তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৯।
আমিরা আবার জানালার সামনে দাঁড়ানো। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে থাকলেও মনোযোগ ভেতরে। আসলে ছেলেটার দিকে সরাসরি তাকাতে বাঁধছে খুব। ‘পাত্রপক্ষের সামনে যাব না’ বললেও পর্দার আড়াল থেকে যখন দেখল, রাস্তায় দাঁড়ানো ওই ছেলেটাই, মুহূর্তেই মন নেচে উঠেছিল ওর। তখনই মন পালটে আমিনাকে বলেছে,
– আপা আমার চুল ঠিক করে দাও তাত্তাড়ি। ওই ঘরে যাইতে হবে তো!
আমিনা বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– কেন? তুই তো বললি পাত্রের সামনে যাবি না।
– বলছিলাম, কিন্তু তখন কি জানতাম এটাই পাত্র? আমি ভাবছিলাম অন্য কেউ হবে।
আমিনা কিছুই বুঝল না। আনিসা তাকে ভেঙ্গে বলল,
– মেজপা একটু আগে জানালার সামনে দাঁড়ানো ছিল। তখন এই ভাইয়াটা ওই চায়ের দোকানে বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেছিল। মজনু ভাই আমাদের বাসা দেখায় দিছে। এরপর ভাইয়া সরাসরি এই দিকে তাকাইছে। মেজপার দিকে তাকাইয়া হাসছেও!
আমিরা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
– এইসব তুই কি বলতেছিস উলটাপালটা? আমার দিকে তাকাইল কখন? তাকাইলেও হাসবে কেন? সে কি আমাকে চিনে নাকি?
– চিনবে না কেন? তোর ছবি দেখছে না উনি? বড় খালা তো মায়ের কাছ থেকে এক কপি ছবি নিয়ে গেছিল।
আমিরার মাথায় বিষয়টা আসলেই আসেনি। এতক্ষণ সে মনে মনে ভেবেই চলেছে, ছেলেটা হুট করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল কেন। ওকে চিনে নাকি সে? এখন বুঝল, ছেলেটা ওর ছবি দেখেছে। এজন্যই ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই ওকে চিনে ফেলেছে। আমিনা আড়চোখে বোনের গালে লাল রঙ ধারণ করতে দেখল। তার মজা লাগছে খুব। কিন্তু এই মজার ভাবটা প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক সুরে বলল,
– এখন চুল ঠিক করার টাইম নাই। তোর তো যেই-সেই চুল না। ইন্টারন্যাশনাল চুলের বাহার!
আনিসা খিলখিল করে হেসে উঠল। পরক্ষণে বাইরের ঘরে বাবার ডাক শুনে দৌড়ে চলে গেল। আমিরার চেহারা প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে যাচ্ছে। এতকাল সেজেগুজে চুল বেঁধে পাত্রপক্ষের সামনে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে, বিয়েটা যেন না হয়। আর আজ চুলটা বাঁধা দরকার ছিল। পাত্রেরও তাকে পছন্দ করার দরকার ছিল। অথচ আজ মাথার উপর কাকের বাসা! মিনমিন করে বলল,
– আপা এখন কী করব?
আমিনা বলল,
– এখন কান্নাকাটি করে লাভ কী? যেভাবে আছিস, ওমনেই যা। তোকে পছন্দ করার হলে এই চুল দেখেও হ্যাঁ বলবে।
আসলেই এখন আর লাভ নেই। সময়ও নেই। তবু আমিরা নিজেই চুলটাকে জাতে তোলার চেষ্টা করল। সবগুলো চুল টেনে মাথার পেছনে উঁচু করে পনিটেইল বাঁধল। ওর বান্ধবী কাকলী একবার বলেছিল, উঁচু পনিটেইল করলে নাকি ওর চুলগুলোকে সুস্মিতা সেনের মতো দেখা যায়। ক’দিন আগে একটা মুভিতে দেখেছিল, গানের মধ্যে এরকম উঁচু করে পনিটেইল করেছে তার কোঁকড়া চুলগুলো। সুস্মিতা সেনের চুল কিন্তু কোঁকড়া না। ওটা গানের প্রয়োজনেই ওভাবে সেট করা হয়েছিল। কিন্তু ওই চুলের সাথে তো শাড়ি পরেনি সে। শাড়ির সাথে কি এটা মানাচ্ছে?
