#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২৬.
‘আমি সেলিমকে ভালোবাসি না এটা সত্যি। সাহেল আমাকে ভালোবেসে ধোঁকা দিয়েছে। দেড়মাসের প্রেগন্যান্ট আমি। এটা শুনে সাহেল আমাকে ত্যাগ করেছে। এখন আমি কীভাবে সমাজে মুখ দেখাব? এই ভেবে আমি সেলিমকে বিয়ে করি। ওর বিয়ের প্রপোজাল আমি রিজেক্ট করতে পারিনি এসব ভেবে।’ সাবিহা তার বান্ধবী মালিহাকে কথাগুলো বলছিল কলে। নন্দন থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে তাদের। সেলিম খাবার আনতে বাহিরে গিয়েছে। এই সুযোগে সে বান্ধবীকে কল দিয়েছে। একই অফিসে কাজ করার সুবাদে মালিহার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। দেড় বছরের পরিচিত তারা। সাবিহার মা নেই। বাবা কিছুদিন আগেই ক্যান্সারে মৃত্যু বরন করেছে। নিজের দায়িত্ব এখন নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে। এরমধ্যে সাহেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে তাদের। বাচ্চার কথা জানানোর পর সাবিহাকে ত্যাগ করেছেন সাহেল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঢাকা থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। একা হয়ে পড়ে সাবিহা। তার মধ্যে বেড়ে উঠা নিষ্পাপ প্রাণকে অস্বীকার করতে পারবে না বিধায় সেলিম বিবাহিত জেনেও বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। এক বছর যাবত সেলিম তার পিছু পড়েছিল। সেলিমের নিজ অফিসের বেতনভোগী কর্মচারী ছিল সাবিহা। ধীরে ধীরে ভালোলাগা থেকে ভালোবেসে ফেলে সাবিহাকে। গোপনে গোপনে সাবিহাকে বার্তা আদানপ্রদান করতো। তবে তেমন রেসপন্স পেতো না। বিয়ের প্রস্তাব দেবার ফলে সাবিহা রাজি হওয়ায় স্ত্রীর মর্যাদা দেয় সাবিহাকে। এই সকল বিষয় জানতো মালিহা। তবুও কাউকে ঠকিয়ে বিয়ে করা অন্যায়। যেটা মালিহা বারংবার বুঝিয়েছে। বুঝতে চাইছে না সে। মালিহা উদ্বিগ্ন হয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘সেলিমকে সব জানিয়ে দে। এত বড়ো অন্যায় করিস না।’
‘অসম্ভব। তুই যদি ওঁকে জানিয়ে দিস আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে।’
‘তোর ভালোর জন্য বলছি। পরে যখন সেলিম তোকে ত্যাগ করবে, কোথাও মুখ দেখাতে পারবি না সাবিহা। আর সত্য চাপা থাকে না।’
‘তুই বরং আমার জন্য দোয়া কর। রাখছি।’ বলেই দ্রুত লাইন বিচ্ছিন্ন করল। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা বলছিল। দরজা খোলার শব্দে ভেতরে এসে দেখে সেলিম এসেছে। হাত থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে খাবার সার্ভ করে খেতে বসলো। নুন্যতম অনুতপ্ত বোধ নেই সাবিহার মনে। সে এখন নিজের স্বার্থটুকু ধরে রেখেছে।
__
রাহা রুহিকে একটি শাড়ী দিতে এসেছে যেটা রায়ান কিনে এনেছে তার এবং রাহার জন্যও। একই রংয়ের শাড়ী। রুহি ছোট্ট গোল একুরিয়ামের সামনে বসে মাছ দেখছে এক ধ্যানে। তাকে অন্যমনস্ক দেখে রাহা ডাক দিয়ে পাশে বসে। রুহি রাহার উপস্থিতি টের পেয়ে নড়েচড়ে বসলো। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু বলবে?’
‘হ্যাঁ! এটা তোমার ভাইয়া এনেছে। কাল রিসিপশনে পড়ে যাবে। আমার শাড়ীও তোমার মতো সেইম রংয়ের।’
‘হঠাৎ….?’
‘মন মতলবি মানুষ। কখন কি করে জানিয়ে করে না সে।’
সরস কণ্ঠে শুধালো রাহা।
মলিন চোখে শাড়ীর পানে তাকায়। রাহা কিছুটা আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘সব কিছু নষ্ট করার উপায় রয়েছে। তুমি যদি তাকে মন থেকে ত্যাগ করতে চাও, আগে মুভ অন করো। যে তোমাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকেও তুমি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারো।’
‘সেলিম আমায় ত্যাগ করতে চায় না। কেন?’
‘মনের কথা, মুখের কথা এক নয়। হয়তো চায় না, হয়তো চায়। তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকবে।’
‘তোমার মতো? তুমি যেমন চেয়েছো ভাইয়ার সাথে সংসার করার। আমারও কি উচিত হবে সংসার ভেঙে দেয়া?’
‘নিজেকে প্রশ্ন করো। কাল আমি তোমার পরিবর্তন দেখতে চাই। তোমার যদি অনুপ্রেরণা প্রয়োজন হয়। কেবল আমায় দেখবে। ব্যস!’
এতটুকু বলেই রাহা প্রস্থান করল। রুম থেকে বেরোতেই রায়ান পাশে সরে গেল। রাহা তাকে দেখতে পেল না। আড়াল থেকে শুধু দেখতে চেয়েছিল রুহি শাড়ীটি গ্রহণ করে নাকি রিজেক্ট। তবে রাহার মোটিভেটেট কথাগুলো শুনে তার ভীষণ ভালো লাগে, আবার দুঃখ হয়। রুহির জন্য নয়, রাহার জন্য। পাঁচ বছর কতোই না ট্রমার মধ্যে ছিল। ঐ সময় কার পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে নিজের মধ্যে অনুতপ্ত অপরাধী বোধ জেগে উঠছে। সে নৈশব্দে জায়গা ছাড়ল।
রুহির শাড়ীর উপর হাত বুলিয়ে রাহার বলা কথাগুলল আওড়াচ্ছে। পাঁচ বছরের ট্রমা থেকে যদি সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে, তবে কেন সে নিজেকে একজন অভদ্র লোকের থেকে মুক্ত করতে পারবে না? নিজের ভেতরে সাহস সঞ্চয় হয় এখন তার। বড়ো বড়ো শ্বাস নিলো বার-বার।
_
‘হ্যালো মি.ছোট ভাই ঘুম?’
ফেসবুক থেকে এরূপ বার্তা পেয়ে আরানের বুঝতে অসুবিধা হলো না টেক্সটটি কার ছিল। সবে বিছানায় শুয়েছে খাবার খেয়ে। ফোন হাতে নেবার পূর্বেই টোন বাজলো। আরান পাল্টা উত্তর দেয় রাফিয়াকে।
‘ঘুমাতে দিলেন কোথায় বড়ো আপু। মেসেজ দিয়ে জাগিয়ে দিলেন।’
খোঁচা দিয়ে টেক্সট দেবার ফলে রাফিয়া হেসে দেয়। লিখে,
‘কল ব্যতীত টেক্সটে কারো ঘুম ভাঙে জানা ছিল না এমনটা। এখন এই ভুলের শাস্তি কীভাবে ঘুচবে?’
‘ভয়েসে গান গেয়ে শুনালে ঘুচবে। আপনি তো আবার গান টান পারেন না।’ ফের পিঞ্চ মেরে কথা বলায় রাফিয়া কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গান গেয়ে তবেই দম নেয়। লাস্টে লিখে দেয়,
‘এবার ঘুম যান ছোট ভাই।’
‘ভয়েস কার ছিল?’
‘একটা মেয়ের।’
‘মেয়েটাকে বলুন গান ও ভয়েস চমৎকার ছিল।’
রাফিয়া মুচকি হাসে। লিখে,
‘আচ্ছা বলে দিবো। আর কিছু বলতে হবে?’
‘তাকে বলুন তার ছোট ভাই ঘুমাবে। সেও যেন ঘুমায়।’
‘বলে দিবো। তুমিও ঘুমাও, শুভ রাত্রি।’
‘সেইম টু ইউ…’ এতটুকু লিখেই ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। চোখ বন্ধ করতেই রাহার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠলো। রাত বারোটার নিকট দেখে কল দিতে চেয়েও দেয় না। তিনদিন হলো দেখা হয়না রাহার সঙ্গে। মনটা তার ব্যাকুলতায় বিষণ্ণ। বড়ো নিশ্বাস টেনে চোখের পাতা মিলিয়ে নিলো।
_
পরদিন সকালে সাবিহা সেলিম ঘুম থেকে উঠার পূর্বেই ফার্মেসী থেকে মেডিসিন নিয়ে এসেছে এবরশনের জন্য। রাতের মধ্যেই তার মন পরিবর্তন হয়েছে। সেলিমের এত এত ভালোবাসা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইছে না। ছোট্ট একটা জানের জন্য নিজের ভবিষ্যত অন্ধকারে ঠেলে দিবে না। সেলিমের সঙ্গেই বাকি জীবনটা অতিবাহিত করতে চায়।
ঔষুধ এনে সাবধানতা অবলম্বন করে ভেতরে প্রবেশ করে। খাবার খাওয়ার পর খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। লুকিয়ে রেখে সেলিমকে খুব আদুরে কণ্ঠে ডাকতে লাগলো। প্রিয়তমা স্ত্রীর ডাকে ঘুমন্ত গলায় সাড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট করে আধো আধো কণ্ঠে বলল,’ভালোবাসি বউ।’ এত সুন্দর ভাবে ভালোবাসার কথা শুনে সাবিহার মায়া হয়। চোখ বন্ধ করল, যে তাকে ভালোবেসে বিয়ের করেছে। তাকেই কি-না ধোঁকা দিয়ে বসে আছে। মনে মনে ভাবে সেও ধোঁকা পেয়েছে অন্যের কাছ থেকে। তখন তো তার কোনো দোষ ছিল না। মন-প্রাণ সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে ভালোবেসেছিল। পরিশেষে ধোঁকাই মিলল। কী ভুল ছিল তার? নিজের মধ্যে প্রশ্নের দলা ঘুরপাক খাচ্ছে। কান্না এসে আঁটকে আছে গলার মাঝখানটায়। সরু নিশ্বাস ত্যাগ করে চোখ বন্ধ করে নিলো সে।
_____
রায়ান ও মেশকাত সামনে কিছু চিত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। এগুলো সব সাবিহার অতীতের চিহ্ন, যেগুলো ডিটেকটিভের মাধ্যমে উদ্ধার করেছে।
রায়ান তাচ্ছিল্য হাসে। মেশকাত রায়ানের হাসি উপেক্ষা করে না। বলে,
‘সেলিমকে জানাবি?’
‘একদম না। সত্য কখনো চাপা থাকে না। সেলিম যেদিন নিজ থেকে জানবে। খেলা তখন স্টার্ট হবে।’
মেশকাত মুখ মলিন করে ফেলল৷ মনে উঠে তার অতীতের অপকর্মের কথা। যেটা ফারিন পরিবারের সামনে খোলাসা করতে চায়। সে আনমনা হয়ে ভাবছে এই বিষয়ে। রায়ান দৃঢ় গলায় ডাক দেয়,
‘তুই কোথায় হারিয়েছিস মেশকাত?’
