তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৫।
খুব সকালেই রিফায়াত বের হয়ে পড়ল বাসা থেকে। খুব সকাল বলতে ঘড়িতে তখন আটটা বাজে। তার অফিস দশটায় শুরু হয়। বাসার কাছেই অফিসে। ড্রাইভ করলে সর্বসাকুল্যে দশ মিনিট লাগবে। যানজট হিসেব করে সাড়ে নয়টার দিকে বের হয় সে। আবার অফিসে দশ মিনিট আগে ঢুকতে পারলে ভালো। কাজ শুরুর আগে ঠিকঠাক গুছিয়ে নেয়া যায়। আজ অবশ্য অফিসে যাচ্ছে না সে। আজ তার ছুটি। গতকাল অফিসে যাবার পথেই আমিরার ফোনকল পেয়েছিল। অফিসের ঠিক সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছে। কলিগকে জানিয়েছে, তার ডায়রিয়া হচ্ছে। কলিগ যেন ওর হয়ে অ্যাটেনডেন্স লগবুকে মেসেজ দিয়ে রাখে। অফিসের খুব কড়া নিয়মগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, কারও ডায়রিয়া হলে আটচল্লিশ ঘন্টা অর্থাৎ দু’দিন অফ থাকতে হবে। ফোনেই আমিরার কন্ঠ শুনে ওর মন বলছিল, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। একদিনের ছুটিতে কাজ হবে না। কমপক্ষে দুইদিন লাগবে। সাধারণ ছুটি হুট করে নেয়ার নিয়ম নেই। কেউ ছুটি নিলেও বস নিজে কল করে অফিস আওয়ারের মধ্যিখানে ডেকে নিবেন। তাই স্পেসিফিক করে ডায়রিয়ার কথাই বলেছে।
গাড়িতে বসেই আমিরা বলল,
– এত সকালে কোথায় যাচ্ছি আমরা?
– এত সকাল মানে? তুমি কি আরেকটুখন থাকতে চাইছিলা বাসায়?
– না মানে আপনার মামা-মামি কারও সাথেই তো দেখা হলো না।
– দেখা হবার দরকারও নাই। মামি তোমাকে দেখলেই আবার ক্ষেপে যাবে। কাল রাতে অনেক কষ্টে তাকে ঠান্ডা করা হয়েছে।
– আপনি উনাকে বলেন নাই, আমি চলে যাচ্ছি?
– বলেছি। তারপরও তার রাগ কমে নাই।
– ওহ। এজন্যই কি উনি ঘুম থেকে উঠার আগেই বাসা থেকে বের হলেন?
– হ্যাঁ। আমি চাচ্ছি না তুমি আবার মামির সামনে পড়ো।
– হু। কিন্তু আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? বাসা খুঁজতে?
রিফায়াত উত্তর দিল না। তার মধ্যে মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রিমা। এতকাল বাদে আচানক রিমার ফোনকল পেয়ে চমকে গেছে সে। তার চেয়েও বড় চমক অপেক্ষা করছিল তখন। রিমা ওকে ‘স্যরি’ বলেছে! আগের সমস্ত অনর্থক ঘটনা আর শর্তাবলীর জন্য ক্ষমা চেয়েছে। রিফায়াতকে সে ভুল বুঝেছিল। তার ধারণা হয়েছিল, রিফায়াত সব জেনেবুঝেই মামির পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। কখনো ভেবেই দেখেনি, ‘মামি’ সম্বোধন করলেও মানুষটা আসলে ওর মা-ই। আর মা-ছেলের মধ্যেকার সম্পর্ক কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। বিচ্ছিন্ন করাও যায় না। রিফায়াতের পক্ষে মামা-মামিকে বাসা থেকে বের করে দেয়াটা কতখানি অসম্ভব, সেটা তখন সে নিজেকে দিয়ে বিচার করেনি। পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবেছে। নিজেকে প্রশ্ন করেছে, আজ রিফায়াতের মামির জায়গায় তার মা হলে কী ঘটত। আর তার জায়গায় রিফায়াত থাকলে কী করত। ওই শর্তগুলো যদি রিফায়াত দিত তাকে, কী করত সে? বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করত? বর্তমানে যে বাসায় সে অবস্থান করছে, এক অর্থে ওটা ওর নিজের বাসা। উত্তরাধিকার সুত্রে মা পেয়েছিল নানার কাছ থেকে। তবে নানা সেটা মেয়ের নামে ট্রান্সফার না করে নাতনীর নামে করেছেন। রিফায়াতের জায়গায় থাকলে কি রিমা নিজের বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করত?
নিজের জুতোটা পরে কখনো কেউ অন্যের মানসিক অবস্থা অনুমান করতে পারে না। অন্যের ভেতর কী চলছে, সে কী ভাবছে, কী করছে, তা অনুমান করতে গেলে তার জুতোটায় নিজের পা গলাতে হয়, যেটা রিমা এতকাল করেইনি। ব্রেকআপের মতো রিফায়াত যেমন মানসিক কষ্টে ভুগেছে, তেমনি সেও শান্তিতে ছিল না। বাইরে থেকে তাকে দেখা গেছে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মনের ভেতর দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন তাকে অনবরত পুড়িয়েছে। শুধু পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আবার ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম ঘটিয়েছে, যাতে আবার নতুন করে পোড়ানো যায়। এই খেলায় সে ক্লান্ত। আর পুড়তে চায় না।
রিফায়াত কথার মাঝখানে টু শব্দ করেনি। চুপচাপ শুনেছে। বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করলেও মনের মধ্যে ঘুটঘুট করছিল, যে কোনো মুহূর্তে আমিরা উঠে আসবে। তার ঘুম বলতে গেলে পাতলা হয়েই গেছে। আধো-ঘুম আর আধো জাগরণে কথা বলছিল। মনোযোগ একদিকে স্থির রেখে অন্যদিকে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়াটা আদতে অসম্ভব। তাই রিমার সাথে কোনোরকম বাদানুবাদে যায়নি। শেষের দিকে শুধু একটা প্রশ্ন করেছে,
– মামি তোমাকে কল দিয়েছিল, তাই না?
