#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
২.
দিন গড়াতে গড়াতে সূর্যের তাপমাত্রা এখন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গরমের আভাস আগের চেয়ে কিছুটা উত্তাপ বাড়লো। ভয়ে ক্লান্তিময় চাহনি জনির। ক্রোধে লালচে মুখশ্রী নীলিমার। সংগোপনে রাহার মন যেন নেচে-গেয়ে উঠছে তাঁদের মনকষাকষি দেখে। এমনই দুষ্টবুদ্ধি চাপিয়েই আগমন ঘটিয়েছে এখানে। নয়তো কখনোই অন্যের ডাকে সাড়াশব্দ দিতো না সে। ম্লান হাসি ঠোঁটে প্রতিফলন হলো তার। অবস্থা বেগতিক দেখে ন্যানো সেকেন্ড দেরি করল না রায়ান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মস্তিষ্কে জলদি নতুন বুদ্ধি আঁটলো। উপস্থিত সবাইকে চমকপ্রদ করে তুলে খপ করে রাহার ডান হাত ধরে মৃদুস্বরে শুধালো,
‘রাহা আমার হবু বউ। আজ দুটো বিয়ে হতে চলেছে। আমার ও জনির।’
ফারিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে হতবিহ্বল হয়ে মুখ খুলতে নিলেই মেশকাত আচমকাই কানেকানে ফিসফিস করে জানাল,
‘হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলালে তোমার আমার বিয়ে হওয়া থেকে রক্ষে হবে। নয়তো….’
ধামকি সরূপ কথনে ফারিন ফ্যালফ্যাল করে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেশকাতের উপর। খুব ভয়াবহ ভাবে মেশকাত ভ্রু উঁচু করে মুখশ্রী কঠিন করে রাখে। যার ফলস্বরূপ কিঞ্চিৎ ভয়ে ফারিন বলার আগ্রহ দেখাল না। কিন্তু এতে প্রচুর বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে রাহা। অবাক হয়ে হাত ছাড়িয়ে কপট কণ্ঠে শুধালো,
‘কী ফালতু… ‘
‘আরে শোনো, তোমাকে বলা হয়নি। সারপ্রাইজ দিবো বলে সিক্রেট রেখেছি। তোরা কথা বল। আমি একটু পার্সোনাল কথা বলব তোর ভাবির সাথে।’ কথন সম্পূর্ণ করে রায়ান রাহার হাত ধরে টেনেটুনে তাঁদের থেকে আড়ালে নিয়ে এলো। একটা বড়ো মোটা নিম গাছের পেছনে নিয়ে এসে বাঁ হাত গাছের সাথে সজোরে চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত পিষে রাহার মুখের পানে ঝুঁকে বলল,
‘আই নো, তুমি কোন মতলব হাসিলের জন্য এসেছো। লিসেন, আমার বন্ধুর বিয়ে যদি স্টপ হয়। তোমাকে আমি এখানেই স্টপ করে দিবো।’
রাহা ক্রুদ্ধ হয়ে ডান হাত দ্বারা সজোরে রায়ানের হাতে আঘাত এনে অপর হাত ছাড়িয়ে নিলো। ব্যথা স্থানে হাত ঘষতে ঘষতে ক্রোধমতি কণ্ঠে বলল,
‘প্রথমত, আপনার থ্রেটে আমি ডরাই না। দ্বিতীয়, আমিও দেখবো এই বিয়ে কি করে হয়। মধ্যরাতে একটি মেয়েকে বিয়ের বার্তা ও কল দিয়ে বলার সময় মনে ছিল না এই থ্রেট? দেখাব, বিয়ে…’
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই রাহা তার পায়ের কাছে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল। রায়ান ও রাহা উভয়ে নজর ফেলতেই দেখল জনি পা ধরে বসে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
‘বোন, আফা, আম্মা, খালাতো বোন, মামাতো বোন, চাচাতো বোন ক্ষমা চাই, মাফ চাই। দোয়া কইরা দেন। বিয়েটা যেন হয়। ভুল করছি, ভুল হয়েছে। প্লিজ।’
জনির এরূপ কাণ্ডে রায়ানের লজ্জায় মুখ ঘুচে এলো। উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়াল। রাহা রাগ ঝেড়ে শান্ত কণ্ঠে জনির বাহু ধরে বলল,
‘আপনি আমার পা ছাড়ুন। উঠুন।’
‘আগে বলো মাফ করেছো?’
‘আচ্ছা ছাড়ুন।’
জনি উঠে রাহার হাত ধরে উৎকণ্ঠে বলল,
‘বিয়েটা হতে দেন আফা। বাঁধা দিয়েন না। গার্লফ্রেন্ড আমার বহুত কড়া। উল্টোপাল্টা হলে আমার খবর আছে।’
চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে নজর সরিয়ে রায়ানের পানে তাকাল। রায়ান তখনো রাগের বশে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জনির আকুতিভরা কণ্ঠের বাক্যগুলো শুনে রাহা সরস কণ্ঠে জানাল,
‘ঠিক আছে ভাইয়া। আমি কোনো প্রকার ঝামেলা করব না। আপনাদের বিয়ে হবে।’
রায়ান আড়চোখে তাকিয়ে প্রস্থান করলে জনি ছুটে তার নিকটে এসে জানাল,
‘কোথায় যাচ্ছিস? ওঁকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে চল। ওরা সবাই ভেতরে। তুই একা গেলে নীলিমা সন্দেহ করবে।’
রায়ান রাগে বিরক্ত জড়িত কণ্ঠে শুধালো,
‘ইরিটেট গার্ল।’
‘প্লিজ দোস্ত। প্লিজ।’ অসহায় স্বরে বললে রায়ান রাহার হাত জোরেশোরে ধরে হাঁটতে নিলে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘বার বার হাত ধরে অসভ্যের পরিচয় কেন দিচ্ছেন?’
বিক্ষিপ্ত রাগে ঘাড় ঘুরিয়ে রায়ান জানায়,
‘আমি অসভ্য নই। সিচুয়েশন হান্ডেল করছি জাস্ট। স্টপ ইউর মাউথ।’
‘আপনি আগে স্টপ করুন হাত ধরা।’ চটপট উত্তর দিলো।
বিরক্তিতে হাত ছেড়েই হাঁটা ধরলো রায়ান। জনি ও রাহা পিছু পিছু ভেতরে এলো। নীলিমা সহ তাদের ভেতরে যেতে বলেই জনি ছুটেছে রায়ানের কাছে। রাহাকে কনভিন্স করিয়ে শান্ত হয় না, ভেতরে প্রবেশ করার আগে রাহার ফোন থেকে মেসেজটি ডিলিট করিয়ে নেয়।
কয়েক ঘন্টা বাদে।
জোড়া হাত ধরে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো জনি ও নীলিমা। পেছনে কান্নারত ভোঁতা মুখ নিয়ে রাহা হাঁটছে। রায়ানের ফেইসে তেমন দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। খুব সরস ভাবে হাঁটছে সানগ্লাস চোখে চাপিয়ে। মূলত ভেতরে প্রবেশের পর জনি, নীলিমার বিয়ের পাশাপাশি রায়ান ও রাহার কোর্ট ম্যারেজ হয়ে যায়। শুধু মাত্র নীলিমার জেদের কারণে হয়েছে এমন নয়। রায়ানও আগ্রহ ছিল বিয়েতে। পছন্দের কারণে বা বন্ধুর বিয়ে বাঁচাতে কোর্ট ম্যারেজে রাজি ছিল এমন নয়। রাহাকে হেনস্তা করার জন্য বিয়েটা করেছে। অতিরিক্ত চালাকের ফল যে কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না, সেটা রায়ান বোঝাতে চেয়েছে রাহাকে হারে হারে। বিয়ে না করলে কেইস দিবে রাহার নামে এই প্রসংগ কানেকানে জানালে নিবোর্ধ হয়ে পড়ে সে। কেননা প্রমাণ হিসেবে তার কাছে মেসেজটিও নেই এখন। বগা যেমন ফান্দে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কান্নায় ভাসিয়ে দেয়। তেমনই অসহায়ত্ব অবস্থায় পড়ে কোর্ট ম্যারেজে রাজি হতে হয় তার। ফারিন মুখ বুজে দেখেছে। বান্ধবীকে নুন্যতম সাহায্য করতে পারিনি কেবল মাত্র মেশকাতের থ্রেটের ভয়ে। মেশকাত প্রাইভেট কার ভাড়া করে জনি নীলিমাকে উঠিয়ে দেয়। মেশকাত ফারিনকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে যায় অন্য গাড়িতে। রয়ে যায় রায়ান ও রাহা। রাহা নৈশব্দে দৃষ্টি নিচু রেখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। রায়ান জোরপূর্বক হাত ধরে টেনেটুনে গাড়িতে বসায়। রাহা দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাইলে দরজা লক করে অপরপাশে উঠে বসে। তীব্র রাগে রাহার বাহু ধরে কাছে টেনে ক্ষুব্ধ গলায় শুধালো,
‘এখন পর্যন্ত চোখ তুলে কারো সাহস হয়নি কথা বলার। তুমিই কেবল সেই সাহস দেখিয়েছো। কীভাবে তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দেবো ভেবেছো? আমার ইগো হার্ট করে তুমি মুক্তভাবে উঠবে। সহজে আমি তা মেনে নিবো? এত বড়ো গর্দভ নই আমি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তোমায় বিয়ে করে পূরণ করলাম।’
কান্নায় গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেল যেন আরো রায়ানের কথা শুনে। অশ্রুসিক্ত নয়নে দৃঢ় কণ্ঠে রাহা শুধালো,
‘শুধু মাত্র ইগো হার্টের জন্য আপনি আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলেন?’
‘রাইট! রায়ান মির্জার জীবনে এমন কারো আগমন ঘটেনি যে তাকে অপমান, অপদস্ত করে মুক্ত আকাশে উঠবে।’
রাহা নিচু স্বরে দৃষ্টি সরিয়ে জানায়,
‘আমাকে যেতে দিন।’
‘ইয়েস, তুমি যাবে। শত হলেও আমার রেজিস্ট্রি করা বউ।’ এক গাল তাচ্ছিল্য হেসে শুধালো রায়ান। চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় রাহা। অশ্রু বর্ষিত হচ্ছিল তখনো আঁখিযুগল বেয়ে। জীবনের কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তার জীবনে রায়ান নামের কালো অধ্যায়ের উদয় হয়েছে, অজানা! ফুল স্প্রিডে গাড়ি ছুটালো। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে দ্রুত বেগে চলছে। রায়ানের আদলে এখনো যেন বিক্ষিপ্ত রাগ লেপ্টে রয়েছে। রাহা একইভাবে মনস্থির করে বসেছে। বক্ষে ঝড়ে তোলপাড়। কি জবাব দিবে বাবা-মা ও বড়ো ভাইয়াকে? সত্যিটা যখন জানবে কোথায় ঠাঁই হবে তার? প্রাঙ্ক করতে গিয়ে, জীনের সত্যের মুখোমুখি হয়েছে সে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তবে এমন একজন ছেলের সঙ্গে আবদ্ধ হয়েছে, যার জীবনের মূল উদ্দেশ্যই কেবল প্রতিশোধের স্পৃহায় উন্মাদ। হঠাৎ জোরে ব্রেক কষার ফলে চৈতন্য ফিরলো রাহার। তিন পাশে রাস্তা যুক্ত এক গোল চক্করের সামনে গাড়ি থামাল। আশেপাশে মানুষজন সহ নিজ গতীতে গাড়ি চলছে। রায়ান গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় দৃষ্টি সামনে নিক্ষেপ করে ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,
‘আমাদের পথ এখানেই সমাপ্ত। আউট!’
রাহা এক মুহূর্ত দেরি করল না। গাড়ির দরজা খুলে আঁখিযুগল মুছতে মুছতে ছুটতে লাগলো। অনেকেই রাহাকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে দেখছে। রাহা নামতেই গাড়ি ফের তীব্র গতিতে ছুটিয়ে প্রস্থান করল। দু’জনার পথ দু দিকে। অথচ, তাঁদের জুটি একত্রে আবদ্ধ এখন। কিন্তু ভাগ্যের ছোঁয়ায় বসন্তের সমাপ্তি যেন এখানেই ঘটলো। মিলল না রঙ্গিন ফুলের দেখা।
.
.
.
চলবে?
®সুমইয়া মনি