‘অতীতে।’
‘সবাইকে বলে দে। ক্ষমা চেয়ে নিবি। ফারিনও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
‘ফারিন কেমন পরিবর্তন হয়েছে। তেমন কথা বলে না। সব বিষয় কেমন এড়িয়ে যায়।’
‘আরো সময় প্রয়োজন ওর। তাড়াহুড়ো করিস না কোনো বিষয়ে।’
‘রুহিকে জানাবি?’
‘অবশ্যই। একজন চিটারের জন্য নিজেকে কেন কষ্ট দিবে।’
‘বলিস। রাতে রিসিপশনে যাবে?’
রায়ান নিরুত্তর। রাহার যাবার গ্যারান্টি দিতে পারলেও বাকিদের কথা সে জানে না। এজন্য এ বিষয়ে নিশ্চুপ।
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২৭.
রাতে বিয়ের রিসিপশনে রায়ান, রাহা ও রুহি এসেছে। এই প্রান্তে মেশকাত, ফারিনও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে। আজ রুহিকে বেশখানিকটা পরিবর্তন দেখাচ্ছে। ভাবি, ননদের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বপূর্ন। মেশকাত আজ ফারিনকে সঙ্গে নিয়েই তাদের সামনে এসেছে। এতদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে সচক্ষে দেখে আবেগী হয়ে পড়ে দু’জন। রায়ান, মেশকাত অন্য স্থানে সরে এলো তাদের একাকী রেখে। রুহিও নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নতুন কনের কাছে এসে পাশে বসে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। ফারিন রাহাকে জড়িয়ে ধরে। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘অনেকদিন পর তোকে দেখলাম। কত পরিবর্তন তুই।’
রাহা ফারিনের পিঠে হাত রেখে কোমল গলায় বলল,
‘তুই নিজেও পরিবর্তন।’
ফারিন ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে টেনে পাশের চেয়ারে বসাল এবং নিজেও আসন গ্রহণ করল।
‘তুই সত্যি ভালো আছিস?’ ফারিনের প্রশ্নে রাহা মৃদু হেসে উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ, তুই?’
ফারিনের মুখ মলিন। শান্ত ভাবে ছোট করে বলল,
‘হুম।’
রাহা বান্ধবীর উদাসীনতা বুঝতে পেরে বড়ো নিশ্বাস টানে। ফারিনের হাতে হাত রেখে শুধায়,
‘আমার জীবনের একটাই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল যেটা পাঁচ বছর পূর্বে নিয়েছিলাম। এখন যেই সিদ্ধান্তে আছি আলহামদুলিল্লাহ! ভবিষ্যতে আফসোস হবে না। তুই নিজেকে ঘুছিয়ে নে মেশকাতের সঙ্গে। মেশকাত যদি বিন্দু পরিমাণ চেষ্টা করে, তুই কেন পারবি না?’
‘মন মানছে না। চেষ্টা করছি। এমন নয় যে করছি না।’
‘চেষ্টাই সব এটা মনে রাখবি। আর একটা কথা। রায়ান আগের থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। মেশকাতের মধ্যেও আমি পরিবর্তন দেখেছি। এখন পরিবর্তন আনার পালা তোর।’
‘আই উইল ট্রাই ইট।’ ম্লান কণ্ঠে বলল।
‘ফাইন।’
‘তোকে খুব মিস করেছি পাঁচ বছরে রাহা।’ শক্ত করে হাত ধরে বলল ফারিন।
‘আমিও প্রতিনিয়তে করি, করছি, করব।’ পেছন থেকে আরান কথাটা বললে দুই চমকে উঠে ঘুরে তাকায়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে দু’জনে। তাদের আহাম্মক চাহনি উপেক্ষা করে আরান মুচকি হাসি প্রধান করে এগিয়ে এসে সামনের চেয়ার টেনে বসল। রাহা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘তুইও গেস্ট?’
‘অবশ্যই। ওনি কি ফারিন আপু?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে ফারিনের দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো রাহা।
‘আপু, বিগ ফ্যান আমি আপনার। অটোগ্রাফ প্লিজ!’ দুষ্টুমি করে নিজের ফোনটি এগিয়ে দিলো ফারিনের দিকে। অপরিচিত হয়ে এভাবে ফাজলামো করছে দেখে ফারিন আরো বেশখানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। রাহা চোখ পাকিয়ে তাকায় বলে,
‘চুপ।’
আরান হেসে বলল,
‘স্যরি, মজা করছিলাম। আপু আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে।’
ফারিন মৃদু হাসে। জানতে চায়,
‘ও কি সেই আরান শেখ?’
‘হুম।’
‘তুমি তো পিচ্চি। বয়স হয়নি তো বিয়ে করার।’ হেসে বলল।
‘দু’জন বান্ধবী যে এক শিকড়ের বোঝা গেল এই মুহূর্তে।’ মুখ ভার করে বলল আরান।
‘স্যরি, আসলে এভাবে বলতে চাইনি।’ বলেই ফিক করে হেসে দেয়।
‘ইট’স ওকে। আজীবন চিরকুমার হয়ে থাকব। পিচ্চি বয়সে কুমারী তো আর পাব না।’
‘তা কেন হবে? পাবে। বাট আরো বড়ো হও।’ বলে এবারও ঠোঁট টিপে হাসে ফারিন। রাহা নিজেও হেসে দেয়। হাসিমাখা মুখে ফারিনকে থামতে বলে রাহা। তাদের এই কথোপকথনের দৃশ্য চোখ এড়ায়নি রায়ান, মেশকাতের। তবে তারা শান্ত। বিন্দুমাত্র ক্ষুব্ধ ভাব নেই মুখশ্রীতে। সময়ের পরিবর্তনে এখন আরানকে নিয়ে তাদের মনে কোনো সংকোচ বোধও নেই। নিজেদের মতো সময় অতিবাহিত করার জন্য তিনজনকে একাকী ছেড়ে দেয়। পরিশেষে যোগ হয় রুহিও। আরানের দুষ্টুমি গুলো তাকেও বেশ আনন্দ দিচ্ছে। সর্বশেষে যুক্ত হয় রাফিয়া। আরানের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে সকলের সঙ্গে বেশ আনন্দিত। তাঁদের আড্ডা প্রায় জমে উঠেছে। এরিমধ্য রায়হান মির্জার কল এলো রায়ানের ফোনে। রিসিভ করার পর এক তৃপ্তিময় হাসির রেখা দেখা গেল তার ঠোঁটে। কল কেটে তাচ্ছিল্য হাসল। মেশকাত উৎসুকভাব দেখছে। প্রশ্ন ছুঁড়ার পর্বেই রায়ান ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,
‘সেলিম ইজ ব্যাক।’
মেশকাতের মুখশ্রীতে এবার একই আফা দেখা গেল। যেটা এতক্ষণ রায়ানের মুখশ্রীতে স্পষ্ট ছিল।
__
এবরশন পিল সেবনের পর সাবিহার মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ব্লিডিং শুরু হয়। এতটাই গভীর ভাবে অসুস্থ হয়ে যায় শেষে সেলিম তাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। সামান্য সুস্থ হবার পর বেডে সিফট করা হয় সাবিহাকে। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সেলিম জানতে পারে সাবিহা দেড়মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। কিন্তু তাদের বিয়ে হয়েছিল কেবল পনেরদিন হবে। সেলিম বেশ আহত হয় বিষয়টি শুনে। কেবিনে প্রবেশ করার পর শোয়া অবস্থায় সাবিহাকে হাউমাউ করে কান্না করতে দেখে নিরাশ নীরব হয়ে পাশে বসে। সে পুরোপুরি হতবিহ্বল এই ঘটনায়। মানসিক অবস্থা বেগতিক। সাবিহা ধীরেধীরে ডান হাত দিয়ে সেলিমের বাহু স্পর্শ করতেই আস্তেধীরে হাত সরিয়ে দেয় সে। করুন চোখেমুখে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে শুধালো,
‘কেন সাবিহা? কেন মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলে? কে ছিল সে?’
সাবিহা কান্নারত কণ্ঠে অপরাধ বোধ নিয়ে বলল,
‘সাহেল আমায় ধোঁকা দিয়েছে।’
‘এজন্য তুমি আমাকে ধোঁকা দিলে?’
অঝোরে অশ্রুপাত হচ্ছে আঁখি পল্লব বেয়ে সাবিহার। ভাষাহীন সে!
‘দোষ আমার। আমি ঠকিয়েছি রুহিকে। আল্লাহ তার বিচার করেছে।’ বলেই ফোঁপাতে আরম্ভ করে সেলিম। সাবিহা ফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
‘আমায় ক্ষমা করে দেও সেলিম। প্লিজ আমাকে ত্যাগ কোরো না। সামান্য একটু স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তোমার পাশে রেখে দেও চিরজীবন। দয়া করো সেলিম।’
‘তুমি আমায় মাফ করো। পারব না আমি। পারব না।’ বলতে বলতে সেলিম প্রস্থান করল। সাহিবা এই মুহূর্তে উঠে বসার পর্যায়ে নেই। কেবল শুয়ে থেকেই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কান্নার মাত্রা আরো বেড়েছে।
সেলিম তৎক্ষনাৎ ছুটে আসে মির্জা ভবনে। রুহিকে চেচিয়ে ডেকে ক্ষমা প্রাথনা করতে থাকে। রায়হান মির্জা দারোয়ান দিয়ে বের করে দেয় দরজার বাহিরে। বাহির থেকেই চেঁচাচ্ছে সেলিম। সে কি নিষ্ঠুরতম সুর তার। অবস্থা বেগতিক দেখে রায়ান বাড়িতে ফিরে এসেছে। গেটের সামনেই সেলিমকে করুণ অবস্থায় দেখে রাহা, রুহি আৎকে উঠে। গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করেই গেট লাগিয়ে দেয়া হয়। সেলিম খুব সজোরে ঘুষি দিয়ে করাঘাত করছে ভেতরে যাবার জন্য। রুহির সঙ্গে কথা বলতে চায় সে। রায়ান ক্ষিপ্ত হয়ে সকলকে সাবিহার বিষয়টি তুলে ধরে। রুহির মন রীতিমতো শক্ত হয়েগেছে। সেলিমের করুণ অবস্থা তার মন ছুঁইছে না এবার আর। শক্তপোক্ত কণ্ঠে রুহি শুধালো,
‘তাকে ভেতরে ডাকো আব্বু। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
রায়ান উদ্বিগ্ন হয়ে কিছু বলার পূর্বেই রাহা হাত ধরে ফেলে। রায়ান তার পানে তাকাতেই চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে। রাহার ইশারায় সে নিজেকে ধাতস্থ করে। রাহা এগিয়ে এসে শ্বশুরকে অনুরোধ স্বরে বলে,
‘বাবা তাকে ভেতরে আসতে দিন। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলুক।’
তিনি বিদ্রোহ করল না৷ দারোয়ানকে দরজা খুলে দেবার নির্দেশ দিলো। সেলিম যেন এক মুহূর্তেই জীবনের আশার আলো খুঁজে পেল সময় বিলম্ব করল না। খোলা দরজায় ছুটেই রুহির সামনাসামনি এসে দাঁড়াল।
নিজের অপরাধ বোধ নিয়ে অসহায় স্বরে বলল,
‘আমি ভুল করেছি রুহি। তোমার কথা শুনিনি। আমাকে কী ক্ষমা করা যায় না? আমরা কী আগের মতো হতে পারি না? ফিরে যেতে পারি না আগের সুন্দর সাজানো সংসারে?’ সেলিমের টলমলানো অশ্রুসিক্ত চাহনি। আকুতিভরা কণ্ঠে বলা কথাগুলো রুহির হৃদয় স্পর্শ করতে পারল না। খুব কঠিনতম উঁচু গলায় বলল,
