তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
6

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_৩৬ [ অরণ্যর মৃত্যু ]

অরণ্যর প্রতিটা কথা ইনায়ার মনে ভয়ের সৃষ্টি করে, অরণ্যর কথার মধ্যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। অরণ্য মানুষটা যতটা শান্ত, তার বলা প্রতিটা কথা ঠিক ততটা অশান্ত। ইনায়ার মনে ভয় জাগে অরণ্যকে হারানোর, জীবনে চলার পথে সে অনেক প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার জীবনে আগন্তুক বা নতুন বসন্তের মতো আগমন হয়েছে অরণ্য নামে মানুষটার, যার আগমণ যদি ও হঠাৎ কিন্তু সে চাই যেনো মানুষটা হাজার বছর স্থায়ী থাকে তার জীবনে। ফোনের অপর পাশে অরণ্য ও শান্ত, যেনো কোনো নীরবতা অন্ধকার হয়ে ছেয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। ইনায়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে

“- অরণ্য আমাকে ছেড়ে যাবেন না কখনো আপনি? কথা দেন যায় হয়ে যাক এই ইনায়ার থেকে দূরে চলে যাবেন না আপনি?

ইনায়ার ভীতু আর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ শুনে অরণ্য বুঝতে পারে ইনায়া ভয়ে পাচ্ছে, হয়তো তাকে হারানোর ভয়। মানুষ মূলত অভ্যাসের দাস, যার সাথে অল্প সময় থাকে তার মায়ায় পড়ে যায়। মনের মধ্যে তার প্রতি ভালোবাসার জন্ম না দিলে ও, তার মায়ায় সে জড়িয়ে যায়। অরণ্য দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে –

“- যদি দূরে চলে যায় আপনার থেকে, হারিয়ে যায় কোনো অজানা গন্তব্যে, তবে কি আমার জন্য আপনি কান্না করবেন ইনায়া। বলুন না ইনায়া কষ্ট হবে আপনার আমার জন্য?

অরণ্যর কথা ইনায়ার মনে ভয়ের মাএা দিগুণ বাড়িয়ে দেয়, অরণ্য এমন করে কথা কখনো বলে নাই। আজ অরণ্যর প্রতিটা কথায় ইনায়ার কষ্ট হচ্ছে, অরণ্যকে হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কি করে? অরণ্য তার সমগ্র অস্বস্তিতে মিশে রয়েছে, যাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা তার দ্বারা অসম্ভব। ইনায়া বলে –

“- অরণ্য আপনি কোথাও যাবেন না? বিয়ে করেছেন আমাকে বউ হই আমি আপনার , যদি ছেড়ে চলে যাবেন তাহলে কবুল বলে বিয়ে করে ছিলেন কেনো?

ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য হাসে, তবে বর্তমান পরিস্থিতির কথা অনুমান করে তার হাসি মিলিয়ে যায়। অরণ্য বলে –

“- হুম বউ আপনি আমার। যদি পুর্নজন্ম বলে পৃথিবীতে কোনো শব্দ থাকে, তাহলে হাজার জন্মে আমি শুধু আমাকে চাইব আমার জীবনে। তবে এই জন্মের জন্য আমাকে বিদায় নিতে হবে আপনার জীবন থেকে?

অরণ্যর কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই ইনায়া বলে উঠে –

“- অরণ্য আপনাকে ছাড়া আমি বাচঁব না। এই ইনায়া মারা যাবে আপনাকে ছাড়া।

অরণ্য মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে –

“- ভালোবাসেন আমাকে ইনায়া?

অরণ্যর ছোট কথার উত্তর ইনায়ার জানা নেই, অরণ্যর প্রতি তার মায়া রয়েছে। অরণ্য তার সমস্ত অস্বস্তি জুড়ে মিশে রয়েছে, এইটাকে কি ভালোবাসা বলে। তবে কি ইনায়া অরণ্যকে ভালোবাসে? কিন্তু ইভানের জন্য তার হৃদয়ের এক কোণে ভালোবাসা রয়েছে, যা মিথ্যা হয়ে যাবে না। ইনায়াকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অরণ্য বলে –

