তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
4

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_২৫ ( নতুন নায়িকা)

সূর্যের তাপে গ্রামের পরিবেশ যখন গরম হয়ে যাচ্ছে, তখন আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিকে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে বৃষ্টি পড়বে চারপাশের জগৎকে শান্ত করতে, তার অবিরাম বর্ষণ দিয়ে প্রকৃতির রুখ ভাবকে শান্ত করতে। অরণ্য আর ইনায়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের মধ্যে দুইজনে শান্ত, ইনায়া চোখ অবিশ্বাস্য অরণ্যর এমন ব্যবহার তার কাছে অপরিচিত। বাহিরে যে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে ইনায়া আর অরণ্যর সেখানে মনোযোগ দেয় নাই, তাদের মধ্যে নীরবতা ভেঙে অরণ্য বলে –

“- ইনায়া বাড়ি ফিরে চলুন। আকাশের অবস্থা ভালো না বৃষ্টি পড়তে পারে।

অরণ্য কথাটা বলে ইনায়ার হাত ধরে ইনায়া তার হাত সরিয়ে নেয়, এরপর সে থানার গেইট থেকে বের হয়ে হেঁটে চলে যায়। ইনায়ার এমন ব্যবহার দেখে অরণ্য হাসে তবে তা সুখের না বরং কষ্টের, অরণ্য পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে। ঝড়ের পূবর্ভাস দেখা যাচ্ছে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি বা অন্য কেনো যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি খুব অল্প চলাচল করে, এর মধ্যে বৃষ্টি আসবে যার জন্য হয়তো একটা গাড়ি ও নাই। ইনায়ার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠছে, এমন বৈরী আবহাওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ কঠিন।

ইনায়া অরণ্যর কাছে আসে রাস্তায় গাড়ি দেখা যাচ্ছে না, যা হয়তো ইনায়ার চিন্তার কারণ। তবে এই মূহুর্তে রাস্তায় থাকা নিরাপদ না, অরণ্য ইনায়ার কাছে এগিয়ে আসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে –

“- ইনায়া অল্প দূরে একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি না থামা অবধি সেখানে বসা যাক। এই বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি পাওয়া যাবে না, আর গ্রামের রাস্তার যা অবস্থা হেঁটে বাড়ি ফিরা ও যাবে না।

অরণ্যর কথা শুনে ইনায়া বিরক্ত হয় এই লোক তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে তাকে কাছে ডেকে নিবে, আবার সময় সুযোগ হলে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। তবে এই সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ও সঠিক কাজ হবে না, ইনায়া বিরক্তি নিয়ে রাস্তা থেকে অল্প দূরে থাকা চায়ের দোকানের উদ্দেশ্য যাএা করে। অরণ্য তার পিছনে হেঁটে সেখানে যায়, দোকান বন্ধ হয়তো বৃষ্টির কারণে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে গেছে এর মালিক। তবে বাহিরে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে সেখানে বৃষ্টির মধ্যে ঠায় নেয় ইনায়া আর অরণ্য।

চৌধুরী বাড়িতে সকলে খাবার খাওয়ার জন্য নিচে আসে, ইভান ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করে এরপর অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিজে চলে যায়। অরুণা বেগম, নাতাশা, আর মিলন সাহেব খাবার খেতে বসেছেন। ইভান সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে এরপর টেবিলে বসে যায়। অরুণা বেগম ইভানের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখে মুখে কালো দাগ পড়ে গেছে, মনে হয় সারারাত ঘুমায় নাই। অরুণা বেগেমের তার প্রতি মায়া হয়, ইভানের অবস্থা এমন কেনো হয়ে গেছে তার কারণ ওনার অজানা নয়।

কিন্তু সময় আর সুযোগ একবার যদি মানুষের হাত থেকে চলে যায় তবে তা ফিরিয়ে নিয়ে আসা অসম্ভব। তবে ইভানের জীবন এমন করে শেষ হয়ে যেতে দিবে না, ওনি মা হয়ে ধ্বংসকারী হতে পারে না। অরুণা বেগম বলে –

“- ইভান তোমার কি রাতে ভালো করে ঘুম হয় নাই?চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো?

অরুণা বেগমের কথা শুনে ইভান শান্ত গলায় বলে –

“- হঠাৎ করে আমার বিষয়ে এতো চিন্তা করা কবে থেকে শুরু করে দিলে? আর অফিসের জরুরি ফাইল চেক করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়।যার জন্য ঘুম সম্পূর্ণ হয় নাই.

ইভান উত্তর দিয়ে আবার খাওয়া শুরু করে অরুণা বেগম একবার মিলন চৌধুরীর দিকে তাকায়, মিলন সাহেব চোখ দিয়ে ইশারা করে ওনাকে। অরুণা বেগম বলে –

“- অফিসের কাজেের সাথে সাথে নিজের উপর ও খেয়াল রাখতে হয়। আচ্ছা শুনো আমার বন্ধু রাইমার মেয়ে প্রভা ও বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এই দেশে আসবে আজ। কাল থেকে আমাদের অফিস জয়েন করবে “।

অরুণা বেগমের কথা ইভান এতো সিরিয়াসলি নেয় না সে খাওয়া দাওয়ার উপর মনোযোগ দেয়। ইভান বলে –

“- বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমাদের কোম্পানি জয়েন করার কি দরকার? আর অফিসে এখন লোকের প্রয়োজন নাই শুধু শুধু ঝামেলা করার কি খুব প্রয়োজন?

“- প্রভা নিজের যোগ্যতায় কাজ করতে চাই, যার জন্য আমাদের অফিস জয়েন করবে। আর তুমি না বললে তোমার কাজের প্রেশার যাচ্ছে অতিরিক্ত এখন। প্রভা যদি তোমার কাজে সাহায্যে করে তাহলে তোমার আর কোম্পানির উন্নতি হবে।

“- ওকে “।

ইভান অরুণা বেগমের কথার পৃষ্ঠে কথা বলে না কারণ সে যানে, তার মাকে যতই বোঝানো হোক না কেনো ওনি সিদ্ধান্ত বদল করবে না। ইভান আর নাতাশা খাওয়া দাওয়া শেষ করে ইভান চলে যায় অফিসে। আর নাতাশা কলেজে চলে যায় অরুণা বেগম ও মিলন সাহেব বাড়িতে বসে থাকেন। এখন বাড়িতে থাকতে তাদের যথেষ্ট বোরিং ফিল হয়, শুধু তারা দুইজন ছাড়া কেউ নাই এই বাড়িতে। কতো বড়েন পরিবার ছিলো তাদের কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আজ সকলে দূরে।

অন্যদিকে বৃষ্টির গতিবেগ সময়ের ব্যবধানে আরো বেড়ে যাচ্ছে, অনেক সময় এক জায়গায় বসে ইনায়া বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। অরণ্য তা বুঝতে পারে অরণ্য বলে –

“- ইনায়া চা খাবেন?

“- না বিষ খাব “।

ইনায়া বিরক্ত হয়ে কথাটা বলে তার ভীষণ রাগ হচ্ছে অরণ্যর উপর, অরণ্য তাকে ইভানের কাছে ফিরে যেতে বললো। প্রতৈকে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ইনায়ার উপর কিন্তু তার মতামত কারো কাছে গুরুত্ব নয়। ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য বলে –

“- আমার উপর রাগ করছেন ইনায়া?

“- শুনুন অরণ্য কাটাঁ গায়ে নুনের ছিটাঁ দিতে আসবেন না। আর রাগ আপনজন উপর করা যায় আপনি কি আমার আপনজন। যদি নিজের বউকে অন্যর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার এতো শখ থাক, তাহলে বিয়ে করে ছিলেন কেনো? আপনি আর ইভান ভাই দুইজন একই কাপুরুষ “।

ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য রেগে যায় আর বলে –

“- কি বললেন আমি কাপুরুষ? ওই ইভান চৌধুরীর সাথে তুলনা করলেন আপনি?

অরণ্যর চোখে রাগ স্পষ্ট ফুটে উঠে তবে ইনায়া কম জেদি না সে বলে –

“- হুম অবশ্যই যে নিজের বউকে বিয়ের পর অন্য পুরুষের কাছে চলে যেতে বলে তাকে খাঁটি বাংলায় এই কথা বলে, যেকোন ঝগড়া বা ঝামেলায় পুরানো প্রেমিক নিয়ে খোটাঁ না দিলে কি হয় আপনাদের? ইভান ভাইয়ের সাথে অতীতে আমার বিয়ে হয়েছে এই কথা কি আপনার অজানা। সত্যি যেনে যদি বিয়ে করতে পারেন তাহলে আবার কথা কেনো শুনান?

“- আমি আপনাকে শুধু বলেছি যে এই সত্যি থেকে দূরে থাকতে, কারণ এখানে অনেক রহস্য আছে যা থেকে আপনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন.

“- আর আমি আপনার কথা কেনো শুনব? কে হন আপনি আমার? শুনন এই ইনায়া তালুকদার নিজের লক্ষ্য থেকে কখনো দূরে সরে যায় না। আর বিয়ে হয়ে গেছে বলে যে আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে এমন কি কোনো কথা আছে?

“- ইনায়া আপনি কি আমার অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেন?

“- বলেন শুনি কি অবস্থায় আছেন আপনি। শুনুন অরণ্য যদি বউয়ের সাথে কথা শেয়ার করতে না পারেন তাহলে বিয়ে করবেন না। আর যদি ডিভোর্স দেওয়ার খুব শখ হয় তাহলে সরাসরি বলে দিবেন, বাজারে পণ্যর মতো এমন বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

অরণ্য যানে ও না সে ইনায়ার শরীরে কতটা রাগ তুলে দিয়েছে, অরণ্য শান্ত গলায় শ্বাস নেয় এরপর বলে –

“- আই এম সরি ইনায়া, বিশ্বাস করেন তখন ইভানের কথাটা বলেছি অন্য কিছু মিন করে না। বিয়ের আগে আপনি ইভানকে ভালোবাসতেন.

“- হুম কিন্তু তা বিয়ের আগে ইভান ভাইয়ের প্রতি আমার হৃদয়ের এক কোণে জমানো অনুভূতি রয়েছে, কিন্তু তার মানে এই না যে আপনি আমার স্বামী কথাটা ভুলে যাব। বিয়ে কোনো মজা বা নাটক না যে দুইদিন পর পর বিয়ে করব, আপনি আমার স্বামী তাই সংসার আপনার সাথেই করব সারাজীবন “।

ইনায়া কথাটা শুনে অরণ্যর হাসি আর ভালোলাগা দুইটাই কাজ করে, অরণ্য হাসি মুখে বলে –

“- ওকে থাকেন সারাজীবন। তবে ভবিষ্যতে যেই ঝড় আসুক না কেনো আপনাকে আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, বিশ্বাস করে সারাজীবন হাত ধরে রাখতে হবে।

“- হুম অবশ্যই থাকব। তবে শাফায়াত মামার মৃত্যুর রহস্য আমি যানব “।

ইনায়ার রাগের পরিমাণ শান্ত হয়, অরণ্য চায়ের দোকানের ভিতরে চলে যায়। সেখানে দোকানদার উপস্থিত নাই, দোকান খোলা যার জন্য অরণ্য ভিতরে ঢুকে যায়। এরপর ও চুলায় গরম পানি দেয়, ইনায়া হাত দিয়ে বাহিরে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখছে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর অরণ্য দুই কাপ চা বানিয়ে ইনায়ার সামনে নিয়ে আসে, ওর মুখের সামনে ধরে বলে –

“- ম্যাডম রাগ করে না থেকে চা খান। এই অরণ্য কিন্তু খুব ভালো চা বানাতে পারে, অবশ্য সব রান্নায় করতে পারে “।

ইনায়া অরণ্যর হাত থেকে চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয়, চায়ে এক কাপ চুমুক দেয় সত্যি অরণ্য দারুণ চা বানাতে পারে। ইনায়া বলে –

“- আপনি এতো সুন্দর চা বানানো কোথা থেকে শিখলেন?

“- ছোটবেলা যখন আম্মু স্কুলে চলে যেত, তখন সায়মা আর আমার জন্য রান্না করা লাগত। আর আম্মুর স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরে আসলে অনেক মাথা ব্যাথা করত, যার জন্য আমি চা বানিয়ে প্রতিদিন তাকে দেয়।

ইনায়া অরণ্যর মুখে তার মায়ের কথা শুনে অবাক হয়। অরণ্য আর রেহানা বেগমের একসাথে কাটানো মূহুর্তের বিষয়ে সে কখনো শুনে নাই। ইনায়া আগ্রহ নিয়ে বলে –

“- আপনার আম্মু চাকরি কেনো করত? আর আম্মু আপনার সাথে ছোটবেলা কথা বলত? তাহলে এখন কেনো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে?

“- আমার আব্বু মারা যায় অনেক আগেই যার জন্য সংসার চালানোর জন্য চাকরি করতে হয় আম্মুর। আর ছোটবেলা আম্মু অনেক আদর করত আমাকে, সায়মা চেয়ে বেশি ভালোবাসত। কিন্তু হঠাৎ করে একজন এসে সব কেঁড়ে নেয় আমাদের জীবন থেকে, আর তার শাস্তি স্বরূপ তাকে মৃত্যু উপহার দিয়েছি তাকে “।

ইনায়া অরণ্যর মুখে মৃত্যু কথাটা শুনে বলে –

“- কে সব কেঁড়ে নিয়েছে সবকিছু? তার নাম কি? আর আপনি কি খুনি?

“- আপনার মামা শাফায়াত সব কেঁড়ে নিয়েছে।আর হুম আমি খুনি আপনার মামার খুনি, এক্সিডেন্টে আপনার মামা মারা যায় না বরং আমার লোক তাকে খুন করেছে।

#চলবে

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_২৬ [ অরণ্যর অতীত ]

আকাশ থেকে তখন গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বাতাসে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির তীব্রতা যদিও এখন কমে যাচ্ছে, প্রকৃতি আবার শান্ত রূপ ধারণ করছে। শহরের অরণ্যর বাড়িতে সায়মা নিজের রুমে বসে আছে, বাড়িতে এখন কোনো মানুষ জনের উপস্থিত নাই। যার জন্য সম্পূর্ণ বাড়ি শূন্য, সায়মার দরজার বাহিরে হঠাৎ করে কারো কণ্ঠ শুনা যায়। সায়মা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দরজার কাছে এগিয়ে যায়, এরপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেয়। দরজার বাহিরে রেহানা বেগম দাঁড়িয়ে আছে, এমন অসময়ে রেহানা বেগমের উপস্থিতি সায়মাকে উত্তলা করে তুলে। রেহানা বেগম নিজের রুম থেকে সচারাচর বের হন না, অতিরিক্ত জরুরি কোনো প্রয়োজন ছাড়া। সায়মা বলে –

“- আম্মু তুমি এখানে? কোনো জরুরি কথা বলার ছিলো?

রেহানা বেগম দরজায় সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সায়মাকে ভালো করে দেখতে থাকে, সময় কত দ্রু পরিবর্তন হয় তার মেয়ে আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে। বিয়ে হয়েছে সংসার হয়েছে, আর এখন ও অন্য একজন সন্তানের বাচ্চার মা হবে। সায়মার গর্ভকালীন সময়ে ও মা হয়ে রেহানা বেগম কোনো দায়িত্ব পালন করেন নাই, রেহানা বেগম কি নিজের সন্তানের উপর বড্ড বেশি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। রেহানা বেগম শান্ত স্বরে বলে –

“- কেনো সায়মা? কোনো জরুরি কাজ ছাড়া কি তোমার রুমে আসার অনুমতি আমার নেই?

রেহানা বেগমের এমন কথা শুনে সায়মা বলে –

“- না আম্মু তুমি আমার রুমে সবসময় আসতে পারবে। আসলে তুমি কখনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া, কথা বা রুমে আসো না আমার তাই জিজ্ঞেস করেছি “।

রেহানা বেগম শান্ত হয়ে সায়মার কথা শুনে, তার সাথে কথা বলার সময় সায়মার মধ্যে জড়তা কাজ করছে। প্রতিটা মেয়ে তার মনের সকল কথা নিজের মায়ের সাথে, কিন্তু সায়মার কথার বলার মধ্যে অস্বস্তি, জড়তা, আর ভয় কাজ করে। রেহানা বেগম তা লক্ষ্য করে, ওনি এগিয়ে যান সায়মার কাছে তার মাথায় হাত রাখে। সায়মা নিজের মাথায় মায়ের হাত অনুভব করে, তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল চলে আসে। প্রায় অনেকদিন পর নিজের মায়ের আদুরে হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে সায়মা, ছোটবেলা ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে রেহানা বেগম অরণ্যর সাথে কথা বলে না।

সায়মা মনে পড়ে যায় ছোটবেলা তাদের মধুর সৃতিময় দিনের কথা, একসাথে জীবন যুদ্ধে লড়াই করা তার ভাই, মা,আর সায়মার কষ্টের দিনের কথা। রেহানা বেগম বলে –

“- সায়মা নিজের মাকে মাফ করে দিও, মা হিসাবে তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি। ভালো থেকো তুমি “।

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে কষ্ট হয় সায়মার, তাদের জীবনের শুধু এক অতীতের জন্য সব শেষ হয়ে গেলো।সায়মা নীরবতা ভেঙে জবাব দেয় –

“- আম্মু তুমি কি অরণ্য ভাইয়াকে কখনো মাফ করতে পারবে না? অতীতে যা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে আবার একবার নিজের সন্তানকে ক্ষমা করে দিতে? আর কতো শাস্তি দিবে ভাইকে?

সায়মার কথা শুনে রেহানা বেগম বলে –

“- সব ভুলের ক্ষমা হয় না সায়মা। আর কিছু শাস্তি কখনো অবসান হয় না। সন্তান যদি অপরাধ করে তাহলে মা হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া আমার দায়িত্ব “।

মায়ের কথার উত্তরে সায়মা আর কোনো কথা বলে নাই, কারণ সে যানে তার মা ঠিক কতটা জেদি। যদি হাজার বার অনুরোধ করে তবুও অরণ্যর করা ভুল, রেহানা বেগম কখনো ক্ষমা করবেন না। রেহানা বেগম বলে –

“- অরণ্য আর ইনায়া? গত তিনদিন ধরে ওদের কথা বার্তার কোনো আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না?

“- হ্যাঁ ইনায়ার নানার বাড়ি রূপনগর সেখানে বেড়াতে গিয়েছে। রূপনগরে ইনায়ার মামা শাফায়াত তালুকদারের মৃত্যুর বিষয়ে কি যেনো জানতে গিয়েছে?

সায়মার মুখ থেকে শাফায়াত নাম শুনে রেহানা বেগম চমকে যায়, ওনার শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে যায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ইনায়ার মামা শাফায়াত, আর অরণ্য শাফায়াত মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য রূপনগর গ্রামে গিয়েছে। যাকে নিজের হাত খুন করেছে তার মৃত্যুর রহস্য সে যানতে চাই। অরণ্য কি করতে চলছে তা রেহানা বেগম বুঝতে পারছে না, তবে মনে হচ্ছে অরণ্য কোনো সাংঘাতিক গেইম খেলছে। হঠাৎ করে তার শএু ইনায়াকে বিয়ে করা? তার মামার খুনের রহস্য উদঘাটন করার পিছনে অরণ্যর কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। কোথাও অরণ্য আড়াল থেকে সব ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে না তো?

চায়ের দোকানে ইনায়া আর অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে, অরণ্যর চোখ মুখ একদম শান্ত কিন্তু ইনায়ার চোখে অবিশ্বাস, সন্দেহ, ঘৃণার সংমিশ্রণ রয়েছে। শাফায়াত খুনি অরণ্য? ইনায়ার কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না, কতো সহজে নিজের অপকর্মের কথা বলে দিয়েছে অরণ্য। আর তার চোখ মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে খুন করে ও তার মধ্যে কোনো অপরাধ বোধ কাজ করছে না। ইনায়া বলে –

“- কেনো খুন করেছেন শাফায়াত মামাকে?

অরণ্য তার ঠোঁটে মৃদু হাসি বজায় রেখে শান্ত স্বরে উত্তর দেয় –

“- আপনার শাফায়াত মামা আমার বাবাকে খুন করেছে?

অরণ্যর কথা শুনে ইনায়া যথেষ্ট অবাক হয়, শাফায়াত অরণ্যর বাবাকে কি করে খুন করবে? বা কেনো খুন করবে? আর অরণ্য বাবা এক্সিডেন্ট মারা যান তাহলে এখানে শাফায়াত কি করে খুনি হতে পারে? ইনায়া বলে –

“- শাফায়াত মামা আপনার বাবাকে খুন করেছে মানে? আপনার বাবা তো এক্সিডেন্ট মারা গেছে? তাহলে মামা কি করে খুনি হতে পারে?

অরণ্য আবার শান্ত স্বরে উত্তর দেয় –

“- শাফায়াত ও তো এক্সিডেন্ট মারা গেছে? তাহলে আপনি কেনো তার খুনির খোঁজ করছেন?

ইনায়া এখন বুঝতে পারে অরণ্য সত্যি তার মামার খুনি? যেমন করে শাফায়াত খুন করার অন্য এক্সিডেন্টের নাটক সাজিয়েছে অরণ্য? ঠিক একরকম করে অরণ্যর বাবা মুরার চৌধুরীর খুন করে এক্সিডেন্টের নাটক সাজানো হয়েছে। অরণ্য ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে মুখ এখনো শান্ত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি যেনো মনে হচ্ছে সে খুনের কথা না বরং কোনো রূপকথার গল্প বলছে। ইনায়া এমন অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে অরণ্য বলে –

“- বৃষ্টি থেমে গেছে, বাড়ি ফিরে চলুন ইনায়া।

অরণ্যর কথা শুনে ইনায়ার মুখে এবার হাসি ফুটে উঠে, সে বলে –

“- তাহলে আবার প্রমাণিত হয়ে গেলো অরণ্য রাজ চৌধুরী স্বার্থপর। শুধু নিজের স্বার্থর জন্য আমাকে বিয়ে করেছেন? এসএস কোম্পানির খাবারের পণ্য বিষ মিশিয়ে হাজারো অসহায় বাচ্চাদের মেরে ফেলেছেন। চৌধুরী বাড়ির সকলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে বিয়ে করেছে৷ ঘৃণা হয় আপনার চেহারা দেখে আমার? আমি ডিভোর্স চাই আপনার থেকে? মুক্তি চাই এমন খুনি আর স্বার্থপর মানুষের থেকে “।

ইনায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই অরণ্যর ওকে পাশে থাকা দেয়ালের সাথে চেপে ধরে, অরণ্যর শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। অরণ্য ইনায়ার গাল চেপে ধরে শক্ত করে এরপর বলে –

“- কি বললেন আপনি ইনায়া অরণ্য চৌধুরী স্বার্থপর তাই না, তাকে ছেড়ে চলে যাবেন ডিভোর্স দিবেন। এতো সহজ সবকিছু। আর কি বললেন অরণ্য চৌধুরী স্বার্থপর ? এই অরণ্যকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করেছে ওই চৌধুরী পরিবার।

“- মিলন চৌধুরী আমার মা আর বাবার বিয়ে মেনে নাই কারণ আমার মা গরীব ছিলেন বলে, তারা পালিয়ে বিয়ে করেছেন বলে। কিন্তু নিজের বউয়ের বন্ধাবীর মেয়ে তাদের বাড়ির কাজের লোক ছিলো, তার সাথে ঠিকই নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছে। অথচ নিজের ভাইয়ের বিয়ে মেনে নিতে পারে নাই তাদের সন্তানদের জায়গা দেয় নাই চৌধুরী বাড়িতে। আমার বাবার মৃত্যুর পর আপনি যানেন কোথায় থেকেছি আমরা, এই অরণ্য তার মা বোন সবাই বস্তিতে থাকত। সারাদিনে একবার খাবার জুটত না কপালে, এমন দিন ও গেছে যখন আমরা পানি খেয়ে থেকেছি শুধু।

“- কিন্তু তখন আপনার ভালো বাবা আর মামণি চৌধুরী পরিবারের ব্যবসা থেকে আসা টাকা দিয়ে রাজকীয় টেবিলে বসে খাবার খেত। আমার বাবাকে খুন করেছে আপনার মামা, এই দুইহাতে নিজের বাবার কবরে মাটি দিয়েছি আমি। বারো বছর বয়সে নিজের বাবার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে কবরে গিয়েছি, তখন কোথায় ছিলেন মিলন চৌধুরী। বিধবা হয়ে চাকরি করেছে আমার মা সমাজের মানুষের কুৎসিত কথা সয্য করেছে আমার মা। হাজারো পুরুষ বাজে নজর দিয়েছে আমার মায়ের দেহে, তবুও নিজের সন্তানদের জন্য স্কুলে চাকরি করত আমার মা।

“- চৌধুরী বাড়ির এক বউ যখন যখন নিজের সন্তান দের নিয়ে জীবন সংগ্রামে কষ্ট করে, নিজের চরিত্র নিয়ে মানুষের কাছে কথা শুনে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। তখন অন্য এক বউ চৌধুরী বাড়ির মহলে বসে সোনার গয়না পড়ে রাজ রানির মতো থেকেছে। রেহানা চৌধুরী আর অরুণা বেগম দুইজনে চৌধুরী বাড়ির বউ ছিলো তাহলে আমার মাকে কেনো সব কষ্ট সয্য করতে হয়েছে। আমার বাবা এক্সিডেন্ট মারা যাওয়ার পর তার কাফনের কাপড় কিনার মতো টাকা ছিলো না, অন্যদিকে তার ভাই হাজার হাজার দামী কাপড় পড়েছে। আমার বাবার মৃত্যুর সময় তার জানাযার সময় একবারের জন্য ও তাকে শেষ বারের মতো দেখতে আসে নাই মিলন চৌধুরী।

“- ইভান চৌধুরী রাগ করে বিদেশে চলে যায়, কিন্তু বিদেশ গিয়ে সে পড়াশোনা করেছে লন্ডনের সবচেয়ে দামী কলেজে। সেখানে এসি রুম, দামী গাড়ি, দিয়ে চলাচল করেছে অন্যদিকে আমি সাধারণ একটা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। তখন টিফিনের সময় খাওয়ার মতো টাকা ছিলো না, রোদ হোক বা বৃষ্টি সবসময় হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। ইভান চৌধুরী আর অরণ্য চৌধুরী মধ্যে পার্থক্য ছিলো বলুন, তাদের রক্ত এক বংশ এক তাহলে জীবন অন্যরকম কেনো?

“- চৌধুরী পরিবারের ব্যবসা আমার দাদুর ছিলো ওনি মারা যাওয়ার সমস্ত সম্পত্তি তার দুই সন্তানের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা। তাহলে মিলন চৌধুরী কি করে একা সব বাড়ি গাড়ির মালিক হতে পারে, আজ ওনি তার পরিবর্তে ইভান চৌধুরীকে বিজনেস সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছে কিন্তু এই বিজনেস কি শুধু একা ইভান চৌধুরী? আমার কি অংশ নেই নিজের দাদার সম্পত্তির উপর বলুন ইনায়া?

“- একজন বস্তি থেকে উঠে আসা অনাথ ছেলে কি করে এই শহরেরে সবচেয়ে বড়ো বিজনেস ম্যান হলো, তা কি আপনি জানতে চেয়েছেন ইনায়া? ইভান চৌধুরী বিদেশ থেকে এসে নিজের বাবার কোম্পানির এমডি হয়ে গেছে? কিন্তু আমি কলেজ লাইফ থেকে টিউশনি করে, কাজ করে টাকা জমিয়ে একটু একটু করে ব্যবসা শুরু করেছি। পাঁচ টাকা ও দেয় নাই চৌধুরী পরিবার আমাকে, অথচ নিজের সন্তানকে সমগ্র বিজনেস দিয়ে দিয়েছে।

“- ইনায়া আপনার সাথে বিয়ে পর ইভান কতো খারাপ ব্যবহার করেছে, আপনাকে কাজের লোক বলে অপমান করেছে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি বিয়ের পর কি কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি, আপনার মায়ের পরিচয় নিয়ে কথা শুনিয়েছি। সবসময় সম্মান দিয়েছে নিজের বউয়ের মর্য়াদা দিয়েছি, তবুও আপনি ইভান চৌধুরীকে ভালোবাসেন। যে পুরুষ আপনাকে ঘৃণা করে, আপনাকে তালাক দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে আপনি ভালোবাসেন। কিন্তু যে আপনাকে সম্মান করে, সবসময় বিপদে আপদে আগলে রাখে, ভালোবাসে তাকে আপনি ঘৃণা করেন।ওয়াও।

“- আসলে ইভান চৌধুরী ভাগ্য সবসময় ভালো, ও না চাইতেই সব পেয়ে গেছে আর আমি অভাগা অরণ্য হাজার কান্না করে ও কিছু পাই না।

অরণ্যর কথা শুনে ইনায়ার খারাপ লাগে, অরণ্যর চোখে পানি এসে যায়। আজ বিয়ের পর প্রথমবার অরণ্যের চোখে পানি দেখছে ইনায়া, ইনায়া বলে –

“- অরণ্য আমি শুধু “।

“- চুপ করুন ইনায়া। আমি যানি আপনি সারাজীবন ইভানকে ভালোবাসেন আর আমাকে ঘৃণা করবেন। মিলন চৌধুরী নিজের ভাইয়ের সমস্ত সম্পত্তি কেঁড়ে নিয়েছে তবুও সে স্বার্থপর হলো না, অরুণা বেগম নিজের দেবরের বউয়ের সব গয়না ছিনিয়ে নিয়েছে তবুও সে স্বার্থপর না, ইভান চৌধুরী নিজের বউকে অন্য কারো বিয়ে দিয়ে দিলো তবুও সে স্বার্থপর না। শুধু এই অরণ্য স্বার্থপর কারণ সে নিজের বাবার খুনির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে,নিজের বোনকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে, কষ্ট করে সফল হয়েছে শহরের বড়ো ব্যবসায়ী হয়েছে তাই না “।

“- অরণ্য “।

“- ইনায়া আপনাকে এই কথা বলতে চাই নাই। কিন্তু কেনো যানি আপনার মুখে স্বার্থপর কথাটা শুনে কষ্ট হয়েছে। আসলে কি যানেন আমার ভাগ্য সবসময় খারাপ যে মাকে বিলাসবহুল জীবন দিলাম সেই মা আজ আমাকে ঘৃণা করে, যেই বোনের পড়াশোনার জন্য নিজের রক্ত পানি করে টাকা রোজগার করলাম, তাক৷ ভালো পরিবারে বিয়ে দিলাম সেই বোন আজ আমার সাথে সারাদিন একবার ও কথা বলে না। যেই বউকে বিয়ে করে ঘরে তুললাম, সম্মান দিলান, মর্য়াদা দিলাম সে আজ অন্য কাউকে ভালোবাসে। অবশেষে সবার জন্য সব করে ও নিকৃষ্ট হয়ে গেলাম আমি। ইনায়া এই অরণ্য রাজ চৌধুরী কি এতো খারাপ?

“- আপনি কি এসএস কোম্পানির খাবারে বিষ মিশিয়ে মানুষকে হত্যা করেছেন অরণ্য?

“- ইনায়া যে নিজেই খাবারের কষ্টে ছটফট করেছে, সে অন্য বাচ্চাদের বিষ খায়িয়ে মেরে ফেলতে পারে। এর পিছনে অন্য কেউ রয়েছে? যার পরিচয় আপনাকে যানতে হবে?

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_২৭ [ নতুন জীবন সঙ্গী ]

বিকাল চরটা বাজে পাঁচ মিনিট আকাশে বৃষ্টির বেগ কমে গেছে, প্রকৃতি এখন শান্ত হয়ে গেছে। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে আসে ইভান, অজানা কারণে তার মন বসছে না অফিসে। যার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছায় ইভানের গাড়ি, ইভান গাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়িতে ভিতরে ঢুকে যায়। বিকালে বাড়ির সকলে ঘুমে থাকে যার জন্য এখন বাসার ড্রয়িং রুমে কোনো মানুষের উপস্থিতি নাই। ইভান সিঁড়ি দিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করে, তবে তার রুমে যাওয়ার আগে নজর যায় ইনায়ার রুমে।

ইনায়ার রুমের দরজা খোলা, বিয়ের পর ইনায়া এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর এই রুম সবসময় বন্ধ থাকে। তবে আজ খোলা কেনো ইভানের মনে সন্দেহ হয়। ইনায়া আর অরণ্য হানিমুন থেকে কি ফিরে এসেছে? এরপর তারা এই বাড়িতে বেড়াতে আসতে পারে। ইভান রুমের ভিতরে যায়, সেখানে খোলা দরজা হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। রুমের মধ্যে কারো অনুপস্থিতি নেই, তবে ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। ইভান কৌতূহল নিয়ে সেইদিকে তাকিয়ে দেখে, ওয়াশরুমের দরজা খুলে এক মেয়ে বের হয়ে আসে।

ওয়াশরুমের দরজার সামনে থাকা মেয়েটা অপরিচিত ইভানের কাছে, এই বাড়িতে তাকে কখনো দেখে নাই সে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসা নারী আর কেউ না প্রভা, অরুণা বেগমের বন্ধুর মেয়ে। প্রভা মাএ গোসল শেষ করে বের হয়ে আসে, বিদেশ থেকে চৌধুরী বাড়িতে ফিরেছে সে দুপুর তিনটার সময়। প্রভা তার ভেজা চুল মুছতে থাকে আর বাহিরে বের হয়ে আসে, হঠাৎ তার রুমের মধ্যে কোনো পুরুষকে দেখে থমকে যায়। প্রভা বলে –

“- কে আপনি? আমার রুমে কি করছেন? অপরিচিত কোনো মেয়ের রুমে ঢুকতে হলে যে অনুমতি নিতে হয় তা আপনার যানা নেই?

ইভান এতোখন প্রভার দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে এখন প্রভার কথা শুনে তার ধ্যান কাটে। ইভান নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে বলে –

” – আমার বাসায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন আমি কে? আর এই রুম আপনার না ইনায়ার? আপনি এই রুমে কি করছেন? আর কে আপনি?

প্রভা ইভানের কথার উত্তরে বলে –

“- আমার নাম প্রভা। অরুণা বেগমের বন্ধাবীর মেয়ে “।

প্রভার কথা শুনে ইভানের মনে পড়ে অরুণা বেগম তাকে সকালে বলেছে তার বন্ধুর মেয়ে আসবে, নাম মনে হয় প্রভা। তবে ইভানের যতদূর মনে পড়ছে প্রভার কাল বিদেশ থেকে ফিরার কথা, ইভান বলে –

“- আপনি মায়ের বন্ধুর মেয়ে প্রভা। সকালে খাওয়ার সময় আম্মু বলেছে আপনার কথা, কিন্তু আপনার না কালকে আসার কথা। আর গেস্ট রুম রেখে ইনায়ার রুমে করছেন আপনি?

ইভানের মুখে অরুণা বেগমকে আম্মু নামে ডাকা শুনে প্রভা বুঝতে পারে, অরুণা বেগমের ছেলে ইভান। প্রভা বলে –

“- অরুণা আন্টি বলেছে আমাকে এই রুমে থাকতে দিয়েছে।

প্রভার কথা শুনে অরুণা বেগমের উপর ইভানের রাগ হয়, এই বাড়িতে এতো রুম থাকতে ইনায়ার রুমে কেনো থাকতে দিয়েছে প্রভাকে। ইনায়ার রুমে অন্য কোনো মেয়ে থাকে ইভান তা সয্য করতে পারবে না, এই রুমের প্রতিটা কোণায় শুধু ইনায়ার শরীরের ঘ্রাণ থাকবে। ইভান যথেষ্ট বিরক্ত হয় তবে সে রাগ করে না, বরং বলে –

“- ওকে আপনি থাকেন। আমি আম্মুর সাথে কথা বলব “।

ইভান কথাটা বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়, প্রভা একবার ইভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে। এরপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে রেডি হতে থাকে।

তালুকদার বাড়িতে আজ বৃষ্টি উপলক্ষে রান্না করা হচ্ছে, বৃদ্ধ আশ্রমের সকল মহিলা খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা খাবে বলে মত দিয়েছে। তালুকদার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ইনায়া আর অরণ্য, সম্পূর্ণ শরীর ভিজে গেছে। বৃষ্টি থামার পর ওরা চায়ের দোকান থেকে রওনা দিয়েছে, তবুও রাস্তায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ার কারণে শরীর ভিজে গেছে। সদর দরজায় কয়েকজন বৃদ্ধ মহিলা মুড়ি চাবিয়ে যাচ্ছে, তারা ইনায়া আর অরণ্যকে দেখে বলে –

“- ইনায়া তোমরা এমন ভিজা শরীরে কোথা থেকে আসলে?
সম্পূর্ণ শরীর ভিজে গেছে, বৃষ্টির পানি শরীরে পড়লে জ্বর আসতে পারে।

ইনায়া আর অরণ্য যথেষ্ট শান্ত চায়ের দোকানের থেকে অরণ্য আর কোনো কথা বলে নাই, ইনায়া ও যথা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করেছে। ইনায়া বলে –

“- সকাল গ্রাম ঘুরতে বের হয়ে ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়। যার জন্য শরীর ভিজে গেছে, আচ্ছা আমরা রুমে যায় জামা কাপড় পাল্টে গরম কিছু পড়ি “।

অরণ্য সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায় ইনায়া পিছন পিছন চলে যায়, অরণ্য রুমে প্রবেশ করে ওয়াশরুমে চলে যায়। ইনায়া রুমে আসে সে ওয়াশরুমের দরজ বন্ধ দেখ বুঝতে পারে অরণ্য গিয়েছে, যার জন্য ভিজা শরীরে অল্প সময় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর অরণ্য বের হয়ে আসে, ইনায়া জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। অরণ্য ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, তার শরীর ভালো লাগছে না। শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় জ্বর আসবে। ইনায়া ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখে অরণ্য বিছানায় গা ছেড়ে শুয়ে আছে।

বিকাল প্রায় চারটা বেজে গেছে এখনো অরণ্য আর ইনায়া দুপুরে খাবার খায় নাই। ইনায়া ভিজা চুল মুছতে থাকে আর শান্ত গলায় অরণ্যকে ডাক দিয়ে বলে –

“- অরণ্য আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন যে? খাবার খাবেন না? দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে চলুন খাবার খেয়ে আসি?

অরণ্য বিছানার অন্য পাশ ফিরে শুয়ে আছে অরণ্য বলে –

“- আমার খিদে নেই, খাব না আমি “।

অরণ্যর কথা শুনে ইনায়া আবার বলে –

“- আমি কি খাবার নিয়ে আসব রুমে? খাবার না খেয়ে ঘুমালে শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে। অরণ্য “।

ইনায়ার কথার উত্তর অরণ্য প্রদান করে না, সে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ইনায়া অরণ্যর সাথে আর কথা বলে না, সে রেডি হয়ে নিচে চলে যায়। বৃদ্ধ মহিলা রাতের খাবার রান্না করছে, ইনায়া রান্না ঘরে যায়। ইনায়া বলে –

“- নানু মণি দুপুরের খাবার কি এখনো বাকি আছে কিছু?

বৃদ্ধ মহিলা রান্না রেখে এগিয়ে আসে আর বলে –

“- দুপুরের খাবার তুমি আর অরণ্য খাও নাই বলে আলাদা করে রেখে দিয়েছি। তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি “।

বৃদ্ধ মহিলা খাবার নিতে যায় রান্না ঘরে এরপর ইনায়ার হাতে খাবার দেয়। ইনায়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে খাবার নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। রুমে প্রবেশ করে ইনায়া অরণ্য এখনো আগের মতো করে শুয়ে আছে, ইনায়া খাবার হাতে করে সামনে যায় অরণ্য। খাবার টেবিলের উপর রাখে অরণ্যর মাথায় হাত দেয়, গায়ে জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। ইনায়া বলে –

“- অরণ্য উঠুন খাবার নিয়ে এসেছি আমি। খাবেন চলুন।

ইনাযার কথার জবারে অরণ্য কোনো উত্তর প্রদান করে না, ইনায়া আবার ডাক দেয় –

“- অরণ্য আপনার শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় জ্বর আসবে উঠুন খাবার খাবেন চলেন “।

ইনায়ার অনেক বার বলার পর অরণ্য উঠে, চোখ মিলে তাকিয়ে দেখে ইনায়াকে। অরণ্য বলে –

‘- নিজ হাতে খেতে ইচ্ছা করছে না। খাবার খায়িয়ে দেন “।

ইনায়া অরণ্যর কথা অনুসারে অরণ্যর মুখে খাবার তুলে দেয়, অরণ্য মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইনায়ার মধ্যে কোনো সংকোচ নাই সে সাধারণ ভাবে খাবার খায়িয়ে দিচ্ছে অরণ্যকে। অরণ্য বলে –

“- ইনাযা আপনি শান্তি দেন বা শাস্তি দেন, কিন্তু কোনোদিন ছেড়ে যাবেন না “।

#চলবে