তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-২১

0
1

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২১.
ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে। আজ উনত্রিশ তারিখ। বিয়ের এক মাসও এখনো পূর্ণ হয়নি ফারিন ও মেশকাতের। সকালেই শ্বশুর, শ্বাশুড়ির অনুমতি নিয়ে মাইশাকে সঙ্গে করে ফারিন তাদের বাড়িতে এসেছে। এই বিষয়টি যখন মেশকাত দুপুরে বাড়িতে এসে জানতে পারে কোনো প্রকার তাদের সামনে সিনক্রিয়েট করে না। সে ফারিনের যাবার বিষয়টি জানে, তবে ভুলে গিয়েছে বলে চাপিয়ে দেয়। এরপর রুমে এসে ক্ষুব্ধ হয়ে ফারিনকে কল দেয়। তিন বারেরবারও কল রিসিভ হয়নি দেখে মেশকাত ভীষণ রেগে যায়। আপাতত মনমেজাজ শান্ত রেখে বিকেলে ফারিনদের বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।
এই প্রান্তে ফারিন মেশকাতের কল ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি। যতপ্রকার টর্চার আছে সে চালিয়ে যাবে মেশকাতের উপর। কোনোভাবেই হার মেনে নিতে প্রস্তুত নয় সে। খুব আরাম করে পেয়ারা খাচ্ছিল। ঠিক তখন রাহার নাম্বার থেকে কল এলো। ফারিন সোজা হয়ে বসে পেয়ারা টেবিলে রেখে দরজা ভিড়িয়ে খাটে বসে কল রিসিভ করল।
উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,
‘রাহা, কেমন আছিস? ঠিক আছিস? তুই কেন রায়ানকে বিয়ের করার ফাঁদে পা দিলি?’
রাহা ফারিনকে শান্ত গলায় বলল,
‘আগে নিজেকে স্থির কর। আমার কথা শোন। আমি ঠিক এবং সুস্থ আছি।’
‘সত্যি? বিশ্বাস হচ্ছে না। রায়ান তোর উপর টর্চার করেনি তো?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলো।
‘নাহ! রায়ান তার মতো রয়েছে, আমি আমার মতো। এখন বল তুই আমার জন্য নিজের জীবন কেন নষ্ট করতে বসেছিস?’
ফারিনের বুক চিড়ে চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। বলল,
‘পাঁচ বছর আগে তোর জন্য কিছু করতে পারিনি। যারা তোর জীবন ধ্বংসের পেছনে রয়েছে। হাতের কাছে পেয়ে কীভাবে এত সহজে ছেড়ে দেই। আমি আমার পরিকল্পনা সফল করবই। মেশকাতকে আমি বরবাদ করব।’
‘শান্ত, সুস্থ মাথায় আমার কথা শোন। প্রতিশোধ চাইলে আমিও নিতে পারতাম বা পারি। কিন্তু আমি বা তুই ওঁদের মতো না৷ কুকুর কামড় দিলে, কুকুর হয়ে আমারও কামড় দিতে পারি না। আমরা মানুষ। মনুষ্যত্ব বোধ আমাদের আছে। কীভাবে ভুলে গেলি তোর বাবা-মায়ের শিক্ষা?’
‘তুই এত সহজে কীভাবে সব ভুলে গিয়ে মেনে নিয়ে সংসার করতে চলে গেলি অহংকারী রায়ানের সাথে? বিবেক বুদ্ধি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে তোর?’
‘পজিটিভ চিন্তাভাবনা কর। আমি যদি আজ আরানকে বিয়ে করতাম রায়ানকে ডিভোর্স দিয়ে। ডিভোর্সি হিসেবে গন্য হতাম সমাজে। সবাই হাসিমুখে আমাকে মেনে নিলেও একদিন ঠিক এই গোটা আমাকে শুনতে হতো কারো না কারো কাছ থেকে। হ্যাঁ, ডিভোর্সি মেয়েরা সুখী হয়। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন। আর দ্বিতীয় কারণ, আমার বাবা-মা, ভাইয়া। রায়ান বড়োলোক বাপের অহংকারী ছেলে। এখন যখন আমাকে পাবার জোঁক তার উঠেছিল। সে কোনোভাবে যদি পরিবারের কারো ক্ষতি করে বসতো। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আমি খুব সুস্থ মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই আমার জন্য নিজের জীবন নষ্টের দিকে ঠেলে দিস না। আরেকটা কথা শোন, মানুষ পরিবর্তন হয়। রায়ানের মধ্যে যদি ক্ষুদ্র পরিমাণ পরিবর্তন না আসে। আমি তাকে ত্যাগ করব।’
ফারিন রাহার কথাগুলো শুনে মৌন হয়ে রয়। এরপর কোমলভাবে বলল,
‘আমি হেরে যেতে চাই না।’
‘সুযোগ দিয়ে যদি হেরে যাস, তখন তোর আফসোস থাকবে না। মানুষ পরিবর্তনশীল। আমি কি বলেছি তুই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস।’
ফারিন বিনাবাক্যে কল বিচ্ছিন্ন করল। রাহা কান থেকে ফোন সরিয়ে সরু নিশ্বাস ফেলল। নিজের আত্মসম্মান বোধ বিসর্জন দিয়ে যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে। আল্লাহ যেন তার পথকে সহজ করে দেয় এবং পরিপূর্ণতা মিলে! মনে মনে কথাগুলো ভেবে ফোন বিছানার উপর রাখল। মনকষ্ট তারও হচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে আজ এই পথে পথচলতে হচ্ছে।
__
মেশকাত সোজা রায়ানের কেবিলে প্রবেশ করে বিনানুমতিতে। প্রথমে রায়ান স্টাফ ভেবে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তবে মেশকাতকে দেখে ল্যাপটপ অফ করে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘এত তাড়া কীসের?’