“- ওকে ইনায়া আমার অফিসের মিটিং রয়েছে বাই “।

অরণ্য কথাটা বলে ফোন রেখে দেয়, ইনায়া যখন অরণ্যর ফোন রাখার কথা শুনে কিছু বলতে যাবে। এর আগেই অরণ্য কল কেটে দেয়। ইনায়া আবার ফোন দেয় অরণ্যকে কিন্তু অরণ্য রিসিভ করে না। অফিসের মিটিং সে জয়েন করে, অন্যদিকে ইনায়ার মনে আর মাথায় অরণ্যর বলা কথাটা ঘুরতে থাকে। দুপুর প্রায় দুইটা বাজে, রান্না ঘরে থেকে এসেছে ইনায়া কিন্তু গোসল করা হয় নাই। ইনায়া বিছানা থেকে উঠে গোসল করে, এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে সায়মা আর রেহানা বেগম খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে তার জন্য।

রেহানা বেগম আজ প্রথম টেবিলে খাবার খেতে এসেছে, ইনায়া খাবার টেবিলে যায়। সায়মার সাথে অল্প সময় কথা বলে, এরপর সকলে খাওয়া দাওয়া শুরু করে। খাবার খাওয়ার মধ্যে সায়মা বলে –

“- ভাবী অরণ্য ভাইয়া কি দুপুরে খাবার খেয়েছে? ভাইয়া কখন আসবে অফিস থেকে?

“- অরণ্য অনেক দিন পর অফিসে গিয়েছে যার জন্য অনেক কাজ জমা রয়েছে। সব কাজ শেষ করতে প্রায় অনেক রাত হয়ে যাবে, আর দুপুরে একটা মিটিং রয়েছে যা শেষ করে খাবার খাবে “।

“- ওকে “।

সকলে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করে, রুমে চলে যায় রেহানা বেগম এখন তার মেয়ের অনেক খেয়াল রাখে। ইনায়ার সাথে সায়মার আগে অল্প কথা হতো, কিন্তু এখন সায়মার সাথে সে সায়মার প্রতিটা বিষয়ে খেয়াল রাখার চেষ্টা করে। রুমে গিয়ে ইনায়া বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, প্রায় রাত সাত টার সময় তার ঘুম ভাঙে। অন্যদিকে ইভান আর প্রভা মিটিং শেষ করে, অফিসের সকল কাজ করে বাড়িতে ফিরে। তারা এক গাড়িতে করে চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছায়, কিন্তু ইভান সবসময় চুপচাপ থাকে৷ প্রভা ইভানের মন খারাপ করে থাকার কারণ যানে, যার জন্য তাকে বিরক্ত করে নাই।

ইনায়ার সাথে ইভানের যে সম্পর্ক রয়েছে তা প্রভা অজানা। চৌধুরী বাড়িতে ফিরে ইভান রুমে চলে যায়, রাতের খাবার খাবে না আজ সে তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছে৷

[ রাত প্রায় : ০ ৭ টা ]

ইনায়া ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে, ওয়াশরুমে থেকে বের হয়ে আসে। ইনায়ার মন যেনো কেমন করছে, অরণ্যকে এতো কল দিয়েছে কিন্তু অরণ্য রিসিভ করে নাই। আর দুপুরে অরণ্যর বলা কথা সব ইনায়ার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ইনায়া ফোন হাতে নেয় অরণ্যকে কল দেওয়ার উদ্দেশ্য। অন্যদিকে অরণ্য গাড়ি ড্রাইভ করছে, আজ ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে আসে নাই। অফিসের সকল মিটিং বাদ দিয়ে দিয়েছে, কেনো জানি আজ ইনায়ার কথা বড্ড মনে পড়ছে। তার মায়ের মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে, ছোট বোনের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।

অরণ্য যানে তার সাথে এখন কি হতে চলছে, তবুও তার প্রাণ বাঁচানোর বিন্দু মাএ চেষ্টা বা ইচ্ছা নাই। কারণ সে যানে একমাত্র তার মৃত্যুর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে শেষ বারের মতো ইনায়ার সাথে কথার বলার জন্য অরণ্য ফোন দিব, এর আগেই ইনায়া তাকে ফোন। অরণ্য ফোন রিসিভ করে বলে –

“- ইনায়া “-

অরণ্যর কণ্ঠ শুনে ইনায়া তাড়াহুড়ো করে বলে –

“- অরণ্য আপনি কোথায়? বাড়ি ফিরবেন কখন?

ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য জবাব দেয় –

“- ইনায়া আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো আমার?

“- কি?

“- আমি আপনাকে ভালোবাসি ইনায়া। অনেক বেশি ভালোবাসি, যদি আমি আজ এক্সিডেন্ট মারা যায় তবে আপনি ইভানকে বিয়ে করে নিবেন। কিন্তু আমি আপনাকে অন্য কারোর সাথে কি করে দেখব ইনায়া, আমি মারা গেলে ও কষ্ট হবে আমার। ইনায়া সারাজীবন কি আমার হয়ে থাকবেন?

অরণ্যর কথার মানে ইনায় বুঝতে পারে না, ইনায়া বলে –

‘- কি বলছেন আপনি অরণ্য? আর এক্সিডেন্ট মানে?

ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য হাসে, হয়তো এইটা তার শেষ হাসি। ইনায়া অরণ্যকে ভিডিও কল দেয়, অরণ্য রিসিভ করে। অরণ্য ইনায়ার দিকে অল্প সময় তাকিয়ে থাকে, জীবনে এই মেয়ের প্রতি তার ঘৃণা সরে কখন ভালোবাসা জন্মেছে তা তার জানা নাই। বিয়ের পর যখন কবুল বলেছে তখন থেকে বউ নামক শব্দটার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে ইনায়াকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে কষ্ট হচ্ছে আজ ইনায়ার জন্য। অরণ্যর জন্য তার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, অরণ্য আবার বলে –

“- ভালোবাসি ইনায়া ভালোবাসি “।

ইনায়া অরণ্যর কথায় কোনেন উত্তর দিতে যাবে, এর আগেই একটা ট্রাক এসে অরণ্যর গাড়িকে ধাক্কা দেয়। অরণ্য মনে হয় যানতো এমন হবে, ট্রাকের ধাক্কার গাড়ি উল্টো যায় প্রায়। অরণ্য বলে –

“- আমার মা আর বোনের খেয়াল রাখবেন। এই জন্মে আপনার সাথে সংসার করা হলো না। তবে শুধু একটা আপসোস রয়ে গেলো ভালোবাসি কথাটা আপনার মুখ থেকে শুনা হলো না।

অরণ্যর কথা বলার মধ্যেই গাড়ি ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, ফোনের ডিসপ্লে ফেটে যায়। যার জন্য ইনায়া অরণ্যকে দেখতে পায় না। তবে অরণ্যর মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, যা দেখে ইনায়া চিৎকার দিয়ে উঠে বলে –

“- অরণ্য “।

#চলবে

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নুসাইবা_এহসানা_হিয়া
#পর্ব_৩৭ [ অরণ্যর মৃতদেহ ]

রাত প্রায় নয়টা, আকাশে থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সূর্যের রোদে যখন সমগ্র শহর জ্বলসে যাচ্ছে, তখন শান্তির পরশ হয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে। ঢাকা গাজীপুর শহরের একটা রাস্তায় গাড়ির দুঘর্টনা হয়েছে। গাজীপুর জনবহুল এলাকা থাকার কারণে, এখানে দুর্ঘটনা ঘটনার সাথে সাথে লোকজনের ভিড় মানে। শহরের সবচেয়ে বড়ো বিজনেস ম্যান অরণ্য রাজ চৌধুরী আজ রাত দুইটার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে এডমিট হয়েছে। শহরের প্রতিটা সংবাদ মাধ্যম আর গণমাধ্যমে এখন এই কথা ভাইরাল। ঘটনা স্থলে পুলিশ সহ হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে গেছে। পুলিশ তার উদ্ধারকারী সংস্থার লোক দিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে অরণ্যর রক্তাক্ত দেহ বের করে আসছে। অরণ্যর মাথা থেকে রক্ত যেনো নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে, তার হাতে পায়ে সহ শরীরের অনেক অংশ ছুলেঁ গেছে।

উদ্ধারকারী সংস্থা অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস চেক করার জন্য, নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে দেখে। জীবিত রয়েছে, তবে ওর শরীর থেকে আর মাথা থেকে যেমন করে রক্ত পড়ছে। যদি এখুনি ব্লাড যাওয়া বন্ধ না হয়, তাহলে তাকে বাঁচানো অসম্ভব। প্রায় তিরিশ মিনিট আগেই তার এক্সিডেন্ট হয়েছে, হঠাৎ করে ট্রাক এসে জোরে তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। যার কারণে অরণ্যর মাথা গাড়ির সামনের অংশের সাথে লাগে, আর গাড়ি উল্টো যাওয়ার কারণে তার পায়ে বা হাতে ব্যাথা পায়। অরণ্যর মাথার এতো আঘাত পেয়েছে যার কারণে তার বাঁচা প্রায় অসম্ভব। যদি অরণ্য বেঁচে যাও হয় সে সারাজীবন কোমায় থাকবে না হয় প্যারালাইসেস হয়ে যাবে।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে আসে, অরণ্যর নিথর দেহ সেখানে উঠানো হয়। তার মুখে দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক লাগলো হয়, এম্বুলেন্স থাকা ডক্টর তার পার্লস চেক করছে বারবার। মাথা থেকে রক্ত বের হওয়া এখনো বন্ধ হচ্ছে না, শরীরে অন্য সব জায়গা থেকে ও রক্ত পড়ছে। অরণ্যর অবস্থা কতটা খারাপ, তা হয়তো ডক্টর নিজে ও বলতে পারবে না। প্রতি মূহুর্তে শরীরের অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, তার শরীর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে। এম্বুলেন্স অবস্থিত একজন বলে –

“- স্যার অরণ্য রাজ চৌধুরী কি অবস্থা?

“- অবস্থা ভালো না। যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয়, তবে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ওনার মৃত্যু হবে “।

শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী অরণ্য রাজ চৌধুরী, প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে তার নাম ছাপে। মাএ পঁচিশ বছর বয়সে, তার ব্যবসায়িক দক্ষতা, বুদ্ধি আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস উঠা নামা করছে, জীবনের প্রতিটা পুরুষের সপ্ন থাকে তার পরিবার সন্তান নিয়ে ছোট একটা সংসার গড়ে তুলার।অরণ্যর এতো সৌভাগ্য কখনো ছিলো না, তার জীবনে সুখ কথাটা খুব একটা সয্য হয় না। তবে তার জীবনে ইনায়ার আগমনের পর সে সুখের সপ্ন দেখেছে, ভালোবাসার মানুষের সাথে সারাজীবন থাকার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এক ঝড়ে সব শেষ হয়ে গেছে তার জীবন থেকে।

গ্রামে থাকা অবস্থায় অরণ্য একবার বলে ছিলো সে অভাগা কথাটা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ছোটবেলা বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে, বিনা অপরাধে মায়ের ঘৃণার কারণ হয়েছে। বোনের সাথে দুরত্ব তৈরি হয়েছে। তবুও তার প্রতি থাকা সকলের অভিযোগ মেনে নিয়েছে। তার জীবনে হঠাৎ করে আসা ঘূর্ণিঝড়ের মতো আগমন হয়ে ছিলো এক রমণীর যার নাম ইনায়া। প্রায় অনেক সময় তার সাথে শএুতার সম্পর্ক ছিলো তার। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার সাথে বিয়ে হয় অরণ্যর। বিয়ে বাড়ির সকলের সামনে কবুল বলে শএু থেকে বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা দেয় সে। প্রতৈকে তার শএুর সাথে খারাপ কথা বলে, তাকে আঘাত করে বিয়ের আগে অরণ্যর পরিকল্পনা ছিলো এমন কিছু করার।

কিন্তু বিয়ের দিন যখন প্রথমবার লাল শাড়ি পড়া বধূ বেশে রূপবতী কন্যাকে দেখেছে। তার মুখ থেকে তিনবার কবুলের মতো পবিত্র ধ্বনি শুনেছে। যখন তার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করেছে৷ তখন শএুর প্রতি থাকা সমস্ত ঘৃণা তার মন থেকে মুছে গেছে, শুধু সামনে হাত ধরে থাকা মানুষটাকে বউ মনে হয়েছে। যার কান্না করা অশ্রু ঝরা দুই আঁখি, তার পড়নে বেনারসি, আর তার নিষ্পাপ মুখ সব অরণ্যর মনে মুগ্ধতা তৈরি করছে। প্রথমবার কোনো নারীর চোখ তাকে আর্কষিত করেছে, তার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অরণ্য।

ভাগ্যের কি নিরর্মম পরিহাস, শুধু জীবনে এইটুকু সুখের কামনা করেছে সে তাও পূর্ণ হলো না। নিজের প্রিয় শএুর সাথে ঘর বাঁধা হলো না, তার মুখ থেকে একবার ভালোবাসি শব্দ শুনার ইচ্ছা পূর্ণ হলো না। রাতের আকাশে নিজের প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকার সৌভাগ্য আর বুঝি এই জন্মে তা হলো না। অরণ্যর শ্বাস নিশ্বাস দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, সে দ্রুত গতিতে নিশ্বাস নেওয়ার কারণে তার বুক উঠানামা করছে। এম্বুলেন্স থাকা ডক্টর অরণ্যর হাতের পার্লস চেক করে সামান্য ভয় পেয়ে তার পাশে থাকা লোককে বলে –

“- অ– অরণ্য “।

চৌধুরী বাড়িতে অরুণা বেগম আর মিলন সাহেব খাওয়া দাওয়া শেষ করেছে মাএ। প্রায় প্রায় নয়টা বেজে তিরিশ মিনিট, মিলন সাহেব খাবার খাওয়া শেষ করে ছোফায় দিয়ে বসলেন। আজ রাত আটটার খবর শুনা হয় নাই, তবে সাড়ে নয়টার সময় আর কি খবর শুনবে। তবুও ওনি টিভি অন করলেন, খববের চ্যানেলে গেলেন খবর শুনবে বলে। অন্যদিকে অরুণা বেগম টেবিল থেকে সকলের এটো খাবার রান্না ঘরে নিয়ে রাখছেন। অরুণা বেগম যখন খাবারের প্লেট হাতে নিলেন, তখন মিলন সাহেব মাএ খবের চ্যানেলে লেগেন। খবরের চ্যানেলে যাওয়ার সাথে সাথে একজন বলে উঠে –

“- ব্রেকিং নিউজ আজ রাত নয়টার সময় গাজীপুর শহরে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী অরণ্য রাজ চৌধুরী। পুলিশ গাড়ির ভিতর থেকে তার দেহ বের করেছে, তবে পুলিশের কথা অনুসারে বর্তমানে অরণ্য রাজ চৌধুরীর অবস্থা খুব খারাপ। দুর্ঘটনায় ওনার মাথা থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।

টিভিতে থাকা লোকের মুখে অরণ্য রাজ চৌধুরীর নাম শুনে অরুণা বেগমের হাত থেকে খাবারের থালি পড়ে যায়। মিলন সাহেব ছোফা থেকে উঠে বসে পড়ে, অরুণা বেগম টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে অরণ্য রাজ চৌধুরী নামটা জ্বল জ্বল করছে। এবং অরণ্যর ছবি রয়েছে, অরুণ মা বেগম পাশে থাকা চেয়ার শক্ত করে ধরে বলে –

“- মিলন অরণ্য “।

মিলন চৌধুরীর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন হঠাৎ করে অরণ্যর এক্সিডেন্ট হয়ে যাওয়ার কথা শনে ওনি সম্পূর্ণ শকড। নাতাশা সিঁড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে, সে তাড়াতাড়ি করে ইভানের রুমের দিকে ছুটে যায়। রুমের মধ্যে অন্ধকার করে বসে আছে ইভান, হঠাৎ দরজার মধ্যে কারো শব্দ শুনে ইভান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়৷ বাহির থেকে নাতাশার কণ্ঠ শুনা যাচ্ছে, ইভান বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে। সে নাতাশাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নাতাশা হাঁপাতে থাকে বলতে থাকে –

“- ইভান ভাইয়া, অরণ্য ভাই এক্সিডেন্ট করছে। ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো না, বাঁচবে কি না সন্দেহ রয়েছে “।

হঠাৎ করে নাতাশার কথা শুনে ইভান অবাক হয়ে যায়, এরপর যখন বুঝতে পারে অরণ্য এক্সিডেন্ট করছে তখন সে বলে উঠে –

“- হেয়াট “।

ইভান নাতাশার সাথে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে যায়, অরণ্যর সাথে তার শএুতা রয়েছে কারণ সে ইনায়ার স্বামী। কিন্তু অরণ্যর সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে ইভানের,। তার ছোট চাচার ছেলে অরণ্য, তার ছোট ভাই। অরুণা বেগম আর মিলন সাহেব সময় নষ্ট না করে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ে। খবরে বলা হয়েছে অরণ্যকে সিটি হাসপাতালের উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

হাসপাতাল রোডের দিকে এক গাড়ি চলছে, যার মধ্যে একজন নারী কান্না করে যাচ্ছে। অন্যজনের হাত পা অনবরত কাঁপছে সে আর কেউ না ইনায়া। তার গলা শুকিয়ে আসছে, বুকের ভিতর ভয় জমা হয়েছে। গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে, পাশের সিটে রেহানা বেগম কান্না করছে। মা তার সন্তানের প্রতি যতো রাগ করে থাকুক, তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেখ। তবুও সে সন্তান, ইনায়া যখন অরণ্য বলে চিকৎকার দেয় তখন রেহানা বেগম ছুটে যায় তার রুমে। এরপর গাড়ি থেকে বের হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্য, সায়মা এখনো কিছু যানে না। তার এই অবস্থায় এখন যদি অরণ্যর এক্সিডেন্টের কথা শুনে তবে সে উত্তেজিত হয়ে যাবে। যা তার সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।

ইনায়ার হাত পা ভীষণ কাঁপছে, সে বারবার ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আজ রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছে না, কখন যে সে হাসপাতালে পৌঁছে অরণ্যকে দেখবে সে আর অপেক্ষা করঅে পারছে না। ইনায়ার সমস্ত শরীর পাথর ন্যায় হয়ে যাচ্ছে, রেহানা বেগম কান্না করছে কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। ভাগ্যার উপর তার করুণা হচ্ছে, কি অদ্ভুত তাই না ছোটবেলা একটা মানুষের জীবন থেকে সব কেঁড়ে নিয়ে ও শান্তি হলো না তার ভাগ্যের। কিন্তু যদি এইবার অরণ্য তার জীবন থেকে চলে যায়, তাহলে সে কি করে বাঁচবে। অরণ্য ছাড়া ইনায়ার কোনো অস্বস্তি নাই।

[ প্রায় রাত ১০ : ০০]

হাসপাতালে এসে গাড়ি থামে ইনায়ার, চৌধুরী বাড়ির সকল সে পৌঁছায় একই সময়। অরুণা বেগম আর রেহানা বেগমের মধ্যে আগে দেখা হয় নাই,বউভাতের অনুষ্ঠানেন দিন রেহানা বেগম রুমে ছিলেন। তবুও রেহানা বেগমের কান্না থামাতে অরুণা বেগম তার কাছে যায় তাকে সান্তনা দেয়। ইনায়া, ইভান, মিলন সাহেব, আর নাতাশা হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়। হাসপাতালে একজন ডক্টর কেবিন থেকে বাহির হয়েছে, ইনায়া তার কাছে ছুটে যায় আর বলে –

“- গাজীপুরে একটু আগে যে এক্সিডেন্টে হয়েছে সেই রোগীর কি অবস্থা? ওনাকে কোন কেবিনে রাখা হয়েছে?

ডক্টর বলে –

“- ওহ হ্যা গাজীপুর থেকে একজন এক্সিডেন্ট রোগী নিয়ে আসা হয়েছে। তবে ওনি বেঁচে নাই, এম্বুলেন্স করে নিয়ে আসার সময় ওনি মারা গেছেন। ওনার লাশ মর্গে রাখা হয়েছে “।

ডক্টরের কথা শুনে ইনায়ার শরীর @অবশ হয়ে যায়, সে শুধু শুনতে পায় যে “- ওনি আর বেঁচে নেই, মারা গেছেন “। ইনায়ার শরীর অবশ হয়ে পড়ে যেতে যাবে, তার আগেই ইভান তাকে ধরে বলে –

“- ইনায়া “।

ইনায়া শুধু মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে –

“- আমার অরণ্য মারা গেছে “।

গল্প শেষ হয় নাই এখনো। সো নেগেটিভ কমেন্ট করবেন না।

,, জীবন এতোটাই অনিশ্চিত যে,,
,, শেষ কথা, শেষ দেখা হবার আগেই,,
,, মানুষ হাতের নাগালের বাহিরে চলে যায়,,

#চলবে

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#লেখনীতে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_৩৮ [ অরণ্য কি সত্যি মারা গেছে ]

রাত প্রায় দশটা। চারদিকে রাতে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালে এক করিডোরে একজন মানুষের আত্মানাথ শুনা যাচ্ছে। একজন মা তার ছেলে হারানোর বেদনায় কান্না করছে, পৃথিবীর সকল মায়া, ভালোবাসা আবেগ তার কাছে এখন তুচ্ছ মরীচিকা। মৃত্যু কথাটা এই দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর আর সত্যি। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার কতো প্রয়াস, সৌন্দর্য, রূপ আর অহংকারের মিথ্যা মায়ায় তারা বন্ধি। কিন্তু সকল মায়া, মোহ, সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে একদিন মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হবে। বহমান জীবন আর
স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে অজানা গন্তব্যর উদ্দেশ্য রওনা দিবে।

হাসপাতালে করিডোরে কান্না করা এক মায়ের নাম রেহানা বেগম। যার সন্তানের মৃত্যুর খবর ওনি শুনেছেন, সমস্ত হাসপাতাল জুড়ে এখন তার কান্নার আত্মনাথ শুনা যাচ্ছে। মায়ের ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না! যে সন্তানের সাথে গত দশ বছর যাবত ওনি কথা বলেন নি, যার মুখ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নাই। আজ তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে ওনি পাগলের মতো কান্না করে যাচ্ছেন। মানুষ বেঁচে থাকলে তার প্রতি সকলের কতো অভিযোগ, নিরপরাধ হয়ে ও ঘৃণার পাএ হয়। কিন্তু মার যাওয়ার পর তার চরম শএু ও তার জন্য কান্না করে, সমাজের মানুষ তাকে ভালো লোক ছিলো বলে সমম্বধোন করে।

ডক্টর অরণ্যর মৃত্যুর কথা বলে চলে যায়, রেহানা বেগম কান্না করছেন। অরুণা বেগম তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডক্টরের কথা শুনে ইনায়া পাথরের ন্যায় শান্ত আর পাষাণ হৃদয়ের মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখ পানির বিন্দুর ফোঁটা দেখতে পাওয়া গেলো না। ডক্টরের বলা কথা ইনায়ার কানে পৌঁছায়, কিন্তু তবুও সে নিরব। ডক্টরের বলা কথাটা আবার নিজের মনে আওড়াতে থাকে, তার অরণ্য কি সত্যি মৃত? ইনায়ার মনের মধ্যে থাকা কথার কোনো উত্তর জানা নেই তার। কিন্তু তার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, প্রচুর ব্যাথা করছে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি তার এখন নেই।

ডক্টরের কথা শুনে মিলন সাহবে মাথায় হাত দিয়ে সিটে বসে পড়ে, অন্যদিকে ইভান ইনায়ার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনায়ার মনের অবস্থা ইভান বুঝতে পারে, ইনায়া তার পাশে থাকা দেয়ালে হাত রাখে। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি তার শরীরে এখন নাই, শরীর ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে। ইনায়া চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে, অরণ্যর হাস্যকর মুগ্ধতায় ভরা চেহারা বার বার ভেসে উঠছে। ইনায়ার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, সে পড়ে যাবে তার আগেই ইভান ছুটে আসে তার কাছে। ইভান তখন ইনায়াকে ধরতে যাবে, তার আগেই ইনায়া প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠে –

“- ছুঁয়েন না আমায় ইভান ভাই। আমার স্বামী জীবিত থাকুক বা মৃত, শুধু সে ছাড়া আমার শরীর টার্চ করার অনুমতি অন্য কোনো পুরুষকে আমি দিব না। দূরে সরে যান “।

ইনায়া তার কণ্ঠ দিয়ে অন্য কোনো শব্দ উচ্চারণ করার শক্তি হয় নাই, সে অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে তার জ্ঞান থাকা অবধি অরণ্যর নাম শুধু তার কণ্ঠ ধ্বনিতে উচ্চারিণত হয়েছে। পাশে থাকা চেয়ারে ইনায়ার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল, আজ যদি অরণ্য থাকত তবে তাকে ধরত। ইনায়ার সব বিপদে তার স্বামী পাশে থেকেছে, ইনায়া মনে হয় আজ ও তার প্রতাশ্যা করছে। ইভান নিজের হাত গুটিয়ে নেয়, সামনে থাকা নারীকে আজ তার অন্য কারো স্ত্রী মনে হচ্ছে। অন্য পুরুষের সম্পত্তির উপর ইভান হক জমাতে চাই নাই, তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা তার মন থেকে লোভ পেয়েছে। ইভান ইনায়ার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে থাকল, এরপর দূরে থাকা নাতাশার নাম ধরে ডাক দেয়।

সকলের থেকে দূরে নাতাশা আর অরুণা বেগম রয়েছে, রেহানা বেগম কান্না করছে। মূলত অরুণা বেগম আর নাতাশা তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে, ভাইয়ের ডাক শুনে নাতাশা কার কাছে আসে। ইভান বলে –

“- নাতাশা তুমি ইনায়াকে অন্য কোনো কেবিনে নিয়ে যাও। ইনায়া অজ্ঞান হয়ে গেছে “।

” লাশঘর ” দেয়ালে স্পষ্ট খোদায় করে লেখা রয়েছে কথাটা। লাশঘরের চারপাশে এক অদ্ভুত নিরবতা কাজ করছে। কি থমথমে পরিবেশ আর অদ্ভুত ভয়ংকর সব আওয়াজ তার কানে ভেসে আসছে। “ লাশঘরের“ সামনে একজন দারোয়ান বসে রয়েছে, তার হাতে একটা লাঠি। দারোয়ান কম তাকে দেখে কোনো ভয়ংকর পিশাচ মনে হচ্ছে। দারোয়ান সামনে থাকা দুইজন পুরুষ আর একজন নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। এরপর গম্ভীর স্বরে বলে –

“- কে আপনরা? কোনো মানুষ মারা গেছে আপনাদের? লাশ লাগবো?

