#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২৪.
আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান আরম্ভ হলো বলে। মেশকাত ফারিনকে নিয়ে অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। ফারিন এক পাশে বসে বারংবার বাহিরে তাকাচ্ছে। রাহার আগমন দেখার আশায়। এক ঘন্টা হয়ে গেল। তবুও আসছে না। মেশকাত পাশে বসে মনোযোগ রেখেছে ফোনে। ফারিন বিরক্ত হচ্ছে তাকে দেখে। হতাশ হয়ে মেশকাতের পানে চেয়ে গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘আসবে না?’
মেশকাত ফারিনের প্রশ্নে এক ঝলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে বলল,
‘নাহ!’
নিমিষেই ফারিনের মনঃক্ষুণ্ন হয়ে গেল। মেশকাতের মিথ্যা বলাটা প্রকাশ পাচ্ছে। ফের কিছু বলতে যাবে এরমাঝে ফোন লক করে মেশকাত সামনের পানে তাকিয়ে বলল,
‘রায়ানদের বাড়ি ঝামেলা হয়েছে। এজন্য আজকে আসবে না। কাল আসবে।’
মনটা খচখচ করে উঠলো। রাহাকে নিয়ে কোনো প্রকার ঝামেলা হলো কি-না ভেবেই চটজলদি প্রশ্ন করল,
‘কি ঝামেলা?’
মেশকাত সেকেন্ড কয়েক বিরতি নিয়ে রুহির বিষয়ে সব খুলে বলল। আজ সকালের ঘটনা ব্যাখ্যা করল সম্পূর্ণ। ঈষৎ চিন্তামুক্ত হলো সে। পরপরই তাচ্ছিল্য হাসির দেখা মিলল তার ঠোঁটে। মেশকাত বেশ ভালো করেই জানে ফারিন এখন মনে মনে কি ভাবছে। তার মন ছোট্ট হয়ে এলো। শত হলেও বন্ধুর বোন মানে নিজের বোনের সমতুল্য। এজন্য নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। ফারিন ম্লান হেসে একটি প্রবাদ আওড়ায়,
‘আল্লাহ ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না। এতে যদি আপনাদের শিক্ষা হয়।’
মেশকাত দৃষ্টি নত রাখে। এ বিষয়ে ফারিনের সঙ্গে তর্কে জড়াতে চায় না। সে রীতিমতো আপসেট।
.
ফোনের পানে দৃষ্টি রেখে শোরগোলের মধ্যে প্রবেশ করার সময় আরান অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে একটি মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। হাতের ফোন পড়ে গেল ফ্লোরে। আরান দুঃখিত সহিত মেয়ের পানে দৃষ্টিপাত ঘটিয়ে বলল,
‘আমি একদমই স্যরি। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড বড়ো আপু।’
মেয়েটি গালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ অভিযোগ ভাব ফুটিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘ইট’স ওকে ছোট ভাইয়া।’
আরান ফোন ততক্ষণে হাতে তুলে রসিকতা ভাব কণ্ঠে ফুটিয়ে বলল,
‘আমার বাক্য আমাকে ফিরিয়ে দিলেন?’
মেয়েটি আরানের পানে চেয়ে চুলোগুলো কানের পেছনে গুঁজে মৃদু হেসে বলল,
‘এমনটা নয়। আপনি যেহেতু আমাকে বড়ো আপু বলে সম্বোধন করেছেন। তেমনি আমারও উচিত ছোট ভাই হিসেবে সম্বোধন করা।’
‘কথা যুক্তিসম্মত। আমি আরান শেখ। খুলনা নিজ বাড়ি। ‘
মেয়েটি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আরানকে সেসব ছেলেদের কাতারে ফেলল যে ছেলেরা মেয়েদের দেখলে ফ্ল্যাটিং স্বভাব বাড়িয়ে দেয়। আরান সেটি বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলল,
‘যেহেতু বড়ো আপু বলে সম্বোধন করেছি। ছোট হিসেবে নাম, পরিচয় জানতেই পারি, তা নয় কি?’
সে কিছুটা স্বস্তি পেল। বলল,
‘রাফিয়া জাহান। ইসলামবাগই আমাদের নিজ বাড়ি।’
‘ছেলের কি হন?’
‘মামাতো বোন। আপনি?’
‘আমার আব্বুর ব্যবসাহিক বন্ধু হিসেবে ইনভাটেট। আব্বু আসতে পারবে না। এজন্য আমায় আসতে হলো।’
‘ও, পড়াশোনা?’
‘সবে শেষ করে আব্বুর কোম্পনিতে জয়েন্ট করলাম।’
‘তাহলে আপনার অনুমান সঠিক। আপনি আমার চেয়ে এক দেড় বছরের ছোট হবেন।’
‘তবে আপনি কেন? তুমি করে সম্বোধন করুন।’
‘আচ্ছা।’ বলেই হেসে দেয় রাফিয়া। হঠাৎ একজন মেয়ে রাফিয়াকে ডাকতে এলো। রাফিয়া ফেসবুক আইডি আরানকে দিয়ে প্রস্থান করল। আরান রাফিয়াকে বিদায় দিয়ে পাশের একটি চেয়ারে বসল। সব কিছুর মাঝে একটু শান্তি খুঁজে পেতে চায়। যেটা তার কপালে নেই। সে রাহাকে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারছে না। একাকী এই বিয়ে বাড়িতে বোরিং অনুভব করবে ভেবে আসতে চাইছিল না। আব্বুর আদেশে এখানে আসতে হয়েছে। একাকীত্ব দূর করতে একটু মজার ছলে পরিচয় হয়েছে রাফিয়ার সঙ্গে। এছাড়া কোনো ভুল উদ্দেশ্য তার ছিল না। যথেষ্ট সুন্দরী রাফিয়া। তার স্থানে অন্যকোনো ছেলে হলে ফ্ল্যাটিং স্কিল দেখিয়ে দিতে সময় নিতো না৷ তবে তার মনে এমন আকাঙ্খা নেই।
__
রাতে রায়ান একটু দেরি করে ফিরে। রাহা খেয়ে ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিল। শ্বাশুড়িকে তার রুমে বিশ্রাম করতে দিয়ে সে এই দায়িত্ব নিয়েছে বলা যায়। আজ সারাদিন তাদের উপর থেকে কম দখল যায়নি। একমাত্র মেয়ের সংসার ভাঙতে বসেছে কোনো বাবা-মা তা সহ্য করতে পারে না৷ কান্নাকাটি করে অস্তির হয়েছিল মা-মেয়ে। কিছুক্ষণ আগে তাদের খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে। খাবার টেবিলে বেড়ে ঢেকে রেখেছে রায়ানের জন্য। এগারোটা ত্রিশ মিনিটে রায়ান বাড়িতে এসেছে। কম্পিত পায়ে উপরে উঠতে দেখে রাহা বুঝতে পারে রায়ান নেশাগ্রস্ত। সেও রায়ানের পিছু পিছু রুমে এলো। ইতিমধ্যে রায়ান শার্ট খুলতে আরম্ভ করেছে। চোখ-মুখ নেশায় বুদ। কয়েকটা বোতাম খুলে বিছানায় বসল। রাহা রায়ানকে পর্যবেক্ষণ করে নিচু স্বরে বলল,
‘আপনি খাবেন না?’
রায়ান চোখ তুলে তাকিয়ে নেশা জড়িত কণ্ঠে শুধালো,
‘নাহ! খেয়েছি। তুমি খেয়েছো?’
