তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-০৯

0
2

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৯.
জুম্মার দিন। নামাজ আদায় করে বাড়িতে এসে সবাই খাবার খেতে বসে। মেশকাত ও ফারিনকে একসাথে বসিয়েছে পাশাপাশি ডাইনিং টেবিলে। ফারিন সকলের সামনে দৃষ্টি কিছুটা নত করে বসে অল্পস্বল্প খাবার খাচ্ছিল। মেশকাত আগেই বলেছে কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট যেন না করে। খুব করে অনুরোধ করেছে। প্রতিত্তোরে ফারিন কিছু বলেনি। অর্ধ খাবার প্লেটে রেখেই ফারিন উঠে চলে যায় রুমে। সবাই বিষয়টি কিছুটা বাঁকা চোখে দেখে। মেশকাত বিষয়টি আয়ত্তে আনতে মোহিনীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘ভাবি মাথা ব্যথার মেডিসিন আছে তোমার কাছে?’
‘হ্যাঁ আছে।’
‘ফারিনের মাথা ধরেছে। মেডিসিন পাঠাও রুমে। এজন্য খাবারও খেতে পারেনি।’
‘আচ্ছা, আমিই দিয়ে আসছি।’
মেশকাত কিছু বলল না। সবাই এবার বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয়। বাড়িতে এখনো মেহমান। রিসিপশনের পর কাছের আত্মীয়রা বাদে বাকিরা রাতেই চলে যাবে। মোহিনী যখন রুম থেকে বেরিয়ে আসে ততক্ষণে মেশকাত এসে উপস্থিত হয়। মেশকাত ভয় পাচ্ছিল মোহিনীকে আবার কি বা কি বলেছে ফারিন। মিথ্যে কথা বলে তখনকার বিষয়টি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল। ফারিন সত্যি বলে দিয়েছে কি-না কে জানে? মোহিনী মেশকাতের পেটে আলতো গুঁতো দিয়ে বলে,
‘মাথায় নয় পেটে ব্যথা করছে। এত দ্রুত ভুলে যাও কীভাবে?’
ফারিন স্বীকার করলেও কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছে। এই মেয়েটার মস্তিষ্কে ঘোরপেঁচের অভাব নেই। মেশকাত ভাবনা ফেলে মৃদু হেসে বলল,
‘সবার সামনে কি আর ঐটা বলা যায়। এজন্য বলেছি মাথা ব্যথার কথা। এক ব্যথার ঔষুধ দিলেই হলো।’
‘হবে না পাগল। ও লাগবে না বলেছে। যাও খেয়াল রাখো ওর। আমি আসবো একটু পর। ফারিনকে নিয়ে পার্লারে যেতে হবে।’
‘আচ্ছা।’ বলে মেশকাত ভেতরে এলো। দরজা লাগিয়ে কাঠিন্য স্বরে ফারিনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘মাথা ব্যথাই না হয় মেনে নিতে। পেটে ব্যথার কথা বলতে গেলে কেন? আর ঐভাবে না বলে চলে এলে কেন?’
‘আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমায় নিশ্চয় কিছু বলতে এবং করতে হবে না।’ ত্যাড়া ভাবে বলল ফারিন।
‘হ্যাঁ সব করতে হবে।’ ক্ষেপে বলল।
‘আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহন করিনি। যাকে ডিভোর্স দিবো দু’দিন পর তার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’
‘ফারিন লিমিট ক্রস কোরো না।’
‘আপনি করবেন না। নয়তো রিসিপশনের আগেই কোর্টে যাব। মেহমান কিন্তু এখনো রয়েছে আপনাদের বাড়িতে।’ গলা উঁচু করে আঙুল তাক করে কথাগুলো বলল ফারিন।
দাঁতে দাঁত পিষে রেখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফারিনের পানে। নিজেকে এই মুহূর্তে ছুঁরি দ্বারা আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করতে ইচ্ছে করছে তীব্র রাগে। দ্রুত প্রস্থান করল সে। ফারিন আঁখি বন্ধ করে বুক ভরে নিশ্বাস নিলো। বিছানায় বসে নিজেকে ধাতস্থ করতে লাগলো। মেশকাতের সঙ্গে এই যুদ্ধে তাকে বিজয়ী হতেই হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে মেয়েরা সস্তা নয়। তাঁদের আত্মসম্মান বোধ রয়েছে। সেটা পুরুষজাত চাইলেই নষ্ট করতে পারে না। সেই অধিকার নেই তাঁদের।
বিকেলের আগে মোহিনী ফারিনকে নিয়ে পার্লারে এলো। ফারিনের আমতে সিম্পল ভাবে বউ সেজেছে। এজন্য তেমন দেরি হয়নি।
যার জন্য বউ সাজবে, তাকে মন থেকে মেনে নেয় নি নিবেও না। তাহলে সেজে কি হবে? তবে মোহিনীর মুখের ওপর না করতে পারেনি। এজন্য আসতে হলো পার্লারে। আটটার দিকে পৌঁছে যায় সেন্টারে। মেরুর রঙের পাথরের কারুকাজময় লেহেঙ্গার সঙ্গে মোহিনীও কিছুটা ম্যাচিং করে পড়েছে লেহেঙ্গা। অবশ্য এটি তাঁকে মেশকাত উপহার দিয়েছে।
মেশকাতের শার্টের রঙ ছিল মেরুন। দূর থেকে সেটা লক্ষ করে ফারিন। রাগে শরীরে যেন আগুন জ্বলছে দেখে তার। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলল না। মেশকাত ফারিনের পানে তাকিয়েছিল বহুবার। নিসন্দেহে বলতে হবে ফারিন বেশ রূপবতী নারীদের মধ্যে একজন। পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আগের তুললনায় এখন আরো সুন্দরী হয়েছে। চেহারা উন্নত হয়েছে। তাকে বারংবার লক্ষ ভেদ করা সেটি ফারিনও অনুভব করছে। অস্বস্তি লাগছে তার ভীষণ।
__
রাত হয়েছে। ঘড়িতে আটটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। রাহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের মৃদু গর্জন শুনছে। মন ভীষণ খারাপ তার। সাইদ ক্ষমা চেয়েছে তার নিকট। রাহা নিজেও অতিরিক্ত চিল্লাপাল্লার জন্য ক্ষমা চেয়েছে সাইদের কাছে। দুপুরে অল্পস্বল্প খাবার খেয়েছিল। সন্ধ্যার আগেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে এখন অব্ধি সেখানেই রয়েছে। তন্নি ঘুরতে যাবার কথা বললে রাহা নিষেধ করে দেয়। মনে তার অস্থির অনুভব হচ্ছে। পাঁচ বছর আগের ঘটনার জন্য হীনমন্যতায় ভুগছে।
কিছুতেই মন শান্ত স্থির হবার উপায়ন্তর নেই। আঁখি পল্লব বন্ধ করে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নেয়। তৎক্ষনাৎ পাশাপাশি এসে দাঁড়াল আরান। তার উপস্থিতি টের পেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। নিজের মনকষ্ট কাউকে বোঝাতে চায় না। আরান গায়ে চাদর জড়িয়ে দেয়। রাহা এক নজর আরানের পানে চেয়ে চাদর গায়ে জড়িয়ে নিলো ঠিকভাবে। ফের আগের ন্যায় দৃষ্টি ফেলল। সেকেন্ড কয়েক নিরবতা বিরাজ করল তাদের মাঝে।
তারপর হঠাৎ রাহা নিরবচ্ছিন্ন করে কোমল গলায় শুধালো,
‘স্যরি।’
‘আল্লাহ! তুমি স্যরি বলছো আমায়?’ আশ্চর্যজনক কণ্ঠে শুধালো আরান। রাহা বিরক্তিতে সরু নিশ্বাস টেনে বলল,
‘পাপ করে ফেললাম মনে হচ্ছে?’
‘সওয়াবের কাজ করেছো। চলো ঘুরতে যাই।’
‘ইচ্ছে নেই।’
‘আশা রাখো। মন ভালো করে দেবো। শুধু আমরা দু’জন যাব।’
প্রতিত্তোরে চুপ থেকে ফের নিশ্বাস টানলো রাহা। আরান ফের জোর গলায় বলল,
‘আজকের রাত আমায় দেও না। দেখ না এক চান্সে মন ভালো করে দিবো মহারানী।’
‘কোনো কিছু নিয়ে জোর করবি না তাহলে বল।’
‘ওকে।’
রাহা যাবার জন্য রাজি হয়ে গেল। শুক্রবার ছিল বিধায় ছোটখাটো একটি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে কাঁপলদের জন্য। সেটা সমুদ্রের কাছাকাছি একটি এরিয়ায়। রাহাকে নিয়ে সেখানে এলো আরান। আগে থেকেই তন্নি ও সাইদ সেখানে ছিল। কাঁপলদের বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করে উপহারও পাওয়া যাবে সেখানে। তন্নি ও সাইদের মতো আরো অনেকেই অংশগ্রহণ করেছে খেলায়। আরান রাহাকে পাশে বসিয়ে খেলা উপভোগ করছে। আধাঘন্টা বাদে খেলা শেষ হয়। তন্নি ও সাইদ একটি খেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। সেখানে তিনটি খেলা হয়েছিল। রাহা খুব এনজয় করেছে। এখন তার মনমানসিকত আগের তুললান কিছুটা সুস্থ। খেলা শেষ হবার পর লাইট অফ করে রোমান্টিক গান বাজানো হয়। একে অপরের হাত ধরে নাচছে জোড়া শালিকগুলো। রাহা এখন বিরক্ত অনুভব করছে। এজন্য উঠে অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে একাকী হাঁটছে। সেখানে মানুষজনের আনাগোনা তেমন ছিল না। আরান পিছু পিছু দৌঁড়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,
‘চলে এলে কেন?’
‘ভাল্লাগছে না।’
‘দাঁড়াও।’ আরান রাহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল। রাহা থেমে তাকাল। আরান পকেট থেকে একটি গোলাপ বের করে রাহার কানে গুঁজে দিলো। রাহার ডান হাত এগিয়ে উঁচু করে ধরলো কোমলভাবে বলল,
‘এই সমুদ্রের গভীরতার ন্যায় আমি তোমাকে ভীষন গভীরভাবে ভালোবাসি।’ কথাটা সম্পূর্ণ করেই আলতোভাবে চুমু দেয় হাতে। তীব্র রাগে সেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সজোরে আরানের গালে থাপ্পড় বসালো রাহা। সমুদ্রের ঢেউ যেন আঁচড়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল রাহার থাপ্পড়ের শব্দে। নিমিষেই আরানের হৃদয় ভেঙে টুকরো হয়ে মাটিতে যেন গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরানের ঘাড় যেভাবে কাত হয়ে আছে, সেভাবেই রয়েছে। রাহা আঙুল উঁচু করে কাঠকাঠ কণ্ঠে শুধালো,
‘বয়সে ছোট হয়ে কোন সাহসে আমায় ভালোবাসার কথা বলিস? লজ্জা করে না তোর? তোর মা-বাবা নিশ্চয় এমন শিক্ষা দেয়নি? তবে কেন তাঁদের ছোট করছিস আমার কাছে? আজ এখন এই মুহূর্তে তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাবি। আর কক্ষণো আমার সামনে আসবি না।’
‘আসবো!’ বলেই আরান রক্তিম চোখে তাকাল। কাঠিন্য গলায় জানাল,
‘মা-বাবাকে নিয়েই তোমার সামনে আসবো। নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে তোমায় আমার করব। প্রমিজ।’ দ্রুত পায় পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরান। রাহা দমে গিয়ে আরানের উগ্রমেজাজী হয়ে যাবার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরানকে চড় দেয়া সেই হাতের মুঠোয় ওড়না চেপে ধরল। আরানকে তার জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র তার ভালো ক্যারিয়ারের জন্য। সে আরানকে চায় না। কখনো চাইবেও না। এজন্য শুধুশুধু তার জীবনে রেখে ধ্বংস করতে চায় না তাকে। রাহা নিজের ভেতরে অনুতপ্ত অনুভব করছে চড় দিয়ে। কান থেকে গোলাপ হাতে এনে এক দৃষ্টিতে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বলছে ‘স্যরি আরান’।
___________
নিজের চোখের সামনে রাহার জীবন ধ্বংসকারীকে দেখে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসতে ফারিন। আত্মীয়দের জন্য নিজেকে এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ রেখে বসে আছে। রায়ান, মেশকাত ও জনি একত্রে বাহিরে বেরিয়ে গেলে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে রায়ান ফারিনের অপর পাশের সোফায় বসলো। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘কেমন আছো ফারিন? পাঁচ বছর পর দেখা।’
‘ভাবতে পারেননি তাই না?’ ভারী গলায় বলল।
‘হুম, একদম।’ খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল রায়ান।
‘তাহলে এখন ভাবার সময় দিচ্ছি আপনাদের। ভেবে দেখুন আপনার বন্ধুর সাথে কি কি হতে চলেছে।’ মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বলল ফারিন।
রায়ান বুড়ো আঙুল দ্বারা কপাল চুলকিয়ে ভাবলেশহীন গলায় শুধালো,
‘কাল ফেসবুকে এক ভিডিওতে রাহাকে দেখতে পেলাম। সম্ভবত কক্সবাজারে আছে। পাঁচ বছর আগের বিয়ে করা বউকে, এখন মনে হচ্ছে আমার বাড়িতে তুলতে হবে।’
‘এই বিয়ে মানি না।’
‘তুমি না মানার কে?’ তাচ্ছিল্য হেসে বলল।
‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন?’
‘তোমার থেকে ইন্সপায়ার।’
‘আমি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবোই আপনার বন্ধুর জীবনে।’
রায়ান উঠে দাঁড়িয়ে কোটের বোতাম লাগিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
‘কংগ্রাচুলেশনস বলো আমাকে। কজ, আমি তোমার পথ অনুসরণ করে চলবো রাহাকে নিয়ে। ভুলে যেও রাহা তোমার বান্ধবী হলে মেশকাতও আমার বন্ধু।’ বলেই জায়গা ছাড়ল। ফারিন রাগে যাওয়ার পানে তাকিয়ে সোফা খাঁমছে ধরেছে। উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে। রাহাকে জীবনে এনে ফের তার জীবন নষ্ট করার চিন্তাভাবনা নিয়েছে রায়ান। এটা ভেবে নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না ফারিন।
.
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।