রিমা হকচকিয়ে গিয়েছিল তখন। রিফায়াতের মামি সত্যিই কল দিয়েছিলেন গতকাল রাতে। খুবই অসময়ে, বলা যায়। ফোনের ওপাশে নিচু সুরে খুব কাঁদছিলেন তিনি। বারবার ক্ষমা চাইছিলেন ওর সাথে দুর্ব্যবহার করার জন্য। উনার অমন আচরণের জন্য রিফায়াতের সাথে সম্পর্কটা অনেক দূরের হয়ে গেছে, বলে আক্ষেপ করছিলেন। মা হয়ে তিনি ছেলের মনের খবর জানার আগ্রহ বোধ করেননি। ছেলের সুখের কথা চিন্তা করেননি। নয়তো সেদিন রিমাকে যা-তা বলে অপমান করতেন না। তার ভুল হয়েছে। এই ভুলের মাশুল এখন দিচ্ছেন তিনি।
রিমা তার কান্নায় গলে গেছে। আচানক কী ঘটল, যে কারণে রিফায়াতের মামি গভীর রাতে কল দিলেন, সেটা মাথায় এলেও জিজ্ঞেস করা হয়নি। একজন মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ তাকে থমকে দিয়েছিল। তখনই কল দিত রিফায়াতকে। মামি নিষেধ করলেন। বললেন,
– তুমি এখন কল দিও না। ও রেগে যাবে অনেক। বুঝে ফেলবে আমি আছি এর পেছনে। আমার সাথে চিল্লাচিল্লি করবে। তার চেয়ে বরং তুমি কাল দিনের বেলায় কল করো। আমার কথা বলবে না কিন্তু। আমি যে তোমাকে কল দিয়েছি, তা জানতে পারলে রিফায়াত খুব রিঅ্যাক্ট করবে।
মামির কথায় সায় দিয়েছে রিমা। কিন্তু রাতভর তার ঘুম হয়নি। রিফায়াতকে কল করার উত্তেজনা ঘর জুড়ে পায়চারী করেছে। কত বছর পর কল করা হবে? দুই বছর? উহু, দুই বছর নয় মাস আর তেরো দিন। প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে! এর মধ্যে রিফায়াতের সাথে একবারও দেখা হয়নি। কথাও হয়নি। সে নিজেই রিফায়াতের নাম্বার ব্লক করেছিল। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মেও রিফায়াতকে ব্লকলিস্টে রেখে দিয়েছে। তবু রিফায়াত সহজে হাল ছাড়েনি। এর-ওর মাধ্যমে রিমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কয়েক মাস। তারপর আচমকা উবে গেল।
সারারাত রিমা পুরনো দিনগুলোর কথা ভেবেছে। রিফায়াতকে কল করবে বলে ফোনটা হাতের মুঠোয় চেপে সময় গুণেছে। ঘড়ি থেকে চোখই সরাতে পারেনি। তারপর দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই নিজেকে আর কল করা থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। আচ্ছা, রিফায়াত বুঝে ফেলল কীভাবে? খুব বেশি সকালেই কি কলটা করা হলো?
রিমা আমতা-আমতা করে বলল,
– উনি কেন কল দিবেন?
– কল দেয়নি বলছ?
– আমি বুঝলাম না রিফায়াত। তুমি হঠাৎ মামির কথা বলছ কেন? উনার কি আমাকে কল দেয়ার কথা ছিল? কিন্তু আমি তো কোনো কল পাইনি।
– এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
– এমনি-এমনি তো মামির কথা বলার মানুষ তুমি না। কী হয়েছে? ইজ এভরিথিং ওকে?
– হু। ওকে।
– তুমি কি বিজি? মানে ঘুমুচ্ছিলে?
– না। কেন?
– খুব আস্তে কথা বলছ। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– আচ্ছা, রাখি তাহলে?
– রেখে দিবে?
– আরও কিছু বলতে চাও?
– রিফায়াত, তুমি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ? অ্যাম স্যরি। আমার ভুল হয়েছিল। আমি তোমাকে সত্যি বুঝতে পারিনি। অ্যান্ড আই ফিল গিলটি ফর দ্যাট। কীসব হাবিজাবি শর্ত দিয়েছিলাম। ওগুলো মনে পড়লে এখন আমার নিজেকেই পাগল মনে হয়।
– ইটস ওকে
– তোমার কিছু বলার নেই?
– আছে।
– তাহলে বলছ না কেন?
রিফায়াত চুপ করে রইল। রিমা এবার নিজেই বলল,
– দেখা করতে পারবে আজ? তোমার তো অফিস আছে। বিকেল ছয়টা। গ্লোরিয়া জিনস। ওকে?
রিফায়াত একটু ভেবে উত্তর দিল,
– আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। তুমি চাইলে আরও আগে দেখা করতে পারি।
রিমা অবাক সুরে বলল,
– অফিস থেকে ছুটি নিয়েছ!! তুমি!!!!
রিফায়াত ওয়ার্কহোলিক না। তবে ডিসিপ্লিন মেনে চলে খুব। অফিসের সময় কাজ বাদ দিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করে না। অফিসের সময় প্রেমিকার কল রিসিভ করে না, মেসেজ পাঠালেও রিপ্লাই দেয় না। যতক্ষণ অফিসে থাকে, রিমাকে সে চেনেই না বলতে গেলে। আর যদি কোনো কারণে অফিস থেকে ছুটি নেয়ার কথা বলা হয়, রিফায়াত এক কথায় ‘না’ করে দেয়। রিমা এই নিয়ে বহুদিন রাগারাগি করেছে। কথা বলা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু রিফায়াতকে তার অবস্থান থেকে নড়ানো যায়নি। একবার রিমার ইউনিভার্সিটি থেকে পিকনিকে যাবে পানাম নগরীতে। ইউনিভার্সিটির প্রশাসনের কেউ নেই। নিজেরাই ব্যবস্থাপনা করেছে সবকিছু। শুধু যে ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরাই যাবে, ওরকম কিছু না। চাইলে বহিরাগতও ওদের সাথে যোগ দিতে পারে। যত বেশি মানুষ, তত জমবে পিকনিক। বাস ভাড়া করার ব্যাপার আছে। পানাম নগরীর ওদিকে একটা রিসোর্ট বুক করা হচ্ছে। পার হেড যে চাঁদা ধার্য করা হয়েছে, ওটা দিলেই হবে। অনেকেই তাদের প্রেমিক-প্রেমিকা বা ভাই-বোনকে সাথে নিচ্ছিল। রিমাও দু’জনের চাঁদা জমা দিল। রিফায়াতকে তখন কিছু বলেনি। পরে যখন বলল, রিফায়াত শুরুতেই ‘না’ বলে দিল। তার অফিস আছে। অফিস বাদ দিয়ে পিকনিকে যাওয়া সম্ভব না। রিমা অনেক অনুরোধ করেছিল, যেন অফিস থেকে ছুটি নেয়। অথবা সিক কল দিক। একদিনেরই তো ব্যাপার। প্রতিদিন তো পিকনিকে যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু রিফায়াতকে টলানো গেল না। সে একবার ‘না’ বলেছে, মানে ওটাই বলবৎ থাকবে।
রিমা সেবার অনেক ঝগড়া করেছিল রিফায়াতের সাথে। কথা বন্ধ রেখেছিল প্রায় দশ-বারো দিন। দেখাও করেনি। রিফায়াত ওর বাসার সামনে এসেছিল অফিসের পর। মেসেজ পাঠিয়েছিল। সে ওই মেসেজ পড়ে আবার ডিলিট করে দিয়েছে। রিফায়াত বাসার ভেতর ঢোকেনি। তবে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল বাসার সামনে।
রিমা বাস্তবে ফিরল। গতকাল রাত থেকেই পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো তার মনের মধ্যে উথাল-পাতাল করছে। এর মধ্যে রিফায়াত কোনো উত্তর দিয়েছে কি না লক্ষ করেনি। সে আবার বলল,
– তুমি কী বললে? অফিস থেকে ছুটি নিয়েছ?
– হ্যাঁ। দুইদিনের ছুটি। গতকাল আর আজ।
এবার রিমা অনেকটাই নিশ্চিত হলো, কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছে। নয়তো রিফায়াত কেন দুইদিনের ছুটি নিবে অফিস থেকে? আর মামিইবা কেন গভীর রাতে কল করে ওর কাছে ক্ষমা চাইবেন? সে বলল,
– মানে কী? ইজ দেয়ার এনি ওকেশন?
– হু।
– কী সেটা?
– সব কথা কি ফোনেই শুনবা?
– কখন দেখা করতে পারবা তুমি?
– অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল!
বাহ, রিফায়াতেরও আজ দেখা করার তাড়া বেশি! রিমা বলল,
– ঠিক আছে, ফার্স্ট আওয়ারেই দেখা করি। কোথায় থাকবা তুমি?
– তোমার ক্লাস আছে না? মানে তুমি তো এখন মাস্টার্সে পড়ছ। তাই না?
– হ্যাঁ। বাট আমার ক্লাস ইভনিংয়ে হয়। আর দিনের বেলায় জব করি। একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মে জয়েন করেছি বছরখানেক হলো।
– গুড। টাইম ফ্লাইস! আচ্ছা, তাহলে ক্রিপসি জোনে আসো। নয়টায়।
রিফায়াত এখন রিমার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছে। সঙ্গে আমিরাকেও নিয়েছে। কারণ ওকে বাসায় রেখে বের হলে মামি আবার তুলকালাম করবেন। হয়তো আমিরাকে একাই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন। তখন আরেক ঝামেলা শুরু হবে। প্রথমে ভেবেছিল, আমিরাকে গাড়িতে বসিয়ে রাখবে। আমিরাও তার মতো ঘুমকাতুরে। কাল বিকেলে ঘুমিয়েছে কয়েক ঘন্টা। এরপর সারারাত ঘুমিয়েও তার ঘুম ফুরোয়নি। বিছানা থেকে উঠতেই চাচ্ছিল না। এখন আবার গাড়িতে বসে ঝিমুচ্ছে। নাহয় আরেকটু ঘুমিয়ে নিক। কিন্তু ক্রিপসি জোনের সামনে গাড়ি পার্ক করার পর মনে হলো, আমিরাকে একা ফেলে যাওয়া উচিত হবে না। পাশেই ফুটপাত। লোকজন চলাচল করছে। তারা সুযোগ নিতে পারে যে কোনো। ওর দিকে জানালাটা অল্প খোলা আছে। জানালা পুরোটা আটকে দিলে ওর দমবন্ধ হয়ে আসবে। গাড়ির ভেতরটা প্রচুর গরম হয়ে যাবে। আবার ওকে ভেতরে রেখে গাড়ি লক করলেও সমস্যা আছে। একটু পর পর নড়াচড়া টের পেলেই সেন্সর ট্যাও-ট্যাও শুরু করবে। তার চেয়ে আমিরাকে সাথে নিয়ে গেলেই ভালো।
রিফায়াত আলতো ধাক্কা দিল আমিরাকে। নিচু সুরে ডাকল,
– আমিরা! অ্যাই আমিরা!