রাহা হ্যাঁ বলে করিডোরের নিকটে এসে একজন সার্ভেন্টকে বলে খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে দিতে। ফের রুমে আসার সঙ্গে সঙ্গে খপ করে রায়ান তার বাহু ধরে বিছানায় বসায়। দু হাঁটু ভাজ করে বসে রাহার কোলে মাথা রাখলো। পুরোপুরি স্তম্ভিত রাহা! না হয়ে উপায় নেই। এমনটা আশা করেনি। দু হাত দু পাশে বিছানার উপর রাখা। রায়ানের সংস্পর্শে রাখেনি। রায়ান তার হাত দিয়ে বা হাত আঁকড়ে ধরে কোলের উপরে রাখলো। সেকেন্ড কয়েক নিরব থেকে বড়ো নিশ্বাস ফেলে কোমল গলায় বলল,
‘সবে কলেজে উঠেছি। নতুন কলেজে প্রথম ক্লাস ছিল সেদিন। জনি, মেশকাত একই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। মাঠ পেরিয়ে ভবনে প্রবেশ করার সময় সিনিয়রদের র্যাগিংয়ের শিকার হবার পূর্বেই নিজের চোটপাট ও দাপটের কারণে মুক্ত হয়েছিলাম সেবার। যার্গিংশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আমার সঙ্গে যুক্ত হয় জুনিয়র ছেলে-মেয়েরাও। প্রতিদিনের টর্চারের হাত থেকে সবাইকে মুক্ত করেছিলাম আমি। সিনিয়রদের মধ্যে সেকেন্ড ছিল অর্পা নামের একটি মেয়ে। তার খুব ইগো হার্ট হয়েছিল আমার হিংস্র কথার কারণে। সে ক্ষেপে ছিল খুব। পরদিন আব্বুর দেয়া নতুন মোটরসাইকেলে চড়ে আনন্দে কলেজে প্রবেশ করছিলাম। এর আগের দিনের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। মাঠ তখন ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ একটি গুনার তাড়ের সঙ্গে প্রথম চাকা আঁটকে যাবার ফলে বড়ো ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমি সিটকে দেয়ালের পাশের উঁচু রড়ের উপুড় হয়ে পড়ি। বাম পাশের স্থানে রড় অর্ধ প্রবেশ করেছিল আমার দেহে। প্রচুর ব্লিডিং হয়। ঝাপসা চোখে অর্পা মেয়েটির ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসি আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। এরপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। কিডনি ড্যামেজ হয়েছিল বা পাশের। অপারেশনের মাধ্যমে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমাকে মার্ডার করার সাক্ষী ছিল কয়েকটা স্টুডেন্ট। তাদের পাঁচ বছরের শাস্তি হয়। তখন থেকেই আমি মেয়েদের খুব ঘৃণার নজরে দেখতাম। আম্মু, রুহি ব্যতীত এখন অব্ধি আমাদের বাড়িতে কাজিনদের আসাযাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আমার সঙ্গে যে এরূপ কাজ করেছে তাঁকে নিজে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আম্মু সেটা বুঝতে পেরে আমাকে ইমোশনাল টর্চার করে কথা নিয়েছিল এ বিষয়ে যেন দামাচাপা দিয়ে দেই চিরতরে, নয়তো তার মৃ’ত্যু’র জন্য আমি দায়ী থাকবো। আম্মুর কথার আগে আমার প্রতিশোধ বৃথা। তোমায় এ বাড়িতে আনার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল সব নারীজাত একই। আমি ভুল, তিনদিনে তোমায় দেখে পরিবর্তন হতে বাধ্য হয়েছে আমার ধারণা। আমি মেনে নিয়েছি। পাঁচ বছর আগে তোমার সঙ্গে করা প্রতিশোধের ফল সরূপ আমার বোন কষ্ট পাচ্ছে। হাসপাতালে থাকাকালীন আম্মুর পর আমার বোন দেখাশোনা করেছে আমায়। আমার রক্তের গ্রুপ রেয়ার ছিল। আব্বু-আম্মুর এলার্জি জড়িত সমস্যার কারণে আঠারো বছরের রুহি আমায় দু ব্যাগ রক্ত দিয়েছে। পরবর্তীতে এক মাস রুহিও বেডরেস্টে ছিল দুর্বলতার প্রভাবে। আজ সেই বোনের পীড়িত মুখশ্রী আমার হৃদয় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বক্ষে যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি বোঝাতে পারছি না কাউকে।’ ক্লেশ মিশ্রিত কথাগুলো শেষ করে রায়ান রাহার হাত আরেকটু ভালোভাবে আঁকড়ে ধরে। যেন সে আজ রাহার সঙ্গকে খুব করে চাইছে আপন করে নিতে। পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে শীতল কণ্ঠে শুধালো,
‘আমায় মাফ করো রাহা। তুমি অসন্তুষ্ট থাকলে আল্লাহ আমায় মাফ করবে না। মাফ করো রাহা।’
‘আমি আপনাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি।’ চাপা কণ্ঠে শুধালো সে।
রায়ান কথাটা শুনেই আরো জোরে আঁকড়ে ধরলো রাহাকে। এই মুহূর্তে তার শান্তির স্থান এখানেই। রাহা ডান হাত ধীরে ধীরে রায়ানের মাথায় রাখল। রায়ানের অসহায়ত্ব অবস্থায় সান্ত্বনা দিতে চাইছে। স্ত্রী হিসেবে এতটুকু তার কর্তব্য। ঠান্ডার মাঝে ফ্লোরে বসে আছে এজন্য রাহা শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ভবিষ্যতে মদ্যপান না করার অনুরোধ রইলো। বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ুন।’
‘ঘুম পাড়িয়ে দেও।’ রায়ান মুখ তুলে বাচ্চাদের মতো আবদার রাখল রাহার নিকট। তার আদল এখন নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো স্বচ্ছ নরম।
রাহা দ্বিধায় পড়ে। এত দ্রুত রায়ানকে তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপাতত বিষয়টি সামলে নেয়। বলে,
‘উঠুন। ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে আসুন। মুখ থেকে মদের বিশ্রীরকম গন্ধ আসছে।’
‘ওকে।’ মাথা ঝুলিয়ে রাহার আদেশ অনুযায়ী ফ্রেশ হয়ে শার্ট-প্যান্ট পাল্টে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। রাহা না চাইতেও লাইট অফ করে টেবিল লাইট অন করে রায়ানের পাশে এসে বসে। হাত গুটিয়ে কিঞ্চিৎ পাশে সরে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘আপনি ঘুমান। আমি পাশেই আছি।’
কথাটা শুনে রায়ান রাহার পা ধরে টেনে বালিশে মাথা ঠেকায়। আকস্মিকতায় হকচকিয়ে উঠে সে। রায়ান মাথা উঁচু করে রাহার কপালে আলতো চুমু দিলো। এরপর রাহার বক্ষে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। আজ যেন তার শান্তির স্থান এখানেই নিবদ্ধ। রাহা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শুধু অপেক্ষা করছে রায়ানের ঘুমের। তবে রায়ানের ছোঁয়ায় আজ সে কেঁপে উঠেছে। সর্বত্র অঙ্গ তার শিউরে উঠেছে। প্রথম কোনো পুরুষের সংস্পর্শ পেয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। নিজেকে ধাতস্থ করে অপর হাত দিয়ে টেবিল লাইট অফ করে দিলো। ইতিমধ্যে নেশারঝোঁকে রায়ান নিদ্রায় কাবু। তবে এই মুহূর্তে তার কখন ঘুম আসবে কে জানে?
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২৫.
সকাল সকাল রায়ানকে বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে রাহা বিষয়টি তেমন আমলে নিলো না। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল ও শাড়ির আঁচল ঠিক করছিল। রায়ান চোখ তুলে রাহার পানে দৃষ্টি ফেলল। হালকা ভারী গলায় জানতে চাইলো,
‘কালকে বেশি পাগলামি করেছিলাম তোমার সঙ্গে?’