‘সেদিনই আপনি আমার জীবন থেকে চলে গেছেন, যেদিন আপনি অন্যকাউকে আপনার জীবনে জড়িয়েছেন। ভালোবাসা একজনের সঙ্গে হয়। দু’জনার সঙ্গে হয় না। আপনি আমার রাখতে চেয়েছেন কেবল সমাজ থেকে বাঁচাতে। সমাজের কটুক্তি, কটু দৃষ্টি থেকে আমাকে রক্ষা করতে। প্রয়োজন নেই। আমি হৃদয় শক্ত করে ফেলেছি। মুভ করতে শুরু করেছি। আপনি আমায় কখনোই আর পাবেন না। ডিভোর্সের কাগজ চলে যাবে বাড়িতে। নাউ গেট আউট।’ হাতের ইশারায় দরজার দিকে। সেলিম বিক্ষিপ্তভাবে ভেঙে পড়েছে। যতোটা না কষ্ট হচ্ছে তার জীবনে যাবে না শুনে, এর বেশি কষ্ট হচ্ছে রুহির মুখে আপনি সম্বোধন শুনে।
হৃদয় চুরমার! অস্বাভাবিক ভাবে কেঁদে ফেলে বলল। আকুতি আর্তচিৎকার করে বলে,
‘এমন কোরো না রুহি। আমি মারা যাব। এত কঠোর হয়ো না প্লিজ। দয়া করো আমার উপর।’
‘স্যরি! করুণাটুকুও আসছে আপনার উপর।’ চলেই রুহি জায়গা ত্যাগ করল।
‘রুহি… ‘ বলে পেছনে ছুঁড়তে নিলেই রায়ান বুকে হাত রেখে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘দারোয়ান তাঁকে বের করে দেও।’
সেলিম হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দেখে রায়হান মির্জার পা ধরে আকুতি মিনতি করতে থাকে।
‘আমায় ফিরিয়ে দিন রুহিকে। দয়া করুন। আমি ভুল করেছি। ক্ষমা করুন আমায় বাবা।’
তিনি গম্ভীর মুখশ্রীতে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তার একমাত্র মেয়ের জীবন ধ্বংসকারীকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না। ক্ষুব্ধ গলায়, ‘তুমি ক্ষমার অযোগ্য’ কথাটা ছুঁড়েই পা ছাড়িতে প্রস্থান করলেন।
দারোয়ান সেলিমকে টেনেছিচড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেলিম আপ্রান চেষ্টা করে তাদের তাকে রুহিকে ভিক্ষা চায়। তবুও কারো মন কিঞ্চিৎ পরিমাণ গলে না৷ অসহায় হয়ে পড়ে সেলিম। দরজার পিঠ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে। এমন নির্মমতা রাহার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে কিছু বলতে চায় সেলিমকে। সেখানে উপস্থিত দাঁড়িয়ে এক কদম বাহিরের দিকে এগোতেই রায়ান গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘যাচ্ছো কোথায়?’
রাহা কিছুটা বাঁকা নজরে তাকাল। কণ্ঠে গম্ভীরতার ছোঁয়া ফুটিয়ে বলল,
‘সেলিমকে শান্ত করতে।’
তার কথায় রায়ান বেশ ক্রোধিত হয়। চটজলদি ভারী গলায় বলল,
‘প্রয়োজন নেই রুমে চলো।’
রাহা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘সেলিমের মানসিক অবস্থা…. ‘
‘তোমায় দেখতে হবে না।’ রাহার কথা সম্পূর্ণ না করতে দিয়েই রায়ান তাকে কাঁধে চড়িয়ে নেয়। এতদ্রুত ঘটনাটি হওয়াই রাহা অপ্রস্তুত হয়ে বিদ্রোহ করল না। চুপ থাকলো। রায়ান তাঁকে সেভাবেই নিয়ে রুমের দিকে এগোয়।
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি