তোমার জন্য এক পৃথিবী পর্ব-৭+৮

0
302

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৭।
ছেলেপক্ষ না বলে একজনই বলা ভালো। পাত্র একাই এসেছে। অবশ্য সঙ্গে আর কে আসবে? আগেই জানা আছে, পাত্রের তিন কুলে কেউ নেই। এতিম ছেলে। মামার বাসায় মানুষ হয়েছে। যদিও শাহিনা বানু বলেছিলেন পাত্রের সাথে তার মামা-মামি আসবে। আজ তারও আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি জরুরি কাজে আটকে গেছেন। তাই আসতে পারবেন না। তবে কথা দিয়েছেন, যতই রাত হোক জরুরি কাজ শেষ করে ফেরার পথে আমিরাদের বাসায় একবার ঢুঁ মারবেন। পাত্রকে সরাসরি বসার ঘরে নিয়ে আসা হলো। তাকে দেখতে খানিক অপ্রতিভ লাগছে। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। যেন আশা করেনি বাড়িঘরের এমন অবস্থা হবে। তার সামনে হুইল চেয়ারে বসা আজগর আলী, আমিরার বাবা। পাত্রের এদিক-ওদিক তাকানো দেখে তিনি বিব্রত বোধ করছেন। কাচুমাচু সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
– আসতে কি কষ্ট হয়েছে বাবা? বাসা ঠিকঠাক চিনে আসতে পারছ তো?
প্রশ্নটা করেই তার মনে হলো, এটা জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি। বাসা ঠিকঠাক চিনে আসতে পেরেছে বলেই তো ছেলে এখন বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। প্রথম প্রশ্ন পর্যন্তই থেমে গেলে ভালো হতো। ছেলেটা না জানি কী ভাববে! প্রথম দেখার পর্বটা সুন্দর হওয়া জরুরি। হোক সে পাত্রী বা তার পরিবারের কেউ। ছেলেটা মনে মনে নিশ্চিত ভাবছে, পাত্রীর বাবা এত ক্যাবলা। পাত্রী না জানি কেমন! যদিও শফিকের চোখমুখে সেরকম কোনো ইঙ্গিত দেখা গেল না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসিমুখে বলল,
– না আংকেল কোনো সমস্যা হয়নি। আপনাদের বাসার লোকেশন তো একদম ইজি! ফুপু একবার বলাতেই চিনে ফেলেছি।
এই ছেলের কি ফুপুও আছে? হবে হয়তো। মামার কাছে মানুষ হলেই যে বাবার দিকে কেউ থাকবে না, এটা ভাবা বোকামি। হয়তো শফিকের বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ওর চাচা ফুপুরা ওর দায়িত্ব নিতে চায়নি। অথবা তারা আর্থিকভাবে অত স্বচ্ছল ছিলও না। কিন্তু বিয়ের মতো জরুরি একটা বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণ করাটা জরুরি। সে যাকগে। আজগর আলী তাল মিলিয়ে বললেন,
– এইটা ঠিক, আমাদের বাসার লোকেশন একবার বললেই মানুষ চিনে ফেলে। তা বাবা, তুমি কি একলাই আসছ? আমি শুনছিলাম, তোমার সাথে তোমার মামা-মামিও আসবেন।
– আসলে আংকেল, মামা-মামি তো আসতে চেয়েছিলেন। ফুপুরও খুব ইচ্ছে ছিল আসার কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। মানে আমার বুবু হুট করে অসুস্থ হয়ে গেছেন।
– তাই নাকি? কী হয়েছে?
– মানে সিরিয়াস কিছু না। বুবুর তো হাই প্রেশার। ওটাই একটু বেড়েছে।
– ওহ, আচ্ছা। আমি জানতাম, তোমার ফ্যামিলিতে কেউ নাই। মানে ভাইবোন, বাবা-মা।
– হ্যাঁ নেই। অনেক আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে সবাই মারা গেছে। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম।
– ওহ। তুমি আর তোমার বুবুর হায়াত ছিল। তাই জন্য তোমাদের কিছু হয় নাই। আল্লাহর দরবারে অনেক শুকরিয়া। তুমি মন খারাপ কইরো না, বাবা। আমি তো আছি। এইখানে তুমি বাবা-মা বোন সবাইকে পাইবা।
– জি, মানে হ্যাঁ।
শফিক লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। আজগর আলী বললেন,
– তোমার বুবু মানে বোনের কি বিয়েশাদি হইছে? মানে তোমার বড় তো নাকি!
শফিক অবাক ভঙ্গিতে তাকাল। পরমুহূর্তে শব্দ করে হেসে ফেলল সে। বলল,
– আংকেল আপনি ভুল বুঝছেন। বুবু মানে আমার নানুর কথা বলছিলাম।
– ওহ। কী অবস্থা দেখো। আমি এত বেক্কল, মনে করছি তোমার বোনের কথা বলতেছ।
– না, আমি তো বললামই বাবা-মা বোন সবাই মারা গেছে। শুধু আমিই আছি।
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে শফিকের মাথা নিচু হয়ে গেল। আজগর আলী বললেন,
– আল্লাহর কাছে শোকর করো, তোমার হায়াত আছে। বাবা-মা আর বোনের জন্য সবসময় দোয়া করবা, যেন আল্লাহ তাদেরকে বেহেশত নসিব করেন। তুমি তো মনে হয় রব্বির হাম হুমা দোয়াটা জানো। ওইটা সবসময় পড়বা। এই দোয়ার ওছিলায় আল্লাহ উনাদেরকে ভালো রাখবেন।
– জি। কোন দোয়া?
– রব্বির হাম হুমা কামা রব্বাইয়ানি সগিরন।
– এটা কি মৃত বাবা-মায়ের জন্য পড়তে হয়?
– হ্যাঁ, তুমি জানো না?
শফিক মাথা নাড়ল। আজগর আলী অবাক হলেন। এত বড় ছেলে, বয়স তো কম হয় নাই। অথচ এই সামান্য এক লাইনের দোয়া জানে না! এটা তো এখনকার দিনে পিচ্চি পোলাপানরাও বলতে পারে। আজগর আলী বিষয়টা নিয়ে অত মাথা ঘামালেন না। মনে মনে বললেন,
– আহারে, এতিম ছেলেটা। বাপ-মা নাই। দোয়া কালাম শিখাবে কে? মামা-মামির দায়িত্ব ছিল শিখানো। কিন্তু তারা শিখায় নাই। থাক, এই ছেলেকে যে ঘরে জায়গা দিয়েছে, খাওয়াপরা দিয়েছে, পড়াশুনা শিখিয়ে এত বড় করেছে, এটুকুই বেশি। আসলে আজগর আলী শফিককে নিয়ে নেতিবাচক কিছু ভাবতে পারছেন না। এর পেছনে দুটো কারণ। এক, ছেলেটার চেহারায় অদ্ভুত মায়া মাখানো। একবার দেখলেই মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে। তাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। চেহারার গঠন কাটা-কাটা। অনেকটা মেয়েদের মতো। শফিকের মা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দরী ছিলেন। শফিক কি তার চেহারার আদলটা পেয়েছে? কথাবার্তাও খুব স্মার্ট। বসার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি সবটাই আজগর আলীকে অভিভূত করেছে। ছেলেটার মধ্যে যে বিষয়টা সবথেকে প্রবল, তা হচ্ছে, বিনয়। কন্ঠও নরম। বাচনভঙ্গিতে এখন পর্যন্ত ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়নি। দুই, ছেলেটা বাসায় পা দেয়ার আগেই তিনি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এই প্রস্তুতি আসলে পাত্রকে দেখার না, পুত্রসম কাউকে দেখার। এই প্রস্তাবটা অন্যদের মতো না। আমিরার খালা এক প্রকার নিশ্চিত করে বলেছেন, বিয়েটা এবার হবেই। সেজন্যই বোধহয় শক্ত একটা কাঁধ তার কাঁধের সাথে মিলিয়ে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় ছিলেন। তাই অতকিছু মাথায় ঢুকাচ্ছেন না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন,
– অসুবিধা নাই। তুমি এখন শিখে নাও। সবসময় পড়বা।
শফিকও বেশ আগ্রহ নিয়ে মোবাইল ফোনের নোটপ্যাডে এই দোয়াটা টুকে নিল। আজগর আলী ফিরে গেলেন পুরনো কথায়,
– তোমার মামা-মামি আসলে ভালো হইত। খালি ছেলে-মেয়ের দেখাদেখি হলেই তো হয় না। দুই পক্ষের মধ্যে আত্মীয়তা হবে।
শফিক ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
– হ্যা, মানে উনারা আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুবু অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি ভাবলাম, আজ নাহয় আমি একাই যাই। আসলে আংকেল, আমি টিপিক্যাল দেখাদেখিতে ইন্টারেস্টেড না। আমার ধারণা, সবাইকে নিয়ে পাত্রী দেখতে আসাটা খুব বেশি ফরমাল। বিয়ে ব্যাপারটা ঠিক তার বিপরীত। মানে বিয়ের পর ফরমালিটির সুযোগ থাকে না। তাই সবকিছু ইনফরমালি হলেই বেটার। তবু আপনি যদি মনে করেন…
– না ঠিক আছে। তোমার সাথে আমি একমত। তুমি ঠিক কথাটাই বলছ। আসলে, এইরকম দেখাদেখি তো অনেকদিন ধরে চলে আসতেছে। একটা রেওয়াজের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। তাই আমরা সবাই কমবেশি আশা করি, সবাই মিলে মেয়ে দেখতে আসবে।
– আমার চিন্তাভাবনা অন্যরকম। একটা সম্পর্ক শুরুর আগে আমি কোনো ফরমালিটি করতে চাই না। এই যেমন এখানে আসার আগে কোনো প্রিপারেশন নেইনি। জাস্ট প্রতিদিন যেভাবে চলি, যা পরি, ওভাবে এসেছি। যাতে ক্যাজুয়াল লুকটাই আপনারা দেখেন আমার।
আজগর আলী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শফিককে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা সত্যিই পাত্র সেজে আসেনি। পরনে বাসি পোশাক। বুঝাই যাচ্ছে, সকালের দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিল। হয়তো কাজ ছিল কোথাও। ওটা সেরে সরাসরি এখানে চলে এসেছে। চেহারায় খানিক ক্লান্তি ভর করে আছে। গলার টাই খানিক অবিন্যস্ত। শার্ট একটু কুঁচকে আছে। শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে। হ্যাঁ, এটাই তার আসল রূপ। এই রূপেই তাকে সুদর্শন লাগছে। সেজেগুজে এলে কি তবে রাজপুত্রের মতো দেখাত?
===========

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৮।
শফিকের কোনো কাগুজে বায়োডাটা নেই। শাহিনা বানু মৌখিকভাবে ছেলের বর্ণনা দিয়েছেন। সামনাসামনি দেখে বুঝা গেল, বর্ণনার সবটুকু হুবহু মিলে গেছে। কোনো হেরফের হয়নি। বাকি আরও কিছু জানার থাকলে আজ জিজ্ঞেস করা হবে, এমনটাই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু আজগর আলীর কিছু জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
– আজই বিয়েটা হয়ে গেলে কি ভালো হয় না? আমার তো সুপাত্র দরকার নাই। রাজপুত্রও লাগবে। টাকাপয়সা ওয়ালা বড়লোক, চাকুরিজীবি পাত্র কিচ্ছু লাগবে না। আমার শুধু এই ছেলেটাকে চাই। আল্লাহ, তুমি আমাকে কোনো ছেলে দেও নাই। এখন কি এই ছেলেটাকে আমার করে দিতে পারো না? শফিকের চাকুরি না থাকলেও আমি ওকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব। দরকার পড়লে ফুটপাতের ধারে বসে ভিক্ষা করব। তবু আমার এই ছেলেটাকেই চাই।
আজগর আলীর মন আজ সকাল থেকেই খানিকটা খারাপ হয়ে আছে। গতকাল রাতে মেয়েদের কথাবার্তার কিছু অংশ কানে এসেছিল। কদিন ধরেই অল্পসল্প কানে আসে। কিন্তু গতকাল অনেকটাই শুনেছেন। তাতে যা বুঝা গেল, আমিরা বিয়ে করতে চাচ্ছে না। সে পড়াশুনা করতে চায়। কিন্তু তার মা ও খালা তাকে এই সুযোগ দিতে ইচ্ছুক না। আমিনার পালিয়ে বিয়ে করার ঘটনায় নাসিমা বানুর মন থেকে বিশ্বাস নামক অনুভূতি একদমই উঠে গেছে। তিনি এখন মেয়েদের কাউকে বিশ্বাস করেন না। আমিরা তো ভালোই বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে। কিন্তু আনিসা একদমই ছোট। নাক টিপলে এখনো দুধ বের হবে। অথচ নাসিমা বানু এই মাসুম বাচ্চাটাকেও সন্দেহ করেন। তিনি কয়েকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছেন স্ত্রীকে। কিন্তু নাসিমা বানুর যুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছে। স্ত্রীর কথাগুলোও আসলে ফেলে দেবার মতো না। এই বিপর্যয়ের দিনে যতগুলো মুখ সংসার থেকে বিদায় হবে, ততই ভালো। অন্যের টাকায় চলেফিরে চলা মানুষগুলোর এত সাধ থাকতে নেই। একারণে আমিরাকে বিয়ে দেবার তোড়জোর চলছে। নাসিমা বানু আর তার বোন পরিকল্পনা করে রেখেছেন, আমিরার বিয়ের কয়েক মাস পরই আনিসার জন্য পাত্র খোঁজা হবে। এখনই বোধহয় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। দু’দিন আগে দুই বোন মিলে কী যেন ফুসুর-ফাসুর করছিলেন। আনিসার নামটা বারবার কানে শুনা যাচ্ছিল। আমিনার জন্যও বর লাগবে। কিন্তু শাহীনা বানুর অন্যরকম পরিকল্পনা, ভাগ্নিকে নিয়ে। তিনি চান, আমিনা নিজের পায়ে দাঁড়াক। সমাজে যথাযথ প্রতিষ্ঠিত হোক। মানুষজনের সাথে চলাফেরা করুক। ওর জন্য রাজপুত্র আসবে। সুন্দর চেহারার একটা মেয়ে যখন নিজেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের উপযোগী করে মানিয়ে চলে, যাকে এক কথায় বলে স্মার্ট। কথাবার্তা আর আচরণ হয় সুন্দর। খালার বিভিন্ন কার্যকলাপের সুত্র ধরে এখানে-সেখানে যাতায়াত করে, তখন অনেকের চোখ ওর দিকে পড়ে। আমিনার বেলায় তাই-ই হয়েছে। বড়সড় যে কোনো ইভেন্টে শাহীনা বানু ওকে সাথে নিয়ে যান। পার্সোনাল এসিস্ট্যান্টের মতো। সেখানে অনেকের সাথে কথা হয় আমিনার। ইভেন্টগুলো কীভাবে কাজ করে, কী কী পরিচালনা করতে হয়, আমিনাকে হাতে ধরে শেখানোর চেষ্টা করছেন তিনি। পাশাপাশি স্কুলের চাকুরিটা তো আছেই। কিন্ডারগার্টেন স্কুল বলেই সুবিধে। ইভেন্টের কাজে যাওয়াটা সহজ হয় ওর জন্য। তবে তিনি একদমই বেগার খাটান না। প্রতিটা ইভেন্টের পর ওকে কিছু টাকা দেন, যাকে বলে সিজনাল স্যালারি। এভাবেই আমিনাকে প্রস্তুত করছেন শাহীনা বানু। এর সুফল ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমিনার সাথে ওর অন্য দুই বোনকে মেলানো আদতেই মুশকিল। এখন ভালোয়-ভালোয় আমিরা পার হয়ে গেলেই হয়। আজগর আলী বুঝেন সবটাই। তবু তার মন পোড়ে। দুঃখ হয় খুব। যদি পঙ্গু না হতেন, আজকের এই দিন আসত না। তিন মেয়েকেই তিনি পড়াশুনা করাতেন।
এতসব মন খারাপের মধ্যেই শফিক চলে এলো। এখন আরও বেশি মন খারাপ হচ্ছে। তার মন বলছে, এই ছেলেটা আসলে অলীক। বাস্তবে অমন কেউ আসেনি। তিনি চোখে ভুল দেখতে পাচ্ছে। একে ধরতে গেলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে হয়তো। এজন্য হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছে লুকিয়ে রেখেছেন। আমিরার ভাগ্যে এত ভালো বর লিখে রেখেছেন আল্লাহ, ভাবতেই চোখ ঝেপে জল আসছে। অনেক কষ্টে কান্না সামলে রেখেছেন তিনি। আনন্দের কান্না।
শফিক তার বিড়বিড়ানি শুনতে পায়নি। তাই এগিয়ে এসে বলল,
– কী বললেন?
– না বাবা কিছু বলি নাই। তুমি কি কিছু খাবা? মানে নাশতা রেডি হচ্ছে। তার আগে একটু শরবত। অ্যাই আমিনার মা, তাড়াতাড়ি শরবত দিয়ে যাও আগে। যেই গরম পড়েছে আজ! ঘরের ভেতরই টেকা দায়। বাইরে না জানি কি অবস্থা!
শফিক তাল মিলিয়ে বলল,
– আংকেল বাইরের অবস্থা প্রচুর খারাপ। অফিসে তো আমরা এসিতে থাকি। তাই অত অসুবিধা হয় না প্রতিদিন। কিন্তু এসি থেকে বের হবার পর জান যাই যাই করে। সত্যি বলতে, আজ অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। আমি যে কীভাবে এই গরমের মধ্যে আপনাদের বাসা পর্যন্ত এসেছি, নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
নাসিমা বানু তড়িঘড়ি করে একটা ট্রে তে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে এলেন। সেন্টার টেবিলের উপর রাখতেই শফিক আগবাড়িয়ে গ্লাসটা হাতে নিল। সত্যিই পানির পিপাসা হচ্ছে তার। না বলতেই আংকেল বুঝে ফেললেন! নাসিমা বানুকে হাসিমুখে বলল,
– থ্যাংকস আন্টি। এই সময়ে এই ঠান্ডা শরবতের কোনো তুলনাই হয় না।
আজগর আলী বিরক্ত সুরে বললেন
– তুমি কী, বলো তো? খালি এক গ্লাস শরবত নিয়াসছ সামনে! খাবার দাবার নিয়া আসো।
নাসিমা ত্রস্ত সুরে বললেন
– এই তো এখনি আনতেছি। শরবতটা আগে দিলাম। খেয়ে গলাটা আজে জুড়াক।
শফিক বলল,
– না ঠিক আছে আন্টি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি বিকেলে খুব একটা খাই না। অভ্যেস নেই। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত হয়। তখন একবারে ডিনার সেরে ফেলি। এখন এই শরবতটাই লাইফ সেভার। আমি আর কিছু খাব না।
– খাব না বললে হয় নাকি? কী যে বলো তুমি!
আজগর আলী হা হা করে উঠলেন,
– ওর কথা শুনতেছে কে? তুমি এখনই নাশতা নিয়াসো।
– আংকেল আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন। আমি খেতে আসিনি। জাস্ট দেখা করব বলে…
– দেখা তো করবা। তাই বলে খাবা না কিছু, এইটা কেমন কথা?
– না মানে আমার একটু তাড়া ছিল।
আজগর আলী বুঝলেন, শফিক আসলে আমিরার সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে আছে। তিনি বুড়ো মানুষ। তার সাথে কথা বলতে অত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। অবশ্য এই বয়সের ছেলেরা কী গল্প করবে তার সঙ্গে? মুরব্বি কেউ এলে নাহয় কথাবার্তা বলা যেত। ছেলের নিজের পরিবার না থাকলেও দেশের বাড়ি কোথায়, বংশে আর কে কে আছে, বংশের কার কীরকম অবস্থা এইসব জানার দরকার আছে। এগুলো শফিককে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে বাঁধছে। তিনি গলা চড়িয়ে মেয়েকে ডাকলেন,
– আমিরা! মা এদিকে আয় একটু।
আমিরা নয়, ঘরের পর্দা তুলে উকি দিল ছোট মেয়ে আনিসা। কচ্ছপের মতো মুখটা বের করে বলল,
– মেজপা এখন আসতে পারবে না।
– আসতে পারবে না মানে? এই আমিনার মা, এদিকে আসো তো। দেখো তোমার মেয়ে কী বলতেছে।
এবার ঘর থেকে বের হলো আমিনা। পরনের আটপৌরে শাড়ি। এটা সকাল থেকেই পরে আছে। বাইরে কী একটা কাজে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে আর পাল্টানোর সুযোগ পায়নি। মায়ের সঙ্গে রান্নাবান্নায় হাত লাগিয়েছে। সচরাচর রান্নার কাজে সাহায্য করে আমিরা। খুব চটপটে সে। ছোটবেলা থেকেই রান্নাঘরে ঘুরাঘুরির অভ্যেস আছে তার। মাকে কাজ করতে দেখে নিজেও একটু-আধটু করার আগ্রহ দেখাত। নাসিমাও আপত্তি করেননি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। এখন তিনি অসুস্থ থাকলে সংসারের লাগাম সে ধরে। অত টেনশন করতে হয় না তখন। অবশ্য এমনিতেও বাবার যত্মআত্তি আমিরা নিজে করে। ঘড়ি ধরে তিনবেলা বাবাকে খেতে দেয়া, খাওয়ার পর ঔষধ খাওয়ানো, পড়াশুনার ফাঁকে এইসব কাজের দায়িত্ব তার উপর অলিখিতভাবে বর্তায়। নাসিমাও কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন সংসারের ভার থেকে। কিন্তু আজ আমিরাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমিনার মতো খুব ফরসা নয় সে। আবার কালোও বলা যাবে না। উজ্বল শ্যামবর্ণ। বাবার গায়ের রঙ পেয়েছে। বাবা অবশ্য উজ্জ্বল শ্যাম নয়। শ্যামলা কালো। মেজ মেয়ের এই গায়ের রঙ নিয়ে মায়ের প্রচুর মাথাব্যাথা। আশপাশে প্রতিবেশি আর আত্মীয়স্বজনের কান ভারিতে তার মাথায় গেড়ে বসেছে, আমিরাকে বিয়ে দিতে গেলে অনেক হ্যাপা হবে। গায়ের রঙের জন্যই বারবার প্রত্যাখাত হতে হবে। যদিও কথাটা বাস্তবে ফলেনি। এই পর্যন্ত যারাই এসেছে আমিরাকে দেখতে, গায়ের রঙ বা চেহারা নিয়ে কেউ আপত্তি করেনি। বরং আমিরাকে সবাই এক বাক্যে পছন্দ করে নিয়েছে। সমস্যা হয়েছে পরিবারের চালচুলোহীন অবস্থার জন্য। যতই পছন্দ হোক, এক কাপড়ে মেয়েকে নিয়ে যাবার মতো মানসিকতা আজকালকার পাত্রপক্ষের নেই।
নাসিমা বানু বের হয়ে এসেছেন রান্নাঘর থেকে। হাতে আবারও ট্রে। এবার তাতে নানা পদের নাশতার আয়োজন। বসার ঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন। আজগর আলীর চড়া কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়িয়েছেন। আবার আমিনাও হুট করে ঘর থেকে বের হয়ে আসায় অপ্রস্তুত বোধ করছেন। মেয়েটার এখনো আক্কেল হলো না। আলুথালু অবস্থায় চলে এলো মেহমানের সামনে! কাপড় না বদলাক, অন্তত মাথায় চিরুণিটা দিলেও পারত! পরক্ষণেই মনে হলো, থাক। আমিনা পরিপাটি হয়ে পাত্রপক্ষের সামনে গেলেই বরং বিপদ। তাকে বরাবরই বলা হয় পাত্রপক্ষের সামনে না আসতে। হোক ডিভোর্সী মেয়ে। তবু প্রথম দেখায় চট করে আমিরার বদলে ওকে পছন্দ করে ফেলে পাত্র। ওর প্রতি আগ্রহ দেখায়। পরে অবশ্য ডিভোর্সী শুনে পিছিয়ে যায়। তখন সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয় আমিরার উপর।
আমিনা অবশ্য এইসব নিষেধাজ্ঞা শোনে না। তার মতে, পাত্রপক্ষ এক বোনকে দেখতে এসে অন্যজনকে পছন্দ করে ফেললে বুঝতে হবে এরা ভালো মানুষ না। মন-মানসিকতা ভালো হলে একই পরিবারের এক বোনকে রেখে অন্য বোনকে পছন্দ করবে না। পরিবারের সদস্যদের বা যে মেয়েটিকে দেখতে এসেছিল, তার মনোকষ্ট অনুভব করবে। তার কথা মাথায় রেখেই অন্য বোনকে পছন্দ করার কথা মুখে আনবে না। অতএব, এই ধরনের পাত্র সবার আগে বাদ।
বড় মেয়ের কথায় পাত্তা দেন না নাসিমা আর আজগর। কিশোরী বয়সে পালিয়ে গিয়ে বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি মারা মেয়ের কাছ থেকে ভালো কিছু তারা আশা করেন না। নেহাতই পেটে ধরেছেন বা জন্ম দিয়েছেন, তাই শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হবার পর ঘরে তুলেছেন। মেয়ে তো তাদেরই। ফেলে দেবার জো নেই। পরের ছেলে ফেলে দিতে পারলেও তারা পারেন না।
আমিনা বলল,
– আনিসা বাড়িয়ে বলে। আমিরা আসতেছে। ও আগেই রেডি হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে…
কথা শেষ করল না সে। তার আগেই শফিক বলে উঠল,
– ইটস ওকে। অত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। আমি আসলে ওর সাথে দেখা করেই চলে যাব। ফরমালিটিজ না করলেই ভালো।
আমিনার চট করে পছন্দ হয়ে গেল শফিককে। সে বলল,
– আপনি নাশতা খান। আমিরা একটু পরই চলে আসবে।
– না, আগে ও আসুক। একসাথে নাশতা খাই। আপনিও আসুন প্লিজ। ফ্যামিলির সবাই মিলে নাশতা খেতে-খেতে গল্প করলে আমিরারও ভালো লাগবে!
আমিনার ভালো লাগা বাড়ল। নাসিমা বানু আর আজগর আলীও শফিকের কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হলেন। এই ছেলে এখনই নিজের পরিবারের অংশ ধরে নিয়েছে! এতিম তো। হয়তো পরিবারের খুব অভাববোধ করে। বিয়ের পর তো এই পরিবারেরই ছেলে হবে সে। তিনি বড় মেয়েকে বললেন,
– আমিরার রেডি হতে হবে না। যেমন আছে, ওকে আসতে বল। তুই আর আনিসাও আয়। এই নাসিমাআআআ, তুমি আসো। অনেকদিন সবাই মিলে বিকেলের চা-নাশতা খাওয়া হয় না।
———————————
চলবে।