এরূপ প্রশ্নে মিরর থেকে দৃষ্টি ফেলে রায়ানের উপর সে। রাতে সরে যাবার বহু চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রায়ান তাঁকে খুব জোরে আঁকড়ে রেখেছে বাহুডোরে। পরিশেষে মধ্যরাতে উল্টোদিক ফিরে শোবার পর রায়ান পেছন থেকে গভীরভাবে চুম্বন করে ঘাড়ে। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ হতেই রাহার শরীর শিউরে উঠে অব্যক্ত অনুভূতিতে। এখনো লালচে দাগ রয়েছে। রাহা দ্বিধাবোধ ফেলে ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে উল্টোদিক ফিরে দাঁড়ায়। রায়ান লালচে দাগ দেখে বিস্মিত এবং সংকোচ বোধ করে ব্রীড়িত হয়। রায়ানের জ্ঞান থাকা অবস্থায় সব স্মরণে ছিল। তবে রাতের কথা মনে নেই। ঝেড়ে কাশলেন সে হালকা। বলল,
‘হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ছিলাম।’
‘তাহলে ড্রিঙ্ক করা ছেড়ে দেন।’ চুল পেছনে নিয়ে সোজাসাপটা জবাব দেয়। রায়ান ফের নিচু স্বরে জানতে চাইলো,
‘শুধু কী এতটুকুই হয়েছিল?’
রাহা ফের তাকালো। লজ্জিত তার মুখশ্রীতে জড়ো হলো। এর চেয়ে বেশিকিছু যে হয়নি লোকটার কি কিছুই মনে নেই? বিড়বিড় করল সে। গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
‘নাহ!’
সে এবার কিছু না বলে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হয়। রাহা দ্রুত আঁচল ঠিক করে চুল বেঁধে নিচে এলো।
খাবার টেবিলে এখন সকলে উপস্থিত। রুহির নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করেছে। ফুলা ফুলা নয়ন দু’টি দেখে রায়ানের বক্ষে মোচড় দেয়। বোনের এই দুঃখ কি দিয়ে ঘুচাবে বুঝে উঠতে পারছে না। রায়ান নীরব পরিবেশ স্বাভাবিক করতে গম্ভীর গলায় বলল,
‘দুপুরে আসবো না৷ মিরাজের বউ আনতে যাব আমি। কালকে রিসিপশনে সবাই যাচ্ছি। কারো নিষেধ শুনতে যেন না হয়।’ বলা শেষ করেই টেবিল ছাড়ল সে। রুহি বুঝতে পারে কথাটা গুরুত্ব দিয়ে ঠিক কার উদ্দেশ্যে বলেছে। তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। একটি পরোটা সম্পূর্ণ খেয়ে টেবিল ছাড়ল। অরুণা বেগমের চোখ পানিতে ছলছল করছে। রাহা সেটি দেখে তার হাতে হাত রাখল। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে চোখ মুছল।
__
সেলিম অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বিছানারত এখন অব্দি। সাবিহা গেঞ্জি ও প্লাজু পরিহিত জানালার কার্নিশে বসে কফি খাচ্ছে। হাতে তার ফোন। ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি। সম্ভব সে কারো সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। আধো আধো চোখ মেলে সাবিহার এরূপ মুখশ্রী দেখে ঘুমন্ত গলায় ডাক দিলো। দ্রুত ফোন লক করে উঠে এসে পাশে বসলো। মৃদু হেসে বলল,
‘মর্নিং জান।’
‘মর্নিং কলিজা।’
‘আজকে কোথায় যাচ্ছি বেড়াতে বলো?’
‘তুমি যেথায় বলবে।’ আদুরে কণ্ঠে শুধালো।
‘চলো নন্দনে ঘুরে আসি।’
‘নো প্রবলেম। ঢাকা যতদিন আছি তুমি যেখানে বলবে যাব।’
খুশিতে গলা জড়িয়ে ধরলো সাবিহা। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছে তারা হানিমুনে। এটা ছিল সাবিহার ইচ্ছে। যেটা পূরণ করার সর্বত্র চেষ্টায় আছে সেলিম। সাবিহাকে আদর আদান-প্রদান করে ওয়াশরুমে এলো। ঝর্ণা ছেড়ে চোখ বন্ধ করার পর রুহির কথা স্মরন হয়। রুহির বাবা এবং রায়ানের কথাগুলো ভেবে তার মাথায় রাগ চওড়া হয়। তবে সে রুহিকে ছাড়বে না কিছুতেই আবার সাবিহাকেও ত্যাগ করতে পারবে না। মন মস্তিষ্ক দু প্রান্তেই স্থির দু’টি মানুষের জন্য।
.
দুপুরে রায়ান ও মেশকাত সে বাড়িতে এসে খেয়েই চলে আসে। বউ আনার পর্বে থাকতে পারে না। রুহির বিষয়টি নিয়ে গাড়িতে বসে আলাপ করছে। হুট করে কাল রাতে অল্পস্বল্প বিষয় জানাতেই মেশকাত কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকায়। রায়ান তার চাহনি উপেক্ষা না করে ছোট্ট করে বলে,
‘হোয়াট?’
মেশকাত বিস্ময়কর ভাব নিয়ে বলল,
‘রাহার স্থানে ফারিন হলে ওভার রিয়েক্ট করতো। আমাকে তো সহ্যই করতে পারে না। পরে দেখা গেল দাগের স্থানে কামড় দিয়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছে আমায়।’
‘নম্রতা বজায় রেখে শান্ত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবি।’
‘পারি না। মাথা গরম করে দেয় সব সময় এটা ওটা বলে।’
‘বাদ দে, কথায় আছে মানিয়ে নিতে পারলে জীবন সুন্দর।’
মেশকাত ফের বিস্মিত চোখে তাকালো। বলল,
‘তুই বলছিস এটা?’
ম্লাস হাসে রায়ান। শুধালো,
‘অতীতের ভুলগুলো সব ফুল হয়ে জড়ে পড়ুক আমার অর্ধাঙ্গিনীর উপর।’
‘কত্ত চেঞ্জ!’ মেয়েদের মতো এবার গালে হাত রেখে বলল। রায়ান মৃদু হাসে মেশকাতকে এত অবাক হতে দেখে। মানুষ পরিবর্তন হয়, তবে তার মধ্যকার পরিবর্তন যেন জীবনকে নতুন সূচনা পর্ব তৈরী করার আহবান জানাচ্ছে। সে মনে মনে খুশি হয়।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘ডংভং টেক্সটাইলে।’
‘সেখানে কেন?’
‘কাজ আছে।’
বলতে বলতে গলির মোড় পেরিয়ে প্রবেশ করার সময় হঠাৎ মাঝপথে গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো রায়ান। এমতাবস্থায় মেশকাত থতমত খেয়ে রায়ানের পানে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বে রাগান্বিত আদল দেখে থেমে যায়। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখে সেলিম একটি মেয়েকে নিয়ে নন্দন পার্কের ভেতরে প্রবেশ করছে। রাস্তার ঐ পাড়ে ছিল পার্কটি। সেখান থেকেই রায়ানের দৃষ্টি পড়ে। সেলিমকে দেখে মেশকাতের চিনতে অসুবিধা হয়না। সঙ্গে যে মেয়েটি রয়েছে এটা যে তার দ্বিতীয় বউ সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়না মেশকাতের। সে রায়ানকে শান্ত করার জন্য বলল,
‘চল এখান থেকে।’
সেলিম তাঁদের দৃষ্টির বাহিরে যেতেই রায়ান চোখ সরিয়ে নেয়। স্ট্রেয়ারিংয়ে সজোরে ঘুষি দিলো। তার বোনের জীবন ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে ফুর্তিতে মেতে আছে এটা কীভাবে মেনে নিবে সে?
‘মেয়েটা ভালো না। বউ থাকা স্বত্বেও কীভাবে সেলিমকে বিয়ে করে? খোঁজখবর নেবার ব্যবস্থা কর।’
‘অলরেডি ডান।’ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল।
‘গাড়ি স্টার্ট দে।’
রায়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জায়গা ছাড়ল। রাগে ফুঁসছে ভেতরে ভেতরে তখনো। মেশকাত সচক্ষে দেখে কোনো প্রকার কথা বলল না। সে নিজেও ক্ষোভিত!
..
রাত এখন গভীর হবার উপক্রম। মেশকাত এখনো বাড়ি ফিরেনি।অমনোযোগী হয়ে ফারিন বসে রয়েছে। সে উদাসীন। তার এবং মেশকাতের সম্পর্ক নিয়ে বেশ চিন্তিত। সে কিছুতেই পারছে না মনের কথা শুনতে, না পারছে ডিভোর্সের ব্যাপার ভুলে যেতে। এত সহজেই হেরে যাবে? এটা কীভাবে মানবে সে? দরজা খোলার শব্দে মনোযোগ নষ্ট হলো তার। মেশকাত ফিরেছে। হাতে তার একটি ব্যাগ দেখতে পেল।
চোখ সরিয়ে কাজের বাহানা খুঁজতে লাগলো। তখনই মেশকাত এগিয়ে এসে ব্যাগটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা তোমার জন্য। কাল রিসিপশনে পড়ে যাবে।’
ফারিন কণ্ঠে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল,
‘এমন নয় যে আমার পরনের কাপড়চোপড় নেই।’
ফারিনের ত্যাড়া কথা শুনে মেশকাতও কঠোর গলায় বলল,
‘জানতে চাইনি। দিয়েছি পড়বে, না পড়লে জোর করে পড়াবো।’
ফারিন চোখ পাকিয়ে তাকায়। মেশকাত হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরে আসে। তবে সে বুঝতে পেরে উল্টোদিকে ফিরে শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
‘তোমার চাহনি উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমি রাখি। যতদিন না স্বাভাবিক হচ্ছো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে, তোমাদের বাড়িতে যাবার কথা ভুলে যাও।’
ফারিনের এবার রাগ হয় না। অসহায়ত্ব ভাব চলে আসে ভেতরে। একে সে দোটানায় পড়ে জ্বলছে-পুড়ছে। অন্যদিকে মেশকাতের অধিকার খাটানো কথাগুলো শুনে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে। কী করবে সে? রাহা হয়তো দিব্যি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এই মেয়েটা পারেও বটে! ধৈর্য্য শক্তি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আজও কথা হয়েছিল। তাকে বুঝিয়েছে। বলেছে তার বাড়ির পরিস্থিতির কথা। পাঁচ বছরে কতটা পরিবর্তন হয়েছে রাহা। ফোনে কথা বলেই অবাক হয়েছে কেবল। বাস্তবে পুনরায় দেখা হলে সে হয়তো চিনতেই পারবে না এটা তার বাল্যকালের বান্ধবী রাহা। ফারিনের নীরবতা দেখে ঘুরে তাকালো। এমন শান্তভাবে বসে রয়েছে তর্কবিতর্ক ব্যতীত খটকা লাগছে। ফারিন ভাবনায় কাতর। ফিরে তাকিয়ে ফারিনকে স্বাভাবিক করার জন্য আদেশ দিলো,
‘আমায় এক গ্লাস পানি দেও ফারিন।’
ফারিন ব্যাগটি বিছানায় রেখে টেবিল থেকে জগ গ্লাস এনে পাশের টেবিলে রেখে বিনাবাক্যে সরে গেল। মেশকাত কেবল ফারিনের মুখশ্রী ও ভাবভঙ্গি দেখছে। হঠাৎ করে কি হলো বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার৷ চিল্লাপাল্লাও করছে না। কেমন রহস্যময় লাগছে!
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি