তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-০৭

0
1

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৭.
সমুদ্র সৈকতের গোধূলির আকাশে ঝাঁক বেঁধে পাখি তাদের নিড়ে ফিরে চলেছে। কুসুম রঙের সূর্য সাগরের গভীরে যেন ক্রমশেই তলিয়ে যাচ্ছে। সেই সূর্যের আলোয় এখন চারদিক মৃদু আলোকিত। স্লিপিং চেয়ারে কপোত-কপোতী সূর্যাস্তের মুহূর্ত উপভোগ করছে। তন্নি, সাইদের থেকে কিছুটা দূরেই বসে রয়েছে রাহা। তার খুব প্রিয় মুহূর্ত কাছ থেকে দেখছে।
মৃদু হাওয়া, শান্ত খোলামেলা পরিবেশ। পরাণ জুড়ে যাবার মতো এক চমৎকার মনোরম স্থান। সূর্যাস্তের সঙ্গে শীতের প্রভাব বেড়েছে। হঠাৎ রাহার মনে উঠে আরানের কথা। সারাদিন আর দেখা মিলেনি তার। দুপুরের আহারের সময়ও আসেনি। কল দিয়েছিল সাইদ। সকালের কথায় এতটাই মনঃক্ষুণ্ন হবে ভাবলে, আর বলতো না। তন্নিকে হাঁক ছেড়ে ডাক দেয়। চেঁচিয়ে বলল,
‘আরান কোথায়? ওঁকে একটা কল দে তন্নি।’
‘তুই দে। আমরা ব্যস্ত আছি।’
মুখ থমথমে হয়ে এলো রাহার। কি এমন ব্যস্ততা তা সে দেখতে পাচ্ছে। নাম্বার নেই তার নিকট। চাইতেও ইতস্তত বোধ করছে। স্থির হয়ে বসে রইলো। তার ঈষৎ চিন্তিত অবস্থায় বসার এক পর্যায় আরানের আগমন ঘটলো। স্লিপিং চেয়ারের কিনারায় এসে বসে সকালের ন্যায় ক্যান্ডি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘খুব বেশি মিস করছিলে আমায়?’
‘আমি কি বলেছি সেটা?’ মেকি রাগ নিয়ে বলল।
‘এখনো রেগে আছো?’ মৃদু হেসে বলল আরান।
‘নাহ!’ ছোট করে উত্তর দিলো।
আরান চুপ থেকে ডুবন্ত আকাশের মানে তাকালো। রাহা আমতা আমতা করে জানতে চাইলো,
‘দুপুরে খেয়েছিস?’
আরান রাহার পানে চেয়ে মৃদুস্বরে জানাল,
‘নাহ!’
‘কেন?’ ভ্রু হালক কুঁচকে জানতে চাইলো।
‘চলো একত্রে খেতে যাব।’ বলেই ঘাড় উঁচু করে তন্নি ও সাইদের পানে দৃষ্টি তাক করে বলল,
‘এই যে কাঁপল। চলেন।’
তারা গুরুত্বপূর্ণ কথপোকথন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একত্রে রওয়ানা হলো। ঘন্টাখানেক বাদে সাগরের পাড়ে চাদর বিছিয়ে বসলো তারা। আরান গিটার এনে পাশে রাখলো।
‘এটা কার?’ রাহার প্রশ্ন।
‘একজনের কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে আসলাম।’
‘ভাড়ায়?’
‘বলতে পারো।’
আরান গানের সুর তুলল। খুব সুন্দর গিটারের সুর তুলে খালি গলায় গান গাইতে লাগলো। আরানের গানের কণ্ঠ এত সুন্দর। তা কারো জানা ছিল না। হাঁটুর উপর হাত রেখে থুতনি দ্বারা ভর রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গান শুনছে রাহা। শীতল পরিবেশের সঙ্গে আরানের গানটি চমৎকার ভাবে মিশ্রিত হলো।
_
রাত বারোটার সময় মেশকাত বাসর ঘরে উপস্থিত হয়। সে চমকালো। ফুলে ভরপুর বিছানায় বধু না বসে ট্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সে তার অলংকার খুলতে ব্যস্ত ছিল। মেশকাত আসার ফলে তার ভাবমূর্তি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না। আশ্চর্য হলো সে। মেশকাত কোন শব্দ মুখে তুলবে বুঝতে পারছে না। ভেবেছিল বিছানার মাঝামাঝি বসে থাকবে। বউয়ের ঘোনটা সরিয়ে উপহার হিসেবে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিবে।
তার ভাবনা ভঙ্গ হলো। সব অলংকার খুলে মাথার ওড়না সরালো।
মেশকাত এবার আমতা আমতা ভাব কাটিয়ে বলল,
‘তুমি কি বেশি ব্যস্ত?’