আমিরা আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। একবার মনে হলো, ঠিক আছে। পরক্ষণে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতে লাগল। কী ক্ষ্যাত দেখাচ্ছে রে বাবা! শাড়ির সাথে উঁচু করে কোঁকড়া চুলের পনিটেইল! ইহ…
আসলেই চুলটা ঠিক করার সুযোগ নেই। আজগর আলীর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল বসার ঘর থেকে। যেন শফিকের থেকেও উনার তাড়া বেশি। অগত্যা চুল এলোমেলো অবস্থাতেই বসার ঘরে যেতে হয়েছে। ওখানে গিয়ে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। শফিককেও দেখেনি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে বসে নাশতা খেয়েছে। কিন্তু কথা বলেনি। অবশ্য কথা বলার মতো পরিস্থিতিও আসেনি। শফিক যেন কীরকম। একবার কুশলও জিজ্ঞেস করল না। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলল। শুধু আমিরা বাদে। যেন আমিরা ওখানে নেই, অথবা সে দেখতে পাচ্ছে না। বিশেষ করে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলারই আগ্রহ বেশি। বড় আপার সাথেও কিন্তু মোটামুটি কথা বলেছে। আপা কোথায় জব করে, কতদূর পড়াশুনা করেছে, সব জিজ্ঞেস করল। আপাও আগবাড়িয়ে অনেক কিছু জানতে চাইল, যেটা আসলে বাবারই জিজ্ঞেস করার কথা। কিন্তু বাবা আজ অন্য ধাতের মানুষ হয়ে গেছেন। শফিককে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবেন না। তাই আপাই কথা বলল।
সেই কথোপকথন থেকে জানা গেল শফিকের সম্পর্কের অনেক কিছু। ওর বাবা-মা খুব ছোটবেলায় একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। ওরা দুই ভাই বোন ছিল। শফিক বড়, বোনটা বছর দুয়েকের ছোট হবে। সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। ফেরার পথে এই অবস্থা। সেবার শফিক তাদের সাথে ছিল না গাড়িতে। নানুবাড়িতে গিয়ে সে এতই আনন্দে মজে গিয়েছিল যে, ছুটি শেষ হয়ে গেলেও ফিরতে মন সায় দিচ্ছিল না। ছুটিতে মামাও সপরিবারে গ্রামে গিয়েছিল। মামাত ভাইবোন আর দূর সম্পর্কের আরও কিছু কাজিনদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। যেদিন ঢাকায় আসার কথা, সকাল থেকেই সে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তা দেখে তার বুবু বলল, নাতি আরও কয়েকটা দিন থাকুক। মামাও সায় বলল, তিন-চার দিন পর তিনিও ঢাকায় যাচ্ছেন পরিবারসমেত। সঙ্গে নিয়ে আসবেন ভাগ্নেকে। স্কুল খুলতে তখনো এক সপ্তাহ বাকি। তাই বাবা-মা আপত্তি করল না। তারা শুধু মেয়েকে নিয়েই রওনা হয়ে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সেই থেকে শফিকের একাকি জীবন শুরু। মামার সঙ্গে তার ঢাকায় আসা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের বাসায় আর ফিরতে পারেনি। মামা প্রথমে নিজের বাসায় নিয়ে গেল। দুই-চারদিন পর নানুবাড়ি আর দাদুবাড়ির সব সদস্যরা মিলে পারিবারিক বৈঠক হলো। সেই বৈঠকের নানা ধরনের আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি শফিকের দেখভাল করার বিষয়টাও উঠে এলো। নানুবাড়িতে বুবু আছেন, আর এক মামা। দাদুবাড়িতে দাদা-দাদি কেউ বেঁচে নেই। এক চাচা আর এক ফুপু আছেন। চাচার সাথে শফিকের বাবার সম্পত্তি সংক্রান্ত ঝামেলা চলছিল আগে থেকেই। তারই জের ধরে তিনি ভাতিজার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হলেন না। তাছাড়া তিনি থাকেনও গ্রামের বাড়িতে। আর ফুপু থাকেন মফস্বলে। ফুপার ওখানে বিশাল বংশ-প্রতিপত্তি। পারিবারিক ব্যবসায়ও আছে। ফুপু চেয়েছিলেন ভাতিজাকে নিজের কাছে রাখতে। ফুপা খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। অতএব, মামার ঘাড়েই এসে পড়ল শফিক। মামার আর্থিক অবস্থা তখন খুব আহামরি কিছু না। তখন মোটামুটি বেতনের একটা চাকুরি করতেন। পরে চাকুরি ছেঁড়ে দিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি শুরুতে। যা আয়-রোজগার হয়, তা দিয়ে মধ্যবিত্ত মানের জীবনযাপন করা যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ের উন্নতি হয়েছে। ভাগ্নেকে পড়াশুনা করাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
এখনই বিয়ে করার চিন্তা শফিকের ছিল না। কিছুদিন হয় ফুপু উঠেপড়ে লেগেছেন ভাতিজার বিয়ের জন্য। তাই নিয়ে মামার সাথে প্রায়ই কথা বলেন ফোনে। মামার অবশ্য ভাগ্নের বউ খুঁজতে খুব একটা তাড়া নেই। মামিও গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছেন। এদিকে বুবুর শরীর খারাপ। বার্ধক্যের কারণে দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। মৃত্যুর চিন্তা চলে এসেছে। আগে একাই থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। কয়েকমাস হয়, ঢাকায় ছেলের বাসায় আছেন। তিনিও নাতির বিয়ের ব্যাপারে চিন্তিত। ফুপু আর বুবু দুজন মিলেই মুলত খুব করে চাচ্ছেন, শফিক দ্রুত বিয়ে করে ফেলুক। তার নিজের একটা পরিবার হবে তখন।
শফিকের কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট হলো, মামার বাসায় পারিবারিক পরিবেশে বড় হলেও উষ্ণতা অনুভব করেনি। বাবা-মায়ের অভাব সবসময়ই ছিল। আমিনা আর আনিসার সাথে কথা বলতে গিয়ে তার নিজের বোনের কথাই মনে পড়ছে। আমিরার সাথে সরাসরি কথা না বললেও কয়েকবার এও উল্লেখ করেছে, আমিরার ভাগ্য ভালো। ওর বাবা-মা আছেন। সঙ্গে দুই বোনও আছে। আজগর আলী তখনই হা-হা করে উঠলেন,
– তুমি এভাবে বলতেছ কেন? আমরা কি তোমার পর? তুমি চাইলে এখনই আমাকে আব্বা ডাকতে পার। আর এই যে তোমার আম্মা। সাথে দুই বোনও আছে।
আমিরা বাবার কথা শুনে মনে মনে বলল,
– দুই বোন আছে, বাপ-মা আছে এবার কি বাবা বলবে, বউও পেয়ে গেছ?
ইশ, কী লজ্জ্বা! বাবার কি মাথা আউলে গেল? কী বলতে কী বলে দিচ্ছে, ঠিক নেই! কিন্তু আজগর আলী আমিরার প্রসঙ্গ তুললেন না। বলা ভালো, সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন। আমিরার মন খারাপ হচ্ছিল। তবে বড় আপার নজরে এসেছে বিষয়টা, তাই বাঁচোয়া। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয়নি। আপাই নাশতার ট্রে নিয়ে যাবার অজুহাতে ওকে ভেতরের ঘরে পাঠিয়ে দিল।
======
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১০।
শোবার ঘরে ঢুকে আমিরার মনে হচ্ছিল, চারপাশ ভাঙচুর করে। কারণ আজকের এই বৈঠকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল, শফিক তাকে পছন্দ করেনি। বরঙ বাবাই বেহায়ার মতো উঠেপড়ে লেগেছে যেন বিয়েটা হয়। বাবার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আজই কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দিবে। কী দরকার ছিল এত আদিখ্যেতা দেখানোর? মেয়েপক্ষ বলে কি ওদের আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই? নাকি বানের জলে ভেসে এসেছে কন্যাসন্তান? শফিকের সামনে বসে থাকতে এত বেশি লজ্জ্বা হচ্ছিল আমিরার, মাথা যেন নুইয়ে মাটির সাথে মিশেই যায়।
বেশিক্ষণ একাকি আস্ফালন করার উপায় রইল না অবশ্য। আমিরা ভেতরে চলে আসতেই শফিক উঠি-উঠব করতে লাগল। তার নাকি দেরি হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু আজগর আলী এত সহজে ওকে ছাড়ার মানুষ নন। তিনি রাতের খাবার খেয়ে যাবার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন। খুব আহামরি রান্নাবান্না হয়েছে, তা নয়। শফিকের বিকেলে এসেই পাত্রী দেখে আর পরিচিত হয়ে চলে যাবার কথা। তাই রাতের আয়োজন সেভাবে করা হয়নি। বরং আর দশদিনের মতোই চারটা ডালভাত। কিন্তু তিনি চাচ্ছেন, শফিক তাদের সঙ্গে খাবে। এদিকে নাসিমা বানুর মুখ শুঁকিয়ে গেছে। তিনি ভাবতে লাগলেন, মেহমানকে কীভাবে আপ্যায়ন করবেন। মুখে চারটা ডালভাত বলাই যায়। তাই বলে মেহমানের পাতে ওসব দেয়া যায় না। মানসম্মানের ব্যাপার আছে না?
আমিনা হঠাৎ করেই বলল,
– আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন। আমিরার সাথে তো কথাই বললেন না।
শফিক লাজুক হেসে বলল,
– না মানে দেখা তো হলো। একসাথে নাশতাও খেলাম। আপনাদের সবার সাথেই কথা বলেছি।
– তবু আমিরার সাথে আলাদা করে কথা বলবেন না?
– আলাদা কী কথা বলব?
– সেটা তো আপনিই ভালো জানবেন। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন?
– আসলে আমার এটাই প্রথম। মানে আগে কখনো কারও বাসায় যাইনি পাত্রী দেখতে বা পরিচিত হতে। তাই…
– তাতে কি? দুদিন বাদে যাকে বিয়ে করবেন, তার সাথে আলাদা কথা বলার বিষয়টা তো সবারই জানা।
– ওসব নাহয় আমার ফুপু আর মামি মিলেই বলবেন।
আজগর আলী বললেন,
– তোমার মামা-মামি আর অন্য সবার সাথে কথা হবে আমাদের। কিন্তু তুমি কি আমিরার সাথে কথা বলতে চাও না? সত্যি করে বলো।
শফিক চুপ করে রইল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, সে আসলে কথা বলতে চায়। কিন্তু লজ্জ্বার কারণে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নাসিমা বানু আগবাড়িয়ে বললেন আনিসাকে,
– অ্যাই আনিসা, তুই শফিককে তোদের ঘরে নিয়ে যা। আমিরার সাথে বসে কথা বলুক কিছুক্ষণ।
তারপর আনিসা নিয়ে এসেছে শফিককে এই ঘরে। বাইরের ঘরের কথোপকথন সবটাই আমিরার কানে গেছে। তারপর পদশব্দ এগিয়ে আসছে শুনে চটজলদি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। লজ্জ্বা শুধু শফিকের একার না, তারও হচ্ছে। মরমে মরে যাচ্ছে সে। এমন নয়, আজই প্রথম কোনো ছেলের সাথে আলাদা করে কথা বলবে। আগেও দুই-তিনবার পাত্রের সাথে কথা বলেছে। প্রথমবার অস্বস্তি লাগলেও শেষ যে পাত্রের সাথে কথা বলেছিল, সাবলীল ভঙ্গিতেই বলেছে। পাত্র যা যা জিজ্ঞেস করেছে, উত্তর দিয়েছে। আবার সে নিজেও পাত্রকে দুটো প্রশ্ন করেছিল। পাত্রপক্ষ চলে যাবার পর নিজেই নিজেকে বাহবা দিয়েছে বেশ। মনস্থির করেছে, এখন থেকে যতবার পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসবে, পাত্রের সাথে আলাদা করে কথা বলার সময় সেও পালটা প্রশ্ন করবে। সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলবে। বলা যায় না, বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে তো দুদিন বাদে এই ছেলের সাথেই এক ঘরে থাকতে হবে! কিন্তু আজ তার মন বলছে, মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে ভালো হয়।
শফিককে ঘরে ঢুকিয়ে আনিসা চলে গেছিল। খানিকবাদে আরেকবার এসে দুই কাপ চা দিয়ে গেছে। শফিক নিজেই তার কাপটা তুলে নিয়েছে হাতে। অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছে। প্রায় কয়েক মিনিট হলো, কেউ কোনো কথা বলেনি। এবার আমিরা নিজেই বলল,
– আপনার বোধহয় আমাকে পছন্দ হয়নি। ঠিক না?
শফিক চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমিরার কথা শুনে বিষম খেল। অবাক সুরে বলল,
– কেন? তা হবে কেন?
– এই যে আমার সাথে কোনো কথা বলছেন না। এরকম হয়, যখন পাত্রী পছন্দ হয় না।
– হ্যাঁ কিন্তু আমি যতদূর জানি আমাদের বিয়ে অলরেডি ঠিক হয়ে গেছে। এখানে পছন্দ-অপছন্দ করার অপশনটা আর নেই।
– আপনি তো আমাকে এই প্রথম দেখলেন, তাই না? ও স্যরি, আগে মনে হয় ছবিও দেখেছেন।
– না আসলে ছবি দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু দেখা হয়নি।
– তাই?
– হ্যাঁ। আপনার বায়োডাটাও আমি পড়িনি।
আমিরা মনে মনে মুখ ভেংচাল,
– ওরে কী ভাব! ছবি দেখেননি উনি। না দেখলে কি তবে উনার ভুত রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে?
মুখে বলল,
– এতেই কিন্তু বুঝা যায়, আপনার এই বিয়েতে আগ্রহ নাই। ইটস ওকে। আপনি রাজি না থাকলে সরাসরি আমাকে বলতে পারেন। আমি আমার ফ্যামিলিকে ম্যানেজ করে নিব।
শফিক অপ্রস্তুত সুরে বলল,
– না না আপনি এরকম ভাবছেন কেন? আমার অবশ্যই আগ্রহ আছে। নইলে এতদূর আসব কেন? জানেন, আমার বাসা কোথায়? এখান থেকে ঠিক উল্টোদিকে। মানে ঢাকার অন্য সাইডে। আসতে প্রায় তিন ঘন্টা লেগেছে। আর ওয়েদারের যে কী অবস্থা, ওটা না বলি। আগ্রহ না থাকলে আমি আসতামই না।
– তাহলে আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?
– এই তো বলছি।
– কোনো প্রশ্ন করছেন না। আপনার কি কিছু জানার নেই আমার সম্পর্কে?
– আমি শুনেছি আপনার সম্পর্কে।
– শুনেই ক্ষান্ত? নিজে যাচাই করতে চান না কিছু?
শফিক এবার বিভ্রান্ত হলো। বলল,
– কী যাচাই করার কথা বলছেন?
– এই যে আমি আসলে কীরকম। আমার কথাবার্তা কীরকম। মেন্টালিটি কেমন।
– ভালোই তো মনে হচ্ছে।
– ওহ! তাহলে তো মনে হয় আপনি আমাকে পছন্দ করেছেন। আচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ করার অপশন নেই, এরকমই কিছু বললেন না একটু আগে?
– আমি আসলে ফরমাল দেখাদেখিটা প্রেফার করি না। বিয়ে মানেই তো সারাজীবনের ব্যাপারে। তাই যতটা সম্ভব ইনফরমাল হয়, ততই ভালো। এজন্যই আলাদা করে মেয়ে পছন্দ করার প্রসঙ্গ টেনে আনছি না। আপনার সম্পর্কে আমি শুনেছি। দেখাটুকু বাকি ছিল, দেখলাম। এই তো? এখানে পছন্দ হলো কী হলো না, ওই ব্যাপারটা না আসলেই ভালো।
– কেন?
– ধরুন আপনাকে আমার পছন্দ হলো না। আমি রিফিউজ করে দিলাম। তাতে কি আপনার লাইফ থেমে যাবে? যাবে না। আপনাকে দেখতে আবার কেউ একজন আসবে। সে হয়তো আপনাকে পছন্দ করেও ফেলবে। বিয়ে হবে। আবার ধরুন, আপনাকে পছন্দ হয়নি। তাই আবার অন্য এক মেয়েকে দেখতে গেলাম। তাকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। আমি বিয়েও করে ফেললাম। আপনার-আমার লাইফ কিন্তু থেমে থাকল না। আপনিও বিয়ে করে সংসারি হলেন। আমিও।
– হ্যাঁ তো।
– তাহলে এই রিফিউজ করাটা কেন? আপনার সাথে যদি কেউ একজন সংসার করতে পারে, আমি কেন পারব না? বা আমার কেন আপনাকে পছন্দ না হয়ে অন্য কাউকে পছন্দ হবে? আপনি একজন মেয়ে, সেও তো মেয়েই। এলিয়েন তো না! আকাশ থেকে নেমে আসা পরীও না। তাহলে আমি কেন আপনাকে রিফিউজ করে আবার মেয়ে দেখতে যাব?
আমিরা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। শফিকের যুক্তি তার মাথায় ঢুকেনি। তবু চুপ রইল আরও কথা শোনার জন্য। শফিক বলল,
– আমি শুনেছি, আল্লাহ নাকি জন্ম বিয়ে আর মৃত্যু তিনটা লিখে রেখেছেন। এই কথাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, যদি আল্লাহর হাতেই বিয়ের ব্যাপারটা নির্ধারিত হয়, তাহলে এইসব দেখাদেখি করাটা, পছন্দ-অপছন্দ করাটা আমার মতে ফালতু সময় নষ্ট। এই যে, আজকে আমি আসলাম আপনাদের বাসায়। ধরেন, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি ডিসিশন নিলাম, বিয়ে আপনাকেই করব। কিন্তু আল্লাহ যদি আমাদের জোড়া লিখে না রাখেন, বিয়েটা কি আদৌ হবে?
আবছা মাথা নাড়ল আমিরা,
– উহু, হবার কথা না।
– তাহলে আপনাকে পছন্দ করে আমার লাভটা কী হলো?
– হুম।
– আবার ধরুন, আপনাকে পছন্দ হলো না। কিন্তু আপনার সাথেই জোড়া লিখে রাখা আছে। তাহলে বিয়েটা হচ্ছেই! অপছন্দের মানুষের সঙ্গেই সারাজীবন সংসার করব।
– এটাও ঠিক।
– তাহলে দেখুন, আমরা কিন্তু অলরেডি এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। আজকের পর কী হবে, বিয়ে হচ্ছে কী হচ্ছে না, সেটা কবুল বলার আগপর্যন্ত কিন্তু আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না। আমাদের জোড়া লেখা থাকলে বিয়ে হবে। লেখা না থাকলে কোনো না কোনো বাঁধা আসবে। বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। তাহলে পছন্দ-অপছন্দের সুত্র ধরে এই অনিশ্চয়তা আরও বাড়ানোর দরকার কী?
শফিকের লজ্জ্বা বোধহয় কেটে গেছে। সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। আমিরারও এখন আর লজ্জ্বা লাগছে না। বরং কথা বলতে ভালোই লাগছে। এই ছেলের সাথে কথা বলায় এক ধরনের আরাম আছে, যেটা অন্য সব পাত্রদের বেলায় ছিল না। আমিরা ডানে-বায়ে মাথা নাড়ল। বলল,
– আপনার এইসব ঘোরপ্যাচ কথা আমি ঠিক বুঝলাম না। আমাকে স্ট্রেইট বলুন, পছন্দ হয়েছে নাকি হয়নি।
– বিয়ে অলরেডি ঠিক করে ফেলেছেন আমাদের গার্ডিয়ানরা। আর আমি কখনোই তাদের কথার উপর কিছু বলব না। সো, আমার দিক থেকে… ইয়েস, পছন্দ হয়েছে আপনাকে।
– এবার বলুন, কেন পছন্দ হলো?
– আমি তো বললামই, গার্ডিয়ানরা…
– উহু, আপনি গার্ডিয়ানদের কথা ভুলে যান। মনে করুন, আমরা দুজন আছি এখানে। আমাদের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে সামনে কথা এগোবে। আমরা হ্যাঁ বললে বিয়েটা হবে, না বললে হবে না। এখন আপনি বলুন, আমাকে যদি পছন্দ হয়ে থাকে, কী দেখে বা কী জন্য পছন্দ করলেন?
– আমি ঠিক জানি না। ভালো লেগেছে এটুকুই।
– তার মানে আমার মধ্যে স্পেসিফিক কিছু নেই, যা দেখে পছন্দ হবে। এই তো? আপনি আসলে আমাকে পছন্দ করেননি। আপনার বড় স্যার বলেছে, এইজন্য বিয়েটা করছেন।
শফিক চমকিত হলো। বলল,
– স্যারের কথা আপনি কী করে জানলেন?
আমিরা সবজান্তার হাসি দিয়ে বলল,
– ইটস ম্যাজিক!
– না আসলে আপনি যেরকম ভাবছেন, ব্যাপারটা তা নয়। কারও বলাতেই বিয়েটা করছি না।
– হুম।
আমিরা চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, সে শফিকের কথা বিশ্বাস করেনি। চেহারায় দুঃখী-দুঃখী ভাবও করে ফেলল। শফিক তাকে পছন্দ করেনি, এজন্য না। তার শফিককে খুব মনে ধরেছে। শফিক যেন কোনোভাবেই পিছিয়ে যেতে না পারে, যেন বিয়েটা বাতিল না হয়, তার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। এতকাল মনের মধ্যে বিয়ে না করার একটা বিদ্রোহ ছিল। এখন সেই বিদ্রোহ উবে গেছে। কী এক অদ্ভুত কারণে তার খুব ইচ্ছে করছে, পড়াশুনা বাদ দিয়ে শফিকের সাথে সংসার করতে। হ্যাঁ, সংসারটা খুব মন দিয়েই করবে সে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সংসারের কাজকর্ম শুরু হবে। আর শেষ হবে সেই রাতের বেলায়। সারাদিনে একদন্ড ফুসরত মেলার জো থাকবে না। হাঁপিয়ে উঠবে সে। অবশ্য দুইজনের সংসারে হাঁপিয়ে উঠার মতো কাজ নেই। তাই সেই চিন্তা করাটা বৃথা।
======
চলবে