রশ্নে সম্মতি দিলো রুবেল। বলল,
‘কাগজপত্র রেডি করেছেন?’
‘আপনারা ডিভোর্স দিতে চাইলেও, ছেলেপক্ষরা রাজি নয় এই বিষয়ে। এক তরফা কখনো ডিভোর্স হয় না।’
‘ওরা কি করবে তা ভেবে আমাদের লাভ নেই। কাগজপত্র দেন, আমার বোন সাইন করে দিবে।’
‘আপনি…’
‘ব্যস!’ রায়ান বিরক্ত নিয়ে বলে উঠলো। সবার নজর এখন তার উপর নিবদ্ধ। চোখ থেকে ফের সানগ্লাস সরিয়ে রুবেলের পানে তীক্ষ দৃষ্টি ফেলে বলল,
‘বউটা আমার। অধিকারও আমার এ বিষয়ে কথা বলার। আপনি সুমুন্দি, জাস্ট স্টপ ইউর মাউথ।’
‘আপনার মুখ বন্ধ রাখুন। এত বছর পর নিজের বউ বলে সম্বোধন করতে লজ্জা করছে না আপনার?’ আরান তেজি কণ্ঠে বলল।
‘হেই পিচ্চি! স্টপ। বড়’রা কথা বলছে। মাঝপথে ছোটদের কথা বলতে নেই।’ রায়ান অপমানসূচক ভাবে কথাগুলো আরানকে শুনাল।
‘সেটআপ।’ বলেই উত্তেজিত হয়ে দাঁড়ায় আরান। সঙ্গে সঙ্গে রায়ানও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ইউ জাস্ট সেটআপ। আমি এখানে রাহাকে ডিভোর্স দিতে আসিনি। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছি।’ কথাটা রুবেলেন পানে চেয়ে বলল রায়ান। রুবেল তেলেবেগুনে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘কার বাড়ি? কিসের বিয়ে? পাঁচ বছর পর এখন মনে পড়েছে আমার বোনের কথা, বিয়ের কথা? আমি আমার বোনকে তোর সাথে কেন, বিয়েটাই রাখব না। বিচ্ছিন্ন করব।’
‘আমাকে জোর করতে বাধ্য করবেন না ভাইয়া।’ গম্ভীর গলায় নজর সরিয়ে বলল রায়ান। রাহা এবার মুখ খুলল। দৃঢ়ভাবে শুধালো,
‘জোর? একবার জোর করে আমার জীবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আবার? আপনাকে আমি চাই না। এই মুহূর্তে আপনার থেকে যেটা চাই আমি, ডিভোর্স!’
‘তুমি আমাকে চাও বা না চাও। আমি তোমাকে চাই, এটি হাউ, এনি ওয়ে।’ চোয়াল শক্ত করে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল সে।
রাহা নজর সরিয়ে লইয়ারের পানে চেয়ে বলল,
‘আপনি কাগজপত্র রেডি করেছেন?’
আচমকা প্রশ্নে তিনি থতমত খেয়ে আমতা আমতা ভাব নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, মানে। রেডি হয়নি এটা রেডি হয়েছে।’ বলেই কাগজ এগিয়ে দিতে নিলে রায়ান সেটা খপ করে কেঁড়ে নিয়ে কলম তুলে রাহার সাইনের উপরের দিকে সাইন করল। তারপর রাহার পানে এগিয়ে দিয়ে বলল।
‘নাউ, দ্বিতীয় বার আমাদের বিয়ে ডান।’
খচ করে উঠলো তার হৃদয়ে। রাহা ভ্রু কুঁচকে কাগজটি হাতে নিয়ে পড়ে দেখলো সেখানে একইভাবে বিয়ের কাগজ তৈরী করা হয়েছে। রাহা উঠে দাঁড়াল। বিক্ষিপ্ত রাগ হলো তার। বলল,
‘সেদিনের বিয়ে, আজকের বিয়ে আমি কোনোটাই মানি না। প্রতিশোধের বিয়ে, কোনো বিয়েই নয়।’
‘সেটা প্রতিশোধের বিয়ে হতে পারে আজকেরটা নয়।’
রুবেল তেড়েফুঁড়ে রায়ানের শার্টের কলার চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘তুই আমার বোনের জীবন নষ্ট করেছিস। দ্বিতীয় বার নষ্ট করতে দিবো না।’
‘হ্যাঁ, নষ্ট করেছি। এখন প্রতিদান দিতে চাইছি আমার অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে।’
‘প্রয়োজন নেই তোর প্রতিদান।’ খেঁকিয়ে বলল সে।
ততক্ষণে মেশকাত ও জনি রুবেলের কাছ থেকে রায়ানকে ছাড়িয়ে নিলো। জনি রায়ান ও মেশকাতকে পেছনে ঠেলে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধায়,
‘ভাইয়া। একটা কথা বলি ছোট হয়ে। আমরা ভুল করেছি পাঁচ বছর আগে। সেই ভুল যেন এখন না হয়। রাহার জীবন সুন্দর ভাবে গড়ে উঠে। এটাই আমাদের কাম্য। এতে করে আমাদের করা পাপ মোচন হবে। রায়ান সত্যি রাহাকে সামাজিক ভাবে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায়। এই চাওয়া কি আমাদের ভুল? আপনি ভেবে দেখুন, মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে।’
মেশকাত এবার জোর গলায় দৃষ্টি নত রেখে বলল,
‘আপনি যদি বড় ভাই হয়ে বুঝতে না পারেন ব্যাপারটা, রাহা কীভাবে বুঝবে? আমারদের সত্যি ভুল হয়েছে। ক্ষমা চাচ্ছি মন থেকে আপনাদের কাছে।’
রায়ান রাগী প্রশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। মেশকাত ও জনির বাড়াবাড়ি কথা তার মনে ধরেনি। আরান কাঠিন্য স্বরে আঙুল রায়ানের পানে তাক করে বলল,
‘ভুল যদি আপনাদের শুধরাতে হয়, তাহলে তাকে ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত করে দিতে বলুন।’
রায়ান চোখ পাকিয়ে রায়ানের পানে তাকাল। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে আরানকে ঘুষি দিয়ে নাক ফাঁটিয়ে ফেলতে। তবে এই পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া উপায়ন্তর নেই।
জনি আরানের উদ্দেশ্য করে নরম স্বরে বলল,
‘ঐভাবে কেন? এভাবেও তো দেওয়া যায় ছোট ভাই। বড়ো ভাইয়া আমরা কথা দিচ্ছি। রাহা রায়ানকে সধরে গ্রহন না করুক। ওদের ছয়মাস সময় দিন এক সঙ্গে সংসার করার। যদি বনিবনা না হয় নিজেদের মধ্যে তখন না হয় ডিভোর্স হবে। আমরা এতে আপত্তি করব না।’
লইয়ার লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমি এই কথাটিই বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। একটা বিয়ে এক মাসেই ভেঙে যায় না। ছয়মাস সময় লাগে। দাম্পত্য জীবনে বনিবনা না হলে তবেই দু’জনের সিদ্ধান্তে ডিভোর্স হয়। যেহেতু এখন অব্দি তারা একত্রে সংসার করেনি। তাঁদের একটা সুযোগ দেয়া উচিত।’
রুবেল বিষয়টি অন্তর নিয়ে ভাবলো। রাহার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাহিরে। আরানের মুখ শুখিয়ে এলো এই কথাগুলো শুনে। হৃদয় তার ভাঙতে বসেছে নদীর তীর ভাঙার ন্যায়। মেশকাত রায়ানকে শান্ত হয়ে চেয়ারে বসাল। আরান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দু ভাই-বোনকে কথা বলতে দেখতে পেল। অসহায় দৃষ্টি তার। একজন ব্যর্থ প্রেমিকের চাহনি কেবল এমনই পীড়াদায়ক।
‘তুই কি চাইছিস রাহা? আমি চাই না তোর সঙ্গে এক মুহূর্ত রায়ান সংসার করুক বা থাকুক।’
‘এ ছাড়া ডিভোর্স হবে কি-না জানি না। রায়ান মির্জা আমার এত দ্রুত ছেড়ে দিবে না ভাইয়া…। সে অবাধ্য, নির্দয় লোক। আমার জন্য তোমাদের ক্ষতি করতে দ্বিতীয় বার ভাববে না। তাঁদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠবো না।’ লাস্টের কথাগুলো রাহা মনে মনে শুধালো।
‘সেটা আমি বুঝবো। তুই কি চাইছিস?’
রাহা এই মুহূর্তে নিজেকে রায়ানের হাতে সঁপে দেয়া ছাড়া কোনো উপায়ন্তর দেখতে পেল না। নিরাশাজনক চাহনিতে তাকাল ভাইয়ার পানে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘ছয়মাস একত্রে সংসার করতে চাই। চুক্তি অনুযায়ী যদি আমাদের বনিবনা না হয়। তখন ডিভোর্স হবে।’
‘তুই ভেবে বলছিস? ওর সাথে তোকে, ভাবতেই পারছি না।’ তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন।
‘ভেবেই বলছি ভাইয়া।’
‘আরান? ওর কি হবে?’ প্রশ্নবিদ্ধ নিয়ে তাকাল।
রাহা দরজার পানে তাকিয়ে আরানকে দেখতে পেল। তার করুণ চাহনি এখনো স্থির ছিল তাঁদের উপর। রাহা সহায়হীন নজরে তাকিয়ে জোরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলে,
‘ওর ভাগ্যে হয়তো আমি নেই ভাইয়া।’
‘ছেলেটার মন ভেঙে যাবে।’ সেও আরানের পানে চেয়ে বলল।
‘নো ওয়ে।’
রুবেল দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ভেতরে হাঁটা ধরলো। তার ইচ্ছেশক্তি নেই ভেতরে যাবার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে এগোয়। ঠিক আরানের মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রেখে সরিয়ে নিয়ে ভেতরে এলো। রুবেল লইয়ারের উদ্দেশ্য করে কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘মেনে নিলাম। তবে আমার বোনকে মানসিক বা শারীরিক কোনো প্রকার টর্চার যদি করা হয় ছয় মাসের পূর্বেই ডিভোর্স দিয়ে নিয়ে আসবো।’
‘ওকে। মেনে নিলাম।’ রায়ান গুরুগম্ভীর গলায় শুধালো।
আরানের হৃদয় এবার ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড। তার প্রিয়তমা হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। কেউ কি শুনতে পাচ্ছে তার হৃদয়ের আর্তনাদ?
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি