তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-২২+২৩

0
1

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ

২২.
রাতে রায়ান ফিরে এসে সোজা রুমে চলে এলো। ড্রইংরুমে রুহি বসে টিভি দেখছিল। অদেখার ভান ধরে চলে এসেছে। রুহি আশ্চর্য হয়। সকালেও সব ঠিকিই ছিল। আবার না জানি কিসের কারণে ক্ষোভিত সে, বোধগম্য হলো না তার। রায়ান রুমে প্রবেশ করেই কোট বিছানায় ফেলল। রাহা তার ক্রুদ্ধ আদলের পানে এক নজর তাকিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। শার্টের বোতাম খুলে সোফার বসে রাহার পানে না তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

‘আরান কেন এসেছিল?’

রাহা নজর সরিয়ে রায়ানের পানে তাকাল। আরানকে নিয়ে তার সমস্যার হবে বুঝলে যাবার পূর্বে পুনরায় আসতে নিষেধ করতো। এজন্য রায়ানের মুখশ্রী ভারী এবার সে বুঝতে পারে। রাহা মৃদুস্বরে বলল,

‘দেখা করতে। রিসিপশনে আরান আসার পূর্বেই আমার বিদায় হয়েছে। এজন্য আজ দেখা করতে এসেছে।’

রায়ান কয়েক সেকেন্ড স্থির রইলো। রাহাও ততক্ষণে নজর সরিয়ে নিয়েছে। এরপর ভারী গলায় শুধালো,

‘এ বাড়িতে আরানের আসাযাওয়া নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় বার যেন আরানের কদম এ বাড়িতে না পড়ে।’

রাহা চোখ না তুলে স্থির হয়ে রইলো। রায়ানের সঙ্গে কথা মিলিয়ে কথা বলার ইচ্ছেশক্তি নেই। এজন্য চুপ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরানকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ বাড়িতে না আসার। মনঃক্ষুণ্ন হয় ভীষণ। আরান তখনো রাহার টেক্সট সিন করেনি। ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত।

রায়ান উঠে এবার নিচে এলো। ড্রইংরুমে বাবা-মাকে দেখে নিচে নেমে এলো। তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে হাঁক ছেড়ে রুহিকে ডাকলো। রুমে অবসর সময় কাঁটাচ্ছিল ছিল। রায়ানের ডাকে রুম ত্যাগ করল। ততক্ষণে রাহা করিডোরের সামনে এসে উপর থেকে নিচে উঁকি দিলো। রুহি বের হতেই ফোন থেকে একটি বিয়ের কাবিননামা বের করে দেখাল। চেঁচিয়ে জানতে চাইলো,

‘এটা কি পড়ে আব্বু-আম্মুকে শোনা।’

রুহি ফোন হাতে নিয়ে কাবিনের পেপারটি দেখেই মুখ মলিন করে ফেলে। চোখ ছলছল করে উঠে নিমিষেই। করুণ চোখে শূন্যে দৃষ্টি নত করে রাখল। রায়ান গর্জে উঠে,

‘পড়তে বলেছি।’

রুহি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। অরুণা বেগম উঠে মেয়ের পাশে এসে পিঠে হাত রেখে ছেলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল,

‘কি হয়েছে তুই বলতে পারিস না? ওর উপর চিল্লাচিল্লি করছিস কেন?’

‘তোমার মেয়ে কেন গোপনে রেখেছে সেলিমের দ্বিতীয় বিয়ের কথা। জিজ্ঞেস করো, ভালো করে জিজ্ঞেস করো।’ আঙুল রুহির উপর তাক করে বিকট কণ্ঠে বলল। রায়হান মির্জা আৎকে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,

‘তুমি কীভাবে জানো? সেলিম তোমায় বলেছে?’

রায়ান রুহির হাত থেকে ফোন কেঁড়ে তার উদ্দেশ্যে এগিয়ে দিলো। বলল,

‘দেখো। কুমিল্লার এক পরিচিত লইয়ার আমাকে বিয়ের কাগজ পাঠিয়েছে।’

তিনি ছেলের পানে উৎসুক হয়ে তাকালো। রায়ান ফের বলল,

‘কাল রাতে আমার কানে ওদের ঝামেলার কিছু টপিক এসেছে। সেই সুত্র ধরে আমি ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেস্টিগেট করাই। দ্যান, সব তোমাদের সামনে। সেলিম বিয়ে করেছে ছয় মাসের হলো। তোমার মেয়ে বিষয়টি জানা স্বত্বেও আমাদের বলেনি। জিজ্ঞেস করো কেন? আমাদের কি মৃ’ত্যু হয়েছে?’