মেশকাত বসতে বসতে রাগ ঝেড়ে বলল,
‘আমি জাস্ট বিরক্ত।’
‘ফারিনকে নিয়ে?’ এক ভ্রু উঁচু করে জানতে চাইলো।
‘হ্যাঁ, আমাকে না বলে মাইশাকে সঙ্গে নিয়ে ওঁদের বাড়িতে গেছে আজ।’
‘কারণ?’
‘দু’দিন ধরে চলে যাবে বলছে।’
‘আজ চলেই গেল?’
‘একেবারে না। ওর মাথায় কি চলছে জানি না।’ হতাশ হয়ে বলল।
‘আমি ঠিক আছি রাহাকে নিয়ে। তোরাও ঠিক হয়ে যাহ!’
‘ইম্পসিবল। ফারিন প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া টাইপ মেয়ে।’
‘হানিমুনে চলে যা ওঁকে নিয়ে।’
মেশকাত সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল,
‘এতটাও খারাপ আইডিয়া না।’
‘মেয়েরা সাধারণত স্বামীর ভালোবাসায়, যত্নে বেজায় খুশি থাকে। তুই ওঁকে সেভাবে ট্রিট করতে পারিস।’
‘ট্রাই করে দেখতে পারি। যদি ব্যর্থ হই, তুই শেষ!’ ধামকি সরূপ বলল।
রায়ান হেসে ফেলে। বলে,
‘ওকে মাই ইয়াং ফ্রেন্ড।’
‘হতাশ!’ নিরাশাজনক কণ্ঠে বলল। রায়ান খুব হেসে আরো মজা নিচ্ছে। হুটহাট মেশকাত প্রশ্ন করে,
‘বাসর ঘর হলো তোদের?’
রায়ান হাসি বন্ধ করে নড়েচড়ে বসল। একটু ভারী গলায় শুধালো,
‘তোদের হয়েছে?’
মেশকাত ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে বলল,
‘ও, তোদেরও হয়নি।’
‘আমি মেয়েদের প্রতি এতটাও আগ্রহ ছিলাম না কখনোই। রাহা আমার ওয়াইফ। একদিন সব হবে। আমি কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করব না।’
‘আমি তো ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও কিছু করতে পারি না।’ মুখ ভার করে বলল।
রায়ান এবারও হাসে বন্ধুর করুণ মুখশ্রী দেখে। মেশকাত দাঁতে দাঁত পিষে তাকায় রায়ানের দিকে। তবুও কি তার হাসি থামে। ফিকফিক করে হাসছে সে। মেশকাত আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে প্রস্থান করল। এরমধ্যে তার ফোনে একজনের কল এলো। রায়ান গম্ভীর মুখশ্রীতে রিসিভ করল,
‘বলো?’
অপরপ্রান্ত থেকে এক নাগাতে একজন লোক অনেককিছু বলছে। রায়ান মুখ বুঁজে শুনে ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে।
_
আরান ঘুমের পিল খেয়ে শুয়েছিল। হোটেলের একজন কর্মচারীর ডাকে ঘুম ভাঙে। উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। তার গন্তব্য এখন রায়ানের বাড়িতে। রাহার সঙ্গে দেখা করা এখন তার মূল উদ্দেশ্য। রাহার প্রিয় জিনিসগুলো কিনে রওয়ানা হয়। গাড়ি বাড়ির বাহিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। ভেতরে গাড়ি প্রবেশ করে এক পাশে রেখে বাড়ির ভেতরে এলো। ঘড়িতে সই বারোটা বাজে। একজন সার্ভেন্ট আরানকে দেখে রান্না ঘরে এলো মালকিনকে ডাকতে। হাত ধুয়ে অরুণা বেগম রান্না ঘর থেকে বের হলেন। আরান তাকে দেখেই বিনয়ী স্বরে সালাম দিলেন। তিনি উত্তর নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি কে বাবা? তোমাকে চিনতে পারলাম না।’
আরান সৌজন্যবোধ বজায় রেখে বলল,
‘আমি আরান। রাহার গেস্ট।’
‘সম্পর্কে কি হও তুমি ওর?’
