তোমার জন্য এক পৃথিবী পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0
482

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩৯। (শেষ পর্ব)
আমিরার ঘুম ভাঙ্গল বিকেল চারটায়। যথারীতি মাথার উপর অপরিচিত সিলিং। সেখানে ভীষণ সুন্দর কারুকাজ! পুরো সিলিংটাই আলপনা করা যেন। ঠিক মধ্যিখানে ফ্যান, যেরকম রিফায়াতের ঘরে দেখেছিল। কিন্তু এটা রিফায়াতের ঘর না। ওই ঘরের সিলিংয়ে এত সুন্দর কারুকাজ ছিল না। আমিরার মনে পড়ল, সে গাড়িতে ছিল। নাশতা খাওয়ার পর পরই ঘুমে ঢুলে পড়ছিল সে। গাড়িতে চড়ার পর আর চোখ মেলে রাখতে পারেনি। এখন কোথায় সে? রিফায়াত কোথায়?
আমিরা ধড়মড়িয়ে উঠল। এই ঘরটায় একটা মাত্র আলমারি, আর বিছানা। বিছানার পাশে এয়ারকুলার টাইপের কিছু দেখা যাচ্ছে। নিচে চাকা বসানো। ফ্যানের পাশাপাশি ওটাও চলছে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। এসির মতো অত ঠান্ডা না। কিন্তু আমিরার শীত করছে। এই বিছানায় সে শুয়ে থাকলেও গায়ের উপর কোনো কাঁথা নেই। শুধু তার মাথার ওড়নাটা লম্বা করে শরীরের উপর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। বিছানায় চাদর-বালিশ কিছুই নেই। এতক্ষণ মাথার নিচে রাখা ছিল রিফায়াতের ব্লেজার, যেটা পরে সকালে বের হয়েছিল বাসা থেকে। দলামোচড় করে বালিশ বানানো। এই ঘরের জানালায়ও পর্দা নেই। ঘরের ভেতর ঝলমলে আলো। কয়টা বাজে এখন?
আমিরা ঘড়ির খোঁজে চারপাশে তাকাল। কোথাও ঘড়ি নেই। এই ঘরের দেয়ালগুলো একদম পরিস্কার। আমিরা প্রথমে ওয়াশরুমে গেল। রিফায়াতের ঘরের মতো এই ঘরের সাথেও ওয়াশরুম আছে। তবে খুব একটা বড় না। হাতমুখ ধুয়ে বের হবার পর সে পা বাড়াল বাইরের দিকে। ঘরের দরজা হালকা ভেজানো। সেটা খুলতেই দেখা গেল বড়সড় ডাইনিং রুম। আশপাশের দেয়ালে আরও তিনটা দরজা দেখা যাচ্ছে। ওগুলো বোধহয় শোবার ঘর। এটা কার বাসা? এখানে সে এলো কীভাবে? যতদূর মনে পড়ে, সে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে কি রিফায়াত নিয়ে এসেছে? ঘুমটা এর মধ্যে একবারও ভাঙ্গেনি।
বাসার ভেতর আবছা কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমিরা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চারপাশ দেখছিল। বুকের মধ্যে ভয় জেঁকে বসছিল অজানা কোনো আশঙ্কায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে আচমকা কেউ আমিরাকে জাপটে ধরল। আমিরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল। ঝট করে পেছন ফিরতেই তার চিৎকার থামল মাঝপথে। রিফায়াত! যেন ধড়ে প্রাণ ফিরল আমিরার। সে রিফায়াতকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
রিফায়াত অবাক হয়েছে। আমিরা এভাবে চমকে যাবে, ভাবেনি। নয়তো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরত না। আমিরাকে দুই হাতে আগলে রেখে নিচু সুরে বলল,
– ভয় পাইছ?
আমিরা উত্তর দিল না। তবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেনি। তার বুকের ভেতর তখনও ধুকপুক করছে। শরীর কাঁপছে। রিফায়াত বলল,
– স্যরি। বুঝতে পারি নাই তুমি ভয় পাবা। আমি তোমাকে ভয় দেখাইতে চাই নাই।
আমিরা আবার মাথা নাড়ল। রিফায়াতকে জড়িয়ে ধরতে অস্বস্তি হচ্ছে। তবু ধরে রেখেছে। কেন, সে জানে না। হয়তো মুখ লুকোনোর অজুহাত, আবার হতে পারে ভয়টা এখনো সরেনি মন থেকে। রিফায়াত আবার বলল,
– ঘুম হইছে ঠিকঠাক?
– হু।
– যেই লম্বা ঘুম দিয়েছ তুমি! উলটো আমিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। কী হয়েছে বলো তো? সারাদিন সারারাত শুধু ঘুমুচ্ছ! এনি প্রবলেম?
– আমি কাল রাতে ঘুমাই নাই। বসেছিলাম চুপচাপ।
– কেন?
– ভয় লাগতেছিল খুব। আমার আসলে একা ঘুমিয়ে অভ্যাস নাই। সবসময় বড়াপা আর আনিসার সাথে ঘুমাই। কালকে ঘুম আসতেছিল না। তার উপর আপনি এসি চালিয়ে রেখে গেছেন। ঠান্ডায় আমার নাক বন্ধ হয়ে গেছে। কানও মনে হচ্ছে বন্ধ। মাথার মধ্যে শো শো শব্দ করতেছিল। ভোরের দিকে বিছানায় শুয়েছি। তখন ঘুম আসছে। কিন্তু আপনি তো ঘুমাইতে দিলেনই না! গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করা লাগবে, এজন্য আমাকে ঘুম থেকে উঠাইলেন।
রিফায়াত নিঃশব্দে হাসল। তবে আর কথা বাড়াল না। আমিরাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণে তার মন থেকে ভয় দূর হয়েছে। আমিরাকে লম্বা সময় ধরে ঘুমুতে দেখে মনের মধ্যে আতঙ্ক জড়ো হচ্ছিল। ভেবে রেখেছিল, ঘুম ভাঙ্গলেই আমিরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। পরীক্ষা করে দেখা দরকার, কোনোভাবে অসুখ তার মধ্যে গেড়ে আছে কি না।
খানিক পর আমিরা নিজেকে সামলে নিল। রিফায়াতকে ছেঁড়ে একটু দূরে সরে গেল। মাথা নিচু করে রেখেছে। ওভাবেই বলল,
– এটা কার বাসা?
রিফায়াত এগিয়ে এলো কয়েক কদম। আমিরার সামনে মাথা ঝুঁকে বলল,
– তোমার।
আমিরা এবার মুখ তুলল। চোখে অবাক দৃষ্টি। মাথা তুলতেই চোখাচোখি হলো রিফায়াতের সাথে। রিফায়াত হাসছে। আমিরা বলল,
– আমার?
– হু, তোমার। এখন থেকে তুমি এই বাসায় থাকবা। মনের মতো করে বাসাটাকে সাজাবা, যেভাবে খুশি। যেমন ইচ্ছে, সেভাবেই থাকবা।
আমিরার মনে মেঘ জমল। তবে কি রিফায়াত সত্যিই ডিভোর্স দিবে ওকে? ডিভোর্স হবে, এটা মনের মধ্যে ঘুটঘুট করছিল গতকাল থেকেই। রিফায়াতের মামির রিএকশন দেখার পর আর বুয়ার কাছে রিফায়াত সম্পর্ক অল্পসল্প জানার পর ওর মনে হয়েছে, মামির কথার বাইরে রিফায়াত যাবে না। মনের মধ্যে খারাপ লাগা জন্ম নিলেও সয়ে গেছিল তখনই। জানেই তো, বিয়েটা টিকবে না! রিফায়াতের সাথে ওকে কোনোভাবেই মানায় না। না চেহারা, না উচ্চতা, পারিবারিক স্ট্যাটাস। কোনোদিক থেকেই মিল হবার জো নেই। পরশু বিকেলে আমিরার মাথায় ঘুণাক্ষরেও আসেনি রিফায়াত কেমন পরিবারের ছেলে, তার আর্থিক অবস্থা কতখানি ভালোর দিকে। রিফায়াতের আচরণে এগুলো বুঝা যায় না। সে গাড়ি ড্রাইভ করতেও জানে, আবার রিকশায় চড়ে পুরান ঢাকায় যাওয়াটাও তার জন্য সহজ। হয়তো যে কোনো পরিবেশে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা আছে তার। গতকাল যতই দেখছিল রিফায়াতের ঘরবাড়ি, চারপাশের চাকচিক্যময় জীবন, অবাক হচ্ছিল। ততই মনের মধ্যে ঘোট পাকাচ্ছিল অবিশ্বাস, রিফায়াত কখনোই ওর সাথে আজীবন থাকবে না! সময়ের সাথে এই অনুভূতি জোরদার হয়েছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে রিফায়াতের রহস্যময় কিছু আচরণ ওকে দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছিল। এখন পরিস্কার হয়ে গেল সবটা। রিফায়াত ওর আবদার মেনে নিয়েছে। ওর সাথে থাকবে না বলেই আলাদা বাসা ঠিক করে দিল। হয়তো খুব দ্রুত টাকাও দিয়ে দেবে।
কেন? জীবনে কি টাকাই সব? আমিরা আপনমনে হিসেব করতে লাগল। টাকা দিয়ে সে পড়াশুনা করতে পারবে, ভালো থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। যখন ইচ্ছে, যা ইচ্ছে কেনাকাটা করতে পারবে। ওকে আর সস্তা স্যান্ডেল পরে চলাফেরা করতে হবে না। চার-পাঁচটা জামা পরে বছর পার করতে হবে না। অনেকগুলো জামা কিনবে সে। অনেক; যেন একেকদিন একেকটা পরতে পারে। মাসের ত্রিশ দিনে অন্তত ত্রিশটা জামা সে পরতে পারে। কলেজের ড্রেসও থাকবে দুই-তিন সেট। একটা ময়লা হলে আরেকটা অনায়াসে পরা যাবে। একটা ওয়াশিং মেশিন কিনবে, যাতে কাপড় ধুতে কোনো কষ্ট না হয়। ক্ষারযুক্ত সাবানের স্পর্শে যেন হাত খরখরে না হয়। বডি লোশনের পাশাপাশি হাত কোমল রাখার জন্য হ্যান্ড ক্রিমও কিনবে। কোঁকড়া চুল সেট করার জন্য যা যা লাগে, হেয়ার জেল, অথবা হেয়ার স্প্রে কিনবে। প্রতি মাসে দুইবার পারলারেও যাবে নাহয়। মন চাইলেই কোনো একটা রেস্টুরেন্টে চলে যাবে চাইনিজ খেতে। বড়াপার কাছে আর আবদার করতে হবে না। মায়ের বকা শুনতে হবে না। এত বড় বাসায় সে একাই রাজত্ব করবে। সম্পূর্ণ একা! এই জীবনটাই সে মনে মনে কামনা করছিল এতকাল। বহুদিন গেছে আপনমনে বিড়বিড় করেছে, যদি কোনো চমক আসত জীবনে। যদি চারপাশের ভোল আচমকা বদলে যেত। এই পরাশ্রয়ী সংগ্রামী জীবন যদি কোনোদিন বিলাসিতায় রূপ নিত। কতই না ভালো হতো!
মনের কথা মনেই রয়ে যায়নি। আল্লাহ পূরণ করেছেন। চমক ঠিকই এসেছে জীবনে। এই চমকের নাম রিফায়াত। কিন্তু সে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসবে না মনের মধ্যে। দুদিন পরই উবে যাবে। আমিরার জীবন চাকচিক্যময় করে দিয়ে আবার সে চলে যাবে। এই মনোকষ্ট আমিরার মনকে ভারাক্রান্ত করে দিল নিমেষেই। এতকাল যে বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন তার চোখে খেলা করত, আজ তা ম্লান হয়ে গেছে। মন বলছে, এই জীবনে শুধু রিফায়াত হলেই চলবে। টাকাপয়সা আর সয়সম্পত্তি লাগবে না। জীবনে চলতে গেলে টাকা লাগে। কিন্তু সেই টাকা খেয়েপরে কোনোরকমে বাঁচতে পারার জন্য যথেষ্ট হলেই আর কিছু লাগে না।
আমিরার মন খারাপ হচ্ছে খুব। কান্না পাচ্ছে। রিফায়াতকে পাবে না বলে খুব বেশি খারাপ লাগছে, বিষয়টা ওরকম না। মুলত বাবা-মা আর বোনদের জন্যই মন পুড়তে শুরু করেছে। রিফায়াত তো শুরু থেকেই দূরের মানুষ ছিল। এখনো তাই। তাকে আপন করে পাওয়ার লোভটুকু সংবরণ করাই ভালো। বিয়ে পরবর্তী জীবনে অশান্তি বাসা বাঁধতে শুরু করলে এই ভালোলাগা-ভালোবাসা ফিকে হতে সময় লাগবে না। তার চেয়ে রিফায়াত দূরের মানুষ হয়েই থাকুক!
আমিরা ফিসফিস করে বলল,
– আমি এখানে থাকব না। আলাদা বাসা আমার চাই না।
রিফায়াত কিছু একটা ভাবছিল। আমিরা ঘুমুচ্ছে, এই ফাঁকে সে বাসার জন্য কিছু ফার্নিচার কিনতে গিয়েছিল। বাসার কাছেই শোরুম একটা আছে। ওখান থেকে অর্ডার করে এসেছে। বিকেলের মধ্যে কিছু ফার্নিচার চলে আসবে। বাকিটা আসবে আগামীকাল। এছাড়াও সংসারের কিছু কেনাকাটা করতে হবে। ভাড়াটিয়া চলে যাবার পর দারোয়ান এসে এই বাসাটা ধুয়েমুছে পরিস্কার করে রেখে গেছে। এরপর ওভাবেই পড়ে আছে। এখানে থাকার জন্য যা কিছু দরকার, আস্তেধীরে সংসারের জিনিসপত্র কিনতেই হবে। তবে আজ কিছু জিনিস না কিনলেই নয়! যেমন বিছানার চাদর, বালিশ, মশারি, রান্নাঘরের জন্য অল্পসল্প বাসন-পেয়ালা ইত্যাদি।
রিফায়াত ভাবছিল, এই কেনাকাটার জন্য এখনই আমিরাকে সঙ্গে নিয়ে বের হবে কি না। আমিরার পরনের জামাটা পর্যন্ত নেই। গতকাল থেকে কলেজের ইউনিফর্ম পরে ঘুরছে। আর এখন পায়ের স্যান্ডেলও নেই। গাড়ি থেকে ঘুমন্ত আমিরাকে কোলে নেয়ার সময়ই লক্ষ করেছিল পায়ের করুণ অবস্থা। তখনই কী ভেবে স্যান্ডেলজোড়া ফেলে দিয়েছে। এখন তাহলে কী পরে বের হবে বাসা থেকে? তাছাড়া এখন বের হলেও বিকেলের আগেই ফিরতে হবে। নয়তো ফার্নিচার রিসিভ করা যাবে না। তারপর আবার আরেক ঝামেলা আছে।
আমিনার মোবাইলে মেসেজ পাঠানোর খানিক পরই কল এসেছিল। রিফায়াত রিসিভ করেছে। মেসেজে যা লিখেছে, সেগুলোই আবার আমিনাকে বলতে হয়েছে। আমিনা খুব কাঁদছিল। গতকাল থেকেই তার কান্নাকাটি চলছে। সারারাত ঘুমোয়নি। আমিরা পুরো একটা রাত ও এক দিন বাসায় নেই, বিষয়টা তার ও তার পরিবারের দৃষ্টিতে খুবই ভয়ঙ্কর কিছু। আমিরা গতকাল রাতে কল না করলে এতক্ষণে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াত। এখানে-সেখানে বোনকে খোঁজাখুঁজি শুরু হতো। শুধুমাত্র আমিরা নিজ মুখে বলেছে, ‘ভালো আছি’, এটুকু তাকে এখন অবধি ধরে রেখেছে নিজের ভেতর।
গতকাল বাসার ভেতর তুলকালাম হয়েছে বলা চলে। বিকেল পর্যন্ত আমিরার খোঁজ নেয়নি কেউ। আমিনা বাসায় ফিরে আমিরাকে দেখেনি। ধরে নিয়েছে, ব্যাচে পড়তে গেছে। ঘন্টাখানেক পর চলে আসবে। নাসিমা বানুর হুঁশ নেই। শফিক আসবে বলে রান্নার আয়োজনে উঠেপড়ে লেগেছেন আবার। আজ তার বোনের জামাইও আসবে। ব্যস্ত মানুষ তিনি। বোনও ব্যস্ত থাকে অনেক। বারবার বিয়ের আলোচনায় বসার সময় তাদের হয়ে উঠবে না। এজন্য একবারেই দেখাদেখি আর বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা যেন হয়ে যায়, তাই তারাও আসবেন। শাহীনা বানু প্রায়ই আসেন বোনের বাসায়। কিন্তু তার বর কখনো আসেননি। এবার প্রথম আসবেন। এজন্য আনিসাকে সকাল থেকে ঘরদোর পরিস্কারের কাজে লাগিয়েছেন। আমিনাকেও আজ স্কুলে যেতে নিষেধ করবেন, ভেবেছিলেন। পরে আর কিছু বলেননি। আমিনা এমনিতেও ঘরের কাজে খুব একটা পারদর্শী না। কাজ জানলেও করতে চায় না। রাজুর সংসারের ঘানি টানার পর সাংসারিক কাজকর্মে তার আগ্রহ কমে গেছে। সে এখন টাকা কামানোর প্রতি মন দিয়েছে। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি টিউশনি করাচ্ছে কয়েকটা। খালার সাথে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিচ্ছে। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সাথে কাজ শিখছে। তার ইচ্ছে, ভবিষ্যতে তার নিজের একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থাকবে।
এত হৈ-হট্টগোলের মধ্যে আমিরার কথা কারও খেয়াল হয়নি। আমিরা ছোটবেলা থেকেই এত বেশি লক্ষী আর শান্ত ধরনের মেয়ে, তাকে নিয়ে কোনোরকম টেনশন করতে হয় না। সময়মতো কলেজে যায় সে। ছুটি হবার সাথে সাথেই ফিরে আসে। পড়াশুনা করে মন দিয়ে। আমিনার টিনএজ বয়সে নাসিমা বানু যেরকম হ্যাপা সামলেছেন, আমিরার বেলায় তা হয়নি। এখানে অবশ্য চেহারা বড় একটা কারণ। আমিনার মতো আমিরার অত সৌন্দর্য নেই, যা দেখে পাড়ার ছেলে-ছোকরা দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাবে।
যখন সন্ধ্যা গড়াল, শাহীনা বানু কল করে জানালেন তিনি রওনা হয়েছেন গাড়িতে। খুব বেশি হলে ঘন্টাখানেক লাগবে। শফিককেও সঙ্গে নিয়ে আসছেন। অফিসের পর ওকে আর বাসায় ফিরতে দেননি আমিরার খালু। আগেই বলে রেখেছিলেন, অফিসের পর উনি ওর সাথে আমিরাদের বাসায় যাবেন। তাই একসাথেই আসা হচ্ছে। শাহীনা বানু বললেন, আমিরাকে যেন শাড়ি পরানো হয়। অল্পসল্প গয়নাগাটিও পরে থাকবে। চুলগুলো পারলার থেকে স্ট্রেইট করে আনলে ভালো হতো। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। তাই আমিনা যেন গতকালের মতোই চুল ঠিক করে দেয়। আর উঁচু পনিটেইল না বেঁধে খোপা করুক। ঠিক তখন খোঁজ পড়ল আমিরার। নাসিমা বানু ভেবেছিলেন, মেয়েরা সবাই ঘরে আছে। কিন্তু দেখা গেল আমিরা নেই। বাকি দুই মেয়েকে জিজ্ঞেস করার পর আসল ঘটনা বের হলো, আমিরা সেই সকালে বের হয়েছে। এরপর আর ফেরেনি। হৈচৈ মুলত তখন থেকেই শুরু।
নাসিমা বানু মোটামুটি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমিনার মাথায়ও ঢুকছিল না কী করবে। এদিকে সময়ের আগেই শাহীনা বানু হাজির। তাকে ভেতরের ঘরে ডেকে বিষয়টা খুলে বলা হলো। তিনি শুরুতেই ক্ষেপে গেলেন। গতকাল যে ছেলেটা শফিকের নাম ভাঙ্গিয়ে এসেছিল, অর্থাৎ রিফায়াতের প্রসঙ্গ তুললেন। তার ধারণা, আমিরা পালিয়েছে। রিফায়াতের খোঁজ নিলেই আমিরাকে পাওয়া যাবে। বলাই বাহুল্য, রিফায়াতের খোঁজ কেউ জানে না। রিফায়াত তার ফোন নম্বর আমিরাকে দিয়ে গেছিল। আনিসা সেটা শুনেছে আড়াল থেকে। কিন্তু রাতে আমিরা সরাসরি অস্বীকার করল। মিথ্যে করে বলেছে,
– নাম্বার দিবে বলছিল। হয়তো যাওয়ার আগে দিয়ে নাম্বার দিত। কিন্তু পরে উনার খেয়াল হয় নাই। আর আমারও মনে ছিল না।
আমিনা তখন বোনের কথা মোটামুটি বিশ্বাস করলেও তার মনে ঘুটঘুট করছিল। মন বলছিল, আমিরাকে অবশ্যই ফোন নাম্বার দিয়ে গেছে রিফায়াত। এখন সেই নাম্বার কারও কাছে নেই। সবটুকু শুনে বড় খালা খুব হম্বিতম্বি করলেন। প্রথমে চাপা সুরে গর্জন করলেও পরে তা বসার ঘর পর্যন্ত ছড়াল। শফিক কিংবা আমিরার বড় খালু, সবারই ঘটনা জানাজানি হলো। শাহীনা বানু জোর দিয়ে বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন, রিফায়াতের সাথে আমিরার প্রেম চলছিল গোপনে। ওই ছেলে ভুল ঠিকানায় আসেনি। নয়তো আজ আমিরা পালাবে কেন? এখন কথা হচ্ছে, রিফায়াতের সাথে পুর্বপরিচয় থাকা মানে আমিরার বোনরা কিছু না কিছু অবশ্যই জানে। যেটা ওই মুহূর্তে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। কিন্তু ওই জানাটুকু দিয়েই আমিরার খোঁজ পাওয়া যাবে।
আমিনা আর আনিসা এরকম কিছুই মনে করতে পারল না। নাসিমা বানুও বললেন, আমিরা ওমন ধাতের মেয়েই না। প্রেম করলেও সেটা গোপন রাখার কারসাজি সে জানে না। পুর্বপরিচয় বা সম্পর্ক থাকলে সে কোনোভাবেই লুকোতে পারত না। সবথেকে বড় কথা, আমিরা পড়াশুনায় ভালো হলেও বাস্তব বুদ্ধি তার মাথায় কম। বুদ্ধির মারপ্যাঁচ সে একটু কমই বুঝে। তার পক্ষে প্রেমিককে পাত্র সাজিয়ে বাসায় আনাটা সম্ভব না। কিন্তু শাহীনা বানু নিজ মন্তব্যে অনড়। অনেক তুলকালামের পর তিনি চলে গেলেন। শফিকও নিজ ঠিকানায় ফিরল। ঠিক তখন আমিরার ফোনকল এসেছে। নাসিমা বানু পারলে ফোনের ভেতর দিয়ে ওর গলা চিপে ধরেন, এমন অবস্থা। যা নয়, তাই বলেছেন মেয়েকে। ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে আমিরা খুব বেশিক্ষণ কথা বলল না। চট করে কল কেটে দিল। আমিনাও কলব্যাক করেনি। তার ততক্ষণে উপলব্ধি হয়েছে কিছু বিষয়, যেটা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
এরপর আমিনা কোমরে আঁচল বেঁধে ঝগড়া করেছে নাসিমা বানুর সাথে। বড় খালা ওদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দেখভাল করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন। কিন্তু তার কোনোটাই নিঃস্বার্থ না। খালার সাথে কাজ করতে গিয়ে আমিনার চোখ খুলেছে আগেই। বুঝতে পেরেছিল, খালা কেন ওদের সংসার টানেন। আমিনা চাকরি পাওয়ার পরও কেন আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তবু সে না বুঝার ভান করেছিল। কিন্তু এখন বিষয়টা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমিরা বিয়ে করতে চাচ্ছে না এখন, জানার পরও জোর করে পাত্রপক্ষকে বাসায় নিয়ে আসা, বিয়ের জন্য জোরাজুরি করাটা বড় খালার এখতিয়ারে নেই। আমিরা পড়াশুনা করতে চায়। সে ভালো ছাত্রী। ক্লাসে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে তার নাম সবসময় থাকে। এরপরেও তাকে কেন ধরেবেঁধে বিয়ে দিতে হবে? কেন বিয়ে দেয়ার পর মেয়ের জামাইকে এই সংসারের দায় নিজ কাঁধে তুলে নিতে হবে? পরাশ্রয় থেকে কি তাহবে মুক্তি পাওয়া হলো? বরং কাঁধটাই বদল হলো। তার চেয়ে আমিরা পড়াশুনা করে নিজ পায়ের মাটি শক্ত করতে পারলে বাবা-মায়ের মুখে ভাত তুলে দেবার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারবে। সেটাই কি সবথেকে বেশি ভালো হয় না? শফিক-রাজুরা আজ নরম সুরে শ্বশুরবাড়ির খেদমত করতে রাজি হলেও পরবর্তীকালে তাদের মন ঘুরে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
নাসিমা বানু মেয়ের সাথে তর্কে জিততে পারেননি। তাকে চুপ হতে হয়েছে একসময়। কারণ আমিনার এই বক্তব্যকে আজগর আলী আর আনিসাও সমর্থন করল। তারা কেউ আজীবন বড় খালার ছত্রছায়ায় বাঁচতে চায় না। হাত পেতে অন্যের থেকে টাকা নিতে চায় না। নাসিমা বানু এতকাল বোনকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। যে কারণে আমিরা বাসা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বিষয়টা এখানেও থেমে গেলে চলত। কিন্তু শাহীনা বানু এখন আমিরার চরিত্রের উপর আঁচ লাগাতে চাইছেন। জোর করেই প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, আমিরার কোনো ছেলের সাথে প্রেম চলছে।
আমিনা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বোনকে এখন থেকে সে নিজে সমর্থন দেবে। বিয়ের ভুত খালার মাথা থেকে সরানোর জন্য সে নিজে লড়াই করবে। অল্প বয়সে সেও বিয়ের মালা গলায় ঝুলিয়েছিল। পড়াশুনা বাদ দিয়ে সংসারের ঘানি টেনেছে মন দিয়ে। তাতে লাভ হয়েছে কী? আজ এসএসসি পাশ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে হয়। এই যোগ্যতা নিয়ে মানসম্মত চাকুরি খুঁজতে গেলে সবাই তামাশার দৃষ্টিতে তাকায়। আমিরার ক্ষেত্রেও কি একই ভুলটা হচ্ছে না? পার্থক্য এখানেই, ভুল পথটা আমিনা নিজে বেঁছে নিয়েছিল। আর আমিরাকে জোরজবরদস্তি ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
রিফায়াতকে সবটাই জানিয়েছে আমিনা। আকুল সুরে আমিরাকে ফেরত চেয়েছে। এই বিয়েটা এক প্রকার ভুল। আমিরার জীবনে এই ভুলটা যেন স্থায়ী না হয়, তার অনুরোধ করেছে। বলা বাহুল্য, রিফায়াত সেই অনুরোধ রাখেনি। আমিরাকে সে কোনো অবস্থাতেই ফেরত দিবে না। বিয়েটা হয়েই গেছে। হোক ভুল কী শুদ্ধ। দরকার পড়লে আরও একবার পরিবারের সবার উপস্থিতিতে বিয়ে হবে। কিন্তু বিচ্ছেদ কোনোভাবেই পাত্তা পাবে না। এই বিয়ের কারণে আমিরার বাসায় যেমন তুলকালাম হয়েছে, তেমনি রিফায়াতের পরিবারেও কম হুলুস্থুল হয়নি। রিফায়াত চেষ্টা করেছে, পুরো বিষয়টা আমিনাকে বুঝানোর।
আপাতত সে বুঝ মেনেছে। আবার মাথাচাড়া দিবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাকে আরও একদফা ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য আমিরার সামনে হাজির করা প্রয়োজন। আমিরা নিজের মুখে বলুক, সে কী চায়। আমিনাকে বাসার ঠিকানা মেসেজ করেছে। আমিনা আসবে সন্ধ্যার পর। বোনের মুখোমুখি হবে। বোন কার কাছে থাকবে এখন থেকে, সেটাও তার নিজের চোখে দেখাটা জরুরি।
আমিরাকে এই কথাটা এখনই জানাতে চায় না রিফায়াত। আমিরার জন্য এটা সারপ্রাইজ থাকুক। সকাল থেকে অস্থির হয়ে আছে সে। বারবার বাবা-মা আর বোনদের কথা বলছে। রিফায়াত বুঝতে পারে ওর মনের ভেতরকার তোলপাড়। পরিবার হারানোর কষ্টটা তার জীবনে অনেক পুরনো। মুলত সেজন্যই আমিনার সাথে কথা বলেছে, আমিনাকে আমিরার নিজের বাসায় দাওয়াত করেছে।
রিফায়াত বলল,
– কেন? এখানে থাকলে কী সমস্যা? এটাই তো তোমার বাসা।
আমিরা প্রবল বেগে মাথা নাড়ল দুপাশে। কান্নাগুলো হামলে পড়ছে প্রায়। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। উপচে পড়ছে নোনাপানি। সেই অবস্থাতেই বলল,
– আমি চাই না আলাদা বাসা। টাকাপয়সাও লাগবে না। আমি কিচ্ছু চাই না। আপনি প্লিজ আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসেন।
– আমাকেও চাও না? তুমি ভালোবাস না আমাকে?
কান্নার তোড়ে দুপাশে মাথা নাড়তে গিয়েও থমকে গেল আমিরা। বলল,
– এইসব কথা আর কখনো বলবেন না আমাকে।
– কেন? বললে কী হবে?
– আমি শুনতে চাই না।
– কেন চাও না?
– আমার কষ্ট হয় খুব।
– কীসের কষ্ট? তোমার লাইফে এখন থেকে সবকিছুই থাকবে! আর কোনো কষ্ট নাই, আমিরা।
– বুঝেন না কেন, আপনি না থাকলে এইসব বাসা টাকা এতকিছু দিয়ে আমি কী করব?
রিফায়াতের মুখে আবারও নিঃশব্দ হাসি। গতকাল থেকে এই পর্যন্ত বারবার হাসছে সে। বিভিন্ন কারণে। কিন্তু হাসির মুল উৎস আমিরা। তার এত বছরের জীবনে ঘন-ঘন হাসির কারণ হয়ে কেউ আসেনি। আমিরা যা বলে, তাতেই মন হাসে। মনে নতুন করে আনন্দ জাগে। সে আমিরাকে জড়িয়ে ধরল। খুব কাছে টেনে নিয়ে বলল,
– আমি থাকব না কেন? তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলেও আমি কোথাও যাব না। আমার জায়গা ঠিক এইখানে, তোমার বুকের মধ্যে। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি এই কথাটা বলব না। এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। দুইদিনের পরিচয়ে খুব বেশি ভালোবাসা তৈরি হয় না। কিন্তু আমি ভালোবাসি তোমাকে।
– সত্যি?
– সত্যি।
– আমার বিশ্বাস হয় না।
– কয়বার সত্যি বললে তুমি বিশ্বাস করবা, এটা আগে বলো। এরপর আমি গুণে গুণে ততবার ভালোবাসি বলব।
আমিরা হেসে ফেলল। তার চোখের পানিরাও হাসছে। রিফায়াত এই হাসিতে ডুব দিয়েছিল গতকালই। আজ মনে হলো অতর গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। এক পৃথিবী সমান সেই গহীন। সেখান থেকে উঠে আসতে বাকিটা জীবন অনায়াসে পার হয়ে যাবে।
(সমাপ্ত)