রায়হান মির্জা এবার ভীষণ রেগে তেঁতে উঠলেন মেয়ের উপর। ধমকের গলায় জানতে চাইলেন,

‘রায়ান কী সত্যি বলছে রুহি? সত্যিটা বলো?’

রুহি অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা উপরনিচ দুলায়। রাহা অবস্থা বেগতিক দেখে নিচে নেমে শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়ায়। তিনি ফের একই কণ্ঠে জানতে চাইলো,

‘বলো কেন লুকিয়েছো? আমরা কী জীবিত নেই?’

রুহি কান্নারত মুখশ্রী তুলে বলল,

‘এটা আমার ব্যর্থতা। আমি পারিনি সেলিমকে আগলে রাখতে। সেলিম আমায় তোমাদের জানাতে নিষেধ করেছে। যদি জানাই তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিবে। এজন্য মুখ বুঁজে সহ্য করেছি। ভবিষ্যতেও আরো করব।

আমি চাই না তোমারা অসম্মানিত হও। সমাজের চোখে নিন্দাসূচক পাত্রে পরিনত হও আমার জন্য।’

‘তোর জন্য? তুই কি অন্যায় করেছিস? অন্যায় করেছে সেলিম।’ অরুণা বেগম খেঁকিয়ে বললেন মেয়েকে।

‘আম্মু সমাজের চোখে একজন ডিভোর্সি নারীর ভ্যালু অপরাধ, নিন্দায় পরিনত। আমার জন্য তোমরা কারো কাছে কটুক্তি কথা শোনো আমি তা চাই না। সেলিম বিয়ে করলেও। আমি তাকে ভালোবাসি। দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি নেয়নি। তবে আমি মেনে নিয়েছি।’

‘সাটআপ! তুই কীভাবে ভেবে নিয়েছিস আমরা এটা মেনে নিবো? কক্ষণো না। সেলিমকে আজই আসতে বলবি, এক্ষুণি।’ ধমক দিয়ে রুহিকে বলল রায়ান। অরুণা বেগম ফুঁপিয়ে উঠলেন। তার মন কেন জানি ছেলের অপরাধের সূত্র ধরে এই একই ভুল ঘটেছে। বিধাতা এ-কোন পরিস্থিতিতে তাঁকে ফেলেছে!

রায়হান মির্জা রায়ানের উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি কল দিয়ে সেলিমকে আসতে বলছি সঙ্গে ওর বাবা-মা’কেও।’

তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন কল দেবার চক্করে। রায়ান তখনো রুহির পানে চেয়ে রাগে ফুঁসছে। রাহা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কেবল দেখছে তাঁদের ভাবভঙ্গি। কীভাবে এবং কী বলে সান্ত্বনা দিবে জানা নেই তার। কাল এ বাড়িতে এসেছে, আজই এরূপ ঘটনার সম্মুখীন হবে কে-ইবা জানতো?

রায়হান মির্জা সেলিম ও তার পরিবারের সাথে কথা বলে ফোন রেখে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,

‘আমি তাঁদের বিয়ের বিষয়টি জানায়নি। রাতেই রওয়ানা হবেন তারা।’ তিনি এবার মেয়ের পানে তাকালেন। মেয়ের কান্না বুকে হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে যেন। পারিবারিক ভাবে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল ভালো পাত্রের সঙে। আড়াই বছর ঘুরতেই মেয়ের সংসারে এমন ধস নেমে আসবে। কে জানতো? হাত ধরে টেনে মেয়েকে বুকে আঁকড়ে নিলেন। বাবার বুকে এক টুকরো ছায়া পেয়ে আদুরে হয়ে আরো ফুঁপিয়ে উঠলো রুহি।

তিনি ভারী গলায় মেয়েকে শুধালো,

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখ, মামনি।’ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মেয়ের। রাহা বাবা মেয়ের আদুরে দৃশ্য দেখে ভেতরে ভেতরে খুশি হলেন। শত দুঃখের মাঝেও মায়ের পর বাবা নামক বট বৃক্ষের ছায়া পেলে শুঁখনো চারাগাছ যেন জীবিত আকার ধারণ করে। এজন্যই বুঝি বলা হয় বাবা নামক ছায়াবৃক্ষ! রায়ান তেড়েফুঁড়ে যেতে নিলো। রাহা অরুণা বেগমকে ধরে সোফায় বসালেন। পাশে বসে কোমল গলায় বললেন,

‘মা আপনি টেনশন করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন। আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেই। ভরসা রাখেন।’ তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে খপ করে রাহার হাত ধরে বলেন,

‘তুমি আমাদের ক্ষমা করো মা।’

মায়ের এতটুকু কথা রায়ানের কর্ণপাত হতেই করিডরে দাঁড়িয়ে গেল সে। ঘুরে তাকাল না। রাহা খুব বিনয়ী স্বরে তার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

‘আপনি কেন বলছেন এসব? শান্ত হন মা।’

তিনি কান্নারত কণ্ঠে শুধালো,

‘তোমার সঙ্গে আমার ছেলের হওয়া অন্যায় আজ আল্লাহ ফেরত দিয়েছে মেয়ের উপর। তুমি আমাদের মাফ করো। নয়তো আল্লাহ তা’আলা আমাদের ক্ষমা করবে না।’

রাহা যেন এবার থমকে গেল শ্বাশুড়ির কথা শুনে। সে এমনটা ভাবেনি, অভিশাপও দেয়নি। মস্তিষ্ক থেকেই উধাও হয়ে গেছিল ব্যাপারটা। মুখ খুলে কিছু বলার সুযোগ যেন হারিয়ে ফেলেছে। কি বলে এখন তাকে সান্ত্বনা দিবে ভেবেই বেকুল। তবে এই মুহূর্তে চুপ থাকলে চলবে না। রাহা ধীরে কণ্ঠে শুধালো,

‘এভাবে বলতে নেই। আপনি শান্ত হন মা। আল্লাহ ভরসা সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন আরো। রাহা যতোই বলুক। এটা যে নির্মম নিয়তি! রাহার হঠাৎ উপরের চোখ গেল। উল্টোদিক ফিরে রায়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। রুহি হাউমাউ করে কেঁদে রুমে চলে গেল। রায়হান মির্জা সোফার অপরপাশে বসলেন কপোলে হাত রেখে।

রায়ান প্রস্থান করেছে। রুমে এসে শার্ট খুলতে খুলতে মায়ের বাল কথাগুলো ভাবে। আসলেই কি এটি রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার? নাকি আল্লাহর দেওয়া তারই কর্মফল ফিরিয়ে দিয়েছে তারই পরিবারে?
ঈষৎ চিন্তিত দেখায় তাকে।

.

