#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৮.
সকাল সকাল রায়ানের হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পেয়ে চোখ কচলিয়ে উঠে বসল মেশকাত। দৃষ্টি সরিয়ে বিছানায় তাকাল। গায়ে কম্বল মুড়িয়ে মুখশ্রী বাহিরে রেখে এলোমেলো খোলা চুল নিয়ে ঘুমে কাতর ফারিন। রাতে ফুল ছিঁড়ে পরিষ্কার করে বিছানা। কিচ্ছুটি না বলেই একাকী বিছানা দখল করে শুয়ে থাকে। ফ্লোরের ফুলগুলো একটি শপিং ব্যাগে পুরে রাখে সে। সকালে এভাবে এলোমেলো ফুলগুলো মেঝেতে দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে। আলমারি থেকে একটি কম্বল বের করে সোফায় তাকে রাত্রিযাপন করতে হয়। কী স্নিগ্ধ আদল এখন তার। কে বলবে এই মেয়ে কালকে তেতে মেতে ঝামেলা করেছে। সরু শ্বাস ফেলে ফোনের স্ক্রিনে নজর ফেলে। ভিডিওটি চালু করে একটি মেয়ে ও ছেলের গিটার বাজানো খালি গলায় গান গাওয়া সম্পূর্ণ শুনে। এরপর রায়ানকে টেক্সট দেয়। ‘সুন্দর গান’। সেকেন্ড কয়েক পর রায়ানের রিপ্লাই আসলো।
‘মেয়েটা রাহা মনি’।
টেক্সটটি দেখতেই চোখ যেন চড়কগাছ মেশকাতের। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে এসে রায়ানকে কল ব্যাক করল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘রাহা, তুই শিওর?’
‘ইয়েস।’ আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল।
‘আমাদের জীবনে ওদের এন্ট্রি কেন হলো?’
‘ডোন্ট নো।’
‘ইউ নো। ফারিনের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।’
‘হোয়াট?’ এবার রায়ানের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার ঝাঁঝ।
‘আমি বাসর ঘরে এসে বুঝতে পারলাম। যখন ও নিজের পরিচয় দিয়েছে।’
‘মানে তুই আগে জানতি না এটা ফারিন?’
‘নাহ! পাঁচ বছর আগের চেহারা ভাই কার মনে থাকে তেমন? আরো ছিল মেকআপ করা কাল। কীভাবে চিনবো আমি তাকে।’
‘বিয়ে পড়ানোর সময় নামও খেয়ালে আসেনি?’
‘আয়াত নাম বলেছে। পুরো না ফারিন আয়াত।’
‘শীট!’ বলেই চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল।
‘ভাই ও আমার বংশ ধ্বংস করতে এসেছে সঙ্গে আমার জীবনও।’ অসহায় স্বরে কথাগুলো বলল।
‘কী করবে?’
‘ডিভোর্স দিবে আমায়।’
‘তুইও দিয়ে দে ডিভোর্স।’
মেশকাত চিবিয়ে চিবিয়ে ধীরে কণ্ঠে বলল,
‘আরে আমাদের বংশে ডিভোর্স হয় না, ভুলে গেলি তুই?’
‘হয় না, এখন হবে।’ স্বাভাবিক ভাবে বলল রায়ান।
‘তুই..তোকে…’
‘কার সাথে কথা বলছেন?’ পেছন থেকে ফারিনের উৎকণ্ঠিত আওয়াজ শুনে কান থেকে ফোন সরিয়ে ঘুরে তাকাল মেশকাত। ফারিন প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। ঘুমন্ত এলোমেলো চুলে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের আভা ছড়াচ্ছে যেন ফারিনের মুখশ্রী থেকে। মেশকাত নজর সরিয়ে নিয়ে মিনমিন স্বরে বলল,
‘তোমার জানতে হবে।’
‘ইচ্ছেও নেই। দজরা খুলে দিন। আপনার পরিবারের লোকজন এসে নক করছে।’ আদেশ সুরে বলে ভেতরে চলে এলো ফারিন। কল কেটে মেশকাত ভেতরে এলো। দরজায় তখনো বড়ো ভাবী একাধারে কষাঘাত করছিল। মেশকাত দ্রুত রুমে এসেই ফারিনের সামনে দাঁড়িয়ে সরস কণ্ঠে শুধালো,
‘রাতে যা হয়েছে হয়ে গেছে। আপাতত আজকের রিসিপশনটায় তুমি কোনো ঝামেলা কোরো না।’
‘তাহলে কি কাল পরশু করবো?’ এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল।
‘আপাতত অফ করো সব। পরে তুমি যা করার কোরো। আমার পরিবাবের সাথে খারাপ আচরণ কোরো না।’ অনুরোধ স্বরে বলল মেশকাত। ফারিন মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
‘দরজা খুলে দিন।’
মেশকাত সেকেন্ড কয়েক ফারিনের পানে চেয়ে রইলো। কোনো উত্তর না পেয়ে মিথ্যে ভরসা নিয়ে মনে দরজা খুলে দিলো। বড়ো ভাবী মোহিনী সহ মেশকাতের ছোট বোন মাইশা, কাজিনরা ভেতরে প্রবেশ করল।
মোহিনী দু’জনকে আপাদমস্তক মেপে হেসে বলল,
‘এত লেট করলে যে দেবর? একি ফুলগুলো সব এক রাতেই ছিঁড়ে ফেললে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
ফারিন মাথায় ওড়না টেনে দৃষ্টি নিচু করে রাখলো। মেশকাত ফারিনের পানে চেয়ে এরূপ ভেজা বেড়ালের ন্যায় আদল দেখে রাগে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ভারীর প্রশ্নের সম্মুখীন এখন তাকেই হতে হবে। মেশকাত আমতা আমতা ভাব কাটিয়ে বলল,
‘ফুলে আমার সমস্যা হচ্ছিল। এজন্য সব ছিঁড়ে ফেলেছি।’
‘তোমার? নাকি কাজে সমস্যা হচ্ছিল?’ বলেই মুখ টিপে হাসলেন তিনি।
ছোট বোনদের সামনে লজ্জাকর কথন শুনে মেশকাত চেঁচিয়ে উঠলো,
‘বিরক্ত কোরো না ভাবী। ফারিনকে নিয়ে নিচে যাও।’
‘ফারিন কে? ও, নতুন নামও ঠিক করা হয়েছে বুঝি বউয়ের?’ ঠেস দিয়ে বলল মাইশা।
‘ফারিন আয়াত ওর নাম। যে যেটা বলে শান্তি পাবে ডাকিস। কেউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।’ ভারী গলায় বলে।
‘তুমি শান্তি পাচ্ছো তো ভাইয়া?’ বলেই ফের হেসে ফেলে।
মেশকাত রাগান্বিত নজরে তাকালে মাইশা চুপ হয়ে গেল।
‘আচ্ছা তুৃমি নিচে যাও। আমরা এখানে আছি দেবর।’
মেশকাত ভাবীর কথায় টাওয়াল ও কিছু জামাকাপড় নিয়ে মায়ের ঘরে এলো ফ্রেশ হবার জন্য। মোহিনী ফারিনকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
‘নতুন বউ তুমি। শাড়ী পড়তে হবে। ফ্রেশ হয়ে এসো জলদি শাড়ী পড়িয়ে দিচ্ছি তোমায়।’
ফারিন কোমল স্বরে বলল,
‘জি, আপনারা বসুন।’
.
মাথায় ফোন বার বার ঠেকিয়ে রাহার কথা ভাবছে। ভাবছে ফারিনের কথা। কাল রাতে ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে হঠাৎ মিলিয়ন ভিউস প্রাপ্ত কক্সবাজারের এই ভিডিওটি নজরে আসলো। ওপেন করার পর রাহার আদল দেখেই রায়ান চিনে ফেলে। চোখে পড়ে পরিচিত সেই মুখশ্রী। একটি ছেলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে বেশ সুন্দর করে। সাইদ নামের এক আইডি থেকে ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে। সেই আইডিতে ছেলেটির ছবি ব্যতীত রাহার কোনো আইডি সে খুঁজে পায়নি।
কেবল ভিডিওটি ছাড়া রাহাকে পাবার সম্ভাবনা দশ পার্সেন্ট। নির্ঘুম কাটিয়েছে রাত। সকালে মেশকাতকে ভিডিওটি পাঠিয়েছিল। মেশকাতের বলা আরেকটি সংবাদ তাকে আরো ভাবিয়ে তুলছে।
ফারিনের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে জেনে ক্ষিপ্র হচ্ছে মনে মনে। রিসিপশনের পর ফারিনের সঙ্গে রাহার বিষয়ে কথা বলবে তা ভেবে নেয়। আপাতত তাঁকে ফ্রেশ হতে হবে। চোখে এখনো ঘুমের ‘ঘ’ পর্যন্ত উধাও। গরম পানিতে গোসল করবে ভেবে শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো।
__
রাহার চেঁচামেচিতে ভড়কে যায় তারা তিনজন। আরান শান্ত হতে বললে বিক্ষিপ্ত রাগ নিয়ে কথা শোনাচ্ছে তাকেও। মূলত ভুল ছিল সাইদের। কেননা কাল সে আরান এবং রাহার গানটি ফেসবুকে আপলোড করেছে অনুমতি ব্যতীত। এজন্য তন্নিও ক্ষেপে আছে সাইদের উপর।
‘নুন্যতম বোধ নেই? অনুমতি ছাড়া কীভাবে আপনি ভিডিও আপলোড দিয়েছেন? এতে আমার কত ক্ষতি হতে পারে আপনার ধারণা নেই সাইদ ভাইয়া।’ ঝাঁঝালো কণ্ঠে শুধালো রাহা।
‘আমায় অন্তত জানাতে পারতে? কেন করলে এটা সাইদ?’ তন্নি খেঁকিয়ে প্রশ্ন করল সাইদকে। সাইদ অপরাধ বোধ স্বীকার করে কোমল গলায় শুধালো,
‘আমি বুঝতে পারেনি এতে রাহা এত ক্ষুব্ধ হবে। আই’ম স্যরি রাহা। ডিলিট করে দিচ্ছি।’
‘যা হবার তা হয়েই গেছে। এখন ডিলিট করে কী হবে?’ দাঁতে দাঁত পিষে বলল রাহা।
‘শান্ত হ বোন। সাইদ বুঝতে পারেনি। ভুলক্রমে ছেড়ে দিয়েছে।’ তন্নি রাহাকে শান্ত করার চেষ্টায় আছে। রাহা রাগান্বিত হয়ে জোরে দরজা খুলে প্রস্থান করল। আরান পিছু যেতে নিলে তন্নির ডাকে থেমে যায়।
‘দাঁড়া, কথা আছে।’
‘আবার রাগের মাথায় কিছু না করে বসে আপু যেতে দেও আমায়।’
‘বললাম না কথা আছে। কিছু করবে না বোস এখানে।’
আরান তন্নির আদেশ অনুসরণ করে আর বের হলো না। মুখ মলিন করে দাঁড়াল। তন্নি সাইদের পাশে বসে ভারী নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘কিছু মানুষের জীবনে ভয়ংকর অতীত থাকে। যার প্রভাব ভবিষ্যত নষ্ট করে দেয়। সামনে এগোতে গেলে পিছু পা হয় বহুবার। রাহা সেই কিছু মানুষের মধ্যে একজন। তবে রাহা খুব শক্তপোক্ত মেয়ে। যার কারণে অতীত প্রভাব ফেললেও দূরে ঠেলে এতদূর আসতে পেরেছে। শুধু ত্যাগ করেছে নিজের জন্মস্থান ঢাকা। অনুমতি ব্যতীত আমি বলতে পারব না রাহার অতীত সম্পর্কে। শুধু এতটুকু বলব এই ভিডিওর কারণে রাহা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
আরান উৎসুক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। তার মনে খুঁতখুঁত কী সেই ভয়ংকর অতীত? যা এখনো লতাপাতার ন্যায় রাহাকে এখনো ঝাপটে ধরে ডালপালা ছড়াচ্ছে। তাকে জানতে হবে।
সাইদ অনুশোচনা বোধ নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
‘আমি ভুল করে ফেলেছি তন্নি। রাহা কি আমায় ক্ষমা করবে?’
‘তুমি না জেনে করেছো। জানি ভুল। সব ঠিক হয়ে যাবে সাইদ চিন্তা কোরো না।’ আশ্বাস দিলো তন্নি।
আরান জায়গা ছাড়ল এবার। রাহা সমুদ্রের পানির ছোট ঢেউয়ের কাছ ঘেঁষে বালির উপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে। আরান রাহাকে দূর থেকে দেখে সামনে এগোয় না। একাকী বসার জন্য সেখানেই স্লিপিং চেয়ারে বসল। রাহার অতীত নিয়ে এখন তার হৃদয়ে প্রশ্ন।যার উত্তর কেবল রাহার থেকেই পেতে পারে।
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।