– হু।
– আবার ঘুমুচ্ছ?
আমিরা চোখ মেলে আড়মোড়া ভাঙ্গল। সকালে বাসা থেকে বের হবার আগে রিফায়াত অনেক কসরত করে আমিরার চুল সেটআপ করেছে। চুলের যেরকম ভয়াবহ অবস্থা ছিল, ওভাবে বাসা থেকে বের হলে মানুষজন ‘পাগল’ ছাড়া আর কিছু বলত না। রিফায়াতের কাছে হেয়ার স্প্রে নেই। তবে হেয়ার জেল আছে। এই জেল সে নিজে ব্যবহার করে না। মামির ভাই ব্রিটেনে থাকেন। উনি কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। উপহারস্বরূপ সবার জন্য নানারকম কসমেটিকস এনেছেন। রিফায়াতকে এই হেয়ার জেল আর জিলেট শেভিং কীট দিয়েছেন। এতকাল জেলটা অবহেলায় পড়েছিল। আজ কাজে লেগেছে। আমিরার মাথায় এই জেল লাগিয়ে চুলটা সুন্দরভাবে সেট করা গেছে। আমিরা অবাক ভঙ্গিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভাবতেই পারছিল না এই জেলের যাদু কীরকম বদলে দিয়েছে তার চুল!
সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে গড়াগড়ি করতে থাকলে জেলের কেরামতি বেশিক্ষণ টিকবে না। রিফায়াত বলল,
– সাবধান! চুল আউলে যাবে কিন্তু।
আমিরা বলল,
– চুল তো বেনী করাই আছে।
– তা থাকুক। এইভাবে সারাদিন পার করতে হবে তোমার।
– কেন? সারাদিন কেন?
– আমার অনেক কাজ আছে।
– আপনার কাজ থাকলে আমার কী?
– তুমি আমার সাথে থাকবা।
– উহু। আমাকে বাসায় নামিয়ে দেন আগে।
– তুমি না বললা, বাসায় গেলে তোমাকে পিটানি দিবে! বাসা থেকে বের করে দিবে। তাহলে বাসায় গিয়ে লাভ কী?
আমিরা এই পর্যায়ে খানিক চুপসে গেল। রিফায়াত ওর চেহারা দেখেই ধরতে পারল, কিছু একটা গড়বড় আছে। বলল,
– কাহিনি কী? আর কী কী মিথ্যা বলছ আমাকে?
– না মানে আমি মিথ্যা কথা বলি নাই।
– তাহলে? আবার কোন আকাম করছ?
– কাল যখন আপনি মামির ঘরে গেছিলেন, আমি আপনার মোবাইল ফোন থেকে বড়াপাকে কল দিছিলাম।
রিফায়াত চমকে গেল। চোখ বড় বড় করে বলল,
– তারপর?
– আপা খুব কান্নাকাটি করতেছিল। সে ভাবছে, আমার কোনো বিপদ হইছে। নাইলে সবসময় কলেজ থেকে ঠিক টাইমে ফিরি।
– তুমি কী বললা? তোমাকে জিজ্ঞেস করেনি কোথায় গেছ?
– হু। আমি বলছি, ফ্রেন্ডের বাসায় আসছি। এটাও বলছি, আমি শফিককে বিয়ে করতে চাই না। কালকে শফিকের আসার কথা ছিল বাসায়। যদি বড় খালা বলে আজকেই আকদ হবে। আমি এই ভয়ে বাসায় যাই নাই।
– তুমি বলো নাই, আমরা বিয়ে করে ফেলছি?
– না।
– ফ্রেন্ডের বাসায় আছ এটা না বলে বিয়ের কথা বললেই ভালো হতো। তুমি নিজেই মাতব্বরি করে কল করতে গেলা কেন তোমার আপাকে? আমি ভাবছিলাম আজকে তোমাদের বাসায় যাব। তোমার মা আর বড়াপার সাথে কথা বলব। এরপর দরকার পড়লে তোমার খালার বাসায়ও যাব। তুমি তার আগেই কাহিনি গড়বড় করে দিলা।
– মাথা খারাপ? বিয়ের কথা বলিনাই। তাতেই মা আমাকে ধুমাইয়া গালাগালি দিছে। কীসব খারাপ গালি, আপনি শুনলে আপনার কান গরম হয়ে যাবে। আমাকে বলছে, আমি যেন বাসায় না আসি কোনোদিন। জাহান্নামে গিয়ে মরি। বড় খালা অনেক চিল্লাচিল্লি করছে মায়ের সাথে। অনেক আজেবাজে কথা বলছে। আপনার কথাও বলছে। খালার ধারণা, আপনার সাথে আমার আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। আমি মিথ্যে কথা বলে আপনাকে বাসায় নিছি। আর পালাইছি আপনার সাথেই। ওসব ফ্রেন্ড-টেন্ড কিছু না। দেখছেন, আমার খালার মাথায় কীরকম বুদ্ধি। আ-বললেই আলাউদ্দিন-সালাউদ্দিন সব বের করে ফেলে।
রিফায়াত হাসল। আমিরা বলল,
– আপনি হাসতেছেন? আর এদিকে আমার ব্যান্ড বাজতেছে। আপনার মামি অনেক ভালো মানুষ। উনি আর যাই করুক, আপনাকে বাসা থেকে বের করে দেয় নাই। আমাকে চলে যাইতে বলছে। কিন্তু আপনাকে একবারও বলে নাই। আর আমার মাকে দেখেন। ফোনেই বলে দিছে, আমি যেন ওদিকে পা না দেই। সে আমাকে বাসায় ঢুকতে দিবে না। খালা নাকি তাকে কঠিন করে মানা করছে। বলছে, আমার সাথে যে সম্পর্ক রাখবে, উনি তার সাথে সম্পর্ক রাখবেন না। কালকে আমার জন্য খালার সম্মানহানি হইছে। শফিক নামের ওই ছেলেটা নাকি আসছিল। খালা-খালুও আসছিল। এদিকে আমার নাই খবর।
– তাহলে তুমি বাসায় যেতে চাচ্ছ কেন? তোমাকে তো ঢুকতে দিবেই না।
– উহু। বড়াপা বলছে, সে ম্যানেজ করবে বড় খালাকে। আর খালা ম্যানেজ হইলে মাও সিস্টেমে চলে আসবে। আমাকে জলদি বাসায় যাইতে বলছে। আমাকে বাসায় ঢুকানোর দায়িত্ব তার।
– তোমাকে বাসায় নিয়ে আবার কোনো ট্র্যাপে ফেলবে না, তার গ্যারান্টি কী?
– কীসের ট্র্যাপ? বড়াপা বলছে খালার সাথে এই নিয়ে কথা বলবে।
– আর শফিক? ওটাকে বাদ করবা কীভাবে?
– উনাকে বাদ করার কী আছে?
– কী আছে মানে? আমিরা, তুমি আমার ওয়াইফ। অফিশিয়ালি ম্যারিড আমরা। এই অবস্থায়…
– ওহ, না না আপনি যেটা বলতেছেন, ওরকম কিছু না। আপা বলছে, শফিককে সাইড করবে। মানে বড় খালাকে বলবে, আপাতত বিয়েশাদির ব্যাপারে আগানোর দরকার নাই। আমি যেহেতু চাইতেছি না এখনই বিয়ে করতে, তো আর কিছুদিন পরে নাহয়…
– তোমার খালা শুনবেন বড়াপার কথা?
– না শোনার কী আছে? বড়াপার তো লজিক্যাল কথাই বলবে।
– হ্যাঁ। কিন্তু তোমার বড় খালার কাছে সেই লজিক অ্যাকসেপ্টেবল হতে হবে। উনি যদি এগুলো না মানেন…
– তাও কথা!
– রিস্ক কিন্তু থেকেই যায়। সো, চিন্তাভাবনা করো আবার নতুন করে।
– কী চিন্তা করব? আমার তো আম-ছালা সব শেষ। আপনার মামি আমাকে বাসায় থাকতে দিবে না। আপনিও আমাকে টাকা দিবেন না…
– আমি কখন বললাম, টাকা দিব না?
– হ্যাঁ তো বলেন নাই। কালকে আমি হিসাব করে বের করলাম আমাকে কমসে কম চার লক্ষ আশি হাজার টাকা দিলে…
– তোমাকে আমি আঠারো লক্ষ বাষট্টি হাজার টাকা দিব, আমিরা। মামির কাছ থেকে পারমিশন গ্রান্টেড করে আনছি।
– সত্যি?
– হু। কিন্তু আমার কতগুলো শর্ত আছে।
– আপনি যা বলবেন, আমি চোখ বন্ধ করে তাই করব। আপনি শুধু আমাকে টাকা দেন। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।
– আমাকেও না?
আমিরা মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আচানক হকচকিয়ে গেল। একটু থেমে বলল,
– আপনাকে মানে?
– তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকতে চাও না?
আমিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকাল। থেমে থেমে বলল,
– আপনার মামি আমাকে কখনো অ্যাকসেপ্ট করবেন না। আর…
– তুমি আমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাও কি না, সেটা বলো।
– আমি জানি না।
রিফায়াত দুই হাতে চেপে ধরল আমিরার বাহু। কাছে টেনে বলল,
– তুমি জানো সবই। পেটের মধ্যে জমা করে রাখো। আর মুখে বলতে গেলেই চিপে-চিপে বলো। তুমি কি ভাবছ, আমি জানব না তোমার পেটের কথা?
আমিরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রিফায়াত ওকে কাছে টেনে নেয়ায় বরফের মতো জমে গেছে। চোখ বড়-বড়। পারলে কোটর থেকে বেরিয়ে আসে যেন। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হচ্ছে। পানির পিপাসা হচ্ছে খুব। কোনোরকমে ঢোক গিলে বলল,
– কী-কী কথা? আপনি কীভাবে জানলেন?
রিফায়াত মুচকি হেসে বলল,
– তুমিই বলছ। ভোরবেলার কথা মনে নাই?
– কোন ভোরবেলা?
– এখন তো এই কথা বলবাই। এখন তুমি ভোরবেলাই চিনবা না। না চিনো। অসুবিধা নাই। আমি তোমার সমস্ত জারিজুরি জেনে গেছি।
– আমার কোনো জারিজুরি নাই। আমি কিছু করি নাই।
– করছ। অনেক বড় একটা কাজ তুমি করে ফেলছ। তাও আমাকে না জানিয়ে।
– কী-কী কাজ?
– সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আমাকে জিজ্ঞেস করতেছ কেন?
– আমি জানি না।
– তুমি সব জানো। কিন্তু না জানার ভান করো। আর এই যে প্রতিটা কথার আগে ‘জানি না’ বলো। এটা তোমার বদভ্যেস।
আমিরা কথা বাড়াল না। আতঙ্ক ফিরে আসতে শুরু করেছে আবার। মনের মধ্যে আতিপাতি করে খুঁজেও সে বের করতে পারছে না, আর কী লুকিয়েছিল রিফায়াতের কাছে। আর কী মিথ্যে বলেছিল। প্রায় কাঁদোকাঁদো সুরে বলল,
– আমি জানি না। সত্যিই জানি না কিছু। আমার কোনো দোষ নাই। আমি কিছু করি নাই…
আমিরার চোখে পানিও চলে এসেছে। রিফায়াত ঝট করে ওর ঠোঁটে চুমু দিল। কয়েকটা মুহূর্ত পরস্পরের ওষ্ঠদ্বয় চুম্বরের মতো লেগে রইল। আমিরা রীতিমতো কাঁপছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিমূঢ়। রিফায়াত ফিসফিস করে বলল,
– তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, এটা আমি জেনে ফেলেছি। কখন কবে থেকে ভালোবেসেছ, তাও জানি। আর এই কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও জানা হয়ে গেছে আমার।
আমিরা কিছু বলল না। তখনো শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। স্থবির হয়ে আছে। ওই মুহূর্তে রিমার ফোনকল ভোজবাজির মতো কাজ করল। রিফায়াতের ফোনটা বেজে উঠতেই সে প্রায় ছিটকে পড়ল নিজের সিটে। রিফায়াতও হতভম্ব। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে রিমা বলল,
– রিফায়াত, তুমি কোথায়? আমি নয়টা থেকে বসে আছি এখানে।
– হ্যাঁ। আমি আসতেছি। নয়টার আগেই পৌঁছে যাব।
– বুদ্ধু! নয়টা অলরেডি বেজে গেছে। এখন নয়টা বিশ বাজে। কোন দুনিয়াতে আছ তুমি?
চকিতে এক ঝলক আমিরার দিকে তাকাল রিফায়াত। আমিরাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রিফায়াতের দুদিন ধরে এই অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমিরার সাথে কথা বলতে শুরু করলে কোন দিক দিয়ে সময় গড়ায়, টেরই পায় না। চারপাশের সবকিছু বেমালুম গুলে খায়। আমিরার দুনিয়াটা এতই যাদুময়!
রিফায়াত বলল,
– হ্যাঁ চলে আসছি ক্রিপসি জোনের সামনে। গাড়ি পার্ক করতেছি।
======================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৬।
রিমার খুব উত্তেজনা হচ্ছে। হাত-পা ঘেমে রীতিমতো একাকার অবস্থা। প্রায় তিন বছর পর রিফায়াতের সাথে দেখা হবে, ভাবতেই শিউরে উঠছে সে। এই তিন বছরে কি খুব বদলে গেছে রিফায়াত? নাকি আগের মতোই আছে? আগের থেকে একটু বয়স্ক কি লাগবে ওকে? রিমা নিজে অনেক বদলেছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া সেই মেয়েটা এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা। রিফায়াতের মতো সেও সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অফিসে কাজ করে। অফিস শেষ করেই আবার দৌড়ায় ক্যাম্পাসে। এখন সে অনুভব করতে পারে, কীরকম পাগলামোই না করত! রিফায়াতকে সে অনেকবার দোষ দিয়েছে অফিসের চামচা বলে। অফিসে ঢুকলেই রিফায়াত হয়ে যায় প্রেমিক থেকে অপরিচিত মানুষ। আর আজ সে নিজেও তাই। নয়টার আগেই মোবাইল সাইলেক্ট করে অফিসে ঢুকে যায়। চারটার আগে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়েই দেখে না। ফোনসেট বলতে কিছু একটা যে তার ব্যাগে আছে, তাও ভুলে যায়। রিফায়াত তবু লাঞ্চ ব্রেকে কল দিত। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলত। রিমা তাও পারে না। লাঞ্চব্রেকের সময়টা তার কাছে খাওয়া আর ফ্রেশ হবার জন্য খুবই কম মনে হয়। ভরপেট খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম না নিলে চলেই না। অথচ তাকে ওই সময়েই আবার কাজের টেবিলে বসতে হয়। আর ছুটি! সেটা তো অমাবস্যার চাঁদের থেকেও কঠিন কিছু। নির্ধারিত দিন ছাড়া ছুটি পাওয়া দুষ্কর। বস আর কোনো ব্যাপারে সহনীয় আচরণ করলেও ছুটির কথা শুনলেই তার মাথায় যেন আগুন জ্বলে। আজ রিফায়াত বলুক ছুটি নেয়ার কথা। রিমা ঠিকই এক বাক্যে ‘না’ করে দিবে। এই যে আজ ক্রিপসি জোনে এসেছে দেখা করতে, অফিস থেকে ছুটি নেয়নি। কলিগকে কল করে বলেছে, তার আসতে ঘন্টা দুয়েক দেরি হবে। এই ঘন্টাদুয়েকের জন্যও বসের সামনে দাঁড়াতে হবে। কিছু উপদেশ বাণী শুনতে হবে।
এখন রিমা বুঝতে পারে, রিফায়াতের প্রতি কতটা অবিচার করেছে। কতটা অত্যাচার হজম করেছে রিফায়াত! এখন সে আগের সমস্ত আচরণের জন্য লজ্জিত। এই উপলব্ধি তার বছরখানেক ধরেই হচ্ছে। গত এক বছর ধরে প্রায়ই রিফায়াতকে মনে পড়ে ওর। ফেসবুকে আনব্লক করেছিল আগেই। কিন্তু রিফায়াতের আইডিতে কোনো রিসেন্ট একটিভিটি নেই। রিমা তার লাইফ থেকে সরে যাবার পর সে যেন নীল-সাদার দুনিয়া থেকে রীতিমতো হাওয়া হয়ে গেছে। আনব্লক করার পর প্রফাইলটা আর ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। আনফ্রেন্ড হয়ে গেছে। তাই পাবলিক পোস্টগুলো খুঁজে দেখছিল। পরে রিফায়াতের এক বন্ধুর ইনবক্সে নক করেছিল। সে বলল, রিফায়াত ইদানীংকালে কারও সাথেই যোগাযোগ করে না। অফিস আর বাসা এই দুটোই তার পুরো জগত। কলিগদের সাথে হয়তো ভালো সম্পর্ক আছে। কিন্তু বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেলেই তার অনীহা জাগে। বন্ধুরা কল করলে অবশ্য ভালোভাবেই কথা বলে। খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে। নিজের খবরও বলে। কিন্তু বন্ধুত্বের যে উষ্ণতা, তা পাওয়া যায় না। ওই বন্ধুর ধারণা, রিফায়াত রিমার কারণেই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক না। রিফায়াতের জীবনের একটা বড়সড় অংশ জুড়ে ছিল রিমার পদচারণা। রিফায়াতের বন্ধুরা সবাই ওকে চিনত। রিমা তাদের সাথেও বন্ধুর মতোই মিশত। এরপর রিমার লজ্জ্বা আরও বেড়েছে। রিফায়াতের নম্বরটা তখনই আনব্লক করেছিল। কলও দিয়েছে। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ ছিল। রিফায়াত নম্বর পালটে ফেলেছে। রিমার হঠাৎ খেয়াল হলো, আজ সকালে ফোনে কথা বলার সময় রিফায়াত একবারও জিজ্ঞেস করেনি তার নাম্বার সে কোথায় পেয়েছে। নাম্বারটা মামিই দিয়েছেন। সঙ্গে বুদ্ধিও বাতলে দিয়েছেন, যেন সাজির নাম বলে। সাজি হচ্ছে রিফায়াতের মামাত বোন। মামিরই মেয়ে। এখন কানাডায় আছে পড়াশুনার সুবাদে। সাজির সাথে এখনো ফেসবুকে এড আছে রিমা। কখনো কথা হয় না। সাজির পোস্টে রিএক্ট বা কমেন্ট করে না। কী কারণে ওকে আনফ্রেন্ড করাও হয়নি।
রিমার অবাক লাগল, নাম্বার জানার বিষয়টা রিফায়াতের চোখ এড়িয়ে গেল কীভাবে? অবশ্য রিফায়াত খুব একটা কথা বলেনি। তার কন্ঠ খানিক নিষ্প্রভ শোনাচ্ছিল। যেন রিমার সাথে কথা বলতে বা রিমার সম্পর্কে জানতে তার কোনো আগ্রহ নেই। নয়তো অবশ্যই জিজ্ঞেস করত, নাম্বার পেয়েছে কোথায়। রিমার মন বলছে, দুই বছর নয় মাস তেরো দিনের ব্যবধান তাদের সম্পর্কের সুতোটা কেটে দিয়েছে। রিফায়াত এখন আর আগের মতো নেই। হয়তো বদলে গেছে। আবার হতে পারে, অভিমান করে আছে। অভিমানই হবে। বদলায়নি রিফায়াত। বদলে গেলে দেখা করত না। রিমা আসলে নিজের মনকেই বুঝ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে রিফায়াতের বেশ কতগুলো পরিবর্তন তার চোখে ধরা পড়েছে। যেমন, অফিস থেকে ছুটি নেয়া, ফোনে রিমার কন্ঠ শুনেও অবাক না হওয়া, নাম্বার কোথায় পেয়েছে জিজ্ঞেস না করা, সর্বোপরি ক্রিপসি জোনে আসতে দেরি করা। রিফায়াত সময় মেনে চলে খুব। দেরি করা তার ধাতে নেই। দরকার পড়লে নির্দিষ্ট সময়েরও আগে চলে আসবে। অথচ আজ সাড়ে নয়টা বাজার পরও তার খোঁজ নেই। ফোনেও তার কথায় গোঁজামিল পাওয়া গেল। নয়টা বিশ বাজে অথচ সে বলছে নয়টার আগেই পৌঁছে যাবে!
রিমা মনস্থির করল, আজ যদি রিফায়াত বলে আজকের দিনটা ছুটি নিতে, সে অবশ্যই নিবে। চাকুরি চুলোয় যাক। আজকের দিনে চাকুরির চেয়ে রিফায়াত তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনমনে অনামিকায় থাকা আংটি নড়াচড়া করছিল সে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান কথা। এর মধ্যে হুট করে চোখ পড়ল আংটির দিকে। এই আংটিটা রিফায়াত দিয়েছিল। হীরার আংটি, তিন বছর আগে ডায়াগোল্ড থেকে কেনা। তখন বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল ওদের মধ্যে। রিফায়াত প্রেম বাদ দিয়ে বিয়ে করতে উদ্গ্রীব। রিমার বাসায়ও বিয়ের চাপ আছে মোটামুটি। নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। রিফায়াতের খুব শখ, ধুমধাম করে বিয়ে করবে ওরা। সাতদিন লাগাতার অনুষ্ঠান হবে। পানচিনি থেকে শুরু। আর বৌভাতে শেষ। কিন্তু রিমার বাসায় অত ধুমধাম করার পরিকল্পনা নেই। ওর বাবা সেই বছর হজ্ব করে এসেছেন সবে। তিনি বললেন, পানচিনি আবার কী জিনিস? আকদ আর ওয়ালিমা ছাড়া আর কিছু হবে না। তাই শুনে রিফায়াতের মন ভার হলো। হবু শ্বশুরের উপর দিয়ে কথা বলা চলে না। এজন্য হুট করেই রিমাকে ডায়াগোল্ডে নিয়ে গেল। দুটো হীরার আংটি কিনে তখনই পরিয়ে দিয়েছিল পরস্পরকে। রিফায়াত হাসিমুখে বলেছিল,
– নাও। আমাদের অ্যানগেজমেন্ট হয়ে গেল। আবার শ্বশুরের কথাও মানা হলো!
আচ্ছা, আংটিটা কি রিফায়াত এখনো পরে? রিমার কখনো মনে হয়নি আংটি খোলার কথা। হোয়াইট গোল্ডের উপর হীরে বসানো। খুবই সাধারণ। দেখলে অতটা চোখেও পড়ে না। তাই এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।
রিমার বুকের ভেতর হঠাৎ ধুকপুক করে উঠল। রিফায়াত চলে এসেছে! রিমার টেবিল থেকে ক্রিপসি জোনের দরজাটা পরিস্কার দেখা যায়। রিফায়াত কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই রিমা হাত নাড়ল। কিন্তু রিফায়াত যেন ওদিকে তাকালই না। সরাসরি কাউন্টারে গেল। রিমা খানিক বিভ্রান্ত। ওর কি এখন উঠে যাওয়া উচিত কাউন্টারের দিকে? নাকি এখানেই বসে থাকবে? রিফায়াত একা আসেনি। ওর সাথে একটা মেয়ে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরনে। কাঁধে ব্যাগ। কোঁকড়া চুলে দুই বেনী করা। রিমা বসে রইল। রিফায়াতকে দেখতে লাগল দূর থেকে। আগের মতোই আছে। খুব একটা বদলায়নি। যদিও পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। রিফায়াত কাউন্টারের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে। ওপাশে দাঁড়ানো লোকটার সাথে হাত নেড়ে কথা বলছে। কী বলছে সে? খাবারের অর্ডার দিচ্ছে কী? বোধহয় বাসা থেকে নাশতা করে আসেনি। তড়িঘড়ি করে বের হয়েছে। কিন্তু রিমাকে জিজ্ঞেস না করে কেন খাবার অর্ডার করবে?
মেয়েটা পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র দেখছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে এই রকম এখানে পা দিল। একবার রিমার দিকেও তাকাল। এই সকালবেলায় রেস্টুরেন্টে মানুষজন তেমন নেই বললেই চলে। দু-একজন এসেছে নাশতা খেতে। এখানকার পরোটা আর কলিজার তরকারি খুব মজার হয়। তবে প্রচারণা করে না সেভাবে, এজন্য কাস্টমার থাকে না এই সময়ে। আবার হতে পারে, সবাই হুড়মুড় করে এত সকালে রেস্টুরেন্টে আসতে ইচ্ছুক না। অনেকেই দেরি করে আসে। কলিজার তরকারি আর পরোটা তো সারাদিনই সার্ভ করে। এই সময়ে মানুষজন নেই। সেজন্যই হয়তো মেয়েটা বারবার রিমার দিকে তাকাচ্ছে। রিমা রেস্টুরেন্টের একমাত্র মেয়ে কাস্টমার!
রিমা ভালোমতো লক্ষ করল মেয়েটাকে। রিফায়াতের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কে হতে পারে? রিফায়াতের মামাত বোনকে রিমা চিনে। নয়তো হুট করে এই মেয়েটাকেই মামাত বোন ধরে নিত। হয়তো অন্য কোন কাজিন। কিন্তু এই সাত সকালে মেয়েটা রিফায়াতের সঙ্গে কী করছে? রিফায়াতইবা ওকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে কেন?
কাউন্টারে কথা বলা শেষ করে রিফায়াত পেছন ফিরল। প্রথমবারেই রিমার চোখে চোখ পড়ল তার। রিমা হাত নাড়ল। রিফায়াত হাত নাড়েনি। তবে মৃদু হাসল। তারপর সঙ্গে থাকা মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে আসতে লাগল। টেবিলের সামনে এসেই চিরাচরিত সেই পুরনো কন্ঠ,
– স্যরি অনেক দেরি করে ফেলছি।
– না ইটস ওকে। বেশিক্ষণ তো হয় নাই।
– আমি আসলে আসছি নয়টায়ই। গাড়ি থেকে বের হতে একটু দেরি হলো।
মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রিমার দিকে। বসেছে রিফায়াতের পাশেই। রিমা একটু মনক্ষুন্ন হলো। এই মেয়েটা অদ্ভুত কেন? এই টেবিলে আরও চারটা চেয়ার আছে। রিফায়াতের পাশে না বসে একটু সরে বসলেই পারত। রিমার পাশে বসলেও অসুবিধে ছিল না। রিফায়াতও কি পারত না রিমার পাশের চেয়ারে বসতে।
রিমা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– গাড়ি থেকে বের হতেই এতক্ষণ লাগল!
– হ্যাঁ, ওর সাথে আর্জেন্ট কথা ছিল কিছু।
– ওহ।
একটু থেমে রিফায়াত আবার বলল,
– পরিচয় করিয়ে দেই। আমিরা, ও হচ্ছে রিমা। আমার ইউনিভার্সিটির জুনিয়র। আমরা খুব ভালো ফ্রেন্ডও ছিলাম একসময়…
আমিরা স্মিত হাসল রিমার দিকে তাকিয়ে। রিমা হাসল না। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিফায়াতের দিকে। এটা কী বলল রিফায়াত? ইউনিভার্সিটির জুনিয়র আর একসময়কার খুব ভালো ফ্রেন্ড মানে? রিফায়াত তখনো কথা শেষ করেনি। এবার সে আমিরার পরিচয় হলো,
– ওর নাম আমিরা। আমার ওয়াইফ।
==========================================