#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৭.
‘বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পারবেও না। এটাই রীতিনীতি, ইসলামিক নিয়ম।’
‘আমাকে নিয়মনীতির অজুহাত দিবে না রাহিলা। তুমি জানো না তোমার মেয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করছে এখন।’ ধমকের স্বরে বললেন মুহিদুল ইসলাম। বাড়ি ফিরার পর মুহিদুল ইসলাম তার ছেলে-মেয়ের উত্তর ক্ষিপ্ত হয়েছেন কোর্টের সম্পূর্ণ কথোপকথন শুনে। তিনি কোনোক্রমে চাইছেন না মেয়েকে রায়ানের হাতে তুলে দিতে।
‘রুবেল তুই কীভাবে রাহার সিদ্ধান্তকে সম্মতি দিলি বুঝতে পারছি না।’
‘আব্বু, লইয়ার যখন বলেছে ছয়মাস সংসার করার পর তবেই ডিভোর্স হয়। তখন আমি নিষেধাজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু… ‘
‘কিন্তু? একজন ডিভোর্স দিলেই ডিভোর্স হয়ে যায়। লইয়ার রায়ানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তোদের অন্যায় নিতি শুনিয়েছে।’
রাহা চোখ তুলে তাকাল। নরম স্বরে বলল,
‘আব্বু, জীবন অর্ধ ধ্বংসের মুখে আগেই থেকে ছিল আমার। এখন নতুন করে আমি কোনো ধ্বংসযোগ্য চাচ্ছি না। তোমাদের কোনো ক্ষতি হোক এ-ও আমি চাইবো না। আর রইলো আমার জীবন। তুমি আমায় বলেছিলে, সুন্দর জীবন গড়ে তোলার জন্য সামান্যতম চেষ্টার প্রয়োজন। আমি সেই চেষ্টা না হয় ধ্বংসযোগ্যের মুখোমুখি থেকেই করি।’
‘নুন্যতম আত্মসম্মানবোধ তোদের আছে?’ তিনি আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
রাহিলা বানু এবার তেতে উঠলেন। বললেন,
‘আত্মসম্মানের কথা ভেবে মেয়ের জীবনের কথা ভুলে যেও না। তোমার মেয়ে বিবাহিত এটা কী তুমি মুছতে পারবে কখণো? যেখানেই বিয়ে হোক, যার সাথে হোক দ্বিতীয় বিয়ের ছাপ রীতিমতো স্পষ্ট! ওদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং সঠিক। তুমি মেনে নেও বা না নেও। রাহা যদি সংসার জীবনে অসুখী থাকে। মানসিক চাপ দৃষ্টি করে তবেই তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিও নতুন রূপে। আপাতত খ্যান্ত দেও।’
কথন শেষ করেই তিনি নির্বোধ হয়ে সোফায় বসলেন। মুহিদুল ইসলাম আক্ষেপ নিয়ে প্রস্থান করলেন স্ত্রীর কথাগুলো শুনে। রুবেল রাহার পানে চেয়ে বাবার ন্যায় প্রস্থান করল। রাহা মায়ের পাশে বসলেন। তিনি ছলছল চোখে মেয়ের পানে তাকিয়ে বলল,
‘তোর কপালে এমন কিছু লিখা থাকবে, কখণো ভাবিনি মা। আমার দোয়া সন্তানের জন্য এভাবে বিফলে গেল?’ বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। রাহা মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
‘সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো মায়ের দোয়া কখনো বিফলে যায় না আম্মু। তুমি মন থেকে পুনরায় দোয়া করো।’
মায়ের কান্না আরো বাড়ে চোখ মুছে ফেলে রাহার গালে হাত বুলিয়ে নিলো। তখনই তার ফোন ভাইবেশন করে উঠলো। স্ক্রীনে ফারিনের নাম্বার দেখে নজর সরিয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
‘বাবার কাছে যাও। তাঁকে শান্ত কেবল তুমিই করতে পারবে আম্মু।’
মেয়ের কথা শুনে সেকেন্ড কয়েক বসে থেকে রুমে গেল। ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। রাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরান তাঁদের পৌঁছে দিয়েই বাহিরে গিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে ভেতরে আসেনি। ছেলেটার যে মন ফের ভেঙেছে এটা সে বুঝতে পেরে সরু প্রশ্বাস নিলো। ফোন ফের ভাইবেশন হচ্ছে দেখে কল কেটে ছোট টেক্সটে জানিয়ে দেয় পরে কল দিবে তাকে। এরপর রুমে এসে বসল। সে রায়ানের কথা ভেবে হীনমন্যতায় ভুগছে। অসহ্য নিপীড়ন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যস্তরে রয়েছে রায়ানের কথা ভেবে।
খোলামেলা মৃদু ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আরানের কপোলে বেয়ে পড়া ছোট্ট চুলগুলো। ভিক্টোরিয়া পার্কের এক প্রান্তে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে পা দু’টি বাহিরে রেখে হাতে একটি সরু চিকন পাতা হাতে তুলে এপাশ-ওপাশ আঙুল দ্বারা ঘুরিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবনায় মসগুল সে। তাঁর চিন্তাচেতনায় দখল সম্পূর্ণ রাহা। সর্বত্র সচেতনতামূলক পরিকল্পনা যেন ধ্বংসের সম্মুখে। কেবল রায়ানের জন্য। ভালোবাসা হারাতে বসেছে, তা দূর থেকে কর্মহীন হয়ে দেখবে চেয়ে চেয়ে। কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারছে না। অসহ্য অনুভব হচ্ছে হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে। তখনই হঠাৎ তন্নির কথা মাথায় এসে ধাক্কা খায়। দ্রুত কল দেবার সিদ্ধান্ত নিলো।
_
আজকে মেশকাতকে হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করতে দেখে ফারিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে। এমনিতেই রাহা ফোন তুলেনি দেখে চিন্তিত। তার উপর মেশকাতের এরূপ মুখশ্রী দেখে তার বিরক্তের চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে। মেশকাত রায়ান ও রাহার বিয়ের কাগজ ফারিনের পানে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘সারপ্রাইজ।’
ফারিন আগের ন্যায় চেয়ে থেকে কাগজ হাতে তুলে নিলো। খুলে বান্ধবীর বিয়ের কোর্ট ম্যারেজের পেপার দেখে চমকালো। আজকের তারিখ লিখা দেখে দ্বিতীয় বারের ন্যায় চমকে উঠলো। সে বাকহীন, ভাষাহারা। মেশকাত তাঁকে এরূপে দেখে নিজ থেকে বলল,
‘তোমার বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে আজ নতুনভাবে। সামনে হবে গ্রান্ড ভাবে আমাদের মতো।’
ফারিন কৌতুহল নিয়ে গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘বুঝিনি।’
মেশকাত আজের সব ঘটনা একে একে খুলে বলল। ফারিন ধপ করে বিছনায় বসে পড়লো। যার জন্য মেশকাতের মতো একজন বদ লোকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে। সে-ই কিনা রায়ানকেই শেষে বেছে নিলো?
মেশকাত হাস্যকর মুখে বলল,
‘ডিভোর্স দিতে হলে তোমাকেও ছয়মাস সংসার করতে হবে আমার সাথে।’
ফারিন ক্ষেপে গেল। তেজি কণ্ঠে বলল,
‘লইয়ারকে হাত করে বানোয়াট বক্তব্য পেশ করেছেন, সেটা আমার উপর চলবে না। এক তরফা ডিভোর্স দিলেই ডিভোর্স কার্যকর হয়। বিয়ের তিনমাস পরই ডিভোর্স দেওয়া যায়। কত টাকা ঘুষ খাইয়েছেন লইয়ারকে?’
মেশকাত হতবিহ্বল হয়ে গেল ফারিনের কথাগুলো শুনে। লইয়ারকে ঘুষ ব্যতীত লইয়ার নিজ থেকেই চাইছিল না তাঁদের ডিভোর্স হোক। এজন্য তাঁদের কাছে মিথ্যে বয়ান পেশ করেছে। সে এমন এক সৎ লইয়ার ছিল। মন থেকে যারা তাঁদের কাছে ডিভোর্স নিতে আসতো। প্রথমে তাঁদের সুযোগ দিতো এবং ভালোবাসা ও সংসার জীবনের সুন্দর সুন্দর বক্তব্য তুলে ধরে তাঁদের পুনরায় সুযোগ দিতো সংসার করার। অথচ, তারা তিন বন্ধু সেই লোককে পাঁচ বছর আগের সম্পূর্ণ ঘটনা তুলে না ধরে তারা চেয়েছে তার কাছে সাহায্য, যেন ডিভোর্স না হয়। এ বিষয়ে অজানা লইয়ার ভুলবার বোঝানো কথাগুলো বিশ্বাস করে তাঁদের সঙ্গে সায় দিয়েছে। এতে তাঁদের মূল উদ্দেশ্য অজানা ছিল তাঁর নিকট।
ফারিন মেশকাতকে ভাবনা কাতর থেকে জোরে হাঁক দিয়ে ডাক দেয়। চৈতন্য ফিরলো তার। সে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,
‘ভাবছেন আপনাদের পরিকল্পনা আমি কীভাবে ধরে ফেললাম?’
মেশকাত চোখ পিটপিটিয়ে কুঁচকে ফেলল। ফারিন ফের বলল,
‘আমি যেন আপনার জীবন অতিষ্ঠ না করে দেই। ডিভোর্স না দিতে পারি। এজন্য রাহাকে রায়ান বিয়ে করতে চাইছে পুনরায় জোরপূর্বক বন্ধুর বিয়ে বাঁচাতে? এ-ই তো আপনাদের পরিকল্পনা, তাই না। আসলে আপনারা মানুষ রূপে শ য় তা ন। যাদের জীবনে কখণো সুখ না আসুক।’
মেশকাত মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলে ফারিন ভারমুখশ্রী নিয়ে বেলকনিতে ছুটে আসলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তাঁর এবং রাহার জীবন এত কেন কঠিন? অন্যসব নারীদের মতো কেন সহজ নয়? অশ্রুসিক্ত নয়নে আকাশের পানে নজর ফেললো। মেশকাত নির্বোধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিন তাকে অপরাধী মনে করছে ঠিক আগের ন্যায়। রায়ান রাহার জীবন পরিবর্তন করতে চেয়েছে এবং পাঁচ বছরের রাগ-ক্ষোভের প্রতিদান একটা সুন্দর সংসারের ন্যায় সাজাতে চেয়েছে। হোক সেটা মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে। এসব ভেবে সে অসহায়বোধ অনুভব করে।
_
তন্নির কল দিয়ে রাহিলা বানুকে আজকের ঘটনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি সর্বত্র খুলে বলল। রেগেমেগে উঠলো সে অপর পাশ থেকে। তিনিও দমে নেই। তন্নিকে কড়া কথা বলতে পিছু পা হলো না।
‘শোন, আমার মেয়ে পূর্বেই বিবাহিত। হ্যাঁ আমি জানি আরান ভালো ছেলো। কিন্তু তার পরিবার ও চোদ্দগুষ্টির কারো সম্পর্কেই আমাদের ধারণা নেই। আজ না হোক, কাল ঠিক রাহাকে এ বিষয় তুলে খোঁটা দিবে, কটুকথা শোনাবে। তখন রাহা ভেতরে ভেতরে আরো ভেঙে পড়বে, নিজেকে দুর্বল অসহায় ভেবে ডিপ্রেশনে থাকবে। চাপা স্বভাবের মেয়েটা কখণো আমাদের মুখ ফুটে জানাবে না। তখনকার সিচুয়েশনের দায়িত্ব কী তুই নিবি?’
বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করে ফেলল তন্নিকে। এভাবে কখণো ভেবে দেখেনি। রাহার জীবনকে নতুন ভাবে গড়ায় সে ব্যস্ত ছিল। তন্নির নিরুত্তরের ফাঁকে সে বের বলল,
‘আরান তোকে এসব বলেছে আমি নিশ্চিত। ওর জন্য আমাদেরও একইভাবে কষ্ট হচ্ছে। তবে আপাতত রাহার দিক ভাবতে হবে। মেয়েটা আমার ভেঙেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ। তোর বোন। এ কয় বছর তোর সাথে থেকেছে। এখন তো তুইও ওঁকে বুঝিস, ওর সম্পর্কে সব ধারণা রয়েছে তোর। এ বিষয়ে আর আমার কিচ্ছু বলার নেই।’ বলেই লাইন বিচ্ছিন্ন করলেন। হাঁপিয়ে উঠেছেন। নিজেকে কেন জানি অসহায়ত্ব অবস্থায় অনুভব করছেন।
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৮.
পুরো একটা দিন অতিবাহিত হয় তাঁদের পীড়াময়। পরদিন মেশকাত রায়ানের মা’কে নিয়ে উপস্থিত হয় রাহাদের বাড়িতে। অরুণা বেগম সম্পূর্ণ ঘটনা জেনেছে মেশকাতের কাছ থেকে। তিনি রাগ-ক্ষোভ ছেলের উপর বর্ষণ করতে দেরি করল না। মেশকাতকে সহ রায়ানকেও কড়া ভাবে শাসিয়েছে। এত বড়ো অপরাধ তার ছেলের দ্বারা হয়েছে তিনি ভেবেই অস্থির, নির্বোধ।
তিনি কালই রাহাদের বাড়িতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলো। স্বামীকে জানিয়ে রাহাদের বাড়ি এসেছে। স্বামী তার উপর এবং ছেলের উপর ক্ষিপ্ত হলেও বিয়েতে আপত্তি করেনি। তবে তাঁদের সঙ্গে যেতে তার ঘোর আপত্তি ছিল। এজন্য তাঁদের একাকী আসতে হয়। অরুণা বেগম কি বলে শুরু করবে বুঝতে পারছেন না। মুহিদুল ইসলাম ও তার বড় ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে স্পষ্ট কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বিনয়ী স্বরে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আপনাদের নিকট প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ছেলের হয়ে। ছেলের এরূপ কর্মকাণ্ডে আমরা অবগত নই। পাঁচ বছর পূর্বেই যদি জানতাম। আপনার মেয়ে তখনই আমার ঘরের পুত্রবধূ হতো। বেশিকিছু বলার ভাষা আমার নেই। আমি রাহাকে আজ আংটি পরিয়ে পরশুদিন বড়ো রিসিপশনের মাধ্যমে বিয়ে কাজি দ্বারা সম্পূর্ণ করে ঘরে তুলতে চাই আপনার মেয়েকে। যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে।’
মুহিদুল ইসলাম ঝেড়ে কাশলেন। নড়েচড়ে বসে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার ছেলে যদি আমার মেয়েকে কোনোভাবে টর্চার করে…’
তার মুখের কথা অরুণা বেগম কেঁড়ে নিয়ে বলল,
‘আমি সব দায়িত্ব নিবো। আমার ছেলের যদি আপনার মেয়ের উপর টর্চার করে এর বিচার আমি করব। কথা দিচ্ছি।’
তার আশ্বাসবাণী শুনে তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। দৃঢ় গলায় বললেন,
‘ঠিক আছে আপনার কথা মেনে নিলাম। রাহার আম্মু, রাহাকে নিয়ে এসো।’ তিনি আদেশ দিলেন স্ত্রীকে। রাহিলা বানু রাহার রুমে প্রবেশ করে মিনিট কয়েক পর বাহিরে বেরিয়ে এলো রাহাকে সঙ্গে নিয়ে। শুঁখনো, ক্লেশময় মুখশ্রী দেখে অরুণা বেগম কিছুটা স্তব্ধ হলেন। মায়াবী মুখশ্রীর মেয়েটার অমন মুখখানা দেখে তিনি নৈঃশব্দ্যে নিশ্বাস নিলো। এসব যে তার ছেলের কর্মের ফল সে জানে সেসব। রাহা পাশের সোফায় বসতেই তিনি আংটির বাক্সহাতে উঠেই তার পাশে বসল। তিনি আলতো হাত রাহার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে শুধায়,
‘আমার ভাগ্যবতী বউমা তুমি।’ বলেই ডান হাত এগিয়ে নিয়ে আংটি পরিয়ে দিলো অনামিকা আঙুলে। রাহা কেবল নির্বাক হয়ে চেয়ে তাঁকে দেখছে। ছেলের তুলতায় মায়ের আচার-আচরণ এতটা নমনীয়, কোমল দেখে কে বলবে এনিই রায়ানের আম্মু, গর্ভধারিণী মা! রাহা নজর সরিয়ে নিলো।
পাকাপোক্ত ভাবে কথা বলে তিনি মেশকাতকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
গাড়িতে বসে মেশকাতের উদ্দেশ্য কাঠকাঠ কণ্ঠে বললেন,
‘তোদের কর্মের ফল মেয়েটা ভোগ করছে। দেখেছিস মেয়েটার চেহারায় কেমন দুঃখী দুঃখী ভাব।’
‘আন্টি আমাদের ভুল হয়েছে।’ নত স্বরে বলল।
‘স্বীকার করছিস যখন ফারিনকে কষ্ট দিস না। যদি জানতে পারি, আমি নিজে তোর পরিবারকে সব জানাব।’
মেশকাত দৃষ্টি নত রেখে নিরুত্তর হয়ে রইলো। আন্টির রাগের আক্রমণে পালাক্রমন করতে চায় না মুখ খুলে। সেজন্য চুপ থাকে।
.
অস্থির হয়ে পায়চারি করছে ফারিন। কাল মেশকাতের মুখে সব জানার পর মরিয়া হয়ে উঠেছে রাহার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু রাহা তাঁর ফোন তুলছে না। প্রতিটা টেক্সটের রিপ্লাইও দিচ্ছে না। এজন্য টেনশনে সে আরো অস্থির হয়ে পড়েছে ক্রমশে। রাহা যে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, এটি জানে না সে। হঠাৎ মাইশার আগমনে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হয়। মৃদু হাসি টেনে বলল,
‘কিছু প্রয়োজন?’
‘নাহ! এমনিতেই তোমার সাথে গল্প করতে আসলাম।’
‘আচ্ছা বোসো।’
‘ভাবি তোমার কাছে এমন কোনো থীম রয়েছে। যার মাধ্যমে একটি সুন্দর গল্প সাজানো যাবে।’
‘হ্যাঁ, আছে তো।’
‘তাই? জলদিই বলো।’ উৎসাহিত কণ্ঠে শুধালো।
‘থীম দিয়ে কি করবে আগে শুনি?’
‘লিখব।’
‘তুমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত?’
‘নাহ! যুক্ত হতে চাইছি।’
‘বেশ, আমি বলছি। পয়েন্টগুলো মনে রেখো।’
প্রথমে ফোনের রেকর্ডিং চালু করে ফারিন। এরপর পাঁচ বছর আগের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ননা করে তুলে ধরে। তবে তাঁদের আসল নামগুলো উল্লেখ করল না।
মেশকাত দোকানে বসে আনমনে রায়ানের আম্মুর কথাগুলো ভাবছে। আজকে সে চোখে আঙুল দিয়ে পূর্বের ভুলগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। সে অনুতপ্ত, ভীষণ অনুতপ্ত বোধ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। ভোঁতা তিক্ত অনুভূতি ক্রমশে তার অন্তরে জ্বালাতন সৃষ্টি করছে। ফোন তুলে রায়ানকে কল দেয়। অফিসের কাজের মধ্যে থাকার ফলে পাশেই ছিল ফোন। ব্লুটুথ কানেক্ট করে রিসিভ করে।
‘বল?’
‘আন্টি কিছু বলেছে?’
‘আমি অফিসে। কি বলবে?’ ল্যাপটপে মনোযোগ রেখে জানতে চাইল।
‘আন্টি আমাদের জন্য ভীষণ হার্ট হয়েছে। বিশেষ করে তোর জন্য খুবই।’
রায়ান হাত স্থির করে ফেলল। লাস্ট একটি বাটন ক্লিক করে চেয়ারে হেলান দিলো। গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘যতটুকু স্যাক্রিফাইস করছি শুধুমাত্র তোর এবং রাহার জন্য। এখন বাকি কি রয়েছে স্যাক্রিফাইসের?’
‘আমার জন্য বাদ দিয়ে ফোকাস রাহার উপর দিলে সকলে খুশি হবে। পরশুদিন রিসিপশন তোদের। আমি চাই এর আগে তুই নিজেকে পুরোপুরি ভাবে পরিবর্তন করে শুধরে ফেল।’
‘হোয়াট?’ ভ্রু কুঁচকে ফের জানতে চাইলো।
‘যেটা কর্ণপাত হয়েছে তোর কানে, তাই বলেছি আমি। তুই রাহাকে কীভাবে এক্সেপ্ট করবি জানি না। ওর বাকি জীবন তোর উপর নির্ভর করছে। মেয়েটা নিজের আত্মসম্মান বোধ ত্যাগ করে তোর সঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। থিংঙ্ক পজিটিভ। ‘
‘ওয়েট। এগুলো কি আম্মু তোকে বলতে বলেছে?’
‘নাহ। তোরও বোন আছে, আমারও। ভাগ্যিস তোর বোন বিবাহিত। যদি এই ঘটনা মাইশার সঙ্গে হয়। আমরা হয়তো ছেলেটিকে মে রে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করব না। সেই তুলনায় অধিক ভালো রাহার পরিবার। জ্ঞান নয়, কিছু উদাহরণ দিলাম। এই মুহূর্তে তোর জন্য উপকারী হতে পারে। বাকি তুই কীভাবে রাহার সঙ্গে জীবন কাটাবি তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
বলা শেষ হতেই ফোন রেখে দিলো মেশকাত। রায়ান ল্যাপটপের পানে চেয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মুখশ্রীতে চওড়া গাম্ভীর্য ভাব ভাস্যমান। পূর্বের পাঁচ বছর আগের রাহাকে বলা কথাগুলো কানে এসে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। মনের আনাচকানাচে কোথাও যেন সুপ্ত অনুতপ্তের আভাস মিলছে।
___
আরান বাহির থেকে ফিরে এসে জানতে পারে রাহার রিসিপশন পরশুদিন। রাগ-দুঃখ হৃদয়ে পুষে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় জয়ি হয় সে। যাকে পাবার আশায় ঢাকা অব্ধি এসেছে, তাঁকে এখন চিরতরে হারাতে বসেছে। ভালোবাসা না পাবার তীব্র যন্ত্রণায় ঔদার্যের সত্তা হারাতে বসেছে। কেড়ে কুঁড়ে নিজের করার আক্ষেপ জাগছে হৃদয়ে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহার কক্ষে টোকা দিলো। রাহা অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ম্লাস হেসে ভেতরে আসার আহবান জানাল। আরান পাশের টুল টেনে রাহার মুখোমুখি বসে হাসিমুখে বলল,
‘আজকে আমি খুলনা যাব।’
রাহা মুখ মলিন করে ফেলল। তার বিয়ে আরান মেনে নিতে পারবে না দেখেই চলে যাবে এটা মনে উঠে তৎক্ষনাৎ। রাহার নিরুত্তরতায় আরান মুচকি হেসে বলল,
‘পরশুদিনই চলে আসবো। এসে তোমার আব্বুকে জিজ্ঞেস করব, আঙ্কেল রাহা কোথায়? রিসিপশন এত সাজানো-গোছানো, অথচ খালি কেন?’ সিরিয়াস অবস্থায় রাহা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। মৃদু হাসতে দেখে আরানও হেসে ফেলে।
‘যখন তোমার আব্বু বলবে, রাহা বিয়ে করে চলে গেছে। তখন আমি বাপ্পারাজের দ্বিতীয় ভার্শন হয়ে সমাধির দ্বিতীয় গানটি গাইব। আমার ভালোবাসা ভেঙে, সমাধির মাটি ছেড়ে পক্ষি যায় হেঁটে যায়…..। সুন্দর হবে না বলো?’
‘হ্যাঁ, খুব।’ পেছন থেকে তন্নি ব্যঙ্গ করে বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করল।
আরান এক গাল হেসে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘তোমার কমতি ছিল তন্নি আপু। পূরণ করে দিলে এ বাড়িতে চরন ফেলে।’
‘নাটক কম কর। তোকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। এত সুন্দর অভিনয় তোর দ্বারাই সম্ভব।’
‘তাহলে বাহবা দিচ্ছো কেন এখনো?’
‘তুই বাহবা পাবারই যোগ্য।’
‘থ্যাংকইউ, থ্যাংকইউ..’
‘তুই একা এসেছিস?’ রাহা প্রশ্ন ছুঁড়ে।
‘আম্মু-আব্বু এসেছে।’ ভারী গলায় বলল।
‘দেখা করে আসছি, কথা বল।’ বলে রাহা বাহিরে এলো। আপাতত আরানের মুখশ্রী ভার। তন্নি তার বুকে চাপড় মেরে বলল,
‘এখনো যাচ্ছিস না কেন? চলে যা খুলনা। সে আর তোর নেই। হবেও না।’
‘তাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাব আপু।’ কোমল গলায় জানাল।
‘সহ্য করতে পারবি না।’
আরান করুণ চোখে তাকাল। চাহনি যেন জীবন্ত কথা বলছে তার। রয়েছে কষ্টময় হাজারো দুঃখ লুকায়িত সে চাহনিতে।
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।