তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১৭।
শাহীনা বানু এলেন রাত দশটার দিকে। এসেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলেন। তারও আগে দুইবার কল করেছেন আমিনার মোবাইলে। তিনি একা আসেননি। সাথে অনেক জিনিসপত্র আর খাবার-দাবারও এনেছেন। এগুলো বাসায় নেয়ার জন্য দুইজন লাগবে। তার গাড়ি এই গলির ভেতর ঢুকে না। তাই অনেকটা পথ বহন করে আনতে হবে। ড্রাইভার এতকিছু দুই হাতে সামলাতে পারবে না। ফোনকল পেয়ে আমিনা নিচতলায় গেল। সাথে আনিসা। আমিরা গেল না। সে আর এই দুনিয়াতে নেই। শফিক তাকে হাত ধরে নিয়ে গেছে স্বপ্নীল জগতে। সেই ঘোর এখনো সামলে উঠতে পারছে না। শোবার ঘরের জানালার সামনে সেই যে দাঁড়িয়ে আছে!শফিক চলে গেছে সেই কখন। কিন্তু তার নড়ার নাম নেই। তার সম্মোহন যেন কাটছেই না। আমিনা আর আনিসাই দুই হাতে সবকিছু বয়ে নিয়ে এলো। এলাহী কারবার বলা চলে। কত কিছু যে নিয়ে এসেছেন বড় খালা! অবশ্য আজই প্রথম না। খালা যতবার আসেন, এরকম ভুরি-ভুরি শপিং ব্যাগ নিয়ে আসেন। সেগুলোয় যে দামি বা নতুন জামাকাপড় থাকে, তা না। বেশিরভাগই তার মেয়ের জামাকাপড়। ভাগ্নিদের জন্য নিয়ে আসেন। কখনো বোনের জন্য আনেন, নিজের ক্লজেটে পড়ে থাকা কোনো শাড়ি। ওগুলো পড়েই থাকে অবহেলায়। শাড়ি তার পরা হয় না খুব একটা। সালোয়ার কামিজ পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি। কখনো কুর্তি-জিনসও পরেন। বয়স হলেও শরীরের চামড়া এখনো বেশ টানটান। সময়ের হিসেবে তার যৌবন চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তিনি তা ধরে রেখেছেন অদ্ভুত কোনো রহস্যময় উপায়ে। মেদ জমতে দেন না খুব একটা। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করেন। পারলারে গিয়ে ত্বকের যত্ম করেন। মুখের চামড়ায় খানিক ভাঁজটাই বরং তার বয়সটা মনে করিয়ে দেয়। এই শরীরে শাড়ি পরলেও খুব মানাবে। তিনি যে শাড়ি একদমই পরেন না, তা নয়। মাঝেমধ্যে হাই সোসাইটির পার্টিগুলোয় শাড়ি পরা হয়। কিন্তু তা বেশ দামি শাড়ি। সাধারণ ঘরানার কাপড়গুলো বোনের জন্য নিয়ে আসেন। বোনের স্বামীর জন্যও আনেন বৈকি।
এছাড়া রইল খাবার-দাবার। নিজের ক্যাটারিং ব্যবসায়ে এখন আর সময় দিতে পারেন না খুব একটা। ওটা বিশ্বস্ত কর্মচারীরাই চালায়। তবু মাঝেমধ্যে ফুসরত পেলে রান্নাঘরে ঢুকেন তিনি। নিজ হাতে কিছু তৈরি করেন। সেখান থেকেও প্রচুর খাবার নিয়ে আসা হয়। তার ক্যাটারিংয়ে কখনো বাসি খাবার রাখা হয় না। প্রতিদিনের তৈরি খাবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। রাতে বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো কখনো অনাথ পথশিশুদের বিতরণ করা হয়। যেদিন বোনের বাসায় আসেন, সেদিন অনেকগুলো বক্স ভরে নিয়ে আসেন। ভাগ্নিরা বেশ মজা করে খায়।
সব জিনিসপত্র এনে বসার ঘরেই রাখল আমিনা। এইটুকু পথ হেঁটে আসতে হাঁপিয়ে গেছে। খানিক স্বগতোক্তির সুরে বলল,
– খালা যে এতকিছু কী আনল! এত ভার কেন?
শাহীনা বানুর চেহারা বেশ চকমক করছে। ঘরে ঢুকেই তিনি ভাগ্নিদের শোবার ঘরে পা দিয়েছেন। হৈ-রৈ করে আমিরাকে ডাকলেন। তার তো বিয়ের ঘন্টা বেজেই গেল! শফিকের বেশ প্রশংসা করতে লাগলেন। শফিক চলে গেছে বেশিক্ষণ হয়নি শুনে আফসোস করলেন। আরেকটু আগে আসলে দেখা হয়ে যেত! ছেলেটাকে এখনো সামনাসামনি দেখেননি তিনি। স্বামীর কাছে অনেক কথা শুনেছেন। বছরখানেক ধরেই শুনছেন। আমিনার বড় খালু অফিসের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলেন না বাসায়। কিন্তু শফিকের কথা প্রায়ই বলেন। তার কর্মজীবনে এত সরল আর সৎ একটা ছেলে তিনি আগে দেখেননি। তার ইচ্ছে, এই ছেলেটাকে নিজে গড়েপিঠে নেবেন, যাতে তার ব্যবসায় শক্তহাতে সামাল দিতে পারে। নিজের ছেলে আছে অবশ্য। কিন্তু সেই ছেলে বড্ড বেখেয়ালী। কখন কী করবে, কোথায় যাবে, ইয়ত্তা নেই। ছেলেটার মধ্যে সমস্যা আছে। মনস্থির করতে পারে না কোনোকিছুতে। একবার মনস্থির করলেও ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। কোনোকিছু অর্জন করে নেয়ার ব্যাপারটা তার মধ্যে নেই। সে চায়, সাজানো গোছানো সবকিছু তার সামনে আপনাআপনি হাজির হোক। শাহীনা বানু এই ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করেন। স্বামীর সাথে আলোচনা করেন। এই কথার ফাঁকেই একদিন তার স্বামী বললেন, শফিককে তিনি সবকিছু শেখাবেন। মূল মালিকানা নিজের ছেলেরই থাকবে। তার অধীনে তদারকি সবটা করবে শফিক। তখনই শাহীনা বানু বুঝে গিয়েছিলেন, শফিককে নিয়ে তার স্বামীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেকদূর। তবে আমিরার সাথে এই ছেলের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানোটা তার হিসেবে ছিল না। তিনি অবাক হয়েছেন স্বামীর কথা শুনে।
আপন ভাগ্নি, তাই তার আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না। এজন্য ঘটকালিটা করে ফেলেছেন। বসার ঘরে তখনই জমজমাট আসর বসে গেছে। আমিনার স্বগতোক্তি শুনে তিনি বললেন,
– আরে কী বলিস? তোর বোনের বিয়ের সানাই বাজল। মিষ্টিমুখ করবি না? আমি তোদের জন্য এবার শপিং করে এনেছি। তিন বোনের তিনটা শাড়ি! এর সাথে ম্যাচিং জুয়েলারিও আছে। আজ তো শফিক আসলো। এরপর ওর মামা-মামি আসবে। ওইদিন তো ভালো জামাকাপড় পরা লাগবে। তোর বাবা-মায়ের জন্যও এনেছি। আবার সুস্মিতা বলল ওর নাকি কতগুলো জামাকাপড় পড়ে আছে। ওগুলো ফেলে দিতে চায়। আমি নিয়ে এলাম। একদিনই পরেছে। এরপর রেখে দিয়েছে ক্লজেটে।
আমিনা কথা বাড়াল না। আনিসা জামাকাপড়ের ব্যাগগুলো নিয়ে গেল শোবার ঘরে। কী কী এনেছেন বড় খালা, ওগুলো বের করে দেখবে। আমিরা লুকিয়ে আছে ঘরেই। খালার সামনে দাঁড়াতে তার লজ্জ্বা করছে খুব। কারণ খালা একটু আগেই শফিককে নিয়ে বড় ধরনের রসিকতা করেছেন। ঘরে ঢুকেই বললেন,
– কী করে? তোর দেখি গালে রঙ লেগেছে। বিয়ে লেগেই গেল তবে?
– কী বলছ খালা?
– আরে হ্যাঁ! টসটসে গাল করে ফেলেছিস গাল। বর পছন্দ হয়েছে নাকি?
আনিসা উত্তর দিল,
– শুধু পছন্দ? মেজপা তো শফিক ভাইকে পারলে আজকে রেখেই দেয়। এই যে পকপক করল সারাটা সন্ধ্যা। শফিক ভাইকে যাইতেই দেয় না।
– তাই নাকি? একদিনেই জমে ক্ষীর! বাব্বাহ!
– শফিক ভাই কিন্তু আপাকে অনেক রোমান্টিক কথা শুনাইছে।
আমিরা চোখ রাঙ্গাল বোনের দিকে তাকিয়ে। তার ইশারা দেখে আনিসা মুখ টিপে হাসছে। শাহীনা বানুকে আমিরা বলল,
– ওর কথা বিশ্বাস কইরো না, খালা। ও বানিয়ে বলতেছে না। উনি এমনিই কথাবার্তা বললেন। বিয়ের পর কী কী করব। আমার কী প্ল্যান এইগুলা জানতে চাইলেন।
– বাপরে! বিয়ের পরের প্ল্যানও করা শেষ তোদের! তাহলে যেতে দিলি কেন? আজই কাজি ডেকে বিয়েটা পড়িয়ে ফেললে ভালো হতো না? ফুল-টুল দিয়ে এই ঘরেই বাসর সাজিয়ে ফেলা যেত! ইশ, আমি একটু আগে আসলেই পারতাম। ধ্যাত! মিটিংটা আজ না হলেই হতো!
আমিরার মুখ আরও লাল হয়ে গেল লজ্জ্বায়। পারলে পাতালে মিশে যায়। তা সম্ভব না বলে সে ওয়াশরুমে ঢুকল। আনিসার কথা শোনা যাচ্ছে। খালার কাছে বেশ রসিয়ে শফিক-আমিরার কথোপকথন তুলে ধরছে সে। আমিরা বিড়বিড় করল,
– এই বদমাইশ ছেমড়িটা এতক্ষণ ধরে সব কথা শুনছে! তো শুনছিস ভালো কথা। হজম করে রাখ পেটের মধ্যে। তা না, উগরে দিতেছে সব! তাও কার কাছে? খালার কাছে! বলার ছিরিই বা দেখো! এত জোরে কথা বলতেছে, বাবা-মাও শুনতে পাচ্ছে। আরো গলা চড়িয়ে বল না! পুরো এলাকা জেনে যাক। এরপর আমার আর মুখ দেখানো লাগবে না।
নাসিমা বানু বোনের হাত ধরে বললেন,
– বড়াপা, ছেলেটা ভালোই। একটু বেশি মিশুক! আমার কাছে মোটামুটি ভালোই লাগছে।
– আরে, তুই মোটামুটি বলতেছিস কেন? বল, ভীষণ ভালো ছেলে। শোন, তোর দুলাভাইকে তো চিনিস। সহজে কাউকে পছন্দ করার মানুষ সে না। সবার মধ্যে দেখবি কোনো না কোনো খুঁত খুঁজে বের করতে ওস্তাদ। সেই মানুষ হচ্ছে শফিককে দেখে কাত! তাহলে বুঝ।
– হু, তুমি এইবার বিয়ের কথা আগাও। দিনতারিখ ঠিক করো। আমার মনে হয়, তুমিই যদি ওর মামা-মামি আর ফুপুর সাথে কথা বলো, ভালো হয়। বিয়ের মধ্যে কত ব্যাপার-স্যাপার থাকে। দেনমোহরের বিষয় আছে। তুমি এগুলা ভালো বুঝবা। ছেলেটাকে আমার ভালোই লাগছে। কিন্তু ওর মামা-মামি কীরকম হয় কে জানে। দেখা যাবে দেনমোহর, খরচ এইসব নিয়া ক্যাচাল করবে।
– ওসব তুই ভাবিস না। তোর দুলাভাই শফিককে একটু টাইট দিলেই সব সুরসুর করে লাইনে চলে আসবে।
– তাও তুমি নিজে কথা বললে ভালো হয়। আমার ভরসা লাগে। ওরা যেদিন আসবে, তুমি কোনো কাজ রাখবা না। আর্জেন্ট কিছু থাকলে ওদেরকেই বলব আরেকদিন আসতে।
– দেখা যাক।
আজগর আলীর সাথে তার জেঠাসের সম্পর্ক খুব একটা সাবলীল না। নাসিমা বানুর মতো তিনি হাত পেতে টাকা নেয়ায় এখনো অভ্যস্ত হতে পারেননি। যদিও শাহীনা বানু সবসময় তার খোঁজ রাখেন। কখন, কী লাগবে, জিজ্ঞেস করেন বোনকে। তবু অস্বস্তি রয়েই যায়। একারণে জেঠাস বাসায় এলে আজগর আলী একটু সিটিয়ে থাকেন। কোনোরকম সালাম আর কুশল বিনিময় করেই নিজের ঘরে চলে যান। শাহীনা বানুও অত গা করেন না। তিনি বোন আর ভাগ্নিদের সাথে মেতে থাকেন। কিন্তু আজ আজগর আলীও সহজভাবে কথা বললেন শাহীনা বানুর সাথে। সবটাই শফিককে নিয়ে। শফিক আর আমিরার বিয়ের ব্যাপারে অনেক কথা হলো। বিয়েটা কীভাবে হবে, কোথায় কী করতে হবে সবই একতরফা পরিকল্পনা হয়ে গেল বলা চলে।
খালা এসেছে, এই উপলক্ষে আমিনা আরও একবার টেবিল সাজাল। শফিকের সঙ্গেই তারা রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। তবু প্লেট বাটি এনে খালার নিয়ে আসা খাবার-দাবার অল্প অল্প করে তুলল। খালা খেয়ে আসেননি। তিনি খাবেন। ওরাও তাকে সঙ্গ দিতে কিছু খাবে। শাহীনা বানু আজ আমিরার জন্য রেড ভেলভেট কেক এনেছেন। কেকটা তিনি সকালেই বানিয়েছেন নিজ হাতে। কর্মচারী ডেকোরেশন করেছে। একটা অর্ডারের কাজ ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়েছে কোনো কারণে। টাকাও রিফান্ড নেয়নি। তিনি এই কেকটা আমিরার জন্য নিয়ে এসেছেন। এক ফাঁকে শফিকের কথা উঠল। নাসিমা বানু বললেন,
– শফিক একদম খালি হাতে আসছে, বড়াপা। হাতে করে কিছু নিয়ে আসতে হয়, এই ছেলে মনে হয় জানেই না। এক প্যাকেট মিষ্টি আনলেও চলত! আবার শুনলাম, আমিরার হাতেও নাকি টাকাপয়সা কিছু দিয়ে যায় নাই। মেয়ে দেখতে আইসা টাকা না দিলে কেমনে হয়? আমার মনের মধ্যে ঘুটঘুট করতেছে। আপা তুমি খোঁজ নিও ভালোমতো। এই ছেলে কিপটা হয় নাকি! দেখা যাবে, আমিরার হাতে টাকাই দিবে না কোনো। সব নিজের পকেটে ভরে রাখবে। তখন তো সংসারে ভেজাল হবে ওর।
আজগর আলী এতক্ষণ কিছু বলেননি। আগে থেকেই ফুঁসছিলেন মনে মনে। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ধমকে উঠলেন জেঠাসের সামনেই,
– চুপ করো, মুর্খ মহিলা! চিনো খালি টাকা। আর কী কিছু ঘটে আছে তোমার? এই ছেলের তিন কূলে নাই কেউ। তার টাকা মানেই আমিরার টাকা। ওইটা আবার আলাদা করে কী বুঝায় দিবে আমিরার হাতে? তোমার মেয়ে কি বুঝদার হইছে সংসার করার জন্য? হাতে টাকা দিলে নয়ছয় করবে। নষ্ট করবে। তার চেয়ে যখন যা লাগবে, শফিকের কাছে চাইলে আইনা দিবে।
আজগর আলী জেঠাসকে সবটুকু খুলে বললেন নাসিমা বানুর কান্ড। শফিকের সাথে কী ব্যবহার তিনি করেছেন। শুনে বোনকে তিরস্কার করলেন শাহীনা বানু,
– তোর মাথায় গোবর ভরা। তাও আল্লাহ কোনো না কোনোভাবে পার করে দিছে। আজগর ভাই তোরে নিয়েই সংসার করতেছে। কিন্তু তোর মেয়েগুলার কপালে কী হবে, আমি সেটাই ভাবি। আর আল্লাহকে বলি, এই মেয়েগুলা যেন মায়ের মতো না হয়। স্পেশালি আমিরাকে নিয়েই আমার ভয় বেশি। আমিনা ভালোই চটপটে আছে। ওরে আমি ঘষেমেজে শান দিতেছি। ও ঠিক উৎরে যাবে। কিন্তু আমিরা খাবে ধরা। ওর কোয়ালিটি পুরাই তোর মতো! এই জন্য বেঁছে বেঁছে শফিকের মতো ছেলে খুঁজে আনছি তোর এই মেয়ের জন্য। কপালে সহজ-সরল জামাই না জুটলে তোর মেয়ের আর ঘর করা লাগবে না। দুই দিন বাদে আমিনার মতো চলে আসা লাগবে। বুঝছিস?
নাসিমা বানু কথা বাড়ালেন না। বোনের কথার উপর দিয়ে তিনি কখনোই তর্ক করেন না। শাহীনা বানু আরও কিছু কথা শোনালেন। সবটাই তার সুমতি হবার জন্য। তিনিও শুনলেন। এগুলো শোনায় তার ক্লান্তি হয় না। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন। সেই মতো চলার চেষ্টাও করেছেন জীবনে। কিন্তু কপালে শিকে ছিড়েনি তার। বোনের কথামতো চলতে গিয়েও বৈষয়িক আর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন টনটনে জ্ঞান তার আজ অবধি হয়নি।
খবরটা এলো রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। শাহীনা বানু উঠি-ঊঠব করছেন। ড্রাইভারকে কল করে বললেন, গাড়িটা যেন গলির মুখে নিয়ে আসে। তিনি কয়েক মিনিটের ভেতরই আসছেন। এমন সময় আচানক তার মোবাইলে কল এলো। কর্তার নম্বর! তার স্বামী রাত বারোটার আগে বাসায় ফিরেন না। আজ কি জলদি ফিরেছেন? তিনি কল রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
– কী বলছ?
আবারও খানিক নীরবতা। ওপাশ থেকে কর্তা কিছু বলছেন। তিনিও শুনছেন। তারপ কলটা রাখলেন। ফোন ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে থমথমে সুরে বোন-বোনাই আর তিন ভাগ্নির উদ্দেশ্যে বললেন,
– তোদের খালু কল করেছিল। বলল, শফিক আজ আসতে পারেনি। কী একটা কাজে আটকে গেছিল। তোদের ফোন নাম্বার তো ওর কাছে নাই। এইজন্য ওর স্যারকে কল করে জানিয়েছিল। কিন্তু তোদের খালু এত বিজি থাকে, সে খেয়ালই করেনি। কল রিসিভ হয়নি। শফিক এরপর ভয়েজ মেসেজ দিয়েছে। ও মাত্রই বাসায় ফেরার পথে মেসেজটা শুনল। শফিক বলেছে, আগামী শুক্রবার আসবে ,যদি তোদের আপত্তি না থাকে।
নীরব বোমা ফাটল বোধহয় বাসার ভেতর। সবাই হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে শাহীনা বানুর দিকে। চোখ বিস্ফারিত। আমিরার অবস্থা সবথেকে খারাপ। সে এমনভাবে তাকিয়েছে যেন হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর আমিনা জিজ্ঞেস করল,
– শফিক আসেনি, তাহলে কে ছিল ওই ছেলে?
=================================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১৮।
রাত গভীর হচ্ছে। দ্বিপ্রহর পেরিয়েছে অনেক আগেই। পুরো শহর ঘুমুচ্ছে। আমিরাদের বাসায়ও কেউ জেগে নেই। বড় খালা চলে গেছেন প্রায় বারোটা নাগাদ। তারপর রাতের তল্পিতল্পা গুটিয়ে শুয়ে পড়তে যতক্ষণ লাগে। আলোচনা আর হয়নি তখন। সবারই তাড়া ছিল ঘুমুবার। তাছাড়া বড় খালাই যা বলার, বলে গেছেন। তার সামনেই যত আলোচনা হয়েছে। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। এই পরিবারের শাহীনা বানুর কথাই শিরোধার্য। আমিরাও বরাবরই খালার কথায় পথ চলেছে। আজকের ঘটনাতেও খালার কথাই মানবে। আসলে মানতে হবে, অনেকটা জোর করেই। কারণ খালার অবাধ্য হওয়াটা তার কম্ম না। আবার মনকেও বুঝ দিতে পারছে না। শফিক আসেনি। তার বদলে এসেছিল অন্য কেউ। হতে পারে সময়টা মিলে গেছে, কিংবা উদ্দেশ্যও। সত্যি কথা এটাই, সে শফিক না। আমিরার সাথে তার বিয়ের কোনোরকম কথা হয়নি। হবেও না। সে এসেছিল। শফিকের প্রক্সি দিয়ে গেছে নিজের অজান্তে। অথবা জেনেশুনে? আমিরার মন বারবার এটাই বলছে। সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না, ওই ছেলেটা শফিক নয়। ওই ছেলেটা ওকে দেখতেও আসেনি। এই কথাটা যতবার মনে হচ্ছে, ততবার কষ্ট হচ্ছে ওর। ঘোর লাগিয়ে রেখে গেছে এই ছেলে। এখনো বের হতে পারেনি সে। কখনো পারবেও কি না সন্দেহ। আগে কয়েকবার পাত্রের সাথে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজকের মতো ভালোলাগার আবেশ তৈরি হয়নি। অথচ আবেশটুকু ছিল অন্য কারও জন্য!
বড় খালা অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন। না জেনে ফট করে কাকে ঢুকতে দিল বাসায়। কোথাকার কোন ছেলে, বাসায় এসে কলিংবেল দিয়েছে। অমনি তাকে জামাই আদর করতে উঠেপড়ে লেগেছিল সবাই! এটা কেমন কথা? আগে তো জিজ্ঞেস করবে, কী চাই? কেন এসেছে? যদি শফিক আসে, সে তো নিজের নাম বলবেই। নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার দরকার মনে হলো না কারও! একবার কি নাম ধরে ডেকেছে? না, কেউ ডাকেনি। নয়তো ভুলটা তখনই ধরা পড়ত।
আজগর আলী ছিলেন বসার ঘরে। শফিক আসার ঠিক কয়েক মিনিট আগে তাকে ভালো জামাকাপড় পরিয়ে, ঠিকঠাক প্রস্তুত করে হুইলচেয়ারে বসানো হয়েছিল। সাধারণত শোবার ঘরেই থাকেন তিনি। বিছানা ছেঁড়ে নড়েন না। তার খাওয়া-দাওয়া বিছানাতেই হয়। প্রাকৃতিক ডাক এলে তার জন্য স্পেশাল বেডপ্যানের ব্যবস্থা আছে। নাসিমা বানুই তাকে পরিস্কারের কাজ করেন। মেয়েরা খাবারের দিকটা দেখে। মেহমান খুব একটা আসে না কেউ বাসায়। যাওবা আসে, আজগর আলীর সাথে দেখা করতে হলে সরাসরি শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু পাত্রপক্ষের আসার দিনই তিনি হুইলচেয়ারে বসেন। বসার ঘরে সোফার এক পাশে তার হুইলচেয়ারটা রাখা হয়। আজও তাই করা হয়েছে। কলিংবেল বাজতেই তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেছিলেন। এই বাসার সদর দরজার ছিটকিনি দুটো। একটা উপরের দিকে, অন্যটা মাঝ বরাবর। দরজা বেশিরভাগ খোলার দায় পড়ে আনিসার উপর। সে উঁচুতে হাত নিতে পারে না তাই দিনের বেলায় মধ্যিখানের ছিটকিনিই আটকে রাখা হয়।
আজ শফিককে দরজা খুলে দিয়েছিলেন আজগর আলী। এরপর কি নামধাম জিজ্ঞেস করেছিলেন? প্রশ্নটা করা হয়েছিল তাকে। তিনি মনে করতে পারলেন না ঠিকঠাক। তার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। কিন্তু আজ হম্বিতম্বির কবলে পড়ে চুপসে রইলেন। প্রথম ভুলটা তারই ছিল। অতি উত্তেজনায় ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করেননি। শুরুতেই ‘বাবা’ সম্বোধন করেছিলেন। সাদরে আপ্যায়ন করেছেন। ছেলেটা অবাক হয়েছিল। সাদর সম্ভাষণ আশা করেনি হয়তো। তবে চতুরতার সাথে খানিকপরই নিজেকে সামলে নিয়েছিল। আজগর আলীর আন্তরিকতায় সেও সহজ হয়ে গিয়েছিল। এই কথা স্ত্রী-জেঠাসের সামনে বলা যাবে না। বেইজ্জতির আর শেষ থাকবে না তাহলে। এজন্য মুখ খোলেননি।
শাহীনা বানু এরপর বোন আর ভাগ্নিদেরও জেরা করতে ছাড়েননি। ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন তিনি। এই রাগটা ঠিক কার উপর, বুঝা গেল না। তবে সবাই ভয়ে তটস্থ ছিল। তিনি গলা চড়িয়ে বললেন,
– তোদের কি মাথা ঠিক থাকে না ব্যাটা মানুষ দেখলে? রাস্তাঘাটে ব্যাটা দেখলেই তার কোলে গিয়ে উঠিস। একবার কি মনে হলো না, এই ছেলের নাম জিজ্ঞেস করি! আচ্ছা, নাম জিজ্ঞেস করিস নাই ঠিক আছে। কিন্তু ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলি না, এটা কীভাবে পসিবল?
কথাটা সত্যি না। আমিরা মোটামুটি সব কথাই জেনেছে শফিকের সম্পর্কে। ওহ, শফিক তো না! যাই হোক, ওই ছেলে নিজের মধ্যে কোনোরকম লুকোছাপা করেনি। নিজ থেকে কিছু বলেনি সেভাবে, এটা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন করলে সহজ করেই উত্তর দিয়েছে। আমিরা প্রশ্ন করেনি। কিন্তু কথায় কথায় অনেক কিছু জানা হয়েছে। কিন্তু বড় খালার সামনে ওসব কথা বলা ঠিক না। কথাবার্তার মধ্যে অনেক আবেগ জড়িত ছিল, যেগুলো মুখে বলা সম্ভব না। আনিসাও শুনেছিল। তারও মনে হয়েছে, না বললেই ভালো। ওই ছেলের বৃত্তান্ত জেনে হবেটা কী? সে তো মেজপাকে বিয়ে করবে না। তার চেয়ে এই ক্যাচাল জলদি থামিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু এই কথা বড় খালাকে বলা সম্ভব না। খালা এক ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখবেন ওকে। মাও চোখ রাঙাবে, পিচ্চি মানুষ কেন বড়দের মধ্যে কথা বলছে।
বড় খালার কথা ওখানেই শেষ হবার নয়। তিনি আরও কিছু বলেছেন, যা শুনে আমিরার মনে হচ্ছিল তখনই মরে যায়। তার কথা যৌক্তিক কিন্তু বলার ধরনটা খুবই সূচময়। তিনি আমিরার দিকে আঙুল তুলে বললেন,
– তুই বা কী এত পেচাল পারছিস ওই ছেলের সাথে? একদম ঘরে ঢুকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা লাগল! কী এত কথা? প্রেম চলে নাকি ওই ছেলের সাথে তোর? আগে থেকেই চিনত, তাই না? তুই বাসার ঠিকানা দিয়েছিস যাতে পাত্র সেজে চলে আসে। এরপর তুই ঘরে ঢুকিয়ে আরামসে প্রেম করতে পারিস।
আমিরার কানের ভেতর মনে হচ্ছিল কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল খালার দিকে। এরকমটা কেন মনে হচ্ছে খালার? কোনো ছেলের সাথে প্রেম থাকলে তো আগেই বড়াপাকে জানাত। পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে উপস্থিত হবার কথাই ছিল না। তাছাড়া সে কীভাবে জানত, শফিক আসবে না? পাত্র আসছে ওকে দেখতে, এই সময়ে প্রেমিককে পাত্র সাজিয়ে ঘরে ঢুকানোর বুদ্ধি কার মাথায়ইবা আসবে? সবথেকে বড় কথা, সে আহামরি কোনো সুন্দরী না। তাকে দেখলেই ছেলেরা ধপ করে প্রেমে পড়ে যাবে না। আর বাসায় আসার জন্যও ছলচাতুরি করবে না। এই যে ছেলেটা এসেছিল আজ, রাস্তাঘাটে কোথাও দেখা হলে এই ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দ্বিতীয়বার দেখত নাকি সন্দেহ! এক পলকের দেখায় ঝট করে কারও নজরে পড়ার অবস্থা থাকলে কলেজ অব্দি সিঙ্গেল থাকত না। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই রমরমা প্রেমে মজে যেত। এইসব কথা খালাকে বুঝানো অবান্তর। তিনি যা বলেন, তাতেই হ্যাঁ-হ্যাঁ করতে হয়। দ্বিমত করলে তার মেজাজ চড়ে যায়। এবং পরিণাম ভালো হয় না। তবু আমিনা মিনমিন করে বলল,
– এইসব কী বলতেছ, খালা? আমিরা কেন এই ছেলেকে বাসায় আনবে?
– ও না আনলে এই ছেলে কি এমনে-এমনেই চলে আসছে? তাও পাত্রী দেখতে?
– ভুল করে চলে আসছে মনে হয়। ঠিকানা ভুল হইছিল।।
– হ্যাঁ, এই এলাকায় তো মেয়ে দেখার ধুম পড়ছে। এখানের মেয়েরা তো বিশিষ্ট সুন্দরী। এজন্য সব ছেলেরা এখানেই আসে মেয়ে দেখতে।
আমিনা আর কথা বাড়াল না। আমিরাও চুপ রইল। তবে তার মনের মধ্যে কথাগুলো খুব বাজেভাবে গেড়ে বসল। ঘৃণায় গা রি রি করতে লাগল। বড় খালার কথাবার্তার ধরন আর কেউ না বুঝলেও সে ঠিক ধরতে পারল। খালা আসলে বাজে ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছেন। এই ছেলেকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে শুধু কথাই বলা হয়েছে নাকি আরও কিছু, তা কেউ দেখতে যায়নি। দরজা খোলা থাকলেও কেউ উকি দেয়নি। একে বলে চোখের সামনে অবাধ ঢলাঢলি। একপর্যায়ে তিনি বলেই ফেললেন সরাসরি,
– খালি কথাই বলছে? নাকি গায়েও হাত-টাত দিয়েছে?
আমিরার চোখে পানি চলে এলো। দৃষ্টি ঝাপসা হলো। মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হলো। খালা কি তবে খারাপ মেয়ে ভাবছেন ওকে? একটা ছেলের সাথে আজই প্রথম দেখা আর আজই কি না শারীরিক সংস্পর্শ হবে, এটা কী ধরনের কথা? তবে মুখ ফুটে কিছু বলা হলো না। কারণ, খালার অনুমান সত্যি। শফিক, উহু ওই নাম-না-জানা ছেলেটা ওর হাত ধরেছিল। তাতে খারাপ কোনো ইনটেনশন ছিল বলে মনে হয় না। ছেলেটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনেকটা কম দুরত্বেই। কিন্তু কাছে আসা বলতে যা বুঝায়, শরীরে হাত দেয়া বলতে খালা যা বুঝাচ্ছেন, সেরকম কিছু মনে হয়নি। শারীরিক ঘনিষ্ঠতা, খালার ভাষায় খুব বাজেভাবে বলতে গেলে গায়ে হাত দেয়ার উদ্দেশ্য তার ছিল না, এটা আমিরা হলফ করে বলতে পারবে। সমস্যা হলো, নিজেকে সে যতখানি প্রবোধ দিচ্ছে, ততটা খালাকে দেয়া মুশকিল। তিনি অন্যকিছু ভেবে বসবেন। তবে সে আশা করেছিল, বড়াপা এই বিষয়ে আপত্তির সুর তুলবে। কিন্তু আমিনা কিছুই বলল না। উলটো খালা চলে যাবার পর মা যখন রান্নাঘরে বসে গজগজ করছিল আপনমনে, তার সঙ্গে সায় দিল। নাসিমা বানুর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে আজগর আলীর উপর। এই লোকটাই যত অনিষ্টের মুলে! কী দরকার ছিল ওই ছেলেকে রাতে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর? নাশতা খেয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়বে, তা না করে পারলে কোলের উপর তুলে রাখে! এই লোকের লাগামছাড়া কথার জন্য হুড়োহুড়ি করে কত আয়োজন করতে হলো! টাকা খরচ হলো একগাদা। আমিনা নিজের পকেট থেকে খরচ করেছে। নাসিমা বানুর গোপন সঞ্চয়েও হাত পড়েছে। অল্প টাকায় বাজার করলেও একদমই কম খরচ হয়নি। যতটুকু গেছে, তা দিয়ে আগামী দুই সপ্তাহের বাজার হয়ে যায়। মা-মেয়ে মিলে বকবক করতে লাগল। আমিরার তখন খুব ইচ্ছে করছিল, পুরো খরচের টাকা দ্বিগুণ করে ওদের গায়ের উপর ছুঁড়ে ফেলতে। একটা মানুষ বাসায় এসে খেয়েছে, হতে পারে ভুল মানুষ। তাই বলে যাচ্ছেতাই বের করতে হবে মুখ দিয়ে? যতক্ষণ ওই ছেলে ছিল বাসায়, একেকজন আনন্দে বুঁদ হয়েছিল। আর যেই শুনল ছেলেটা শফিক না, অমনি ভোল পালটে গেল।
আমিরার আসলে নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে। মা-বোনদের সাথে একমত হতে পারছে না বলে নিজের কাছেই কেমন অপরাধবোধ অনুভূত হচ্ছে। অনেকটা নিষিদ্ধ কিছুতে জড়িয়ে যাবার মতো। ওই ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে তার মনপ্রাণ মুখিয়ে আছে। কিন্তু সে মুখ তালা দিয়ে রেখেছে। কারণ, টু শব্দ করলেই আস্ত বোমা ওর গায়ের উপর এসে পড়বে। খালা যে ধরনের কথাবার্তার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, তা মা-বোনদের মগজে ভালোই ঢুকে গেছে।
দুঃখ নাকি শক, কে জানে আমিরা চটজলদি শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। নড়চড় করেনি আর। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার ভান করেছে। কান পেতে শুনছিল আর কী কী কথা হয় ওই ছেলেকে নিয়ে! আমিনা শুতে এসে ওর গায়ে আলতো ধাক্কা দিল। বলল,
– অ্যাই তুই কি ঘুমায় গেছিস?
আমিরা নড়েনি। তার বদলে উত্তর দিয়েছে আনিসা,
– মেজপা আগেই শুয়ে পড়ছে আজকে। তার মনে হয় মন খারাপ।
– মন খারাপ হবে কেন? ওই ছেলের সাথে কথা বলছে, তাতে কী? ওরকম কতজনের সাথেই তো কথা বলল।
– মেজপার তো উনাকে পছন্দ হইছে। উনিও কিন্তু মেজপাকে পছন্দ করছে।
আমিনা বিরক্তির সুরে বলল,
– চুপ থাক। এত পছন্দ-অপছন্দের কী বুঝিস তুই?
– আমি বুঝব কেন? মেজপার কথা বললাম।
– ওর অত বুঝার বয়স হয় নাই।
– উহু, তুমি জানো না। আপা আজকে অনেক খুশি ছিল। অন্যদের সাথে তো এত হেসে হেসে কথা বলে নাই।
– তাতে কী হইছে? কোথাকার কোন ছেলে আইসা দুই লাইন মিষ্টি কথা বলল আর তোর বোন হাইসা কাত হয়ে গেল! লাইফ কি সার্কাস নাকি?
– কাত হয় নাই গো বড়াপা। কাত হইলে তো তারে টাইনা সোজা করে দেয়া যাইত। মেজপা চিত হয়ে গেছে একদম। তুমি দেখলা না, উনি চলে যাবার পরেও জানালার সামনে দাঁড়াইয়া থাকল!
– এই বয়সে ওরকম রঙঢঙ্গ সবাই করে। তাতে তো লাইফ সেট হয়ে যায় না। ছেলেদের মিষ্টি কথায় না ভুলাই ভালো।
– এই আপা, আমি কিন্তু একটা জিনিস দেখছি! উনি মেজপার হাত ধরছিল।
– কী বলতেছিস? হাত ধরছে?
– হ্যাঁ। হাত ধরে কী পিরিত! যদি দেখতা!
– পিরিত মানে? আর কী করছে?
– আরে, তুমি বুঝো নাই, আমি কিছু করার কথা বলতেছি না। বললাম, হাত ধরে প্রেম-প্রেম টাইপ তাকাইছিল।
– তাতেই এই মাইয়া মজে গেছে! ওর কপালে কী শনি আছে, বুঝাই যাইতেছে। অ্যাই আমিরা, উঠ। তোর সাথে কথা আছে আমার। ওই ছেলে কী কী বলছে, আমাকে ডিটেইলস বল। বড় খালা জানতে চাইছে।
ধাক্কা খেয়েও আমিরা নড়ল না। সে ঘুমোয়নি। তবে উত্তর দিতেও ইচ্ছুক না। তার বুক কাঁপছে। আমিনা আবার বলল,
– কী রে? কী মরার ঘুম দিছস? নাকি ভান ধরছস?
আমিরা এবার সত্যিকার অর্থে চোখ বুজল। বড়াপা কি যাদু জানে? কীভাবে বুঝল, সে মটকা মেরে শুয়ে আছে? আমিনা কথা বাড়াল না। রাত হয়েছে অনেক। সকালে তো উঠতে হবে। স্কুল আছে। আমিরার সাথে পরেও কথা বলা যাবে। আমিরা তো পালাচ্ছে না!
ওই মুহূর্তে আমিরা সত্যিই পালানোর কথা ভাবছিল। তার মন বলছিল, সকাল হলেই সে পালাবে। কলেজের নাম করে বের হবে। আর ফিরবে না। কোথায় যাবে, জানে না।
এর কয়েক ঘন্টা পর বাসার প্রতিটা কোণ মানুষের গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের হিসেব গুনতে ব্যস্ত, আমিরা চুপচাপ উঠে বসল বিছানায়। মশারি তুলে বের হলো নিঃশব্দে। আলতো পায়ে হেঁটে আসলো জানালার সামনে। আকাশে খুব বড় চাঁদ উঠেছে। বাইরে কী সুনসান! কাকপক্ষীও শব্দ করছে না। গভীর রাতে কখনোসখনো রিকশার টুংটাং বা গাড়ির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। মেইন রোড এখান থেকে একটু দূর হলেও রাতের নিস্তব্ধতায় তা অনেকদূর গড়ায়। আমিরাদের জানালায়ও এই শব্দ চলে আসে। কিন্তু এখন সেটুকুও নেই। চারপাশ শব্দহীন। আমিরার হাতে মোবাইল ফোন। অনেকটা সময় ফোনটা হাতে নিয়েই বসে রইল সে। বাম হাতের তালুতে কাগজে লেখা একটা নাম্বার। শফিক অথবা নাম-না-জানা কেউ একজন ওর কাছে মোবাইল নাম্বার চেয়েছিল। ওর নিজের কোনো ফোন নেই। বড়াপার ফোন দিয়েই জরুরি কথাবার্তা হয় বান্ধবীদের সাথে। কলেজে আর ব্যাচেও এই নাম্বার দেয়া আছে। তাই মাথা নিচু করে বলেছিল,
– আমার ফোন নেই!
– কেন?
কী অবাক করা প্রশ্ন! যেন দুনিয়ার প্রতিটা মানুষের হাতে ফোন থাকাটা বাধ্যতামুলক! পরক্ষণে অবশ্য সে কথা বাড়ায়নি। পড়ার টেবিল থেকে একটা খাতা টেনে নিয়ে বুকপকেট থেকে কলম বের করল। একদম শেষ পৃষ্ঠায় এগারোটা সংখ্যা লিখল। বলল,
– তুমি কল দিও!
– আমি কীভাবে কল দিব? আমার তো ফোন নাই!
– ওহ, আশপাশে কারও নেই?
– বড়াপার আছে। কিন্তু আমাকে খুব একটা ধরতে দেয় না।
– ফ্রেন্ডদের কারও?
– আমার বান্ধবীদের কারওই ফোন নাই।
– হুম। তাহলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে কীভাবে?
– কথা তো বললামই!
– আর কিছু বলার নাই?
– না।
– যদি পরে কিছু বলতে মনে চায়?
আমিরা উত্তর দিল না। পরে কী বলতে ইচ্ছে করবে? সে বুঝেও না বুঝার ভান করল। ছেলেটা পৃষ্ঠার ওই অংশটুকু ছিঁড়ল। এরপর আমিরার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
– পরেরবার আমি তোমার জন্য ফোন নিয়ে আসব।
– আপনি আনবেন?
– হ্যাঁ। আমার বাসায় একটা স্পেয়ার ফোন আছে। তুমি ইউজ করবা।
– আমি আপনার ফোন ইউজ করব কেন?
– কারণ আমি তোমার সাথে প্রতিদিন কথা বলতে চাই! সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে এনগেজড থাকতে চাই।
– হু, আমার জানি আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই!
– তোমার কাজ থাকলেও আমার নাই।
– কেন? আপনি কি ভাদাইম্মা? কাজকর্ম কিছু করেন না বুঝি? বড় স্যার ধোলাই দিলে এরপর বুঝবেন।
ছেলেটা কী সুন্দর করে হাসল। হো হো করে হাসি। এরপর বলল,
– বড় স্যার যদি জানেন আমি কার সাথে কথা বলছি ফোনে। আমার ধারণা উনার চেয়ে খুশি এই দুনিয়াতে আর কেউ হবে না।
আমিরা বারবার তলিয়ে যাচ্ছে পুরনো কথোপকথনে। নাম্বার লেখা কাগজটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে তার হাতের মুঠোয়। এই নাম্বারে কল করা উচিত হবে কি না ভাবছে। বড়াপা যদি টের পেয়ে যায়? যদিও নাম্বারটা ডিলিট করে দিবে। তবু ভয় হচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। বড়াপার ঘুম অনেক পাতলা। একটু শব্দ হলেই জেগে যায়। যদি কথা বলার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে তার?
আমিরার মনে দোনোমনা চলছে। কল করে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না সে। কেবল নামটা জানতে চাইবে। নাম না জানা পর্যন্ত তার কেন যেন অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। কল কি করবে একবার?
====================