সেলিম বাবার কথা শুনে দমে যায় না। সাহস নিয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ত্যাগ করবে না আবার রুহিকেও ডিভোর্স দিবে না। বিষয়টি গোপনে রাখার জন্য কেবল রুহিকে চাপ সৃষ্টি করেছে। এখন যখন সব সত্য ঘটনা উদঘাটন হয়েছে বাবা-মাকে না জানিয়েই ঢাকা যাবে। যাবার পর যা হবে দেখা যাবে। মনে মনে এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সেলিম।
__
রাত এখন গভীর। রাহার চোখে ঘুম উধাও। শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো এখনো কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারংবার। রায়ানের করা অন্যায়ের শাস্তি সে কখনো নিতে চায়নি। না কখনো মন থেকে অভিশাপ দিয়েছে। তবে আল্লাহ তার বিচার ঠিক দেখিয়েছে। এতে তার ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন। রায়ানের শাস্তি তার বোন কেন পাবে বা ইতিমধ্যে পাচ্ছে? শব্দ বিহীন প্রশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো।
এপাশে যে রায়ান নিদ্রায় কাবু এমনটা নয়। সেও একই কথা উপলব্ধি করছে। রুহির সাথে এমন হচ্ছে এটা কতটুকু যুক্তিসম্মত? এখানে কি তার দোষ বেশিরভাগ, নাকি সেলিমের? অতীতের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত বোনের উপর ফলচ্ছে? রায়ান অন্ধকারের মাঝে রাহাকে অনুসরণ করে তাকায়। তার স্থানে অন্য কোনো মেয়ের অবস্থান হলে এই বিষয়ে খোঁটা সরূপ কথা শোনাতো। অথচ, এখন অব্দি কোনো প্রকার কথা সে বলেনি। না বলার কোনো আগ্রহ আছে। তার জন্য রাহাই কি পারফেক্ট জীবনসঙ্গী বুঝে উঠতে পারছে না। শুধুমাত্র রাহার যে জীবন সুন্দর ভাবে গড়ে দিতে পারে তার দ্বারা এজন্যই তাকে বিয়ে করা। মধ্যকার সম্পর্ক সুন্দর হোক না নড়বড়ে। তার দ্বারা সমাজের চোখে রাহা যেন সুন্দর ভাবে বিবাহিত নারী হিসেবে স্বীকৃতি পায় এটাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২৩.
সকালের পরিবেশ স্নিগ্ধ শান্তময় থাকলেও এখন মির্জা পরিবারের আবহাওয়া বেশ গরম উত্তাপ ছড়াচ্ছে যেন। রায়হান মির্জা একাই পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে রেখেছে। মানসম্মান ধুলিস্বাদ হবার উপক্রম দেখে দৃষ্টি নত সেলিমের বাবা মায়ের। সেলিম শূন্যে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বসেছিল। ড্রইংরুমে আপাতত সকলেই উপস্থিত। রুহি নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। পাশেই বসেছিল রাহা। নয়টার দিকে তারা পৌঁছে গেছে ঢাকায়। নাশতার পর্ব শেষ হতেই রায়হান মির্জা বিয়ের প্রসংগ তুলে।
‘পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে। আপনার ছেলে সবার অগোচরে এমন ভুল কীভাবে করতে পারে? নাকি এর পিছনে আপনারাও জড়িত?’
আগের কথাগুলো সেলিম হজম করে নিলেও এখনের বলা শ্বশুড়ের কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধে। সে চোখ তুলো কাঠ কাঠ কণ্ঠে শুধালো,
‘তবে কি আমিও বলব, পাঁচ বছর পূর্বে রায়ানের ভুলের সঙ্গে আপনারাও জড়িত ছিলেন?’
রায়ান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালে সেলিম কিছুটা দমে এলো। সেলিমের বাবা ওসমান আহমেদ ছেলের পানে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘কথা বলবি কু’লা’ঙ্গা’র ছেলে। এক বিয়ে করার পর দ্বিতীয় বিয়ে কীভাবে করিস না জানিয়ে? আমাদের বংশে কালি মাখিয়ে উঁচু গলায় কথা বলছিস।’
‘ভুল কি বলেছি আমি? রায়ান যে ভুল করেছে রাহাকে বিয়ে না করলে হতো পাপ, এখন বিয়ে করে বউয়ের স্বীকৃতি দিয়ে সওয়াব করেছে। তাহলে আমারও ভুলও ভুল নয়।’
‘ভুল নয়?’ উঠে গিয়েই তেড়েফুঁড়ে ছেলের গালে চড় দিলেন ওসমান আহমেদ। সেলিম রেগেমেগে দাঁড়িয়ে গেল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
‘তুমি আমায় মারতে পারো মারো। তাদের কোনো অধিকার নেই আমাকে শাসানোর। তার ছেলে প্রতিশোধের কারণে বিয়ে করেছে। আর আমি ভালোবেসে পরকীয়ায় না জড়িয়ে বিয়ে করেছি। ভুল কোথায় হয়েছে? এমন নয় যে আমি রুহিকে জানায়নি।’
‘নিজের দোষের দিকে দৃষ্টিপাত দে। অন্যের কথা বলে নিজেকে বড়ো প্রমাণ করিস না। রুহি তোর বউ হলেও আমরা তোর বাবা-মা। আমাদের জানানো হক আছে। কেন জানাসনি? কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছিস?’
‘আমি রুহিকে কষ্ট দেইনি। উভয়কেই আমি সমান অধিকার দিয়েছি। রুহির প্রতি যদি অন্যায় করতাম, দায়িত্বহীনতার আচরণ করতাম তখন আমায় তোমরা ব্লেম করতে পারতে। এমনটা তো আমি কিছুই করিনি। জিগ্যেস করো রুহিকে।’
রুহি কান্না বন্ধ করে বিক্ষিপ্ত রাগ নিয়ে এগিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘স্বামীর ভাগ কোনো স্ত্রী দিতে পারে না। তুমি সেটাই দিয়েছো নিজ থেকে। তোমার কাছ থেকে এখন আমার একটাই চাওয়া, ডিভোর্স।’ বলেই রুহি তার কক্ষে প্রস্থান করল।
সেলিম রুহির যাবার পানে চেয়ে উঁচু গলায় বলল,
‘আমি তোমাকে কখনো ডিভোর্স দেবো না রুহি। তুমি আমার বউ, ও আমার ভালোবাসা। কাউকেই আমি ত্যাগ করে জাহান্নামে যেতে চাই না।’
রায়ান সেলিমের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘তুই কি ত্যাগ রাখবি? আমি তোকে আমার বোনের জীবন থেকে ত্যাগ করে দিবো চিরতরে। তুই জানিস, আমার সম্পর্কে তোর ধারণা রয়েছে।’
‘তোমার থ্রেটে আমি রুহিকে ছাড়ব না।’ সরস কণ্ঠে বলল।
‘দেখ, তুই।’
‘ভুল করছো তুমি।’
‘বিয়ের পর পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে গোপনে বিয়ে করে নিজেকে পাপমুক্ত রাখতে চাইছিস? কাপুরুষ।’
সেলিম এবার চটে গেল। রায়হান মির্জা রায়ানকে সরিয়ে আনলো। সেলিমের উদ্দেশ্য বলল,
‘ত্যাগ যদি তোমায় করতেই হয় দ্বিতীয় স্ত্রীকে করো। তবেই তুমি রুহিকে পাবে।’
‘কোনো গ্যারান্টি নেই যে তৃতীয় বিয়ে করবে না ও। কখনোই রুহিকে দেবো না ওর সঙ্গে।’ আঙুল তাগ কর বলল।
রায়হান মির্জা এবার ছেলের পানে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘তুমি চুপ থাকো। নিজের ভুল যখন বুঝতে পারবে সেদিন আমার মেয়েকে তুমি পাবে। তোমার আমি সুযোগ দিলাম সেলিম।’ লাস্টের কথা সেলিমের পানে চেয়ে বলল।
‘আব্বু, তুমি ঠিক করছো না।’ গম্ভীর গলায় বাবার উদ্দেশ্যে বলে।
তিনি ছেলের পানে তাকিয়ে জানায়,
‘তুমিও ঠিক কাজ করোনি রাহাকে তার পরিবাবের সবার বিরুদ্ধে এ বাড়িতে এনে? ভুলে যেও না তারাও তোমায় সুযোগ দিয়েছে।’
রায়ানের আত্মসম্মানে খুব লাগে বাবার কথাটা। রেগেমেগে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল বাহিরে।
সেলিম কিছু বলতে উদ্যোত হতেই রায়হান মির্জা ওসমান আহমেদকে দৃঢ় গলায় জানালেন,
‘আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে এক্ষুণি চলে গেলে খুশি হবো। ঐ মেয়েকে ত্যাগ করে যেদিন আমার মেয়েকে নিতে আসবে। সেদিন রুহি আপনাদের বাড়িতে যাবে। এর আগে নয়।’
ওসমান আহমেদ ছেলের জন্য নিজের সম্মান হারাতে বসেছে। বাকহারা সে। বিনাবাক্যে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্থান করলেন তারা। অরুণা বেগম চোখের পানি এবার আর ধরে রাখতে পারল না। ছেড়ে দিয়ে মেয়ের কক্ষে ছুটে এলেন। রায়হান মির্জা রাহার পানে তাকিয়ে স্বর নরম করে বলল,
‘যাও, তাদের সান্ত্বনা দেও।’
