তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৭।
রিমা হতভম্ব। বিস্ফারিত চোখে তাকাল একবার রিফায়াতের দিকে, আরেকবার আমিরার দিকে। ভাবতেই পারেনি তার জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছে। খানিক আগে এই মেয়েটা কাউন্টারের সামনে রিফায়াতের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো ছিল, রিমা ভাবছিল কে হতে পারে মেয়েটা। অনেক কিছু মাথায় এসেছিল। কাজিন, কাজিনের ফ্রেন্ড, ভাগ্নি, ভাতিজি, বন্ধুর ছোট বোন ইত্যাদি। হয়তো কোনো দরকারে এসেছে রিফায়াতের কাছে। রিফায়াতও মেয়েটাকে ইগনোর না করে সঙ্গে এনেছে। থাক, বাচ্চা মেয়েই তো! দূর থেকে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা আর চুলে দুই বেনী দেখে মেয়েটাকে বাচ্চাই লাগছিল। অন্তত কোনোভাবেই মনে হয়নি, রিফায়াতের নতুন প্রেমিকা হতে পারে। স্ত্রী হবার বিষয়টা মাথায় আসেইনি।
খানিকক্ষণ হতবাক দৃষ্টিতে আমিরাকে লক্ষ করল সে। মেয়েটা একদমই বাচ্চা না, আবার খুব বড়ও বলা যাবে না। আসলে ইউনিফর্মটাই ওকে একটা বয়সে আটকে ফেলেছে। টিনেজ, কিশোরী – দেখলে এটাই মাথায় আসে। এই মেয়েটা কী করে রিফায়াতের বউ হয়? রিফায়াত নিশ্চয়ই মজা করছে!
রিমা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল,
– কী বললে? তোমার ওয়াইফ? এই মেয়েটা?
উত্তরটা আমিরা দিল। রেস্টুরেন্টে ঢুকার পরই রিমার দিকে চোখ গেছিল তার। তখনই হুট করে মনে হয়েছিল, এই মেয়েটার সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছে রিফায়াত। গাড়িতে বসে বলেছিল, কারও সাথে দেখা করবে। এই রেস্টুরেন্টে এখন যে বা যারা আছে, রিমা বাদে আর কাউকে দেখে মনে হয়নি রিফায়াতের সাথে কোনো সংযোগ থাকতে পারে। অবচেতন মন তখনই বলছিল, এই মেয়েটা রিফায়াতের প্রাক্তন প্রেমিকা। গতকাল বুয়া এর কথাই বলেছিল। বুয়ার একটা স্বভাব হচ্ছে, অতিরিক্ত কথা বলা। আর আমিরাকে সে ধর্তব্যেই নেয়নি শুরুতে। তাই মন খুলে যাচ্ছেতাই বলেছে। আমিরার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে একটু-একটু শুনে মনে হলো, ঘটনা সত্য হলেও হতে পারে। তখন থেকেই অপেক্ষা করছিল রিফায়াতের কাছ থেকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা শোনার। রিফায়াত নিজে তো অবশ্যই বলবে না। প্রাক্তন প্রেমের কথা কেউ সেধে সেধে বলে না। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার কাছ থেকে কৈফিয়ত বের করতে হবে। মুলত প্রাক্তন প্রেমিকার কথা শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে ঘুটঘুট করছিল আমিরার। মন বলছিল, রিফায়াত কখনোই তাকে ভালোবাসবে না। হয়তো পছন্দ করে, হয়তো ওকে ভালো লেগেছে। কিন্তু ভালোবাসা, যেটা আমিরার মনের মধ্যে ডালপালা ছড়িয়ে ফেলেছে, ওই অনুভূতিটুকুর স্থান রিফায়াতের মনে কখনোই হবে না। কারণ অনুভূতিটুকু অন্যের জন্য বরাদ্দ হয়েই আছে। হোক প্রাক্তন। একবার শুনেছিল, মানুষ কখনোই প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না। পরের প্রেমিকা বা স্ত্রী হাজার মনমতো হলেও প্রথম প্রেমের অনুভূতি কখনো মুছে যায় না। রিফায়াতের বেলায়ও কি তাই হবে না?
পরশু বিকেলে যখন রিফায়াতের সাথে গল্প করছিল, আমিরার একবারও মনে হয়নি রিফায়াতের জীবনে কেউ থাকতে পারে। তার ধারণা ছিল, রিফায়াতের জীবনে সে-ই প্রথম। যেমনটা তার জীবনে রিফায়াত। গতকাল বুঝতে পেরেছে, রিফায়াত আসলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারে খুব সহজে। তার মুখে হাসি থাকলেও মনের ভেতর আনন্দ থাকবেই, হলফ করে বলা যায় না। রিফায়াত হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ, যারা দ্বৈত জীবন যাপনে অভ্যস্ত। মুখভঙ্গি কখনোই তার মনের খবর প্রকাশ করে না। আমিরার তখন মনে হয়েছিল, নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল। যদি ভালোই না বাসে, তাহলে রিফায়াত বা শফিক কী এসে যায়? হাজব্যান্ড একজন হলেই হলো! খুব বড় ধরনের ভুল করেছে সে। এমন একটা ভুল, যা চট করে শোধরাবার উপায় নেই। এমনকি একটু সময় নিয়েও ইরেজার দিয়ে ভুলটা মুছে ফেলা সম্ভব না। অথচ এই ভুলটা হয়েছে রিফায়াতের জন্যই। গতকাল সকালে বাসা থেকে বের হয়ে রিফায়াতকে কল করলেও আমিরার মাথায় বিয়ের চিন্তা ছিল না। সে কয়েকটাদিন গা-ঢাকা দিতে চাচ্ছিল। রিফায়াত এটাকে আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে। এখন কি সে এই জট খুলবে? নাকি দায় তুলে নিবে নিজের কাঁধে?
গতকালকের পরিস্থিতি আর এই উপলব্ধি সবটুকু মিলিয়ে আমিরা ইতোমধ্যে হিসেব করে ফেলেছে, রিফায়াতের সঙ্গে আজীবন থাকাটা আদতে অসম্ভব কিছু। মামি কখনোই ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দিবেন না। সারাক্ষণ খোঁচাখুঁচি লাগিয়ে রাখবেন। রিফায়াতের মনের মধ্যে ওকে নিয়ে যত ধরনের নেতিবাচক অনুভূতি ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তার প্রাণপন চেষ্টা করবেন। আর রিফায়াত? সে নিজেও কি ঠিক থাকবে? একসময় তারও মনে হবে, বিয়েটা না করে আরও একবার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে যোগাযোগ করলেই হতো!
মুলত আমিরা তখনই হাল ছেঁড়ে দিয়েছে। রিফায়াতকে পাওয়ার আশা মনের মধ্যে যে একেবারেই নেই, তা নয়। ক্ষীণ আশা তো একটু-একটু করে জ্বলবেই। কিন্তু মন অনেকটাই নিশ্চিত, এই বিয়ে টিকবে না। ওরকম চিন্তাভাবনা থেকেই বড়াপার মোবাইলে কল করেছিল। এক কুল তো যাচ্ছেই। আরেক কুল না ঠেকালে কপালে দুর্গতি ছাড়া আর কিছু নেই। আজ সকালে রিফায়াতের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, মিরাকল হলেও হতে পারে। কিন্তু এখন যা বুঝা যাচ্ছে, মিরাকল না। ক্ষীণ যে আশাটুকু ছিল, তাতে পানি ঢালা হয়েছে। রিফায়াত নিশ্চয়ই ঝগড়া করতে প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসেনি এই সাত সকালে। এই মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য হুড়মুড় করে বাসা থেকে বের হয়েছে। আমিরাকেও প্রায় টেনেহিঁচড়ে বের করেছে, বলা চলে।
কান্না পাচ্ছিল আমিরার। মন ভার হচ্ছিল খুব। নিজেকে সামলে রেখেছিল এতক্ষণ। রিফায়াত যখন রিমার নাম বলল, মন নিশ্চিত হয়েই গেল এটাই রিফায়াতের প্রাক্তন প্রেমিকা। পরক্ষণেই ওকে ‘স্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ায় চমকে গেছে। এই কথাটা ওর জন্য ট্রিগার হিসেবে কাজ করল। তাই চট করে রিফায়াতের বদলে উত্তরটা দিল সে,
– কেন? আমি উনার ওয়াইফ হলে কী সমস্যা?
রিমা অপ্রস্তুত। রিফায়াতের সাথে তার চোখাচোখি হলো। রিফায়াত চুপ করে আছে, যেন আমিরা তার হয়ে উত্তরটা দেয়াতে সে নিশ্চিন্ত। তার আর কিছু বলার নেই। রিমা বলল,
– সমস্যা আছে, তা তো বলিনি।
– বলেননি। কিন্তু আপনার কথার ধরনের তাই মনে হলো।
– তুমি ভুল বুঝছ। আমি অবাক হয়েছি সেজন্য হয়তো কথা অন্যরকম শোনা গেছে। আমি আসলে এক্সপেক্ট করিনি রিফায়াতের বিয়ের খবর আমি জানব না।
– তাহলে কী এক্সপেক্ট করছিলেন, উনি আপনাকে বিয়ের দাওয়াত দিবে?
রিমা হতভম্ব। এই মেয়েটা ফরফর করে কথা বলছে আর রিফায়াত চুপচাপ বসে শুনছে? রিমা এবার আমিরাকে সম্পুর্ণ এড়িয়ে রিফায়াতের দিকে তাকাল। তাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, রিফায়াত। তুমি কি এক্সপ্লেইন করবা প্লিজ?
এর মধ্যেই ওয়েটার চলে এলো খাবার নিয়ে। তিনজনের অর্ডার দিয়েছে রিফায়াত। রিমার পছন্দের কথা সে জানে। তার জন্য হালুয়া আর পরোটা। আমিরার জন্য কলিজা আর পরোটা। আর তার নিজের জন্য এক মগ ক্যাপুচিনো কফি। আগে যখন রিমার সাথে প্রায়ই এই রেস্টুরেন্টে আসা হতো, দুজনের এই মেন্যু সবসময়ই নির্দিষ্ট থাকত। এখানকার তৈরি হালুয়া রিমার খুব প্রিয়। তেল ছাড়া ভাঁজা পরোটা দিয়ে এই হালুয়া খেতে অমৃতের মতো লাগে। রিফায়াত হালুয়া পছন্দ করে না তেমন। বাইরের খাবার খাওয়াটা আসলে তার ধাতে নেই। মামি ছোটবেলা থেকে ওর জন্য নিজ হাতে বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে খাইয়েছেন। কখনো বাইরে খাওয়ার দরকার হলে টিফিন বক্সে খাবার দিয়েছেন। এজন্য বাইরের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যেস তার হয়নি কোনোকালে। এই রেস্টুরেন্টে আসা হতো শুধু রিমার কারণেই। রিমা হালুয়া-পরোটা খেত আর সে এক মগ কফি। কখনোবা কফির সাথে দুই পিস কুকিজ।
রিমার মনের মধ্যে প্রজাপতি উড়তে লাগল, রিফায়াত এখনো ওর পছন্দের খাবারের কথা মনে রেখেছে! এই রেস্টুরেন্টে সকালবেলায় এসে নাশতা খাওয়াটা তার প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। সে প্রায়ই আসে এখানে। তার কথা মনে রেখেই রিফায়াত এখানে আসতে বলেছিল! এর মানে কি রিফায়াতের মনে তার জন্য একটুখানি অনুভূতি অবশিষ্ট আছে? অবশ্যই আছে। নয়তো রিফায়াত দেখা করতে আগ্রহী হতো না। কিন্তু বিয়ের কথাও যে বলল! সত্যিই কি এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে রিফায়াত?
খাবার চলে এসেছে গরম-গরম। তাই কথাবার্তার দিকে আর এগোল না রিমা। রিফায়াতের সঙ্গে দেখা করবে বলে সকালে হুড়মুড় করে বাসা থেকে বের হয়েছে। নাশতা খায়নি। চোখের সামনে পরোটা আর হালুয়া দেখে নিজেকে আর সামলে রাখা যাচ্ছে না। রিফায়াতও কফির কাপে চুমুক দিতে ব্যস্ত। আমিরা বলল,
– কী আজব! আপনি নাশতা খাবেন না? বাসা থেকে তো নাশতা করে আসেননি।
রিফায়াত উত্তর দিল,
– আমি কফি খাচ্ছি।
– শুধু কফি খাইলে কি হবে? সকালের নাশতা ভালোমতো খেতে হয়। পেট খালি থাকলে সমস্যা।
– আমার আপাতত কফি খাইলেই হবে। আর কিছু লাগবে না।
রিমা আগবাড়িয়ে বলল,
– রিফায়াতের তো বাইরের খাবার খেয়ে অভ্যেস নেই। বাইরের খাবার ওর হজম হয় না।
আমিরা চোখ ঘুরিয়ে বলল,
– এইটা কীরকম কথা?
বলেই পরোটা ছিঁড়ল সে। এরপর কলিজার দিকে হাত বাড়াল। রিমা ভেবেছিল, কাহিনি এখানেই খতম। কিন্তু দেখা গেল, আমিরা ছিঁড়া পরোটায় একটু কলিজা তুলে রিফায়াতের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। মুখে বলল,
– হা করেন।
এরপরের ঘটনাও রিমার ধর্তব্যে ছিল না। রিফায়াত বিনা বাক্য ব্যয়ে আমিরার হাত থেকেই খেয়ে নিল। রিমা হতবাক। যে রিফায়াতকে কখনো হাজার বলেকয়েও বাইরের খাবার খাওয়ানো যায়নি, আজ সে রেস্টুরেন্টের পরোটা-কলিজা খাচ্ছে! মনে পড়ল, একবার মৌচাক মার্কেট থেকে কলিজার পুর দেয়া অনেকগুলো সিঙ্গারা কিনেছিল রিমা। ওর সামনেই এই সিঙ্গারাগুলো বানিয়ে ভাঁজা হয়েছে। বান্ধবী ছিল সঙ্গে। দুজন মিলে চার-পাঁচটা খেয়েছে। সিঙ্গারাগুলো খুবই মজার ছিল। তাই দোকান থেকে বের হবার সময় বাসার জন্যও গুনে-গুনে দশটা নিয়ে নিল। এরপর রিফায়াতের সঙ্গে দেখা করার কথা। ওর হাতে সিঙ্গারার প্যাকেট দেখে রিফায়াত জিজ্ঞেস করল,
– কী আছে ওর মধ্যে?
রিমার তখন মনে হলো, রিফায়াতের জন্য কেনা হয়নি। বাসায় পাঁচজন সদস্য। প্রত্যেকের জন্য দুটো নিয়েছে। আগে খেয়াল ছিল না। নয়তো আরও দুটো বেশি কিনত। এখন উপায়? তড়িঘড়ি করে মনকে বুঝ দিল, রিফায়াত নিশ্চয়ই দশটা সিঙ্গারাই খাবে না। বড়জোর একটা কী দুটো খেতে পারে। বাকিগুলো নাহয় বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। সে মিথ্যে করে বলল,
– তোমার জন্য সিঙ্গারা এনেছি। ভেতরে কলিজার পুর দেয়া। বড় সাইজের সিঙ্গারা। খুব টেস্টি।
– কিন্তু কাগজের প্যাকেট কেন?
– দোকানে তো কাগজের প্যাকেটই দিবে, তাই না?
রিফায়াত অবাক সুরে বলল,
– দোকান থেকে কিনছ?
– হ্যাঁ। আর কোথা থেকে কিনব?
রিফায়াত গলার সুর পালটে বলল,
– স্যরি আমি দোকানের খাবার খাই না। তুমি এটা নিয়ে যাও বাসায়।
রিমার মন থেকে অস্বস্তি দূর হলো। রিফায়াত এর মধ্যে ভাগ বসালে বেকায়দায় পড়তে হতো। তবু রিমা আরও কয়েকবার অনুরোধ করল। রিফায়াত বরাবরের মতোই ‘না’ বলল। রিমার তখন মেজাজ চড়ে গেছে। রিফায়াতের ‘না’ বলাটা তার ইগোতে লেগেছে। সে উঠেপড়ে লাগল অন্তত একটা সিঙ্গারা হলেও রিফায়াতকে খাইয়ে ছাড়বে।
বলাই বাহুল্য, সেবার সফল হয়নি। অবশ্য সফল কোনোকালেই হতো না। রিফায়াত একবার ‘না’ বলেছে মানেই এই ‘না’ আর কখনো ‘হ্যাঁ’ হবে না। এতকাল পর এই স্মৃতিটা মনে পড়ল রিমার। আমিরাকে একজনের নাশতা দেয়া হয়েছে। আমিরা সেখান থেকে রিফায়াতকে খাইয়ে দিচ্ছে। হালুয়া-পরোটা খাওয়ার ফাঁকে এই দৃশ্যটা আচানক রিমার চোখে জ্বালা ধরাল। সে অনেকবার রিফায়াতকে বাইরের খাবার খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করেছে। কখনো কি মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে? কই, মনে পড়ে না তো। আমিরা যেভাবে এপ্রোচ করল, সেদিন সেও কি পারত না প্যাকেট থেকে একটা সিঙ্গারা বের করে রিফায়াতের মুখের সামনে ধরে বলতে, খাও প্লিজ! রিফায়াত কি তাহলে ‘না’ বলতে পারত?
উহু, রিফায়াত বদলেছে। অনেকটাই বদলে গেছে। অথবা ওদের সম্পর্কের সুতো কোনোদিনই মজবুত ছিল না। তাই ছিড়ে যেতে সময় লাগেনি। আমিরার সাথে কতদিনের পরিচয়, রিমা জানে না। কিন্তু হলফ করে বলতে পারবে, আমিরা এর মধ্যেই এমন কিছু আচরণ করেছে, যেটার অনুপস্থিতি বিচ্ছেদের পর রিফায়াতকে বহুকাল পোড়াবে। হয়তো সারাজীবনই। আচ্ছা, বিচ্ছেদের কথা মাথায় আসলো কেন? আমিরা আসলেই রিফায়াতের বউ কি না, বিষয়টা মনের মধ্যে পাকাপোক্ত হতে পারছে না বলেই কি?
রিমা খাওয়ার ফাঁকে বলল,
– আই অ্যাম এক্সপেক্টিং অ্যান এক্সপ্ল্যানেশন, রিফায়াত। কী যেন বলছিলে, আমিরা তোমার ওয়াইফ! বাট হাউজ দ্যাট পসিবল?
রিফায়াতের খাওয়া শেষ। আমিরা এতক্ষণ ওকে খাইয়ে দিয়েছে। নিজেও অল্পসল্প খেয়েছে। কিন্তু রিফায়াতকে খাওয়ানোর দিকে তার আগ্রহ বেশি ছিল। রিফায়াত টিস্যুতে মুখ মুছে বলল,
– বাকিটা তুমি খাও। আরেকটা দিতে বলি পরোটা।
– না, আমার এইটুকুতেই হবে।
আমিরার প্লেটের দিকে তাকাল রিমা। একটা পরোটার অর্ধেক আর দুই তিন টুকরো কলিজা। দুটো পরোটা দিয়েছিল। রিফায়াতকে দেড়টা খাইয়েছে আমিরা। রিফায়াত বলল,
– সিরিয়াসলি? এইটুকু খেয়ে তুমি সারাদিন পার করবা? দুপুরে কী খাওয়া হবে, আমি কিন্তু এখনই জানি না। আজকে সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতে হবে।
আমিরা মাথা নেড়ে বলল,
– দুপুরে তো আমার খাওয়াই হয় না। কলেজে থাকি তখন।
রিফায়াত কথা বাড়াল না আর। আমিরাকে জোর করেও খাওয়ানোর উপায় নেই, এটা গতকাল রাতেই প্রমাণিত। খাওয়ার বেলায় খুব অনীহা ওর। কফির কাপে চুমুক দিয়ে রিমার দিকে মনোযোগ ঘোরাল রিফায়াত। আমিরাকে বলল,
– আমি যদি রিমাকে নিয়ে পাশের টেবিলে বসি। তুমি কি মাইন্ড করবা? আমরা কিছু কথা বলব। যেটা তোমার না শোনাই ভালো। তুমি চাইলে শুনতে পার। তবে শুনলে তোমার ভালো লাগবে না।
– আপনি যেহেতু বলতেছেন, না শোনাই ভালো। তাইলে শুনব না। আপনারা পাশের টেবিলে গিয়ে কথা বলেন।
রিফায়াত হাসল। টুপ করে আমিরার কপালে আলতো চুমু দিল সে, রিমার সামনেই। রিমা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। তার বুকের মধ্যে খচমচ করছে খুব। রিফায়াত আর কোনো কথা না বলে পাশের টেবিলে গিয়ে বসল। রিমাও ওর পিছু নিল। ভেবেছিল, আলাদা কথা বলার ফাঁকে যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়, রিফায়াতকে ফিরে পাবার। কিন্তু রিফায়াত কোনোরকম ভুমিকা ছাড়াই মুল প্রসঙ্গে চলে গেল,
– ঠিক শুনছ। আমিরা আমার ওয়াইফ। গতকাল বিয়ে করছি আমরা। কাজি অফিসে। এজন্য তুমি খবর পাও নাই আগে। ইভেন মামা-মামি আর তুমি বাদে এখন পর্যন্ত কেউ জানেও না। সাজি আর সাজ্জাদকেও বলা হয় নাই।
সাজি জানলে অবশ্যই ফেসবুকে এই খবরটা শেয়ার করত। রিফায়াত-আমিরার বিয়ের ছবিও পোস্ট করত। আর তখনই রিমা জানতে পারত। এটাই কি বুঝাতে চাইল রিফায়াত? প্রশ্নটা রিমার মনে ঝুলে রইল। রিফায়াত আবার বলল,
– আমিরাকে আমি আগেভাগে চিনতাম না। আমার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলাম পরশুদিন। ভুল ঠিকানায় মানে আমিরাদের বাসায় চলে গিয়েছিলাম। আমিরাও পাত্রপক্ষ আসার অপেক্ষায় ছিল। ওর খালার পছন্দ করা পাত্র। মানে মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়ে গেছে। অনেকটা সময় পর যখন বুঝতে পারলাম ভুলটা, উই ওয়্যার মেন্টালি অ্যানগেজড। স্পেশালি আই ওয়াজ। পরে অবশ্য জানতে পারছি আমিরাও অ্যানগেজড।
– মানে কী? একদিনেই অ্যানগেজড?
– হু। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই ট্রু।
– তারপর?
– আমিরার দিক থেকে অলরেডি জানাজানি হয়ে গেছে যে, পাত্র হিসেবে যার যাওয়ার কথা ছিল ওদের বাসায়, সেই ছেলেটা আমি না। তারা এটাকে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ধরে নিল। বাট আমরা এই চান্সটুকু লুফে নিলাম। কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম।
রিমা নিভে যাওয়া সুরে বলল,
– কাজটা বোধহয় ঠিক হলো না। তোমার মামি নিশ্চয়ই ভালোভাবে নেননি বিষয়টা।
– মামি অবশ্যই ভালোভাবে নেয়নি। কীরকম রিএক্ট করেছে, তা তুমি ভালোই জানো। ওকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। এজন্য সাথে নিয়ে আসলাম। রেখে আসলে মামি নির্ঘাত ওকে একা পেয়ে বাসা থেকে বের করে দিত।
রিমা একটু ভাব ধরল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, রিফায়াত এই ব্যাপারে ওর সাহায্য চাচ্ছে। কেন করবে সে সাহায্য? কী লাভ তার? সে বলল,
– তো? এখন কী করবা ভাবছ?
– ভাবাভাবি শেষ। ডিসিশন অলরেডি নিয়ে ফেলছি।
– কী ডিসিশন?
– আমিরা আমার নিকুঞ্জের ফ্ল্যাটে থাকবে।
– অ্যা?
– এই মুহূর্তে ফ্ল্যাটে কোনো টিন্যান্ট নাই। বাসার টু-লেট দেয়া হয়েছিল। আজকে ওটা সরিয়ে ফেলব। বাসা মোটামুটি ফারনিশড। তারপরও আমিরার যদি কিছু লাগে, সে আলাদা করে কিনে নিবে। অথবা পুরো ইন্টেরিয়র চেঞ্জ করে নিতে পারে। ওর ইচ্ছা। ওর সংসার ও নিজের ইচ্ছামতো সাজাবে।
রিমা হতবাক। বলল,
– সিরিয়াসলি? আর তোমার মামি চুপচাপ বসে থাকবেন?
– কেন থাকবে না চুপ? তার একটাই কথা ছিল, আমিরাকে বাসা থেকে বের করে দিতে হবে। ওই বাসায় হয় আমিরা থাকবে, নয়তো সে। আমি আমিরাকে সরিয়ে দিচ্ছি। মামির সংসার মামিরই থাকল। আর আমিরা তার সংসার নিজের মতো করে সাজিয়ে নিল। ব্যস, প্রবলেম সলভড।
রিমা কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
– এই ডিসিশনটা তুমি আরও আগে নিলেও পারতা, রিফায়াত! তাহলে আমাদের ব্রেকআপ হতো না। আর এই তিনটা বছর…
– উহু। তোমার ধারণা ভুল। হতে পারে আমিরার আজকের সিচুয়েশন তুমি তিন বছর আগেই ফেস করেছ। বাট তার মানে এই না, তুমি আর আমিরা সেইম।
– তাই? আমিরা কেন ডিফ্রেন্ট?
রিফায়াত খানিক এগিয়ে এলো সামনের দিকে। গলা নামিয়ে বলল,
– আমিরা ডিফ্রেন্ট না। আমিরা খুব সিম্পল একটা মেয়ে, যে কি না লাইফের প্রতিটা স্টেজে ধাক্কা খেয়েছে। তার স্বপ্নগুলো কখনো বেড়ে উঠতেই পারে নাই। জন্ম হতে না হতেই মারা গেছে। তোমার সাথে ওর ডিফ্রেন্স এখানেই, ও তোমার মতো পাকা অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে উঠতে পারে নাই। সবকিছু পাই-পাই করে হিসেব করতে জানে না। আমি বলছি না, ও হিসাব করতে পারে না। ওর যে সিচুয়েশন, বা ফ্যামিলি স্ট্যাটাস, তাতে ও অনেকটা বাধ্য হয়ে লাইফের ক্যালকুলেশন করতে শিখেছে। হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক্সপার্ট। বাট তোমার মতো ওভার-এক্সপার্ট না।
– ওভার এক্সপার্ট? আমি?
– হু।
– তুমি কি আমাকে অপমান করতে ডেকে এনেছ? তাও আবার বউকে সাথে এনেছ, যাতে সে এনজয় করে।
– ও খাচ্ছে। ওইটুকু খাবার খেতে ওর সময় লাগবে। কারণ ও খুব আস্তে খায়। সো, এনজয় সে করছে না। সত্যি বলতে, ওরকম মেন্টালিটিও তার নাই। আর রইল তোমাকে অপমান করার জন্য ডেকে আনা। প্রথমত, আমি তোমাকে বলিনি দেখা করার কথা। তুমিই কল দিয়েছ। স্যরি বলেছ। এরপর দেখা করতে চাইলে। এখানে আমার ‘না’ বলার কোনো কারণ নাই। একটা মানুষ ‘স্যরি’ বলার পর মনের মধ্যে আর কিছু পুষে রাখা উচিতও না। তবে হ্যাঁ, আমিরাকে আমি চাইলে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আসতে পারতাম। কিন্তু সঙ্গে এনেছি তোমাকে একটা বিষয় জানানোর জন্য।
– কী?
– গতকাল আমরা যখন কাজি অফিসের ভেতর বসে আছি, কাজি ওকে জিজ্ঞেস করলেন দেনমোহর কত হবে। আমিরা দেনমোহর সম্পর্কে খুব একটা জানে না। কাজি ওকে বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। এরপর সে কী করল, জানো? আমার ওয়ালেট থেকে ঝেড়েঝুড়ে সব টাকা নিল। মোট আঠারোশ বাষট্টি টাকা ছিল। ও নিয়ে নিল। কাজিকে বলল, এটাই দেনমোহর।
একটু থেমে রিফায়াত আবার বলল,
– যেরকম ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা মেয়ে সে, অভাব না থাকলেও সচ্ছ্বলতা নাই। প্রতিটা পয়সা হিসেব করে চলা ফ্যামিলি ওর। বিয়ের পর ভুল করেও যেন বাবার বাড়িতে চলে না আসে, সেই শিক্ষা ওর ফ্যামিলিতে দেয়া হয়। কারণ ডিভোর্সী মেয়েকে ঘরে রাখার সামর্থ্য বা মানসিকতা তাদের নাই। তাছাড়া, ওর দেখভাল করবে কে? ওর বাবা নিজেই পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। উনাকেই দেখভাল করে আরেকজন। বুঝতেই পারছ, ওর লেভেলটা ঠিক কোথায়!
– লো লেভেল অফ দ্য সোসাইটি!
– হু। চাইলে আমার কাছ থেকে দেনমোহর বাবদ অনেক টাকা আদায় করতে পারত। কিন্তু সে নিজের জায়গায় স্টিক হয়ে রইল। আমি নিজেও তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এত কম টাকা দেনমোহর হয় না। কিন্তু ওর একটাই কথা, দেনমোহরের থিউরি অনুসারে ওই টাকাটাই ওর প্রাপ্য। এরপর আমি ওকে আরও টাকা অফার করেছি। ওটা সে লোন হিসেবে নিয়েছে অথবা ভরণপোষণ। দেনমোহর না। আমি কোনোকিছু লিখিত দেইনি। মুখে বলেছি, দিব। ওটাই ও বিশ্বাস করেছে। ইভেন, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, টাকার অঙ্কটাও ওর কাছে ম্যাটার করে না। ওর শুধু ভালো থাকা-খাওয়ার খরচটুকু দরকার। তার থেকেও বেশি দরকার আমাকে। ওর লাইফে সবথেকে বেশি প্রায়োরিটি হচ্ছে, আমি যেন ওর সাথে আজীবন থাকি। এই আমি মানুষটা ভালো হতে পারি, খারাপ হতে পারি। ও কিন্তু জানে না আমি কেমন। তারপরও সে চায় আমি সারাজীবন ওর সাথে থাকব। আমার সাথে অ্যাডজাস্ট করে চলতে ও মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড। আর এটা যদি কোনোভাবে সম্ভব না হয়, ওকে টাকা দিতে হবে ভরণপোষণ বাবদ, যেন বাবার বাড়ি ফিরতে না হয়। সেই টাকার অঙ্কটা আমিই ঠিক করব। মানে আমি যা দিব, ততটুকুই সই। যদি বলি, কিছুই দিব না। তাহলেও সই।
– এসব কথা তুমি আমাকে কেন বলছ?
– বলছি এজন্য যেন তুমি আমিরার ক্যালকুলেশনটা বুঝতে পার। আর নিজের সাথে কম্পেয়ার করো।
– আমার সাথে?
– তোমার মনে আছে শর্তগুলোর কথা?
রিমা বুঝে ফেলল রিফায়াত আসলে কী বলতে চাচ্ছে। সে ফিসফিস করে বলল,
– রিফায়াত প্লিজ। ওই প্রসঙ্গ থাক। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে কথা আর না বলি।
রিফায়াত ওর কথায় কান না দিয়ে বলল,
– তুমি ওর মতো ফ্যামিলি বিলং করো না। তোমার বাবা রিটায়ার্ড গভমেন্ট অফিসার। বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তুমি আর তোমার ভাইবোনদের জন্য এনাফ প্রপার্টি আর ব্যাংক ব্যালেন্সও করেছেন। এরপরেও তোমার বাবার দাবি ছিল, তোমাকে বিয়ে করতে হলে দেনমোহর হতে হবে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা এবং একটা প্রপার্টি তোমার নামে ট্রান্সফার করতে হবে। উনি বলেছিলেন, এটা তোমার সিকিউরিটির জন্য। আর উনার এই দাবিটা তুমি শর্ত হিসেবে রেখেছিলে।
– এতদিন পর এইসব কথা বলতেছ কেন, রিফায়াত? প্লিজ স্টপ। আমি স্বীকার করতেছি, ওটা আমার ভুল ছিল। ওভাবে শর্ত দেয়া উচিত হয় নাই আমার। আর বাবা তো ওরকম দাবির কথা বলবেই। প্রতিটা বাবাই চায় তার মেয়ে ভালো থাকুক। মেয়ের লাইফ সিকিউরড থাকুক। আমার ভুল ছিল, বাবার দাবিটাকে রিপ্রেজেন্ট করা। আমি বাবার সাথে এই নিয়ে কথা বলতে পারতাম। তা না করে…
– লেট মি ফিনিশ ফার্স্ট। এই পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর একটা প্রপার্টি তোমাকে দেয়া আমার জন্য খুব একটা টাফ ছিল না। এটা তুমিও ভালো করে জানো। আমি তোমার কাছে আমার ফিন্যান্সিয়াল অ্যাবিলিটি কিছুই লুকাইনি। ঠিক?
– হ্যাঁ জানতাম।
– সো, ওই মুহূর্তে তোমার বাবার দাবি মেনে নেয়াটা আমার জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমি মেনে নেইনি। কেন জানো?
রিমা চুপ করে রইল। রিফায়াত আবার বলল,
– তুমি এই সোসাইটিতে এনাফ সিকিউরড একটা লাইফ লিড করতেছ, তোমার ফ্যামিলিরও এনাফ অ্যাবিলিটি আছে ফিন্যান্সের। তারপরেও আমার কাছে এই সিকিউরিটি তোমার চাইতে হয়েছিল! তোমার একবারও মনে হয়নি, ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটির চেয়ে আমি তোমার লাইফে বেশি ইম্পরট্যান্ট। আমি তোমার লাইফে থাকলে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর একটা প্রপার্টি কেন, আমার সবকিছুই তো তোমার হতো। তাই না? আমিই তোমার মেইন সিকিউরিটি হবার কথা ছিলাম। কিন্তু তুমি সেভাবে চিন্তাই করোনি। তোমার বাবা আর তোমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটির কথা। দ্যাট মিনস আজকে আমার যদি কিছু না থাকত, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতে না। ইভেন প্রেম করার প্রশ্নও আসত না। কারণ টাকা দিয়ে তুমি সম্পর্ক বিচার করো। আবার ধরো এমনও হতে পারত, ওই সময় আমি শর্তটা মানলাম। আমাদের বিয়ে হলো। আমি তোমাকে দেনমোহর বাবদ পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর একটা প্রপার্টি বিয়ের দিনই ট্রান্সফার করে দিলাম। অ্যান্ড বিয়ের পরদিন আমি আরেকটা মেয়েকে নিয়ে হানিমুনে গেলাম। তখন কেমন লাগত? ভালোই লাগার কথা। কারণ তুমি যা চেয়েছ, তা অলরেডি পেয়ে গেছ। এখন তোমার হাজব্যান্ড কোথায় কোন মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে, তাতে তোমার কী এসে যায়? তোমার লাইফ তো সিকিউরড। তাই না?
– কী বলছ তুমি, রিফায়াত?
– তুমি তো আমাকে এতগুলো বছর ধরে চিনেও ট্রাস্ট করতে পারোনি। যেটা আমিরা একদিনেই করে ফেলেছে। ওই মেয়েটা, যার কি না পায়ের তলায় শক্ত মাটি নাই। মাথার উপর ছাদ নাই। নড়বড়ে জীবন। ওর কাছে এই টাকার মুল্য অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে চুজ করছে আমাকে। সে ক্লিয়ার করে বলছে, আমি যদি তার সাথে আজীবন থাকি, টাকাপয়সা কিছুই তার লাগবে না। ইভেন আমার সাথে থাকার জন্য সে মামির টর্চারও হজম করবে। মামি তাকে গতকাল কীরকম অপদস্থ করছে, তুমি দেখোনি। কিন্তু ধারণা নিশ্চয়ই আছে। এরপরেও সে কী বলতেছে, জানো? মামি যেন বাসা থেকে বের হয়ে না যায়। মামি চলে গেলে ও সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধি হয়ে থাকবে। ওর মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করবে। হ্যাপি হতে পারবে না লাইফে। ও এটাও জানে, মামি আমার লাইফে কী। আমি নিজে জানতাম না, রিমা। ও আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমার লাইফে মামির পজিশন কী। ও আমাকে একদিনেই এতটা চিনেছে যে, ও ভালো করেই জানে মামির সাথে রিলেশন অফ করা মানে আমার এক অর্থে মরেই যাওয়া। আর আমি মরে যাওয়া মানেই ওর লাইফ থেকে হ্যাপিনেস সরে যাওয়া। ও টাকার থেকেও বেশি প্যাম্পার করে রিলেশনকে। অ্যান্ড দ্যাটস ট্রিগারড মি টুওয়ার্ড হার। এই রিয়েলাইজেশন হবার আগপর্যন্ত আমি তোমাকে মনের মধ্যে পুষে রাখছিলাম। গতকাল বিয়ে করে ফেললেও আমার মনের মধ্যে তুমি ছিলা। আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম, তুমি যদি কোনোভাবে ফেরত আসো। এইসব আমিরা-টামিরাকে আমি লাইফে জায়গা দিব না। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমিরা আমাকে রিয়েলাইজ করালো, আই রিপড ইউ অফ মাই মাইন্ড। টোটালি ভ্যানিশ হয়ে গেছ তুমি। আর সেজন্যই যে ডিসিশনটা আমি আজ নিতে পারছি, সেটা আরও তিন বছর আগে নিতে পারিনি।
রিমা স্তব্ধ হয়ে আছে। তার চোখভর্তি নোনাজল। আগের দিনগুলোয় ফিরে যেতে পারলে রিফায়াত এই নোনাজল দেখামাত্রই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠত। কিন্তু আজ সে পুরোপুরি অন্য মানুষ। পুরোটাই আমিরার। তাই চোখের পানি উপেক্ষা করে বলল,
– আমিরা আমার কাছে ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি চায় না। সে চায় আমাকে। আমি ইভেন তাকে এও বলছিলাম, আমার সবটুকু তাকে দিয়ে দিব। তখন সে পালটা প্রশ্ন করছে, সবটুকু দিয়ে দিলে আমি কীভাবে চলব? এর মানে আমার পরোয়া সে করে। এজন্যই আমাকে ডাউন করে নিজে উপরে উঠতে চায় না। তার চাওয়া, এই সবটুকু দিয়ে আমার দুজন একসাথে চলব। ও যেহেতু ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি চায় নাই, চেয়েছে আমাকে। তাই আমি কতটা তার প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে আছি, এটুকু আশ্বস্ত করার জন্য ওকে নিয়ে আসছি। আমি চাইনি, ওকে দূরে রেখে এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা করতে, যাতে ওর মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে। আবার ওর কাছেও আমার পাস্ট লুকাতে চাইনি। নয়তো ফোনেই বলতে পারতাম বিয়ের কথা। যে মেয়েটা টাকাপয়সাকে একপাশে রেখে আমাকে চুজ করে তার লাইফে, আমার কর্তব্য লাইফের প্রতিটা স্টেজে তাকে আশ্বস্ত করা, আমি তার হয়েই আছি। আর এখন থেকে আমি এটাই করব।
=========================================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৮।
রিমাকে এক প্রকার হতভম্ব অবস্থায় রেখেই চলে এলো রিফায়াত। ওর পেছনে আমিরা। ব্যাটারি দেয়া পুতুলের মতো অনুসরণ করল। রিমা পেছন থেকে ডাকল কয়েকবার। রিফায়াত ফিরে তাকায়নি। আমিরা অবশ্য তাকিয়েছিল একবার। কিন্তু রিফায়াত দাড়াচ্ছে না দেখে সেও ঘুরে হাঁটা ধরল।
রেস্টুরেন্ট থেকে গাড়ি – এই সময়টুকু রিফায়াত কোনো কথা বলেনি। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেছে। আমিরা ওর পাশে-পাশে হাঁটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু রিফায়াতের হাঁটার গতি বেশি। তাল মিলাতে পারছিল না। আমিরা দু’বার বলেছে, একটু আস্তে চলতে। কিন্তু রিফায়াত সেই কথা শোনার মানুষ না। রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে আমিরা দাঁড়িয়ে পড়ল। জোরে হাঁটতে গিয়ে তার পা ছিলে যাচ্ছে। স্যান্ডেলটা ভালো না। সস্তা দামের। বিধায় প্রথম দিন থেকেই এটা পরতে অসুবিধে হয়। সাবলীল্ভাবে হাঁটতে গেলে পায়ের চামড়া ছিলে যায়। তবু চালিয়ে নিচ্ছে। কয়েকবার এই স্যান্ডেল পরার পর সে খেয়াল করেছে, আস্তে হাঁটলে খুব একটা সমস্যা হয় না। পায়ের চামড়া ছিলে গেলেও অল্পের উপর দিয়ে যায়। প্রথমদিনই বড়াপাকে বলেছিল, বদলে আনতে। বড়াপা বলল,
– ফুটপাত থেকে কিনছি। রিসিট নাই। এখন নিয়ে গেলেই কি রিটার্ন দিবে? তোর শ্বশুর লাগে নাকি জুতাওয়ালা?
আমিরা আর কথা বাড়ায়নি। বুঝে নিয়েছে, কপাল খারাপ। আগামী এক বছর অথবা যতদিনে এই স্যান্ডেলের দফারফা না হয়, এটা পরেই দিন পার করতে হবে। কলেজে কেডস পরা যায়। কিন্তু কেউ পরে না। সবাই স্যান্ডেল সু পরে। কেউ কেউ পাম্প সু পরে। কারও দুই-তিন জোড়া স্যান্ডেল আছে। তারা একেকদিন একেকটা পরে আসে। আমিরার এই একটাই স্যান্ডেল। গত ঈদে কিনেছিল বড়াপা। বছরখানেকের কাছাকাছি হয়ে গেছে। আগামী ঈদ আসলে আর মাত্র দুই-আড়াই মাস। স্যান্ডেল সু এখনো ছিড়েনি। আমিরা কয়েকবার ছিঁড়তে চেষ্টা করেছে অবশ্য, পারেনি। উলটো একদিন আনিসার সামনে এই চেষ্টা করেছিল। পরে সে কথায়-কথায় আমিনার কানে দিয়েছে। আমিনা রাগী সুরে বলেছে,
– স্যান্ডেল ছিঁড়লে ছিঁড়ুক। ছিঁড়া স্যান্ডেল পরে হাঁটবে। সমস্যা কী? এক বছরের আগে তো নতুনটা কিনতেছি না আমি। অত্ত গাবায় না টাকা।
পায়ে ব্যাথা হচ্ছে। এমনিতেও জোরে হাঁটতে পারে না আমিরা। অভ্যেস নেই। এজন্য ছোটবেলা থেকে এই অবধি কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। মা-বোনদের ভাষায়, ঢিবঢিব করে চলা। নাসিমা বানু প্রায়ই এই নিয়ে আমিরাকে কথা শোনান,
– জীবনে কী করে খাবি তুই এত আস্তে হাঁটলে?
আস্তে হাঁটার সাথে জীবনে কিছু করে খাওয়ার কী সম্পর্ক, আমিরা জানে না। মাকে প্রশ্নও করে না। জানে, এই কথা জিজ্ঞেস করলেই উলটো স্যান্ডেল নিয়ে মা তেড়ে আসবে মারতে। রিফায়াত হেঁটে যাচ্ছে। আমিরা তার পাশে আছে কি না, সেই খেয়াল তার নেই। আমিরা অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল ওর গমনপথের দিকে। বিল্ডিং থেকে বের হয়ে খানিকটা সামনে এগোলেই ফুটপাত। ওর একপাশে গাড়ি পার্ক করা যায়। রিফায়াত ওখানেই গাড়ি রেখে এসেছে। কখন আমিরার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রিমা, টের পায়নি। আচানক কন্ঠ শুনতেই ঘাড় ঘোরাল,
– কী ব্যাপার? শেষমেশ নকল বউকে ফেলেই চলে গেল রিফায়াত?
রিমার মুখে ব্যঙ্গ হাসি। আমিরা অপ্রস্তুত। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। বলল,
– আপনার মূল সমস্যা কী, জানেন? আপনি খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। যেদিকেই তাকান, আপনার মনে হয় সবখানে ভন্ডামি চলছে। কেন এভাবে চিন্তা করেন আমি জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনার নিজের মধ্যেই ভন্ডামি আছে। এজন্য আপনি সবাইকে ভন্ড মনে করেন।
রিমা হতবাক ভঙ্গিতে বলল,
– কী বললে তুমি? আমি ভন্ড?
– সরাসরি বলি নাই। আমার মনে হচ্ছে। আমার মা প্রায়ই একটা কথা বলে। যার মনের মধ্যে চোরামি, সে দুনিয়ার সব মানুষকেই চোর মনে করে। আর যে সবসময় অন্তর পরিস্কার রাখে, তার কাছে সবকিছুই ফকফকা।
রিমা কিছু বলল না। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। দুইদিনের বাত্তি ছেমড়ির মুখে চটাং চটাং কথা! এই সঙকে নাকি রিফায়াত বিয়ে করেছে! আমিরা আবার বলল,
– আপনার মনের মধ্যে এত অবিশ্বাস নিয়ে রিফায়াতের সাথে সংসার করতেন কীভাবে? রিফায়াত তো সবকিছু সহজেই বিশ্বাস করে নেয়। যেমন করেছিল আপনাকে।
রিমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
– যেমন করেছে তোমার মতো ফ্রডকে!
আমিরা গা-ঝাড়া দেবার ভঙ্গিতে বলল,
– হতেও পারে। বিশ্বাস করে এরপর ঠকলে তারপর উনি কৌশলী হতে শিখবে। যদি আমি ঠকাই আর কী। আমার অবশ্য প্ল্যান নাই ওরকম। উনার সাথে আমার সারাজীবন একসাথে থাকার ব্যাপারেই কথা হইছে।
– টাকা নাকি দিবে শুনলাম! প্রপার্টিও দিবে! আমার বাবা মেয়ের জন্য ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি চেয়েছে। এজন্য রিফায়াতের পিত্তি পর্যন্ত জ্বলে গেল। আর তোমাকে সবটাই দিবে। কারণ তুমি ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি চাওনি। মাত্র আঠারোশ বাষট্টি টাকা দেনমোহর নিয়েছ! রিফায়াত তোমার চালাকি ধরতে পারেনি এখনো।
– টাকা উনি দিলেই আমি নিব কেন? প্রপার্টিও দিলেই আমি অ্যাকসেপ্ট করব কেন?
রিমার অবিশ্বাসের দিকে তাকাল। আমিরা আবার বলল,
– আমি যদি স্পেসিফিক অ্যামাউন্টের টাকা চাই, উনি দিবে। এটা আমি জানি। প্রপার্টিও দিবে হয়তো। কিন্তু আমি তা চাইব না। উনি দিলেও নিব না। কেন জানেন?
রিমার উত্তর দিল না। এই চতুর মেয়ের সাথে কথা বলার রুচি চলে গেছে তার। আমিরা নিজেই উত্তর দিল,
– কারণ রিফায়াতের সবটুকু আমার চাই। সবটুকু মানে ইচ অ্যান্ড এভরিথিং। রিফায়াতের বাড়িঘর, টাকাপয়সা, রিফায়াত নিজে, ওর মামা-মামি, মামাত ভাইবোন, মানে পুরো একটা ফ্যামিলি, ওর গাড়ি… আমার সব লাগবে। সবথেকে বেশি লাগবে উনাকে। কারণ আমার ধারণা, উনি আমার সঙ্গে থাকা মানেই এই পুরো ব্যাটেলিয়ন আমার হয়ে যাওয়া। সেখানে কয়েক লক্ষ টাকা আর একটা দুইটা ফ্ল্যাট অ্যাকসেপ্ট করা মানে নিজেরই লস।
বলেই হাসল আমিরা। রিফায়াত এগিয়ে আসছে। গাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল সে। এরপর খেয়াল করল, আমিরা নেই। মুহূর্তের জন্য তার মাথায় চক্কর দিয়েছিল। কী এক অদ্ভুত কারণে গতকাল থেকেই মনের মধ্যে আমিরাকে হারানোর ভয় গেড়ে বসেছে। একমুহূর্তও চোখের আড়াল করতে মন সায় দিচ্ছে না। পেছন ফিরে খানিক খোঁজাখুঁজি করতেই দেখল, রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছে সে। পাশে রিমা। কথা বলছে দুজন। রিফায়াত দ্রুত পা চালাল। আমিরার সাথে রিমার কীসের এত কথা? আমিরার কানে উলটাপালটা কিছু বলছে নাকি? বলতেও পারে। এই মেয়েকে দিয়ে বিশ্বাস নেই!
রিফায়াত কাছাকাছি চলে আসতেই আমিরা প্রসঙ্গ বদলে ফেলল,
– আপনার মনের মধ্যে যত সন্দেহ, সব আপনার কাছেই রাখেন প্লিজ। আমাকে দিতে আইসেন না কিছু। আমি সন্দেহবাতিক না। ঘটনা হচ্ছে, আমার পা ছিলে গেছে। এজন্য রিফায়াত বলল এখানেই দাঁড়াইতে। উনি গাড়ি নিয়ে আসবেন, যাতে বাকিটা রাস্তা হাঁটতে না হয়।
রিমা বলল,
– তোমার বিয়ে করা বর তো খালি হাতেই ফিরছে দেখি! গাড়ি তো কাঁধে তুলে আনেনি।
– না আনুক। গাড়ি কাঁধে না তুললেও আমাকে তুলতে পারবে। আপনার সমস্যা কোথায়, আমি ঠিক বুঝতেছি না।
রিফায়াত পুরোপুরি ইগনোর করল রিমাকে। থমথমে সুরে আমিরাকে জিজ্ঞেস করল,
– তুমি এখানে দাঁড়ায় আছ কেন?
– আপনাকে টেস্ট করতেছিলাম।
– কী টেস্ট?
– দেখলাম, আমাকে ফেলেই আপনি চলে যান নাকি আবার ফেরত আসেন আমাকে নিয়ে যেতে।
– মানে?
আমিরা এবার রিমার দিকে নির্দেশ করে বলল,
– আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সন্দেহ, আপনি আমাকে নকল বউ বানিয়ে উনার সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসেছেন। কাজ শেষ। তাই আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন। তাই ভাবলাম, এই চান্সে একটা পরীক্ষা করি আপনাকে। সত্যিকারের বউ হলে আপনি অবশ্যই ফিরে আসবেন আমাকে নিয়ে যাইতে।
রিফায়াত হাসল। রিমা ততক্ষণে নিজের পথ ধরেছে। রাগে রীতিমতো গা জ্বলছে তার। রিফায়াতের সাথের মেয়েটা হুল ফোটানো কথা বলায় ওস্তাদ!
ফিরতি পথে রিফায়াত আর আমিরা পাশাপাশি হাঁটছে। রিফায়াত এবার আমিরার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমিরার কবজিতে ব্যাথা লাগছে। তবু সে চুপ করে আছে। এই ধরে রাখাটা তার খুব ভালো লাগছে কেন জানি। রিফায়াতের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়েও মোটামুটি হিমশিম খেতে হচ্ছে। পায়ের চামড়া ছিলে দফারফা অবস্থা এখনই। সারাদিন কীভাবে কাটবে, কে জানে। আজ সারাদিনের কী পরিকল্পনা, রিফায়াত বলেনি। দু-একবার জিজ্ঞেস করেছিল। সদুত্তর পায়নি।
রিফায়াত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
– তুমি বুঝলা কীভাবে, রিমা আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড? আমি তো বলি নাই।
আমিরা মুখ টিপে হাসল। রিফায়াত আবার বলল,
– রিমা তোমাকে উলটা পালটা কিছু বলছে?
– উলটাপালটা কী?
– কতকিছুই তো বলতে পারে। ওকে বিশ্বাস করা যায় না। দেখা গেল, এমন কিছু বলল তোমাকে যেটা শুনে তুমি আর আমার সাথে থাকতে চাইলা না।
– এমনিতেও আপনার সাথে থাকার অপশন আমার হাতে নাই। আপনার মামির কাহিনি আমার বুঝা হয়ে গেছে। উনি কখনোই আমাকে অ্যাকসেপ্ট করবেন না।
– মামির কথা বাদ দাও। আমি তো তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করছি।
– শুধু আপনি অ্যাকসেপ্ট করলেই হবে?
– হবে না?
– মনে তো হয় না। আপনি যেরকম মামির বাধ্য ছেলে!
– তোমার কি তাই মনে হলো?
– হু। কালকে সারাদিন তো মামির ঘরেই দৌড়াদৌড়ি করলেন।
রিফায়াত হেসে ফেলল। ততক্ষণে গাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে ওরা। দুজনই গাড়িতে উঠে বসল। আমিরা গাড়িতে বসেই স্যান্ডেল খুলে ফেলল। তার পায়ের অবস্থা আসলেই করুণ। গোড়ালির দিকে বেল্টের ঘষায় চামড়া ছিলে গেছে। সামনেও দু’পাশের চামড়া লাল হয়ে আছে। রিফায়াত বলল,
– স্যান্ডেল খুললা কেন?
আমিরা দুই পা সিটের উপর তুলে বলল,
– পা ব্যাথা করতেছে খুব।
– তুমি তো হাঁটলাই না। শুধু গাড়ি থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে গেছ আর ফিরে আসছ। এতেই পা ব্যাথা হয়ে গেছে!
আমিরা কিছু বলল না। তার শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। সকালের নাশতাটা খুব মজার ছিল। আরেকটা পরোটা আর কলিজা খেতে ইচ্ছে করছিল। রিফায়াতকে বললে অর্ডার করত। কিন্তু বলেনি লজ্জ্বায়। তবু, যতখানি খাওয়া হয়েছে, একদমই খারাপ না। অনায়াসে আরেক দফা ঘুমের রাজ্যে রওনা দেয়া যাবে।
রিফায়াত নিচু সুরে বলল,
– তুমি আর আমি একসাথে থাকব, আমিরা। মামি যত যাই বলুক, আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। আমার নিজের দরকারেই তোমাকে লাগবে। আমি খুব করে চাই আমার নিজের একটা ফ্যামিলি হোক। তুমি আমাকে এই ফ্যামিলিটা দিতে পারবা না?
আমিরা তখনই উত্তর দিল না। তার ঝিমুনি চলে এসেছে। গাড়ি চলতে শুরু করলেই এই অবস্থা হয় তার। রিফায়াতের কথা কানে গেছে। কিন্তু স্পষ্ট কিছু শোনেনি। গাড়ি অবশ্য এখন থেমে আছে বিখ্যাত যানজটে। আমিরার মুখের উপর রোদ এসে পড়েছে। রিফায়াত গাড়ির জানালা তুলে দিল। ফ্রন্ট আর ব্যাক দুইপাশেই চারটা জানালায় লাইট টিন্টেড গ্লাস লাগানো। তাই রোদটা সরাসরি আমিরার উপর এসে পড়বে না। এসিও অন করল।
আমিরা বিড়বিড় করে বলল,
– আমি বাসায় যাব। আমার খুব মন টানতেছে বাসায় যাওয়ার জন্য।
রিফায়াত আমিরাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। গতকাল আমিরা বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। এরপর আর ওই বাড়ির সাথে যোগাযোগ হয়নি। আমিরা তার বোনের সাথে ফোন করে কথা বললেও সামনাসামনি হওয়া দরকার। নয়তো পুলিশ পর্যন্ত গড়াতে পারে বিষয়টা। কিন্তু আমিরার কথা শুনে সে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলল। মোবাইল ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে আমিনার নম্বরটা বের করে মেসেজ পাঠাল,
– আমি রিফায়াত। গত পরশু আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। আমিরা এখন আমার সঙ্গে আছে। গতকাল আমিরা বাসা থেকে বের হয়েই আমার কাছে চলে এসেছে। এরপর আমরা বিয়েও করেছি। আমিরা আপনাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। তাই আমি জানিয়ে দিলাম। ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকবেন না প্লিজ। আমি ওকে আর কখনোই ফিরতে দিব না।
===================================