‘আপনি নিশ্চয় সেটা দেখতে পাচ্ছেন?’ রাশভারি গলায় শুধালো।
নতুন বউয়ের কথন তার কাছে কেমন অদ্ভুত ঝাঁঝাল লাগছে। মনের মধ্যে খচখচ শব্দ তুলছে। মেশকাত ফের জানতে চাইলো,
‘তোমার নাম আয়াত?’
এবার ট্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে মুখ সরিয়ে ঘুরে তাকালো। ভারী গলায় বলল,
‘ফারিন আয়াত।’
মেশকাতের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ দেখা গেল ফারিন নামটি শুনে। আঁখি পল্লব বারংবার পিটপিট করে এক দৃষ্টিতে ফারিনকে দেখছে। উঠে দাঁড়ালো সে। মাথার ওড়না খুলে টুলে রেখে ওয়াশরুমে গেল। মেশকাত ফারিনের যাওয়া দেখে বিচলিত হয়ে পাঁচ বছর আগের ফারিনের কথা ভাবছে। মুখশ্রী আবছা মনে থাকলেও, কণ্ঠের স্বর পুরোপুরি অজানা। সামান্যতম কথা বলার কারণে কার-বা মনে থাকবে। মিনিট কয়েক পর পুরো মুখশ্রী থেকে মেকআপ তুলে ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলো নরমাল সেলোয়ার-কামিজ পড়ে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘দেখুন তো এখন আমায় চিনতে পারছেন কি-না?’
প্রশ্ন ছুঁড়ে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফারিন। হতবিহ্বল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার চাহনিতে রয়েছে বেশখানিক প্রশ্ন। ফারিন মেশকাতের হতভম্ব মুখশ্রী দেখে দৃষ্টি সরিয়ে কৃত্রিম হেসে ফের চেয়ে বলল,
‘আমি সেই ফারিন। যার বান্ধবী রাহাকে জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল এবং তাকেও মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন বিয়ের করার ধমকি জারি করে। দেখুন, আমি ফারিন বলছি। আপনার অর্ধাঙ্গিনী।’
আকাশ থেকে বাজ পড়ার মতো মেশকাত যেন পড়েই মরচে গেল। অপ্রত্যাশিত নারীকে নিজের বউ হিসেবে দেখতে পেয়ে তার অনুভূতি ভোঁতা! হতবাক সুরে বলল,
‘তুমি আমার বউ..কীভাবে হলো এসব?’ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে প্রশ্ন করল মেশকাত।
‘আমি বলছি, ওয়েট। তার আগে আপনি বসুন। দাঁড়িয়ে শুনবেন?’ তাচ্ছিল্য হেসে বিছানার দিকে হাত তাক করে বসার আহবান জানাল সে। মেশকাতের চাহনি ও মুখশ্রী আগের ন্যায় পোক্ত। ফারিনের তাচ্ছিল্য হাসি দেখে জেদি স্বরে জানাল,
‘আমায় বিয়ে করা তোমার প্লান ছিল?’
তেতে উঠে ফারিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘আপনাদের মতো বড়োলোক বাপের নিকৃষ্টতর চরিত্রের অধিকারী পুরুষজাত আমরা নারীরা তা নই, যে সব প্লান মোতাবেক করব। আল্লাহ আমায় সহজ পথ দেখিয়ে দিয়েছে আপনাকে শিক্ষা দেবার। আমি সেটাই অবলম্বন করেছি।’
‘সাফসাফ বলো।’ মেশকাতের কষ্টে বিক্ষিপ্ত রাগ এবার।
‘আপনার মামার কথা নিশ্চয় মনে আছে? তার ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ির কাছে। প্রতিবেশী হিসেবে তিনি একদিন আমায় দেখে আপনার আব্বুর নিকট প্রস্তাব দেয়। এরপর তো আপনি সবই জানেন। কেন বিয়ের আগে আপনি আমায় দেখেন নি?’
‘দেখেছি, ছবিতে একবার।’
‘শীট! ইউর মিস্টেক।’ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল।
মেশকাত রাগী নিশ্বাস ত্যাগ করল। সেদিন যদি মায়ের সাথে মেয়ে দেখতে যেতো। তবে আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনের মুখদর্শন করতে হতো না৷ ফারিন নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘আমি আপনার ছবি দেখেই চিনে ফেলি। বিয়েতে মত দিয়েছি, কারণ আপনার জীবনকে নষ্ট করব বলে।’
‘জাস্ট রিভেঞ্জের জন্য বিয়ে?’ মেশকাত দমে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি ফেলে ম্লান হেসে জানতে চাইলো।
‘হ্যাঁ, আপনারা আমার এবং রাহার জীবন নষ্ট করেছেন। হাতের কাছে পেয়ে কীভাবে ছেড়ে দিবো?’ রাগান্বিত গলায় কথাগুলো বলল।
মেশকাত করুণ চোখে তাকিয়ে অতি নরম স্বরে শুধায়,
‘কী চাও তুমি আমার কাছে?’
‘ডিভোর্স।’
‘শুধু ডিভোর্স?’
‘হ্যাঁ। বাড়ির সবাই যখন জানতে চাইবে নতুন বউ কেন ডিভোর্স চাইছে। তখন টেনে আপনাদের মুখোশ খুলে তুলে ধরব সবার সামনে। আপনারা সকলে মিলিত হয়ে রাহার জীবন নষ্ট করেছেন। সেদিনের পর রাহাকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে। কিচ্ছুটি জানি না। একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে বড় বন্ধনে আবদ্ধ হয় বিয়ের ফলে। আপনারা সেটা ছেলেখেলা মনে করে প্রতিশোধের স্পৃহায় ধ্বংস করেছেন। আমার জীবন নষ্ট হবে হোক। আমি এই বেপারি বংশে কালি লাগাব।’
‘তুমি সত্যিই তাহলে সব জেনেশুনেই আমায় বিয়ে করেছো?’ স্বাভাবিক ভাবে বলল।
‘জি মেশকাত বেপারি। আপনাদের বংশে ডিভোর্সের নামনিশানা নেই। আমি সেই প্রথম নিশানা তৈরি করব। জাতে আপনাদের বংশের পরবর্তী অংশগুলো এটা দেখে ডিভোর্সের রেকর্ড ঘটতে পারে।’
মেশকাত রীতিমতো ঘামছে ফারিনের কথা শুনে। তবে ভয়ের কারণে নয়, নিজের বংশপরম্পরার কথা ভেবে। তাঁদের বংশে দু’টি বিয়ে করার অনুমতি থাকলেও, ডিভোর্সের অনুমতি নেই। এটা তাদের বংশপরিচয়ে আঘাত আনবে দেখে যুগযুগান্তর ধরে বাপ-দাদার রীতি মেনে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। মেশকাত ফারিনের কাছে নত হতে পারছে না। তার সম্মানে লাগছে। আবার ডিভোর্সের অনুমতিও দিতে পারছে না। ফারিন মুখ ঘুরিয়ে বিছানার ওপরে সাজানো ফুলগুলো রাগের বশে টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলছে। মেশকাত একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। আপাতত এই বিষয়ে কোনো কথা না বলাই ঠিক হবে। সকালে ফারিনের মাথা ঠান্ডা হলে তবেই এই প্রসংগ তুলবে। শেরওয়ানি খোলার সময় পকেটে আংটির বাক্সটি দেখতে পেয়ে মন ছোট হয়ে যায় তার। ভেবেছিল এই আংটিবদলের পর দাম্পত্য জীবনের সূচনা হবে। নৈঃশব্দে নিশ্বাস ফেলল। ফারিন ফুলগুলো টেনেটুনে সব ফ্লোরে ফেলছে। কিছু ফুল মেশকাতের পায়ে এবং গায়ে এসে ছুঁইয়ে দিচ্ছে। পেছনে ফিরে ফারিনের রক্তিম আদল দেখছে। কীভাবে জোর ঘাটিয়ে ফুলগুলো ছিঁড়ছে। কত যত্ন করে সেগুলো সাজিয়েছিল তার পরিবারপরিজন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় মেশকাত। তার ভাগ্যচক্র কোথায় এসে ঠেকল।
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।