রাহা শ্বশুড়ের কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন। কয়েক কদম বাড়িয়ে থেমে ঘুরে তাকালেন। রাহা আজ গর্বিত এমন ভালো শ্বশুড়- শ্বাশুড়ি পেয়ে। তার এবং পরিবাবের দুঃখগুলো বুঝতে পেরেছে এটাই তার কাছে অনেক বেশি পাওয়া। দৃষ্টি নত রেখে নিচু স্বরে বললেন,
‘আব্বু আপনাকে ধন্যবাদ।’ এতটুকু বলেই প্রস্থান করল। রায়হান মির্জা এক পলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলো। তিনি বুঝতে পেরেছেন রাহা তাকে কেন ধন্যবাদ প্রধান করেছে। সরু নিশ্বাস ফেলে সে। আদর্শ বাবা হতে পারলেন না ছেলের ক্ষেত্রে। এটা তার জীবনের চড়ম হতাশাজনক ব্যাপার!
__
ফারিন আনমনা হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নাস্তা করে অনেক আগেই রুমে এসেছে। মেশকাত সেখান থেকেই দোকানে চলে গেছে। মাইশার আগমন হলো বলে যে কোনো সময়ে। খুব ভাব জমেছে মাইশার সঙ্গে তার। এ বাড়ির প্রতিটি মানুষ অত্যন্ত ভালো। কেবল মেশকাত ব্যতীত। শ্বাশুড়ি, বড়ো জা তারা কখনো ছোট চোখে বা কটুক্তি করে কথা বলেনি। কাজবাজ একা হাতে কাজের লোক নিয়ে বড়ো ভাবি সামলেছে। কোনো কাজ আগ্রহ পূর্বক করতে গেলে ভাবি নিষেধাজ্ঞা আরোপ লাগিয়েছে। শ্বশুড় প্রতিনিয়ত তার এবং সকলের জন্য বাহির থেকে খাবার এনেছে। প্রতিটা মানুষ কতটা বিনয়ী, শান্ত স্বভাবের। পুরো বংশের মানুষগুলো যদি এমনই হয়ে থাকে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে। তবে ডিভোর্স হবেই বা কীভাবে? এজন্য বুঝি এই বংশে ডিভোর্সের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তবে সে কী করবে? ভাবনার অন্তিম পর্যায়ে নিজেই প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু হলো। সরু প্রশ্বাস ফেলল। আদৌও কি রাহার কথাগুলো মেনে নেওয়া উচিত? তার এই শক্ত হৃদয় নরম হবার চান্স শূন্যের কোঠায়। মেশকাতকে মেনে নেয়া তার পক্ষে অসম্ভব চ্যালেঞ্জ সম্মুখীন। কিছুতেই অতীত ভুলতে পারছে না। এটাই তার জীবনের অসহায়ত্ব বড়ো দূর্বলতা!
রিংটোন বেজে উঠলো তার ফোনের। চৈতন্য ফিরে ফোনের স্ক্রিনে নজর ফেলতেই মেশকাতের নাম্বার দৃশ্যমান হলো। ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে কল রিসিভ করল,
‘হ্যালো।’
‘আমার আসতে আজ সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যার পর এক ছোট ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে যাব আমি ও তুমি। রেডি থেকো। আর হ্যাঁ, রায়ান রাহাও যাবে অনুষ্ঠানে।’
বলা শেষ হতেই কল বিচ্ছিন্ন করল মেশকাত। ফারিন কিছুটা তাচ্ছিল্য হেসে ফেলে। সে যাবে না জেনেই রাহার কথা বলেছে। এতে করে এখন নিষেধাজ্ঞা না করতে পারে। প্রতিটা মানুষের তার নিজ নিজ দুর্বলতার কাছে অসহায়। মানুষ সেই দুর্বলতায় আঘাত করতে অবস্তু।
_
আরান হোটেলে এসে সবে গা দুলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। খুব ক্লান্ত সে। রাতে একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। সকালে সেটি সাবমিট করে এখন সে ফ্রী। রাহার জন্য সে তার বাবার কোম্পানিতে জয়েন্ট হয়েছিল। এখন সে যখন নেই তাকে এই দায়িত্ব থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চায় না।
তাঁকে হয়তো পাওয়ার উপায় এখন হাতছাড়া। নিজের পরিবারের মানুষের কথা বাদ দিলে তো আর চলবে না। খুব ব্যথা লাগে হৃদয়ে, যখন সে ভাবে রাহা অন্যের কাছে রয়েছে। তীরের ন্যায় আঘাত তার বক্ষে লাগে কাঁটার চেয়ে বিষাক্ত। তবে সে এত দ্রুত হাল ছাড়বে না। পরবর্তীতে রাহার সুখ ও দুঃখের উপর নির্ভর করে তাকে পাওয়া না পাওয়া। অপেক্ষা করবে সে!
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।