‘রাহার খালাতো বোন তন্নি আপুদের বাড়িতে ব্যাচেলর হয়ে ভাড়া থেকেছিলাম। সেখান থেকেই আমাদের পরিচয় তন্নি আপুদের সাথে এবং তার সাথে।’
‘আচ্ছা, বোসো আমি রাহাকে ডাকছি।’
এই বলে তিনি একজন সার্ভেন্টকে দিয়ে রাহাকে ডাকতে পাঠাল। আরানের কথা শুনে রাহা দ্রুতই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। উল্টোদিকের সোফায় বসল রায়ান। ঠিক তখনই রাহা হাতের চুড়ির ঝিনিঝিনি মৃদু আওয়াজ তুলে নিচে নামছে। আরান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ব্লু রঙের শাড়িতে রাহাকে বেশ সুন্দর লাগছে। আজ হলেও হতে পারতো রাহা তার অর্ধাঙ্গিনী! সদ্য বিয়ে করা বধুর নতুন সাজসজ্জা দেখে উৎফুল্ল হয়ে আবেগে দিশেহারা হতো সে। সবই স্বপ্ন, কল্পনা কেবল।
রাহার প্রতি আরানের এরূপ চাহনি রাহা সহ রুহিও খেয়াল করে। বিষয়টা অদ্ভুত লাগে তার কাছে। রাহা নিচে এসে আরানের অপরপাশে সোফায় বসে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘কেমন আছিস?’
‘যেমন রেখে এসেছো।’
আরানের এরূপ উত্তর আশা করেনি রাহা। রুহির সামনে কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ অনুভব হয়। আরান রাহার লজ্জাজনক পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বলল,
‘যেমন রেখে এসেছো আমাদের। তেমনই আছি আমরা। শুধু তোমাকে সবাই মিস করছে।’
‘তন্নি চলে গেছে?’
‘ঠিক জানি না।’
‘তুই কখন যাবি?’
‘আমাকে তোমাদের শহর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছো মনে হচ্ছে।’ দুষ্টু হাসি প্রদান করে বলল।
‘হ্যাঁ, তাই মনে কর। আমাদের এড়িয়া ছাড়!’
‘ভয় নেই। চলে যাব। কিছু কাজ আছে। শেষ হলেই চলে যাব।’
রুহি ততক্ষণে রাহার পাশে এসে বসেছে। রাহা আরানকে উদ্দেশ্য করে পরিচয় করিয়ে দেয়। রুহি টুকটাক কথা বলে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকায়। রাহার জন্য আনা জিনিসগুলো হাতে তুলে দেয়। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পূর্বেই আরান চলে যায়। রায়ান দুপুরে বাড়িতে আসে না। একেবারে রাতেই ফিরে।
.
নয়টার দিকে মেশকাত ফারিন ও মাইশাকে নিতে এলো। একাকী ভাবে ফারিনের সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই দেখে বাড়িতে ফিরে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু ফারিন যাবার জন্য অমত পোষন করলে পরের সপ্তাহে এসে থাকার কথা সবাইকে বলে ফারিনের বাবা-মাকে রাজি করায়। তারাও যাবার জন্য আপত্তি দেখাল না। ফারিন মনমেজাজ ক্ষুন্ন করে মেশকাতের সঙ্গে যাবার জন্য উদ্যোত হয়। বাড়িতে ফিরেই মেশকাত ফারিনকে কেবল হানিমুনে যাবার কথা বলে। ফারিন তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বলল,
‘মিথ্যে বলার অভ্যাসটা গেল না?’
‘তখন মনে ছিল না।’ ভারী গলায় বলল।
‘আমি কোত্থাও যাব না।’
‘কনফার্ম যখন করেছি যাব, তখন যাবই।’
ফারিন কিছু একটা ভেবে চুপ হয়ে রয়। মৌন হয়ে কিছু ভেবে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। রাহার কথা তার মনে উঠেছে। কিন্তু মেশকাত এবং রায়ানকে যদি কোনো ভাবে শাস্তি দিতে পারতো, হয়তো তখন মেয়েদের দুঃখ বোঝার ক্ষমতা রাখতো। তার বক্ষ চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি