#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৩.
জোয়ার ভাটার পানি কভু কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। ছুটে চলে নিজ গতিতে। একুশ থেকে আজ দুই হাজার পচিশ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় চলছে। কেবল এই মাসটার পদচারণের ফলে রাহা যেন ছন্নছাড়া, উদাসীনতায় ভুগে। ভুলে যায় ভবিষ্যতের কথা৷ উন্মাদ হয়ে একাকী বদ্ধ ঘরে নিজেকে বন্দী করে নেয়। আজও তার সেই একুশ সালের কথা মনে রয়েছে। কীভাবে ভুলে যাবে সেই ভয়ংকর অতীতের কথা? সেই কালো অধ্যায়ের নাম রায়ান মির্জাকে? অসম্ভব!
জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত সেই মুহূর্তগুলো আজও তাকে বিক্ষিপ্তভাবে তাড়া করে বেড়ায়। সেই দিনের কিছু ঝলক চোখে দৃশ্যমান হয় আজ হঠাৎ। বাড়ি ফেরার পর অতিরিক্ত পাগলামির ফলে রাহা ঢাকা থেকে খুলনা চলে আসে। সেখানে খালা বাড়িতে বসবাস শুরু করে। সমবয়সী খালাতো বোনের সাথে একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। বক্ষে বেয়ে যাওয়া ভয়াবহ তান্ডবকে জয় করে আজ সে এ পথে পাড়ি দিয়ে এতদূর আসতে পেরেছে। পড়াশোনার সমাপ্তির পর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোট-বড় টেক্সটাইল কোম্পানিতে ইন্টারভিউর প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে খুলনার এডামজি টেক্সটাইল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়েছে এক মাস হলো। তার এই অর্জনের পেছনে রয়েছে কত অসুন্দর, সুন্দর স্মৃতিময় দিনগুলো। রীতিমতো হাঁক ছেড়ে কয়েক ডাক পড়লো খালাতো বোন তন্নির। চৈতন্য ফিরলো রাহার। ভাবনার জগতের সমাপ্তি ঘটিয়ে ভেতরে এলো। তন্নি একটি শাড়ী নিয়ে এগিয়ে এসে তুলে ধরে শুধালো,
‘আজ ফাস্ট ডেটে এটা পড়তে চাই। কেমন লাগবে আমাকে?’
প্রশ্ন ছুঁড়ে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাহার নিকট। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে রাহা জানাল,
‘অবশ্যই সুন্দর।’
খুশিতে হেসে দেয় তন্নি। শাড়ীটি নিয়ে দ্রুতই অঙ্গে জড়িয়ে নিলো। সম্পূর্ণ শাড়ী পড়ে কুঁচিগুলো ঠিকঠাক করছিল। বিছানায় বসে তন্নিকে দেখছে অপলক দৃষ্টিতে রাহা। সেদিনের পর শাড়ী পড়েনি রাহা। প্রায় ভুলেই গেছে যেন শাড়ী পড়া। তন্নিকে গোলাপি রঙের জামদানী শাড়িতে ভারী সুন্দর লাগছে। আজ শুক্রবার। অফিস ছুটির দিন। এই সময়টায় ঘরে বসেই অতিবাহিত করতে চায় সে। বাহিরে যাবার মনমানসিকতা নেই বললেই চলে। তন্নি রাহার সেবারের সিচুয়েশনে সম্পর্কে অবগত।
এজন্য রাহার কোনো কারণে যাতে মনঃক্ষুণ্ন না হয় সে-সব কাজ এড়িয়ে চলে এসেছে এখন পর্যন্ত সে। বোনের দুঃখে বোন পাশে থাকবে না, এটি আদৌও হয়েছে কি-না জানা নেই তার। তবে সে সব সময় তাকে সমর্থন করে এসেছে, আগেও করবে। নিজ মনে কিঞ্চিৎ ভাবনাগুলো ভেবে ছোট্ট ব্যাগ হাতে তুলে বিদায় নিলো তন্নি। রাহা দেয়াল ঘড়ির পানে এক ঝলক তাকিয়ে ড্রইংরুমে এলো। সবে হাতের কাজ সেরে সোফায় বসেছে রুমানা খাতুন। খালার পাশাপাশি আসন গ্রহণ করল সে। টিভির চ্যানেল পাল্টিয়ে রুমানা খাতুন বলল,
‘বাহিরে গিয়ে তন্নির সাথে ঘুরেফিরে আসতি। নিজেকে এমন ঘরবন্দী করে আর কত বছর রাখবি? সেই যে ঢাকা থেকে এলি, আর ঢাকাতেও ফিরলি না। তোর মতো এমন ঘরবন্দী মেয়ে আমি একটিও দেখিনি রে রাহা।’
খালার কথনে নৈঃশব্দ্যে নিশ্বাস ত্যাগ করল রাহা। বছরের দু’টি ঈদ এখানেই উৎযাপন করা হয়েছে। বাবা-মা, বড়ো ভাইয়া শতবার বলেও ঢাকায় নিতে পারেনি রাহাকে। বরং রাহার জেদের কাছে হার মেনে তারাই ঈদ এখানে উৎযাপন করেছে। শত হলেও এক মেয়ে বলে কথা। তাকে ফেলে ঈদ পালনে নারাজ যেন তারা। রাহার প্রতুত্তর না পেয়ে তিনি ঘুরে তাকালেন। উদাস আদলের পানে চেয়ে শুধালেন,
‘তুই এই একটা মাসেই সব সময় মনঃক্ষুণ্ন করে থাকিস। অফিস ব্যতীত বাড়ির বাহিরে পা দিস না। নিজেকে একাকী চিলেকোঠায় আবদ্ধ করে রাখিস। এভাবে আর ক’দিন?’ রাহা মলিন হাসি দেয়। জানায়,
‘তোমায় এসব বেহুদা কথা কে বলল আন্টি? মুড সুইংয়ের ব্যাপার স্যাপার আছে না। এজন্য অলওয়েজ মুখমণ্ডল এমন দেখো। তুমি টিভি দেখো। আমি ছাদ থেকে ঘুরে আসি।’
‘আচ্ছা। জলদি আসিস।’
বড়ো বড়ো কথায় বন্দী হতে চায় না খালার। এজন্য না চাইতেও ছাদে আসতে হয় তাকে। মিষ্টি সোনালী রোদে চারদিক ঝলমলে। মৃদু হাওয়া শীতের উষ্ণতা অনুভব করিয়ে দিচ্ছে বারংবার। চাদর আঁকড়ে ধরে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ানোর পূর্বেই তার মুখশ্রীর পানে অন্য একটি যুবকের আগমন ঘটে। একটু হকচকিয়ে উঠে পিছু পা হয় কয়েক কদম। সেই যুবকের নাম আরান। রাহার এক বছরের ছোট। সবে অনার্স শেষ করল। তন্নিদের বাড়িতে আরান সহ আরো দু’জন ছেলের সঙ্গে ব্যাচেলর ভাড়া থাকছে বছর দুয়েক হলো। এই বাড়িতে উঠার পরপরই আরানের নজরে পড়ে যায় রাহা। যখন যেথায় দেখা হয় জ্বালাতনের এক মুহূর্ত মিস করে না। প্রচুর দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে আরান। শ্যামলা চেহারার অধিকারী যুবক সে। মুচকি হাসিতে দু গালে যেই টোল দু’টি দেখা যায়, সে দু’টি রাহার খুব পছন্দের। এজন্য রাহা আরানকে টোলম্যান বলে সম্বোধন করে সব সময়। এই নাম অবশ্য আরান নিজেও গ্রহণ করেছে হাসিমুখে। রাহা বক্ষে ঈষৎ হাত রেখে বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরানকে বলল,
‘আমাকে মে’রে ফেলার ইচ্ছে আছে নাকি তোর?’
হঠাৎ আগুনে একটি আঙুল পড়লে মানুষ যেমন ‘ছ্যাঁত’ বলে উঠে। আরানও ঠিকিই সেভাবেই ‘ছ্যাঁত’ করে উঠেই বক্ষে হাত রেখে কোমল গলায় শুধালো,
‘তোমার ঐ সুশ্রী ওষ্ঠদ্বয় আমায় যখন তুই করে সম্বোধন করো, তখন হৃদয় যেন উথাল-পাতাল ঢেউ খেলে উঠে। আমি হারিয়ে যাই….’ কবির মতো বনিতা করে কথনগুলো বলল আরান। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে সরে এলো পাশের রেলিঙের নিকট। উঁকি দিয়ে পাঁচতলা থেকে নিচে তাকাতেই আরান ফের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে শুধালো,
‘ঐভাবে আমার হৃদয়ে উঁকি দিয়ে দেখ না একবার, জান।’
রাহার কপাল আরো ঘুঁচে এলো। রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল,
‘কোষে গালে চড় বসালে, কবিতা ছুটে পালাবে।’
আরান বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘অলওয়েজ তুমি আমার সাথে এমন বিহেভিয়ার করো।’
রাহা রাগী দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় তাকালে তীব্র বাতাসে ছোট ছোট চুলগুলো ওড়ে চোখ ঢেকে দেয়। আলতোভাবে সেগুলো সরিয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে শুধালো,
‘তুই আমার ছোট। ফ্ল্যাটিং করা তোকে সাজে না।’
‘জাস্ট এক বছরের ছোট। তাতে কী? আমি ফ্ল্যাটিং করবোই। কি জানি, কবে তুমি পটে যাও।’
‘দুঃস্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকুন।’ তাচ্ছিল্য হেসে বলেই বিরক্ত নিয়ে প্রস্থান করল। আরান এক হাত বাড়িয়ে হাঁক ছেড়ে ডাকল,
‘ও সুন্দরী, যাচ্ছো কোথায় একা রেখে আমায়।’
রাহা ঘুরে তাকিয়ে কপট রাগ নিয়ে ঝাড়ল,
‘ঠেঙ্গা।’
‘সেটাও অন্তত দিয়ে যাও।’
এবার বিনাবাক্যে দ্রুতই প্রস্থান করল রাহা। আরানের সাথে কোনো প্রকার কথায় জড়াতে চায় না সে। বিরক্তের আরেক নাম আরান।
__
হেয়ার ড্রাই দিয়ে চুলগুলো শুকিয়ে ব্লু রঙের শার্ট গায়ে জড়িয়ে হাতা ফোল্ড করতে লাগলো রায়ান। জেল দ্বারা আলতো চুল নাড়াচাড়া করে আঁচড়িয়ে রোলেক্সের স্টেইনলেস স্টিল ঘড়িতে পড়ে নেয়। কালো জিন্সে বেল্ট লাগিয়ে ফোন ও সানগ্লাস হাতে তুলে রুম ত্যাগ করল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় ভাজ পড়া চুলগুলো এদিক ওদিক দোল খাচ্ছিল। অরুণা বেগম ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি ছিলেন। সেখান থেকেই এক প্রকার মৃদু হাঁক দেয়,
‘আম্মু আমি বেরোচ্ছি।’
‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে আমার পুত্রের?’
‘ফ্রেন্ডদের সাথে।’
‘কখন আসা হবে শুনি?’
‘নাইট।’
‘সাবধানে যাবেন পুত্র।’
‘টেক ইয়ার, আম্মু।’ বলে জায়গা ছাড়ল। অরুণা বেগম ছেলের যাবার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। তার এত বড়ো সংসারের তিন জনের সদস্য কেবল। এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরো তিন বছর পূর্বে। কুমিল্লায় মেয়ের শ্বশুর বাড়ী হওয়ায় সহজে আনাগোনা নেই। এক মাত্র ছেলে বিয়ের উপযুক্ত হলেও, এখনো বিয়ে করছে না। ঘোর আপত্তি তার বিয়েতে। তিনি প্রায় হিমসিম খেয়ে উঠে বড়ো সংসার সামলে উঠতে। তবুও ছেলেকে রাজি করাতে পারছেন না। বাড়ীর কর্তা কাজের দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছেন ছেলের উপর। এজন্য ছুটির দিনে এখনো রায়ান বন্ধুদের সঙ্গে মজমস্তি করে বেড়ায়। বিলাসবহুল জীবন অতিবাহিত করে।
.
.
.
চলবে?
~সুমাইয়া মনি
কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।