তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-১৯+২০

0
2

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
১৯.
বাড়িতে এসেই মুখশ্রীতে একরাশ রাগ দেখে মাইশা মেশকাতকে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। মেশকাত তাকে উপেক্ষা করে হনহনিয়ে উপরের দিকে অগ্রসর হয়। রেগেমেগে রুমে প্রবেশ করে কঠোর গলায় ফারিনের কাছে জানতে চাইলো,
‘মাইশাকে কেন বলেছো? তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম এসব কাউকে বলতে।’
ফারিন খুব শান্ত ভাবে তাকালো৷ সেভাবেই উত্তর দিলো,
‘ভাগ্যিস, ওঁকে থীম বলেছি। এটা বাস্তব সেটা বলিনি। এখন কেবল মাইশা জেনেছে। পরবর্তীতে সকলে জানবে।’
‘বড্ড বাড়াবাড়ি করছো তুমি।’ ধমকের গলায় শুধালো।
‘আপনি? না…আপনারা? একবার রাহার জীবন নষ্ট করে ক্ষান্ত হননি, আবার একই ভুল করতে চলেছেন।’
‘রাহার জীবন এখন আর নষ্ট হবে না। রায়ান রাহাকে সদরে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে।’
‘ঐ বিষাক্ত মুখ দিয়ে বলছেন? অবশ্য মিথ্যা বিষের ন্যায় বিষাক্ত।’
‘ফারিন, মানুষকে পরিবর্তন হবার সুযোগ দেয়া উচিত।’
‘আপনাদের মাতো মানুষদের সুযোগ? ফানি… ‘
মেশকাত রাগে দাঁতে দাঁত পিষে রাখল। প্রত্যেকটা কথার কড়া পাল্টা জবাব ফারিন ছুঁড়ছে। তর্কে বিতর্কে যেতে চাইছে না। এজন্য চুপ থেকে সরে এসে সোফায় বসল। ফারিন মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল,
‘আমি কাল সকালে চলে যাব। তাতে আপনি বাড়িতে থাকেন বা না থাকেন।’
মেশকাত রক্তচক্ষে তাকাল। ফারিনকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে দু বাহু সজোরে চেপে ধরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘আমি পরিমাণে কতটা ভয়ংকর হতে পারি তোমাকে দেখাতে চাই না। এক পা বাড়ির বাহিরে দিলে আমার চেয়ে কেউ খারাপ হবে না।’
বলেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম ত্যাগ করল। ফারিনের ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। এমন হিংস্র রূপ মেশকাতের আজ প্রথম দর্শন করল। দু বাহুতে হাত রেখে হালকা ঘষতে লাগলো। মনে হচ্ছে ব্যাথায় দাগ বসে গেছে।
_
রাত, দিন পেরিয়ে মাঝখানে একদিন অতিবাহিত হয়ে যায়। বিয়ের তোড়জোড় পুরো দমে চলছে দুই বাড়িতে। একই সেন্টার একত্রে বুকিং করেছেন দু পক্ষের লোক। সেন্টারও বিলাসবহুল বেশ। সকালেই হলুদ দিয়ে গোসল করিয়ে রাহাকে কনে সাজানো হয়। নওজানা আগেই পাঠানো হয়েছে। এজন্য সাজাতে বেশি সময়ও লাগেনা। ভারী লেহেঙ্গা ও গহনায় ইতিমধ্যে রাহার হাসফাস লাগছে। চোখে কাজল ও ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ব্যতীত মেকআপ বিহীন সাজ তার। সম্পূর্ণ ভাবে তৈরী সে। রাহিলা বানু বোনকে সঙ্গে নিয়ে রুমে এলো। মেয়েটা চলে যাবে ভেবেই বুক দগদগ করে উঠে কষ্টে। কান্না চাপিয়ে হাতে স্বর্ণের মোটা রুলি পড়িয়ে দেয়। নত স্বরে বলে,
‘তোর নানুর দেয়া শেষ স্মৃতি তোর হাতে তুলে দিলাম। তোর জন্যই রেখে গিয়েছে সে। যত্ন করে রাখিস। নিজের দিকেও যত্ন নিস।’
রাহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে কোমল গলায় বলল,
‘তোমার দোয়া এখন আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আম্মু।’
তিনি মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। তন্নি মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে মুহিদুল ইসলাম বড্ড আক্ষেপ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল না৷ চেপে গেলেন। সবে ফুরসত পেয়েছিল কাজ থেকে। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে নিজের মনকে শক্ত করতে পারবে না বিধায় প্রস্থান করল। দুইটার দিকে আত্মীয় সহ সবাই সেন্টারে উপস্থিত হয়। রায়ান কালো রঙের কোট প্যান্ট পড়া ছিল। চোখে সানগ্লাস পড়ে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিল। রাহাদের আসতে দেখে রায়ান নিজ থেকে এগিয়ে এলো হাইচের নিকট। তন্নির হাত ধরে এক কদম দেবার আগেই রায়ান রাহাকে কোলে তুলে নিলো। আকস্মিক ঘটনায় সকলেই যেন বিপর্যস্ত। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকলেও রায়ানকে কিছু বলার সাহস দেখাল না৷ রাহা থতমত আদলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে রায়ানের পানে। এই ঘটনার জন্য নিজেকে পূর্বে প্রস্তুত রাখেনি। ভীতু হয়ে রায়ানের কোট খামচে ধরে রেখেছে শক্ত ভাবে। ভুলেও পলক ফেলে রায়ানের পানে তাকায়নি। রায়ান রাহাকে এরূপ খামচে ধরেছে দেখে হাঁটার সময় বিড়বিড় করে একটু জোরেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘কোট ছিড়ে ফেলার ইচ্ছে রয়েছে?’
রাহা এবার ভ্রু বাকিয়ে তাকাল। চোখ দেখার সুযোগ নেই রায়ানের সানগ্লাসের জন্য। নিরুত্তর থেকে দ্রুতই নজর সরিয়ে নিয়ে হাত হালকা করল। রায়ান সকলের সামনে থেকে হেঁটে স্টেজের উপরের মধ্যখানের সোফায় বসাল। তারপর পাশে হেলার দিয়ে বসল। হয়রান হয়ে বড়ো বড়ো নিশ্বাস টানছে। রাহা একটু চেপে বসল। রায়ান বিষয়টি এতটা গুরুত্ব দিলো না। পুরো বিষয়টি ফারিন দূর থেকে লক্ষ করেছে। নিজের বান্ধবীকে এতটা কাছে পেয়েও যাবার সুযোগ নেই। মেশকাত পাশে বসে কড়া পাহারায় রেখেছে। রাহা খেয়াল করেনি ফারিনকে। তবে সে জানে এখানেই রয়েছে পূর্বপরিচিত প্রিয় বান্ধবী তার। চোখ তুলে তাকানোর ইচ্ছে শক্তিটুকুও নেই তার হৃদয়ে। কেমন যেন অসহ্যকর অনুভব হচ্ছে।
আত্মীয়দের খাওয়াদাওয়া শেষে কাজিকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে পড়ানো হলো। রায়ান দ্রুত কবুল বললেও রাহার কবুল বলতে কয়েক মিনিট সময় লেগেছিল। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক হলেও রাহার ক্ষেত্রে এটা ছিল একটু বেশিই অস্বাভাবিক। নিজেকে অন্যের দলিলে পুরোপুরি ভাবে আজ লিখে দিয়েছে কালেমা পাঠ করে। তাও এমন একজন মানুষকে! এবার বর কনেকে একত্রে খাওয়াদাওয়া করানোর পালা। পাশাপাশি বসিয়ে রাহাকে খাইয়ে দিচ্ছিল তন্নি। রায়ান একাকী খাচ্ছে।
হঠাৎ বাম হাত দিয়ে রাহার ডান হাত চেপে ধরল সবার অগোচরে। রাহা আড়চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এর মূল কারণ! হাত মুচড়িয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পারল না। তখনই রায়ান এক টুকরো গোস্তের পিস নিয়ে রাহার মুখের সামনে ধরে ধীরেধীরে বলল,
‘নেও, নয়তো ছাড়ব না।’
তন্নি রাগী দৃষ্টিতে এক পলকে তাকিয়ে ছিল রায়ানের পানে। সে বিরক্ত জড়িত কণ্ঠে শুধালো,
‘লাগবে না আমি খাইয়ে দিচ্ছি তো।’
বলতে বলতেই রাহা মুখে নিলো। তন্নি রাহার উপর অভিমান করল কিঞ্চিৎ। অবশ্য সে জানে না তার বোন ফাঁদে পড়েছে। হাত ছাড়িয়ে তন্নিকে ইশারায় ডেকে বিষয়টা জানালো। তন্নি শান্ত হলেও রায়ানের জন্য মনে মনে বিষাক্ত গালি ঝাড়ল। বিদায়ের সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে রাহা। ভাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়েছে। পরবর্তী আফসোস হবে নাকি সুখ হবে এই গন্তব্যের, অজানা! রাত হয়ে যায় বিদায়ের পর্ব শেষ হতে হতে। গাড়িতে উঠে। রায়ান, রাহা ও ড্রাইভার ব্যতীত গাড়িতে কেউ ছিল না। রাহা নিজেকে সরিয়ে রেখেছে রায়ানের কাছ থেকে। এক মুঠে ছিল টিস্যু, অন্য হাতে ফোন। নৈঃশব্দের কান্নায় বার বার চোখ মুছছে টিস্যু দ্বারা।
রায়ান ফোন থেকে চোখ সরিয়ে এক পলক তাকাল। পাশ থেকে টিস্যুর বাক্স রাহার কোলে তুলে দিলো। রাহা বাক্সের পানে তাকিয়ে ড্রাইভারের ফাঁকা সিটে নিক্ষেপ করল সেটা। রায়ান আড়চোখে একবার তাকিয়ে ফোনে মনোযোগ রাখল। রাহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো মেনে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেন্টার থেকে বাড়ি আসতে বেশি সময় লাগে না তাদের। অরুণা বেগম তার একমাত্র মেয়ে রুহিকে নিয়ে তাদের আগেই উপস্থিত হয়েছিল বাড়িতে। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে রাহাকে রীতিনীতি অনুযায়ী শরবত ও সামান্য মিষ্টিমুখ করিয়ে ভেতরে নিয়ে আসা হয়। হাতেগোনা কয়েকজন কেবল কাছের আত্মীয় ছিল। বাকিরা সেন্টার থেকেই চলে গেছে। রায়হান মির্জা তখন ড্রইংরুমেই বসে ছিলেন। অরুণা বেগম রুহিকে রায়ানের রুমে দিয়ে আসতে বলে। রুমে পৌঁছে রুহির সাহায্যে লেহেঙ্গা ও গহনা পরিবর্তন করে। ফ্রেশ হয়ে ব্লু রঙের সিল্কের শাড়ি পরিধান করার পর খাবার নিয়ে আসে রুহি। সামান্য খাওয়াদাওয়ার পর ননদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। বয়সে তারা একই। রায়ান বড়ো হওয়ায় রুহি রাহাকে ভাবি বলেই সম্বোধন করে,
‘আপনার ছেলেমেয়ে নেই?’
রাহার প্রশ্নে রুহির মুখ গোমড়া হলেও পরমুহূর্তেই কৃত্রিম হেসে বলল,
‘এখনো নেবার পরিকল্পনা করিনি ভাবি। তবে শীঘ্রই নিবো। তুমি করে বললে ভালো হয়।’
‘তাহলে আমাকেও তুমি করে বোলো।’
রুহি হেসে সম্মতি দেয়,
‘আচ্ছা।’
‘তুমি রেস্ট নেও। আর দুধ খেতে ভুলে যেও না তোমরা। আমি গেলাম।’
রাহা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলে রুহি প্রস্থান করে। ঘড়ির পানে তাকিয়ে দশটা একত্রিশ দেখে মায়ের নাম্বারে কল দেয়। একবার রিং হবার পর কল রিসিভ হলো।
‘কেমন আছিস রাহা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’
‘তুই কই এখন?’
‘রুমে আম্মু।’
‘সবাই তোর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে?’
‘সবাই খুব ভালো। আম্মু, আরান এসেছিল?’
প্রশ্ন শুনে তিনি সেকেন্ড কয়েক চুপ রইলো। বলল,
‘তোদের গাড়ি সেন্টার থেকে বের হবার পরপরই আরানের গাড়ি এসে প্রবেশ করে। এরপর তন্নি যখন বলল তোর বিদায় হয়েছে। চোখমুখ কুঁচকিয়ে প্রস্থান করেছে। আর দেখা হয়নি।’
মায়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহা। তিনি ফের বলল,
‘ফারিনও এসেছিল। মেশকাতের জন্য তোর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। আমার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে চলে গেছে।’
‘তন্নি, খালা মনি, খালু আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। কাল চলে যাবে।’
‘আব্বু?’
‘সে মাত্র সেন্টার থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় কাত হলো। রুবেল এখনো আসেনি।’
‘তোমার ও আব্বু দিকে খেয়াল রেখো। রাখছি।’
‘ভালো থাকিস।’
‘দোয়া কোরো।’
লাইন বিচ্ছিন্ন হলো। রাহা ফোনের পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সংসার জীবনের সূচনা পর্ব কেমন হবে জানা নেই তার। তবে সবচেয়ে বেশি মনঃক্ষুণ্ন হচ্ছে আরানকে নিয়ে। পেতে গিয়েও হারিয়ে ফেললো তাঁকে।
.
.
#চলবে?

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২০.
দূরবর্তী বন্ধুদের বিদায় দিয়ে সবে বাড়িতে এসেছে রায়ান। ঘড়িতে তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। অরুণা বেগম ড্রইংরুমের সোফায় বসে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ছেলের পানে রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে মুখ বন্ধ রেখেই চলে গেলেন নিজের কামরায়। মায়ের রাগী দৃষ্টি তাকে যে সতর্কতা বার্তা দিয়েছে এটা রায়ানের বোধগম্য নয়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় পাশের রুম থেকে রুহির চেচামেচি কর্নপাত হলো তার। সে থামল। দুলাভাই ও রুহির কিছু কথপোকথন কানে এসেছে। অস্পষ্ট হলেও কাল সকালে ঝামেলার বিষয়টি জানবে বলে জায়গা ছাড়ল।
রমে এসে রাহাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়াতে দেখে কোট খুলে সোফায় রাখল। ইন করা শার্ট তুলে পকেট থেকে একটি মাঝারি বাক্স ও আংটির বাক্স বের করল। রাহার সামনে এসে আংটির বাক্স খুলে ডান হাত কেঁড়ে নিয়ে অনামিকা আঙুলে ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিলো। অপর বাক্সটি ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে কাপড়, তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো।
দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কৌতুহল বশত রাহা সেই বাক্সটি খুলল। হারিয়ে যাওয়া ব্যাচলাইট দেখে রাহা মনে মনে সন্তুষ্ট হলো খুব। ঘুরে তাকাল ওয়াশরুমের দরজার পানে। চাহনিতে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। এরপর হাতের আংটির পানে তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড কয়েক। ডায়মন্ডের ছোট ছোট পাথর গুলো চকচক করছে। বেশ সুন্দর ছিল এটি। মিনিট কয়েক পর রায়ান শাওয়ার নিয়ে বের হয়। রাহা তখনো সেখানেই বসেছিল। উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘ব্যাচলাইট কোথায় পেয়েছেন আপনি?’
রাহার প্রশ্নে রায়ান নিরুত্তর হয়ে রয় কয়েক সেকেন্ড। ঐ মুহূর্তের কথা তার স্মরণ হতেই রায়ান গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
‘আমার গাড়িতেই।’
রাহার জানতে ইচ্ছে করছে এটা এখনো যত্ন করে রেখে কেন দিয়েছে। ফেলে কেন দিলো না? তবে এই মুহূর্তে রায়ানের সঙ্গে কথা বলার মনমানসিকতা মোটেও নেই তার। এজন্য চেপে যায়। ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার এক প্রান্তে শুয়ে মাঝ বরাবর কোলবালিশ রাখতে ভুল হয়না রাহার। গায়ে কম্বল জড়িয়ে বালিশে মাথা রাখল। রায়ান সবটা সোফায় বসে পর্যবেক্ষণ করেছে। একাকী বিছানায় শোবার অভ্যাস তার। ভাগাভাগি করে শুতে হবে এটা ভেবেই রায়ান বেশখানিকটা বিরক্তবোধ অনুভব করছে। তবে নেই কোনো উপায়। কমফোর্ট জামাকাপড় পরিধান করে আলমারি থেকে আরেকটি কম্বল বের করে শুতে এলো। বড়ো লাইট অফ করে টেবিল লাইট জ্বালালো। শোবার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে টেবিল লাইট অফ করে দিলো। কাল একাকী শুয়েছিল। আজ পাশে তার অর্ধাঙ্গিনী। অন্ধকারেই রাহাকে অনুসরণ করে তাকাল সে। তার জীবনের বাসর রাত নিয়ে তেমন জল্পনা কল্পনা ছিল না। বিয়ে নামক বন্ধন থেকেই অনেকটা দূরে ছিল। বাসর রাত সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। হঠাৎ টেবিল লাইট অফ করার সময় দুধের গ্লাস দেখেছিল। ফের পুনরায় লাইট অন করল। সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে ফের লাইট অফ করল। মনে মনে অধিক ভাবনাচিন্তায় ডুব দিয়ে চোখ বন্ধ করল।
_
এই প্রান্তে নিদ্রাবিহীন ফারিন এপাশ ওপাশ করছে। রাহার জন্য অধিক চিন্তিত সে। একটি বারের জন্য কথা বলার সুযোগ দেয়নি মেশকাত। ভীষণ রাগ হচ্ছে। না পারছে এ বাড়ির বাহিরে যেতে, না পারছে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে। এক প্রকার বন্দি সে মেশকাতের কাছে। এত দ্রুত হার মেনে নিবে না সে। কাল এর একটা বিহিত করবেই। মেশকাত ফারিনের ছটফটানি দেখে বুঝতে পারে এখনো ঘুমায়নি। ফারিনকে কাছে টেনে নেবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। যদি রাগের বশে সোফায় গিয়ে ঘুমায় হিতে বিপরীত হবে।
.
অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য পদ্মার পাড়ে এসে পাথরের উপর বসেছে। এত রাতে এখানে থাকা মোটেও ভাল দেখায় না। তবুও সে এসেছে। অনুভব করছে বারে বারে মৃদু বড়ো ঢেউ গুলো যেন মাটি ছেড়ে তার বুকেই আঁচড়ে পড়ছে। সব কিছু পরিপূর্ণ পাওয়ার এই জীবনে, কেবল অপূর্ণ রয়ে গেলে তুমি!
প্রবাদটি মনে মনে বারংবার আওড়িয়ে যাচ্ছে। ফোন বের করে গ্যালারিতে প্রবেশ করে রাহার একটি চিত্র মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে সেখান থেকে হোটেলের গন্তব্যে রওয়ানা দেয়।
___
সকাল সকাল ঘুম ভাঙার পর রাহা নিজেকে অচেনা রুমে আবিষ্কার করে। হঠাৎ-ই মাথায় আসে তার যে কাল বিয়ে হয়েছে। মনঃক্ষুণ্ন করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উঠে বিছানা ত্যাগ করার পূর্বে রায়ানের পানে তাকাল। শান্ত মস্তিষ্কে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নজর সরিয়ে মুখ ধুয়ে বাহিরে এলো। করিডর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে টেবিলে খাবার সার্ভ করছে তার শ্বাশুড়ি। দ্রুতই নিচে নেমে এলো। সুন্দর করে শ্বাশুড়িকে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল। তিনি বেশ খুশি হয়ে উত্তর নিয়ে বলল,
‘ভাবছিলাম ডাকতে পাঠাব। যাক ভালো হয়েছে উঠেছো।’
‘রুহি আপু, বাবা উঠেনি?
‘উঠেছে। ফ্রেশ হচ্ছে তারা। তুমি বোসো। সব নাস্তা রেডি। এখন শুধু আমার জমিদার পূত্রের উঠার পালা।’
‘তিনি কখন উঠেন?’ রাহা ভুলক্রমেই প্রশ্ন করে কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেল। অরুণা বেগম সেসব কিছু মনে করল না। বলল,
‘নয়টায়। অফিসে যেতে হয় তার এজন্য।’
‘বাকি মেহমান?’
‘তারা ভোরেই রওয়ানা হয়েছেন। তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারেনি।’
‘আমাকে ডেকে তুলতেন মা।’
‘সমস্যা নেই।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন।
তাঁদের কথোপকথনের মাঝে রুহি এলো। মুখ ভীষণ ভার। চোখমুখ শুঁকনো যেন রাত জেগেছে। মেয়ের ওমন মুখশ্রী দেখে তিনি জানতে চাইলো,
‘রাতে ঘুমাসনি? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’
রুহি ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘এলার্জির কারণে ঘুমাতে পারিনি।’
‘জামাই কোথায়?’
‘উনি ভোরেই চলে গেছে কুমিল্লা। তোমাদের বলে যেতে পারিনি। আমাকে বলতে বলেছে।’
‘এতদিন পর এলো। হঠাৎ এমন কি কাজ পড়েছে, ভোরেই যেতে হলো। ভোরে তো তোর খালা, চাচা-চাচিও গেছে। কই দেখলাম না তো।’
রুহি মায়ের এই কথায় থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা ভাব নিয়ে বলল,
‘তাঁকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস কোরো।’ বলেই চেয়ারে বসে রুহি।
‘রায়ানকে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়।’
‘আমার এই দায়িত্ব থেকে কালই ছুটি মিলেছে। ভাবিকে বলো।’
‘তোকে যেতে বলেছি তুই যাহ।’ আদেশ স্বরে বললেন। রুহি বিনাবাক্যে টেবিলে ছেড়ে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। রুমে এসেই দেখল ইতিমধ্যে রায়ান প্রস্তুত অফিসে যাবার জন্য। রুহি কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল,
‘আজ মনে হচ্ছে বউয়ের ডাকে উঠেছিস?’
রায়ান বডি স্প্রে গায়ে ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল,
‘নাহ!’
‘তাহলে সূর্য মনে হয় ভুল স্থানে উঠেছে। বাহিরে গিয়ে দেখতে হচ্ছে।’
রায়ান-এর উত্তরে কিছু না বলে ঘুরে তাকালো। বোনের মুখশ্রী দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে। সে গম্ভীর গলায় বলল,
‘বল কী সমস্যা?’
‘মানে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল রুহি।
‘সেলিমের সাথে কী নিয়ে গতকাল রাতে ঝামেলা হয়েছে?’
মুখ আরো মলিন হয়ে এলো রুহির। প্রসংগ পাল্টে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘কোথায়? কিছুই না-তো।’
‘শিওর?’ এক ভ্রু উঁচু করে দৃঢ় গলায় জানতে চাইলো রায়ান।
‘পাক্কা।’ মৃদু হেসে বলল।
‘আমি যদি ইনভেস্টিগেট করি জানতে পারি, খবর আছে।’ থ্রেট দিয়ে বলল সে। রুহির মুখ গোমড়া হবার পূর্বেই হেসে প্রস্থান করল। যেন সে রায়ানের কথা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে ভালো মতোই জানে রায়ান যদি তিল পরিমাণ আঁচ করতে পারে তাদের ঝামেলার মূল বিষয়, সর্বত্র প্রকাশে আনবে যেভাবেই হোক। সে তার ভাইকে কড়া ভাবে চিনে।
রুহি নিচে আসার পর রায়ান দ্রুত গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নামল। ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি এসে বাবা, মা, রুহি ও রাহাকে দেখে চেয়ার টেনে খেতে বসে। একটি পরোটা নিয়ে গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে রুহিকে জিজ্ঞেস করে,
‘সেলিম কোথায়?’
‘কাজ পড়েছিল, সেজন্য কুমিল্লা চলে গেছে ভোরে।’
সন্দেহজনক নজরে তাকাল রুহির পানে। রায়ানের এরূপ চাহনি রাহার চোখ এড়ায়নি। রায়ানকে আপাদমস্তক মেপে নিলো কয়েক সেকেন্ডে। নেভিব্লু রঙের শার্ট ও প্যান্ট পড়েছে। শার্টের উপরের অংশের দু’টি বোতাম খোলা। লোমহীন ফর্সা বুক স্পষ্ট। হাতে ব্লু রঙের ঘড়ি। চুলগুলো কাকের বাসার মতো জেল দিয়ে মৃদু উঁচু করে রেখেছে। আদলে সুদর্শন সুপুরুষের ভাব স্পষ্ট দেখা গেলেও, হৃদয় নিরহংকারী নয় মোটেও। নৈঃশব্দ্যে মৃদু প্রশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। রায়ান খাবার মাঝে রাহাকে আঁড়চোখে কয়েকবার দেখেছে। তার পানে দৃষ্টি স্থির ছিল বিষয়টি তার চোখ এড়ায়নি। কালকের আংটি এখনো অনামিকা আঙুলে দেখে হৃদয়ে কিছুটা সন্তুষ্টি মিলে। পরোটা পুরো শেষ করে ‘আমি আসছি’ বলে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। রায়ান যেতেই অর্ধ খানা রেখে প্রস্থান করে রুহি। মায়ের ডাক পেছন থেকে শুনলেও সাড়া দেয়নি সে। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। রুহির এরূপ আচরণ রাহার কাছেও অদ্ভুত লাগছে। কাল অব্ধি সব ঠিকঠাক থাকলেও, হঠাৎ এমন হবার কারণ বোধগম্য নয় তার। রায়হান মির্জা মেয়ের এরূপ আচরণ সন্দেহজনক নজরে দেখেন। তবে সরাসরি কিছু বলে না।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি