তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৬।
আমিরার হাত-পা কাঁপছে। ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাওয়াটাই বাকি কেবল। তবু যতটা সম্ভব, সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কাজি অফিসের বাইরে এসে কোথাও একটু দাঁড়ালে ভালো হতো। কিন্তু তা করা যাবে না। কারণ রিফায়াত পেছন-পেছন আসছে। আমিরার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে খুব। খুব দূরে, যেখানে রিফায়াত থাকবে না। রিফায়াত যেন কখনো ওকে খুঁজেই না পায়। কেন এমন লাগছে, জানে না। রিফায়াতকে সে ভালোবাসে। অবশ্যই বাসে। এই ব্যাপারে একবিন্দু সন্দেহও নেই। তবু আজ রেজিস্টার খাতায় সাইন করার জন্য যে সাহসটুকু দরকার, তা সঞ্চয় করতে পারছে না। আজকের মতো নার্ভাস সে আগে কখনোই হয়নি।
রিফায়াত প্রায় চলেই এসেছে কাছে। আরেকটু হলেই ধরে ফেলতে পারবে আমিরাকে। গলা চড়িয়ে ডাকছে সে। কী ব্যাকুলতা সেই কন্ঠে! আমিরা দাঁড়িয়ে পড়ল একপাশে। আর পা চালাতে পারছে না সে। রিফায়াত সামনে এসে দাঁড়াতেই তার হাত চেপে ধরল সজোরে। এই মুহূর্তে রিফায়াত না থাকলে ধুপ করে পড়েই যেত। রিফায়াত অবাক সুরে প্রশ্ন করল,
– কী হয়েছে, আমিরা? তুমি ওভাবে উঠে আসলা কেন?
আমিরার বুক হাপরের মতো উঠানামা করছে। যেন অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছে। তখনই উত্তর দিতে পারল না সে। রিফায়াতও সময় দিল। তার হাতের মুঠোয় আমিরার হাত। রীতিমতো কাঁপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে। তাই হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। অবচেতন মন হয়তো ভয় পাচ্ছে, এই বুঝি দৌড়ে পালিয়ে গেল আমিরা।
কয়েক মুহূর্ত পর আমিরা ফিসফিস করে বলল,
– আমি বিয়ে করব না।
– কিন্তু কেন? কী সমস্যা?
– জানি না।
আমিরা উত্তর দিল না। রিফায়াত একটু বিরতি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
– তোমার মনে কি কনফিউশন আছে কোনো?
আমিরা উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। বলল,
– আমি এইভাবে বিয়ে করতে পারব না।
রিফায়াত প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শান্ত ভঙ্গিতে আমিরার হাতটা ছেঁড়ে দিল। তারপর বলল,
– তুমি কি চলে যেতে চাও?
– হু।
– একা যেতে পারবা? উবার ডেকে দিই। নাকি আমি পৌঁছে দিয়ে আসব?
– একাই যেতে পারব।
– আচ্ছা, উবার ডাকি।
– না, আমি উবারে চড়ব না। আমার ভয় লাগে।
– তাহলে? কীভাবে যাবে?
– রিকশায়।
– তোমার বাসা এখান থেকে অনেকদূর, আমিরা। এতটা পথ তুমি রিকশায় যেতে পারবে না। তার চেয়ে উবারে যাও। জলদি হবে।
– আমি বাসায় যাব না।
– তাহলে?
আমিরা চুপ করে রইল। রিফায়াত আবার জিজ্ঞেস করল,
– বাসায় যাবে না কেন?
– আপনাকে তো বললাম, আজকে ওই ছেলেটা আসবে। বড় খালা আর খালুও আসবেন।
– আসুক। তাতে প্রবলেম কী?
– যদি আজই বিয়ে পড়ায়?
– নাও হতে পারে। বিয়ে পড়াবেই, এমন কথা নিশ্চয়ই কেউ বলেনি।
– কিন্তু আমার মনে হচ্ছে।
– বিয়ে হলেই বা কী? তুমি তো আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছ না। তাহলে ফ্যামিলির পছন্দটাই অ্যাকসেপ্ট করে নাও।
আমিরা মুখ তুলে তাকাল। তার চোখ টলমল করছে নোনাপানিতে। রিফায়াতও তাকিয়ে রইল। খানিকবাদে চোখ সরিয়ে ফেলল সে। বলল,
– বাসায় চলে যাও, আমিরা। অন্য কোথাও থাকার প্ল্যান করো না। তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তুমি আজ বাসায় না ফিরলে সিচুয়েশন আরও ঘোলা হবে।
আমিরা কান্না চেপে রাখতে পারছে না। তার বুকের ভেতর লুকানো ব্যাকুল অনুভূতি নিজেদের প্রকাশ করতেও উদগ্রীব। ঝট করে রিফায়াতকে জড়িয়ে ধরল সে। তার বুকে মুখ গুঁজে কান্না লুকোবার প্রাণপন চেষ্টা করতে লাগল। রিফায়াত অবাক হলেও চুপ রইল। আশপাশে এক ঝলক তাকিয়ে আলতো ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরল আমিরাকে। লক্ষ করার মতো কেউ নেই এখানে। তবে কমল নামের বন্ধুটা কাজি অফিসের বাইরে চলে এসেছে। দুজনকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়ল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
– ঘটনা কী রে?
আমিরা তাকে লক্ষ করেনি। রিফায়াত উত্তর দিল ইশারায়,
– ম্যানেজ হইতে সময় লাগবে। তুই যা, আমি ওকে নিয়ে আসতেছি একটু পর।
কমল আশ্বস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। আমিরাকে শক্ত বাহুডোরে আগলে ধরে রিফায়াত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমিরার জন্য রিফায়াতের প্রচন্ড খারাপ লাগছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। জোর করে হলেও আমিরাকে বিয়ে করতে মন সায় দিচ্ছে। মন বলছে, আজ যদি এই বিয়ে না হয়, আর কখনোই হবে না। মনের মধ্যে যত যাই চলুক, তার বহিপ্রকাশ ঘটছে না। বহু কষ্টে নিজের অনুভূতি সামলে রেখেছে। বিয়ে কোনো জোরজবরদস্তির বিষয় না। বিয়েটা হতে হয় স্বেচ্ছায়। আমিরা না চাইলে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।
আমিরা অস্ফুট সুরে বলল,
– আপনাকে নিয়ে আমার কোনো কনফিউশন নাই। বিয়ে আমি আপনাকেই করব।
– তাহলে উঠে আসলা কেন?
– কাজি অফিসে বসে বিয়ে করতে চাই না। এই কাজি অফিস জায়গাটা ভালো না। এখানে যারা বিয়ে করতে আসে, তাদের বিয়ে টিকে না।
– এটা তোমার ভুল ধারণা।
– উহু, আমি জানি। বড়াপার সাথে এরকম হয়েছে। এরপর আমাদের উপরতলায় একটা মেয়ে থাকত। ও বিয়ে করেছিল কাজি অফিসে। ওর ফ্যামিলিও ছিল। পরে বড় করে অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু বিয়েটা পড়াইছিল কাজি অফিসে। ওই মেয়ে ছয় মাস পরেই সংসার ফেলে চলে আসছে।
– শোন, বিয়ে আর ডিভোর্স দুটো কিন্তু কানেকটেড। বিয়ে হলে ডিভোর্স হবার পসিবিলিটি চলে আসে। কিন্তু সেটা কনফার্ম হবে কি না, তা ডিপেন্ড করে দুজন মানুষের চিন্তাধারার উপর। হুট করে দুই ফ্যামিলি থেকে দুজন এক ছাদের নিচে থাকতে গেলে নানা রকম ঝামেলা হবার চান্স থাকে। তখন অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপার চলে আসে। স্যাক্রিফাইস করতে হয়। মানিয়ে চলতে না পারলে তো ডিভোর্স হবেই। আরও কিছু কারণ থাকে। যেমন এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার, বেবি না হওয়া এটসেটরা। বিয়ে বাসায় পড়ানো হলো নাকি কাজি অফিসে, তার সাথে ডিভোর্সের কানেকশন নাই।
– উহু, অবশ্যই আছে। কাজি অফিসে বিয়ে হলেই দুইদিন পর ডিভোর্সের গুনগুনানি শুরু হয়। এরকম অনেক কাহিনি শুনছি। আমি চাই না, আমার লাইফে এরকম কিছু হোক। আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই। বাবার বাড়ি ফিরব না। বড়াপা চলে আসছে, এইটা বাবা-মা কোনো না কোনোভাবে মানতে পারছে। মন থেকে না পারলেও চেষ্টা করতেছে মেনে নেয়ার। তারপরেও মা অনেক টেনশন করে। মাঝেমধ্যেই বড় খালার সাথে আপার বিয়ে নিয়ে কথা বলে। খালা মাকে পালটা বুঝায়। আপাও বিয়ের কথা শুনলে রাগারাগি করে। সে নাকি বিয়েই করবে না। আমার সাথেও সেইম কাহিনি হলে মা একদম মানবে না। আমাকে জায়গাই দিবে না বাসায়। বলবে, ঘরের মধ্যে দুই-দুইটা ডিভোর্সী মেয়ে থাকলে আনিসার বিয়ে তো দেয়া যাবে না। তাছাড়া বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার উপায়ও তো আমার নাই। বড়াপা অনেক স্মার্ট। মানুষের সাথে ইজিলি চলতে-ফিরতে পারে। সে চাকুরি জুটিয়ে ফেলছে। বড় খালাও সাপোর্ট দিয়েছে অনেক। কিন্তু আমাকে দিবে না। আমি তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করলাম না, এই জন্য। আমি অত স্মার্টও না, নিজে জব জোগাড় করব।
– শসসস, তুমি কি পাগল? একলা-একলাই কত কী ভেবে ফেলতেছ! তোমার কেন মনে হচ্ছে আমরা একসাথে থাকব না?
আমিরা উত্তর দিল না। রিফায়াত আবার বলল,
– আমরা একসাথে থাকব, আমিরা। ঠিক আছে? আমাদের লাইফে যত যাই হোক, যত ঝড় তুফান আসুক, আমরা কখনোই আলাদা হব না। আই প্রমিজ! আমি এই কথা গতকালও তোমার বাবাকে বলছি। তারপরেও যদি তোমার মনে হয়, আমরা একসাথে থাকব না, আমি অন্তত এতটুকু অ্যাশিউর করতে পারি তোমাকে বাবার বাসায় ফিরতে হবে না। আমার বাবা-মায়ের প্রপার্টি আছে। ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। সবকিছুর আমি একাই মালিক। বিয়ের পর তুমিও এই মালিকানার অংশীদার হবা। আমি তোমার নামে অর্ধেক ট্রান্সফার করব, যাতে আমাদের ডিভোর্স হলেও তুমি যেন সেলফ ডিপেন্ডেন্ট থাক।
আমিরা মুখ তুলে তাকাল। বলল,
– সত্যি? আপনি লিখে দিবেন আমাকে অর্ধেকটা?
– হ্যাঁ দিব।
– প্রমিজ বলেন।
– প্রমিজ!
আমিরার মুখে হাসি ফুটল। রিফায়াতকে ছেড়ে খানিক সরে দাঁড়াল সে। দুই হাতে চোখ মুছে বলল,
– চলেন, বিয়ে করি।
=========================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৭।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে শেষমেশ আমিরা স্বাক্ষর করে ফেলল। কলমের কালিতে নিজের নাম সে অনেকবার লিখেছে। বইখাতায় অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নিজের নামটা বারবার লেখা তার বদভ্যাস বলা চলে। কিন্তু আজকের এই স্বাক্ষর দেয়াটা জীবনের বাকি দিনগুলোর প্রতি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। এই স্বাক্ষর তার জীবনটাই পালটে দিতে বাধ্য। সত্যি কি তাই?
রিফায়াতকে সে অবিশ্বাস করে না। অল্প সময়ের পরিচয় হলেও মনের মধ্যে এতই পাকাপাকিভাবে গেড়ে বসেছে, সমূলে তাকে উৎপাটন করা তো দূরে থাক, তাকে নিয়ে একবিন্দু নেতিবাচক শব্দও মনের মধ্যে জায়গা পায়নি। তবু নাম লেখার সময় খচমচ লাগছিল খুব। কী একটা ভয় মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বুকের ভেতর দুমদাম হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। রিফায়াত বোধহয় ওর অনুভূতিগুলো টের পেয়ে যাচ্ছিল। স্বাক্ষর করার সময় আমিরার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল সে। চোখে-চোখে কথা বিনিময় হলো, যার অর্থ ‘সাইন করো’।
এর মধ্যে কাজি আচানক বললেন,
– একটা কথা বলেন তো আমাকে। এরা কি আপনাকে জোর করে নিয়ে আসছে?
রিফায়াত তেঁতে উঠল,
– কী বলতেছেন হাবিজাবি! জোর করে নিয়ে আসব কেন ওকে? বিয়ে কি জোরজবরদস্তির ব্যাপার নাকি?
কমল বলল,
– না না, জোর করে আনে নাই।
কাজি তাও গোয়ারের ভঙ্গিতে বললেন,
– আমি আপনাদের জিজ্ঞাস করি নাই। বিয়ের পাত্রী নিজেই বলুক।
আমিরা এতক্ষণে মুখ খুলল,
– আমাকে জোর করে নিয়ে আসে নাই। আমি নিজের ইচ্ছায় আসছি।
– আপনি শিউর তো?
– হ্যাঁ।
– একটু আগে যে উঠে গেলেন!
– সেটা আলাদা ব্যাপার। আমাদের মধ্যে পরে সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে।
– কী ঠিক হলো, জানতে পারি?
রিফায়াত আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমিরা তার আগেই বলল,
– উনি আমাকে প্রমিজ করছে, আমরা সারাজীবন একসাথে থাকব। যদিওবা কোনোদিন সেটা সম্ভব না হয়, যদি কোনো সমস্যা চলে আসে, তাইলে যেন আমাকে বাবার বাড়িতে ফিরতে না হয়।
– খালি প্রমিজ করলেই হবে? কাজেও তার প্রমাণ দিতে হয়। আপনি দেনমোহর লিখাইলেন আঠারোশ বাষট্টি টাকা। এই টাকা দিয়ে কী করবেন এই যুগে?
– আঠারোশ বাষট্টি টাকার কথা আসতেছে কেন? এই টাকা তো আমি অলরেডি নিয়ে ফেলছি উনার থেকে। এইটার লেনদেন শেষ। উনি আমাকে উনার প্রপার্টির অর্ধেক আমাকে লিখে দিবে। তাতে করে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারব।
কাজি হাসলেন। বললেন,
– আপনি অনেক আলাভোলা মেয়ে, বুঝতে পারছি। এইজন্য আমার সন্দেহ লাগতেছে এরা আপনাকে ভুলভাল বুঝাইছে। এখনো চিন্তা করে দেখেন বিয়েটা করবেন নাকি। এই সাইন করলেই কিন্তু…
রিফায়াত বলল,
– আপনি না কাজি? আপনার কাজ হচ্ছে বিয়ে পড়ানো। অথচ আপনি এখন বিয়ে ভাঙ্গানি দিতেছেন!
– এইটা পাত্রীর নিজের দরকারেই বলতেছি। উনার সারাটা জীবন এইখানে জড়িত। আপনি ছেলে মানুষ। এই বিয়ের কারণে আপনার লাইফে খুব বেশি কিছু যায় আসবে না। কিন্তু মেয়ে মানুষের লাইফ হইতেছে ট্রেনের মতো। একবার রেল লাইন থেকে উনিশ-বিশ হইলেই ছিটকে কোথায় গিয়ে পড়বে, তার ঠিক নাই।
– আপনি বেশি কথা বলেন। এখন থেকে কম কম কথা বলার চেষ্টা করবেন।
– আপনার এত বেজুত লাগতেছে কেন? আমি কথা বলতেছি পাত্রীর সাথে। সে উত্তর দিক। আপনি মুখ বন্ধ রাখেন। নাবালিকা মেয়ে নিয়ে আসছেন বিয়ে করতে। বয়স প্রমাণের সার্টিফিকেট নাই। মেয়ে বলতেছে, তার এখনো আঠারো হয় নাই। পুলিশ ধরলে তো আপনারে চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকাবে। সাথে আমার উপরেও হামলা দিবে। বেশি কথা আমি এইজন্যই বলতেছি। এইরকম কেস তো আজকে নতুন দেখতেছি না। মেয়ে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে আইসা বিয়ে করার কাহিনি অনেক হয়। পরে ফ্যামিলির প্যাদানি শুরু হইলে মেয়ে বলে, তাকে নাকি ছেলে উলটাপালটা বুঝাইয়া নিয়ে আসছিল।
রিফায়াত চোখমুখ শক্ত করে বলল,
– আমিরা এই কথা কোনোদিন বলবে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমাদের আগে থেকে বিয়ে করার প্রিপারেশন ছিল না। নাইলে বয়স প্রমাণের সার্টিফিকেট এনে আপনার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতাম।
– ওই তো। ফেক সার্টিফিকেট নিয়ে আসবেন। আসলটা তো আনা পসিবল না।
– ফেক বলেই আপনাকে এনাফ টাকাপয়সা দেয়া হয়েছে। তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট না? নাকি এতগুলো টাকা পেয়ে আরও ঘুষ খাইতে মন চাচ্ছে?
আমিরা বলল,
– কত টাকা নিয়েছে উনি?
রিফায়াত উত্তর দিল না। কাজি বললেন,
– বিশ হাজার টাকা অফার করছে উনার বন্ধু।
রিফায়াত বলল,
– আমিরা, তুমি এর মধ্যে কথা বলো না। আমি ডিল করতেছি উনার সাথে।
আমিরা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে কাজিকে বলল,
– এই বিশ হাজার টাকা কি শুধু ফেক সার্টিফিকেটের জন্য?
– জি।
রিফায়াত আবার বলল,
– আমিরা!
আমিরা হাত তুলে বলল,
– ওয়েট। আমি একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করি আগে। এরপর আপনি ডিল করবেন নাকি সেইটা আপনার ব্যাপার।
রিফায়াত অসহায় ভঙ্গিতে বন্ধুর দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে অবশ্য আগুন ঝরছে। সেই আগুন দৃষ্টির ভাষা স্পষ্ট,
– হারামজাদা, একটা কাজি ম্যানেজ করার যোগ্যতা নাই তোর। টাকা দেয়া হয়েছে। এরপরেও বদমাইশ কাজি ফরফর করতেছে কী জন্য? এমনিতেই আমিরা স্ট্রংলি ডিটারমাইন্ড না। একবার অলরেডি উঠে চলেই গেছিল। অনেক কষ্টে বুঝিয়েশুনিয়ে ফেরত আনছি। আবার যদি চেয়ার ছেঁড়ে উঠে, তো বুঝিস। তোর একদিন কী আমার একদিন। আজকে আমার বিয়ে ভাঙ্গলে তোর বিয়ে আমি জীবনেও হইতে দিব না।
কমল সহজেই কথাগুলো পড়ে নিল। তার গলা শুঁকিয়ে কাঠ হচ্ছে। রিফায়াতের সম্ভাব্য রোষানলে পড়লে তার কপালে কী কী ঘটতে পারে, সেটা অনুমানের চেষ্টা করল। আর কিছু না হলেও এই জীবনে বিয়ে যে হবে না, এটা নিশ্চিত। শেষের কথাটাই রিফায়াতের আগুন দৃষ্টির মূল অর্থ। কমল মিনমিন করে কাজির উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাচ্ছে। আমিরা তাকেও থামিয়ে দিল। তারপর কাজিকে বলল,
– আচ্ছা ধরেন, আমার মা আর বড়াপা সাথে আমার বড় খালা আর খালু মানে আমার ফ্যামিলি আসলো আপনার কাছে। তারাই আমার বিয়ে দিবে। সেই ক্ষেত্রে বয়সের ব্যাপারটা আপনি কীভাবে ম্যানেজ করতেন?
– ফ্যামিলির লোকজন হলে বিষয়টা আলাদা।
– কেন? আলাদা কেন? বাংলাদেশের আইনে তো আঠারোর নিচে মেয়েদের বিয়ে করার নিয়ম নাই।
– বাংলাদেশের আইনে না থাকলেও ইসলামী শরীয়তে নিয়ম আছে। ফ্যামিলির মানুষজন নাবালিকার পক্ষে অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে।
– আচ্ছা। তাহলে কে হবে আমার অভিভাবক? আমার মা, বড়াপা নাকি খালা-খালু?
– একজন পুরুষ থাকলে ভালো হয়। আপনার খালু হইতে পারে। যদি সেরকম কেউ না থাকে, তাইলে আপনার মা। মায়ের পর বড় বোন।
– কেন? বাবা থাকলে হবে না? আমার বাবা তো বেঁচে আছে।
কাজি বিষয়টা খেয়াল করেননি প্রথমে। এবার থতমত খেয়ে বললেন,
– বাবা বেঁচে থাকলে তো বাবাই আসল অভিভাবক।
– তার মানে আমার বাবা চাইলে নাবালিকা অবস্থায় আমার বিয়ে দিতে পারবেন।
– জি।
– কিন্তু আমার বাবা পঙ্গু। কাজি অফিস পর্যন্ত সে আসতে পারবে না। সেইক্ষেত্রে কী করণীয়?
রিফায়াতের ধৈর্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার রাগ গিয়ে পড়ছে আমিরার উপর। এই মেয়ে এত প্যাঁচালো কেন? পেটের মধ্যে দুনিয়ার প্যাঁচ নিয়ে ঘুরঘুর করে। প্রথমবার ফট করে মন পালটে ফেলল সে নাকি বিয়েই করবে না। কাজি অফিস নিয়ে তার মনের মধ্যে ভুল ধারণা গেড়ে আছে। সেই ধারণা ভাঙ্গতে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। বহু কথা খরচ করে, ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে এরপর তাকে ফেরত আনা হয়েছে। এখন আবার নাবালিকার অভিভাবকত্ব নিয়ে কাহিনি শুরু করল!
এখন ধৈর্য সামলে রাখা সত্যিই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সে চোখমুখ শক্ত করে আমিরাকে বলল,
– আমি বাইরে গিয়ে সিগারেট খাব। তোমার এই জাতীয় কনভারসেশন শেষ হলে প্লিজ সাইনটা করে দিও। এরপর আমাকে ডাক দিবা।
– ওয়েট। এতক্ষণ বসে থাকতে পারছেন। আরেকটু কষ্ট করেন। আমার কথাবার্তা প্রায় শেষ।
রিফায়াত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমিরার দিকে। আমিরা স্মিত হেসে আবার কাজির দিকে মনোযোগ দিল। বলল,
– হ্যাঁ বলেন। বাবা পঙ্গু হলে তো তার পক্ষে কাজি অফিসে আসা পসিবল না।
– সেরকম বিষয় হলে তার লিখিত অনুমতি দিলে ভালো। তার পক্ষে অন্য একজন কাজির সামনে উপস্থিত থাকতে পারবে। অথবা চাইলে কাজিকে বাসায় ডেকে নেয়া যায়।
– আমি আপনাকে আমার বাবার লিখিত অনুমতি এনে দিব। এবং এই বিয়েতে আমার উকিল হিসেবে যিনি আছেন, তিনি আমার বাবার পক্ষে উপস্থিত আছেন, এরকম একটা লাইনও সেই অনুমতি পত্রে থাকবে। ঠিক আছে? তবে আপনাকে বিশ হাজার টাকা রিটার্ন করতে হবে। এই টাকা আপনাকে দেয়াই হচ্ছে যেন সলিড এভিডেন্সের ফাঁকফোঁকর আপনি ম্যানেজ করতে পারেন।
কাজি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই মেয়েকে তিনি আলাভোলা ভেবেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, মেয়ে জাতে মাতাল তালে ঠিক। নয়তো এই বুদ্ধি তার মাথায় আসত না। তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
– আমার আরও বিয়ে পড়ানো বাকি আছে। আপনি সাইনটা করে দেন।
– তার আগে বলেন, আপনি টাকা নিবেন নাকি অনুমতি পত্র নিবেন?
এদিকে রিফায়াতের মন বলছে, এই প্যাঁচওয়ালী মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। সারাজীবন আমি প্যাঁচগোছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। আর এখন কি না আস্ত প্যাঁচওয়ালীই আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে! বাবা কি সহজ ধরনের কোনো মেয়ে খুঁজে পায়নি ছেলের বউ করার জন্য? আর ফুপুরও কি একবার মনে হলো না, এই প্যাঁচওয়ালী মেয়ে নিয়ে তার ভাতিজা কীভাবে সংসার করবে? ফুপু তো জানে আগের সম্পর্কগুলোর কথা। রিমাকে তার অনেক পছন্দ হয়েছিল। তখনো ভাইয়ের পছন্দের ভুত তার মাথায় চেপে বসেনি। বড় স্যারের সাথে সেভাবে যোগাযোগও ছিল না অনেক বছর। তাই তখন রিমা বলতে ফুপু অজ্ঞান ছিল।
মামির হাতে অপমানিত হবার পর রিমার পেটের মধ্যে যত ধরনের প্যাঁচ আছে, বের হয়ে এলো। নানারকম শর্ত দিল সে। তাকে বিয়ে করতে হলে মামা-মামির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে। বুবুও চলে যাবে মামার সাথে। এখানেই শেষ নয়। রিমার বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রিফায়াতকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে মামা-মামির পক্ষে। আরও কী কী যেন শর্ত দিয়েছিল। রিফায়াতের অত মনে নেই। তার মাথায় কেবল একটাই শব্দ ছিল, ব্রেকআপ। এই প্যাঁচওয়ালী জিলাপির সাথে সে সারাজীবন থাকতে পারবে না। তাছাড়া, মামা-মামি তার কাছে পিতামাতার চেয়ে কোনো অংশে কম না। তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাও তার পক্ষে সম্ভব না। এগুলো সব ফুপু জানে। ফুপুকে সে এও বলেছিল, বিয়ে করলে সহজ-সরল আলাভোলা ধরনের কোনো মেয়েকেই করবে, যার মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্যাঁচ নেই। এরপরেও ফুপু জেনেশুনে এমন কাজ করতে পারল? ভাইয়ের পছন্দের ছুঁতো ধরে এই জিলাপিকে জোগাড় করল? অবশ্য ফুপুর এই কাজে অবাক হবার কিছু নেই। সে নিজেও নারী জাতির একজন। মামি-ফুপু-বুবু-রিমা সবাই প্যাঁচওয়ালা জিলাপি।
রিফায়াতের দমবন্ধ হয়ে আসছে। সে বড়সড় নিঃশ্বাস ফেলে আমিরার কাঁধে হাত রাখল। আমিরা ঘুরে তাকাতেই শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
– তুমি যদি এখন এই মুহূর্তে সাইন না করো, আমি উঠে চলে যাব।
– কথা প্রায় শেষ। আর অল্প একটু বাকি আছে। আপনি এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন?
– এক।
– কী?
– দুই।
কমল মুখ নামিয়ে আমিরার কানে কানে বলল,
– তিন পর্যন্ত গুনবে। এর মধ্যে আপনি সাইন না করলে এই বিয়ে আর হওয়া লাগবে না। রিফায়াত খুবই ত্যাড়া ধরনের মানুষ।
– সোয়া দুই…
আমিরা হতভম্ব ভঙ্গিতে বলল,
– দুই এর পর তিন হয়। সোয়া দুই আসলো কোথা থেকে?
– আড়াই।
– এভাবে কাউন্ট করে নাকি কেউ?
– পৌণে তিন।
আমিরা আর কোনো ঝুঁকিতে গেল না। রিফায়াত তিন বলার সাথে সাথেই তার সাইন করা শেষ। রেজিস্টার খাতাটা এগিয়ে রিফায়াতকে দেখাল সে। রিফায়াত এক ঝলক দেখল খাতাটা। তার মনের মধ্যে আশার আলো যতটুকু জ্বলছিল, ধপ করে নিভে গেল। এই প্যাঁচওয়ালী মেয়ের সাথে বিয়েটা কি সত্যি-সত্যিই হয়ে গেল? নাকি সে সাইন করার পরই বিয়ে সম্পন্ন হবে?
কাজি বললেন,
– এবার আপনি সাইন করুন। এখানে।
আমিরা বলল,
– উনি সাইন করার আগে আমি কথা শেষ করে নিই? আপনি ঝটপট বলে ফেলেন, অনুমতি পত্র নিবেন নাকি বিশ হাজার টাকা। তাড়াতাড়ি বলবেন। আমার হাজব্যান্ড কিন্তু খুব ত্যাড়া ধরনের মানুষ। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে সে বসে আছে চুপচাপ। এটাই মনে করেন আপনার চৌদ্দ জেনারেশনের কপাল। তার পকেট থেকে টাকা খসিয়ে আবার কথা শোনাবেন ফরফর করে। আর আমি সেইটা হজম করব, ভাবলেন কী করে? আপনি নিজেই দুই নাম্বার। আবার বড় গলায় কথা বলেন…
রিফায়াত ক্ষমা করে দিল আমিরাকে। এই প্যাঁচওয়ালী মেয়ের সাথে আজীবন থাকতে তার হয়তো কষ্ট হবে। তবু এই মুহূর্তে আমিরার কথাগুলো তার মন ভালো করে দিল। ঝটপট সাইন করল সে। তারপর হাসিমুখে আমিরাকে বলল,
– তুমি এখন তোমার প্যাঁচওয়ালা কথাবার্তা শেষ করো। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। এখনই সিগারেট না খেলে আমার জান বের হয়ে যাবে।
বলেই দ্রুত বের হলো কাজি অফিস থেকে। দুই বন্ধু ওর পিছু নিল। বোধ করি, তাদেরও ভালোরকমের পিপাসায় ধরেছে, নিকোটিনের পিপাসা। কমলের এইসব অভ্যেস নেই। সে রয়ে গেল আমিরার সাথে। তাছাড়া টাকাপয়সার বন্দোবস্ত করেছিল সে নিজে। তাই এই আলোচনায় তার থাকাটা জরুরী।
বাইরে এসেই রিফায়াত সিগারেটে আগুন ধরাল। পাশে দুই বন্ধু। তারাও সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিল। দুই-একটা টান চলল নিশ্চুপ। তারপর এক বন্ধু মুখ খুলল,
– তুই বুঝেশুনে বিয়েটা করলি তো?
রিফায়াত বলল,
– কেন? কী সমস্যা?
– এই মেয়ে কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। বিয়ের আগেই যেভাবে টাকাপয়সার পাই পাই হিসাব করতেছে। আঠারোশ বাষট্টি টাকা যেমনে ব্যাগের মধ্যে ঢুকাইল।
আরেক বন্ধু বলল,
– ওই টাকা তো আবার দিয়ে দিছে রিফায়াতকে।
রিফায়াত বলল,
– সেকেন্ড টাইম কাজি অফিসে ঢুকার আগে আবার টাকাগুলো নিয়ে নিছে।
– অ্যা?
প্রথম জন বলল,
– এই মেয়ে শুধু ডেঞ্জারাস না। ধুরন্ধরও। আঠারোশ বাষট্টি টাকার দেনমোহরে বিয়ে করতে রাজি হইছে। এইটা আসলে তার নাটক। তোর কী মনে হয়, সে দেনমোহরের অঙ্ক সম্পর্কে জানে না কিছু?
দ্বিতীয় বন্ধু বলল,
– অবশ্যই জানে। এইখানে রিফায়াতের সামনে সে বোকা সাজার ভান করতেছে। কিন্তু অভিনয়টা আবার ভালো পারে না। এইজন্য তার জারিজুরি সহজেই বের হয়ে যাইতেছে।
রিফায়াত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল,
– এই বিয়েটা করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো অপশন নাই। ফুপু সহজে আমাকে ছাড়ত না। আর মামিও আছে অন্য তালে। তার পছন্দের লিস্টে দুই-তিনটা মেয়ে আছে। সবথেকে প্রায়োরিটি হচ্ছে তার বোনের মেয়ে।
– তুই না কানে ধরছিলি, প্যাঁচওয়ালী বিয়ে করবি না। আমিরা কিন্তু বিরাট প্যাঁচওয়ালী। চামে চামে তোর কাছ থেকে প্রমিজ আদায় করে নিয়েছে, হাফ প্রপার্টি ট্রান্সফার করতে হবে!
– এরা সবাই হচ্ছে প্যাঁচওয়ালী। আমার ধারণা, প্যাঁচ ছাড়া কোনো মেয়ে এই দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই প্যাঁচওয়ালী বিয়ে করতে না চাইলে সারাজীবন আনম্যারিড থাকতে হবে। আর সেটা ইম্পসিবল। আমার চারপাশে যারা আছে জ্ঞাতিগুষ্টি, তারা আমার বিয়ে না দিয়ে ক্ষান্ত হবে না। প্যারা দিতেই থাকবে একের পর এক। তাছাড়া, আমি জাস্ট প্রমিজ করছি। অর্ধেক তো লিখে দেই নাই। লিখে দিব, তার গ্যারান্টিই বা কী?
– তাইলে প্রমিজ করলি কেন? আগেই বলে দিতে পারতি, এইসব প্রমিজ-টমিজ করতে পারব না। বিয়ে করলে এমনেই করো, না করলে ভাগো। এই মেয়ে তোকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়ায় আছে। তুই প্রমিজ না করলেও সে বিয়ে করত।
– আমাকে বিয়ে করার জন্য আমিরা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি দুই পায়ে দাঁড়ানো। বিকজ, আমিরা ইজ ভেরি মাচ স্পেশাল। আমার বাবার পছন্দ করা মেয়ে সে। আমি জানি না, কখন কবে বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল তার আর বড় স্যারের মধ্যে। কিন্তু ফুপু বলেছে, ওটাই নাকি বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল। আমার নানুবাড়ি থেকে ঢাকায় আসার পথেই ফুপুর শ্বশুরবাড়ি পড়ে। বাবা নাকি ওখানে থেমেছিল। ফুপুর সাথে দেখা করে আবার রওনা হয়েছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেবার নাকি ফুপুকে সে আমিরার কথা বলেছিল। ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে বড় স্যারের সাথে ভালোমতো আলোচনা করা হয়নি তখন। বলেছিল, শীতের ছুটিতে আবার গ্রামে যাবে। তখন যেন ফুপুও দাদুবাড়িতে যায়। আমিরার বাবা-মায়েরও তখন গ্রামে যাওয়া হবে। দুই ফ্যামিলি মিলে ফাইনাল আলোচনা করবে। কিন্তু তার আগেই…
কমল পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রাখল। বলল,
– দোস্ত, বুঝতে পারছি বিষয়টা। তুই আসলে ইমোশনালি আটকে আছিস ওই সময়টায়।
– হয়তো।
আমিরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল,
– কোন সময়ের কথা বলতেছেন?
– যখন আপনার বাবা-মা আর রিফায়াতের বাবা-মায়ের সামনাসামনি বসে আপনাদের বিয়ের কথাবার্তা বলার ছিল। সেই সময়টা কোনোদিনই আসে নাই। তার আগেই আংকেল-আন্টি মারা গেছেন।
আমিরার মুখে কালো ছায়া ঘনিয়ে গেল। বুকের ভেতরকার খচমচে অনুভূতি আবার ফিরল। রিফায়াত বলল,
– এখনো আসল ঝড়ঝাপটা বাকি আছে। আগামী কয়েকদিন তুমি আমার বাসায় থাকবা। তোমার ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করার দরকার নাই। তাদেরকে আমি নিজে ম্যানেজ করব। ঠিক আছে?
আমিরা খানিক অন্যমনস্ক ছিল। চমকে উঠে বলল,
– না, আমি বাসায় যাব। মানে আমার বাসায়।
– কেন? বিয়ে তো হয়ে গেছে আমাদের।
– হ্যাঁ সেজন্যই বাসায় যাব। এখন তো আর কোনো ভয় নাই।
– আছে। বিয়ে করলেও কাবিননামা এখনো আমাদের হাতে আসে নাই। তাছাড়া তোমার বয়স নিয়েও ঘাপলা আছে। আজ তুমি তোমার বাসায় না গেলেই ভালো হবে।
– আমি আপনার বাসায় যাব না।
– কেন? আমার বাসায় কী সমস্যা?
– আছে। অনেক বড় একটা সমস্যা আছে।
– আমাকে বলো। সমস্যা থাকলে দুজন মিলে সলভ করব।
আমিরার ইতস্তত করতে লাগল। রিফায়াত ভাবল, ওর বন্ধুদের সামনে আমিরা এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাচ্ছে না। তাই কমলকে বলল,
– দোস্ত, তোদেরকে অনেক অনেক থ্যাংকস। খুব বড় একটা উপকার করছিস আমার। আমি কোনোদিন এই উপকারের কথা ভুলব না।
কমল হেসে বলল,
– যা, কী কস এইগুলা?
অন্য এক বন্ধু বলল,
– আমাদের ফ্রেন্ডলশিপ কি এতই ফরমাল, আলাদা কইরা থ্যাংকস দেয়া লাগবে?
আরেকজনও সুর মিলাল,
– তুই ভুলে যাইস আজকের কথা। আমরাও মনে রাখুম না।
রিফায়াত বলল,
– সিরিয়াসলি বলতেছি। তোরা না থাকলে এই বিয়েটা পসিবল হইত না। তবে এইবার তোরা ভাগতে পারিস।
– কী কস? তুই বিয়ে করলি। ট্রিট দিবি না?
– ট্রিট বাকি রাখ আপাতত। আমার শ্বশুরবাড়ির ভ্যাজাল আগে ক্লিয়ার করি। অনেক ফাড়া যাবে, বুঝাই যাইতেছে।
কমল বলল,
– আসল ভ্যাজাল তোর নিজের ফ্যামিলিতে। ভাবিকে দেখার পর তোর মামি কী রিএকশন দিবে, আমি জাস্ট কল্পনাও করতে পারতেছি না।
– ওটা কোনো সমস্যা না। তার রিএকশন ম্যানেজ করার জন্য ফুপু আছে। আমিরা তো আমার গার্লফ্রেন্ড না। আমরা নিজেরাই কাজি অফিসে এসে বিয়ে করলেও ইটস কাইন্ড অফ অ্যারেঞ্জড। আমার আসল টেনশন হচ্ছে পুরান ঢাকায়।
বন্ধুরা কথা বাড়াল না। রিফায়াত তাদেরকে সবসময়ই ট্রিট দেয়। দেখা হলেই খাওয়া-দাওয়া হবে আর সব খরচ রিফায়াতের পকেট থেকে যাবে। বহু বছর ধরে এমনটা হয়ে আসছে। তাই আজকের ট্রিট আলাদাভাবে না পেলেও চলবে। তবু আবদার বাকি রেখে তারা বিদায় হলো। রিফায়াত বলল,
– ট্রিটের দিন গিফট আনবি আমার বউয়ের জন্য।
আমিরা একটু দূরে দাঁড়ানো। তার শরীরটা হঠাৎই হালকা হয়ে গেছে যেন। ডানা থাকলেই পাখির মতো উড়ে যেতে পারত। সাইন করার পর পরই তার মনে হচ্ছিল। বুকের উপর চেপে বসা ভারী পাথরটা নিমেষেই উবে গেছে। পরম প্রশান্তি দখল করে নিয়েছে মনকে। রিফায়াত তার দিকে এগিয়ে আসছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। রিফায়াত হাসল হঠাৎ। কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
– আমরা বিয়ে করে ফেলছি!
আমিরার হাসি পাচ্ছে। তবে চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। নার্ভাস ভঙ্গিটা এখনো যায়নি। সে চেষ্টা করল হাসি-হাসি মুখ করতে। খুব একটা সফল হলো বলে মনে হয় না। রিফায়াত ওকে আশ্বস্ত করল,
– এত টেনশন করতেছ কেন তুমি? রিল্যাক্সড হও। আমাদের শুধু যার-যার ফ্যামিলি অ্যাপ্রোচ করাটা বাকি।
আমিরা এবার জোর করে হাসল। বলল,
– আসল তুফান এখনো আসেইনি।
– তাতে কী? আসতে দাও। তুফানকে জব্দ করার অস্ত্রও আমাদের জোগাড় হয়ে গেছে।
====================================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৮।
আমিরাকে বাসায় নিয়ে এসেছে রিফায়াত। আমিরা আসতে চাইছিল না। তার ইচ্ছে, বান্ধবীর বাসায় থাকবে। যদি রিফায়াত তাতে বাঁধা দেয়,যদি সে বান্ধবীর বাসায় থাকার বিষয়টা পছন্দ না করে, দরকার পড়লে সে নিজের বাসায় ফিরবে। তাও রিফায়াতের বাসায় যাবে না। রিফায়াত বেশ কয়েকবার এর কারণ জিজ্ঞেস করেছে। সে উত্তর দেয়নি। অবশ্য উত্তরটা সে নিজেও জানে না। হয়তো ভয়, হয়তো অনিশ্চিত জীবনকে সামনাসামনি দেখার আতঙ্ক। একই সঙ্গে, ভুল মানুষকে বিয়ে করার ফলভোগ তো আছেই। আবার হতে পারে তার মানসিক প্রস্তুতি নেই নতুন জীবন শুরু করার। গতকালও এই সময়ে বাবার বাড়ি ছিল। মা-বোনদের সাথে দিন পার করেছে। মাত্র চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে তার জীবনের মোড় কোথা থেকে কোথায় ঘুরে গেছে, বিষয়টা ভাবতে গেলেই শিউরে উঠছে। অবশ্য বলতেই হবে এই প্রথম সে চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য তার নিজেকে বাহবা দেয়া উচিত। কিন্তু মন এই বাহবাকে সায় দিচ্ছে না।
রিফায়াত গোঁ ধরে আছে। বউ ছাড়া বাসায় ফিরবেই না। এমনকি আমিরাকে তার বাবার বাড়িতেও যেতে দিতে চাচ্ছে না। খানিকক্ষণ এই নিয়ে তর্কাতর্কির পর এক পর্যায়ে সে গাড়ির ইগনিশন অন করল। আমিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই সেন্ট্রাল লক অন করে দিল। বলল,
– তুমি আমার সাথে যাইতেছ, এটাই ফাইনাল।
– উহু। আমি যাব না।
– তুমি যাবা।
– আপনি কি আমাকে ফোর্স করতেছেন? আমি না চাইলেও জোর করে নিয়ে যাবেন, এইটা কেমন কথা?
– আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, আমিরা। তুমি এখন আমার বাসায় থাকবা। এই নরমাল বিষয়টা বুঝতেছ না কেন?
– আমি কি বলছি আপনার সাথে সংসার করব না? আমার একটু সময় দরকার…
– যত সময় লাগে, নাও। আই হ্যাভ নো রাশ। কিন্তু তুমি তোমার বাবার বাসায় যাবা না। ওখানে আজ বিশাল কাহিনি হবে। আর আমি চাই না তুমি কোনো ফাঁদে পড়ো।
– ফাঁদে পড়ব মানে? বিয়ে করে ফেলছি। এখন আবার কীসের ফাঁদ? আপনার কী মনে হয় আমার বড় খালা সবকিছু জানার পরেও তার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে আমার? একবার বিয়ে করে ফেলছি, এই অবস্থায় আবার বিয়ে করা কি পসিবল?
– পসিবল না। কিন্তু তারা তোমার কথা বিশ্বাস করবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই। কাবিননামা হাতে না আসা পর্যন্ত আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আর কাবিননামা হাতে পাইলেই কেল্লাফতে, বিষয়টা এরকম না। তোমার বয়স নিয়েও ঘাপলা আছে। তোমাকে যে আটকে ফেলবে না, তার গ্যারান্টিও কিন্তু নাই!
– এজন্যই বলতেছি, আজকে আমার ফ্রেন্ডের বাসায় থাকব। ওর বাসায় কেউ থাকে না। ওর বাবা-মা দুইজনই জব করে। ভাইবোন যে যার কাজে বিজি। ও বলতে গেলে একাই থাকে। আমি গেলে কোনো প্রবলেম হবে না। বিশ্বাস না হলে আপনিও চলেন। আমাকে ওর বাসায় নামিয়ে দেন।
– আমি যে প্রবলেমের কথা বলতেছি, তুমি সেটা বুঝোই নাই।
– বুঝায় বলেন।
– আপাতত এটাই শুনে রাখো, আমি চাই না আমার বউ তার নিজের বাসা ছাড়া এক রাত বাইরে কোথাও থাকুক। কয়েকদিন তো দূরের কথা। আর নিজের বাসা মানে শ্বশুরবাড়ি। হাজব্যান্ড যেখানে থাকে।
আমিরা হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হুট করেই গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করল। রিফায়াত বলল,
– লাভ নাই। লক করে রাখছি।
আমিরার হতাশা বাড়ল। সে বলল,
– আপনি খুব ঘাউরা, বুঝছেন? নিজে যা বলেন সেটাই ফাইনাল। আরেকজনের কথা শুনার দরকারই মনে করেন না।
– আমি তোমার সব কথা শুনছি কিন্তু। গতকাল থেকে এই পর্যন্ত তোমার সব কথা কান দিয়ে ঢুকাইছি। তার মানে এই না, বাকি জীবনে যখন যা বলবা, আর আমি চুপচাপ শুনব।
আমিরা আর কোনো কথা বলল না। তার মনে হচ্ছে, ভোগান্তির কেবল শুরু। রিফায়াতের গোয়ার্তুমির জন্য তাকে আরও অনেকবার ভুগতে হবে। বিয়ে করেছে ঘন্টাখানেক মাত্র। এই সময়ে বরের সাথে ঝগড়া করাটা মানায় না। আর সে ঝগড়া করতেও জানে না। কেউ ঝগড়া করলে চুপচাপ শুনে। ঝগড়ার সময় উপস্থিত বুদ্ধিতে কথা বলার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দেননি।
রিফায়াত নরম সুরে বলল,
– তুমি এত টেনশন নিচ্ছ কেন, বলো তো! সব প্রবলেম সলভ হবে। আমরা দুইজনই একসাথে আমাদের ফ্যামিলি ফেস করব। যা ঝড়-তুফান আসবে, একসাথে সামাল দিব। আমি চাই না, তোমাকে একা পেয়ে তোমার ফ্যামিলির লোকজন চড়াও হোক। প্লিজ, চলো।
আমিরা চুপ করে রইল। রিফায়াত এবার ওর হাত টেনে নিল আলতো ভঙ্গিতে। খানিকটা কাছে সরে এসে বলল,
– আমিরা, আমার দিকে তাকাও।
আমিরা ঘুরে তাকাল। রিফায়াত বলল,
– তুমি আমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাও। তাই না?
আমিরা উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। রিফায়াত আবার বলল,
– বাবার বাসায় যেন ফিরতে না হয় কোনোদিন, এটাই তোমার একমাত্র কনসার্ন। ঠিক কি না?
আমিরা আবার মাথা ঝাঁকাতে গিয়েও থেমে গেল। রিফায়াতের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল, কী বলতে চাচ্ছে। রিফায়াত ওর প্রশ্নবোধক দৃষ্টির উত্তরে বলল,
– এই চাওয়াটা আজ থেকেই শুরু করো। এই যে বাবার বাসায় ফিরতে চাও না, এটা আজ থেকেই হোক। তুমি তো বিশ্বাস করো, কাজি অফিসে বিয়ে করলে নাকি বিয়ে টিকে না।
আমিরা ক্ষীণ সুরে বলল,
– কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন না। বারবার বললাম। বিশ্বাসই করলেন না।
– আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বাদ। তোমার তো এটাই বিশ্বাস, তাই না? তাহলে তোমার মনে ভয় থাকা উচিত যে, এখন তুমি বাবার বাসায় ফিরলে আমাদের আর একসাথে থাকা নাও হতে পারে।
আমিরার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে বলল,
– মানে কী?
– কতকিছুই হতে পারে। আমি সেগুলো মুখে বলতে চাচ্ছি না। তুমি অনুমান করে নাও। তবে এটুকু তো মানতে হবে, ভাগ্যের উপর আমাদের হাত নাই। আমরা আজকে এই মুহূর্তে যা কিছু বলছি, এক মিনিট পর তা উলটে যাবে কি না, তার গ্যারান্টি নাই।
আমিরার সবথেকে দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছে রিফায়াত। ওর মনের বদ্ধমূল বিশ্বাসকে পুঁজি করে এতটাই নাড়া দিয়েছে যে আমিরা ছটফট করে উঠল। বলল,
– চলেন। আপনার বাসায়ই যাব।
রিফায়াত হাসল। বিশ্বজয়ের হাসি। আমিরাকে খুব সহজেই মুঠোবন্দি করার আনন্দ মিশে আছে সেই হাসিতে। মেয়েটা খুব বেশি সরল মনের। আজকালকার দিনে এত সহজ-সরল মানসিকতার কাউকে দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে সে আচানক প্যাঁচ লাগানোর খেলা শুরু করে, এটাই একমাত্র সমস্যা। এটা আসলে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। নারী জাতি মানেই প্যাঁচওয়ালী জিলাপি। আশার কথা হচ্ছে, আমিরা বেশিক্ষণ এই প্যাঁচ লাগানোর খেলা খেলতে পারে না। একসময় সরলতা তার চোখমুখে ধরা দেয় অবলীলায়। আসল রূপটা চট করেই বের হয়ে আসে।
রিমার সাথে ব্রেকআপ হবার পর থেকেই এক ধরনের মানসিক কষ্টে ছিল রিফায়াত। বাইরে থেকে তাকে শক্ত মনে হলেও ভেতরটা ভেঙ্গে ঝুরঝুর করছিল। ব্রেকআপের সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়েছে খুব। তবু নিজ অবস্থানে অনড় ছিল। যদিও দুনিয়া জানে, রিমাই ব্রেকআপ করেছে। কারণ রিফায়াত ওর সবগুলো শর্ত মানেনি। রিমার বাবা-মায়ের সামনে ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও মামা-মামিকে বাড়ি থেকে বের করা বা জীবন থেকে দূর করে দেয়ার শর্ত ফিরিয়ে দিয়েছে। রিফায়াতও এই নিয়ে কথা বাড়ায়নি। ব্রেকআপ কে আগে করল, আর কে পরে, সেটা জরুরি কোনো বিষয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মনের মধ্যে একটা কথাই ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বাজছে, ‘যা হয়, ভালোর জন্যই হয়’।
সত্যিই তাই। রিমার সাথে ব্রেকআপ না হলে আজ আমিরাকে বিয়ে করতে পারত না। হয়তো সরল অবুঝ এই মেয়েটার সাথে কোনোদিন দেখাই হতো না। মৃত বাবাকে উদ্দেশ্য করে সে মনে মনে বলল,
– থ্যাংকস আব্বু। তোমার জন্যই আমিরাকে পেয়ে গেলাম!
=====================
গল্প কি খুব বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে? অথবা এক জায়গায় আটকে আছে, এরকম কিছু?
অনেক পাঠক আছে, অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তাদের মনে হয়, অযথা গল্পটাকে রবারের মতো টেনে বড় করা হচ্ছে। আমি বলব না যে, এরকম হয় না। প্রায়ই দেখা যায় লেখক আপনমনে লিখতে থাকেন। এক জায়গায় গল্প আটকে আছে। বই পড়তে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে এরকম দেখেছি। বিরক্তও হয়েছি।
তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি কখনোই রবারের মতো করে গল্প টানি না। নতুন পর্ব লিখতে শুরু করার আগে মনে মনে সাজিয়ে নিই, কী কী লিখব, কীভাবে লিখব।
তবে হ্যাঁ এটা সত্যি যে, আমার গল্প প্রায়ই দেখা যায় এক জায়গায় আটকে থাকে, অথবা এক বিন্দুতে ঘুরপাক খায়। কিন্তু তার মানে এই না, আমি রবারের মতো টেনে-টেনে বড় করছি। আমি ঘটনা বাড়াই না তেমন। কিন্তু ছোট-ছোট অনুভূতিগুলোকে ব্যাখ্যা করি। গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে যেন পাঠকরা একাত্ম হতে পারে, সেটা চেষ্টা করি। এটাকে আপনি গল্পের অলংকারও বলতে পারেন। একটুখানি ঘটনার মধ্যে অল্প অল্প করে অনুভূতিগুলোকে মিশিয়ে দেয়া যেন, গল্পের চরিত্রটাকে আপনি পুরোপুরি চিনে নিতে পারেন।
আজকের পর্বটা ঠিক তেমন। শুধু এই পর্ব না। গত দুই-তিনটা পর্বেই আমি চেষ্টা করেছি রিফায়াতের ইমোশনটা কোন পর্যায়ের, তা তুলে ধরার জন্য। আমিরার মনের মধ্যে কী চলছে, কেন চলছে, কোন পরিস্থিতিতে সে এভাবে চিন্তা করছে, তাও লেখার চেষ্টা করেছি। অনেকের মনে হতে পারে, একদিনের পরিচয়ে কেউ এইভাবে বিয়ে করতে পাগল হয় নাকি? আমিরার দিক থেকে বিষয়টা মানা যায়। সে এখনো টিনএজ লেভেলে আছে। এই বয়সের মেয়েদের মন ক্ষণে-ক্ষণে বদলায়। তারা বড়দের মতো বুঝদার চিন্তাভাবনা করতে পছন্দ করে, সেভাবে কথাও বলে। তবুও ছেলেমানুষি বা টিনএজ সিন্ড্রম কিন্তু তারা লুকোতে পারে না। তাদের কথাবার্তা আর চিন্তাভাবনায় প্রকাশ পেয়ে যায়। এইজন্য কখনো তাকে প্যাঁচওয়ালী মনে হবে, আবার কখনো খুব সরল।
কিন্তু রিফায়াত? সে তো ম্যাচিউর। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করতেছে, এর মানেই তার বয়স পঁচিশের বেশি। হতে পারে সাতাশ-আটাশ, আবার হতে পারে ত্রিশের দিকে। তার টিনএজ সিন্ড্রম নেই। তবে সেও মানসিকভাবে আটকে আছে একটা বয়সে। এই বয়সটা আমিরার থেকেও ছোট কোনো এক বয়সের, যখন তার বাবা-মা মারা গেছে। তাদেরকে তার খুব একটা মনে নেই। কিন্তু মামা-মামি আর বুবুর কাছে গল্প শুনে শুনেই বড় হয়েছে। এজন্য দেখা যায়, বাবা-মা রিলেটেড কিছু কাজকর্ম সে করে ফেলে প্রায়ই, যেগুলো অন্যের কাছে মনে হবে খুব ছেলেমানুষী, যেটা হয়তো তার বয়সের সাথে যায় না। যেমন, ফুপুর কথা শুনেই আমিরাকে বিয়ে করা। এখানে আমিরার চেহারা, ব্যাকগ্রাউন্ড, ফ্যামিলি, হাইট কিছুই তার কাছে ম্যাটার করে না।
রিফায়াত ওর বাবা-মায়ের সাথে ইমোশনালি খুব অ্যাটাচড। একারণে বাবা-মায়ের দোহাই দিয়ে ওকে সহজেই ঘায়েল করে ফেলা যায়। আমার গল্প বা গল্পের মুল বিষয় এটাই। দুজন মানুষ, ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা, ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে বাস করা, কিন্তু দুজনের মানসিকতাই আটকে আছে নিজ নিজ ইমোশনসে।
আমিরা তার জীবনে যা কিছু দেখেছে, সেখান থেকে সে এটুকুই শিখেছে যে, একবার বিয়ে হলে বাবার বাড়িতে আর ফেরা যাবে না। রিফায়াত তাকে মারলে-কাটলেও সে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। রিফায়াতের অন্যায়গুলো মেনে নিবে। এটা অবশ্যই সুখকর না। উচিতও না। কিন্তু সে এটাই শিখেছে আশপাশ থেকে। তার ফ্যামিলিই শিখিয়েছে। এরপর তার বোনের বিয়ে আর ডিভোর্স। এখান থেকেও তার মস্তিষ্ক পরোক্ষভাবে অনেক কিছু শিখে রেখেছে।
গল্পের মুল ঘটনার বাইরে গিয়ে এই ছোট-ছোট বিষয়গুলো যদি আমি গল্পে তুলে না ধরি, আপনারা কীভাবে চিনবেন আমিরাকে? কীভাবে জানবেন রিফায়াতকে?
চলবে