দারোয়ানের গম্ভীর ভাষায় বলা কথা শুনে ইভান সামান্য ভয় পায়। জীবনে তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে, বহু দেশ, শহর, ভ্রমণ করেছে। কিন্তু আজ প্রথম লাশঘর নামে এক অদ্ভুত জায়গায় তাকে আসতে হয়েছে, তার পাশে রয়েছে মিলন সাহেব আর নাতাশা। হাসপাতালে এক ফাঁকা রুমে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইনায়া শুয়ে রয়েছে, তার শরীর দুবর্ল ডক্টর তাকে ভিটামিন জাতীয় ইনজেকশন দিয়েছে। আর রেহানা বেগম এখনো কান্না করে যাচ্ছেন, অরুণা বেগম তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। হাসপাতালে থাকা এক ওয়ার্বয় বলেছে, মৃত বক্তির লাশ মর্গে রাখা হয়। যার জন্য ইভান চৌধুরী আর মিলন সাহেব এখানে এসেছে, অরণ্যর পরিবারে কোনো পুরুষ সদস্য নাই। নাতাশা তাদের সাথে এসেছে, যদি কোনো খারাপ সংবাদ হয় তাহলে তার বাবাকে সামলাতে হবে।

ইনায়ার অজ্ঞান ফিরতে এখনো সময় রয়েছে, ডক্টর যা ইনজেকশন দিয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টার পর তার অজ্ঞান আসবে। দারোয়ানের কথার জবাব মিলন সাহেব দেয় –

“- প্রায় দুই ঘণ্টা আগে অরণ্য রাজ চৌধুরী নামে, একজন মানুষ এক্সিডেন্ট মারা গেছে। তার পরিবারের সদস্য আমরা, তার মৃতদেহ কোথায়?

দারোয়ান মিলন চৌধুরীর কথা শুনে বলেন –

“- এই জায়গায় হাজার হাজার মানুষের লাশ আসে প্রতিদিন, একটু আগে একটা মানুষ মারা গেছে তার দেহ এখানে নিয়ে এসেছে। যান দেখুন ওনি আমার আত্মীয় কি না?

ইভান আর মিলন সাহেব দারোয়ানের সাথে ভিতরে ঢুকে যায়, নাতাশা তাদের সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু ইভান তাকে নিষেধ করে দেয়, নাতাশা বাচ্চা, ও ভয় পাবে। লাশঘরের ভিতরে ইভান শুকনো ঢুক গিলে, সারা রুম বরফ ন্যায় শীতল। শরীরের হাড্ডি মাংস জমে যাওয়ার উপক্রম। মগ্নের মধ্যে প্রায় শত খানিক লাশ রয়েছে, সবার শরীর সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো রয়েছে। মিলন সাহেব আর ইভান এগিয়ে যায়। দারোয়ান তাদের একটা লাশের কাছে নিয়ে যায়, যার সমস্ত শরীর সাদা কাফনের কাপড় দিয়ে আবৃত। সদ্য মারা যাওয়ার কারণে রক্তের লাল বিন্দু বিন্দু সাদা কাপড়ে উপর রয়েছে। মৃতদেহের কাছে গিয়ে ইভানের শরীর ভয় বা কষ্টে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়।

মিলন চৌধুরী খুব শান্ত, কিন্তু সেটা শুধু তার বাহিরে। মৃতদেহর দিকে এক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখেন ওনি। আজ থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে, ঠিক এমন এক এক্সিডেন্ট তার ছোট ভাই মারা গেছে। অরণ্যর বাবা নিলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগমের যখন বিয়ে হয়, তখন মিলন চৌধুরী তা মেনে নেন নাই। কারণ রেহানা বেগম গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন, আর নীলয় মিলন সাহেব না জানিয়ে বিয়ে করে ছিলেন। যার জন্য রাগে অভিমানে নীলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগমকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কিন্তু মিলন সাহেব তার ভাইকে অনেক ভালোবাসত। শুধু তার অভিমান আর বংশের মর্যাদার রক্ষার জন্য ওনি এমন করেছেন।

চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নিলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগম বস্তির এক বাসায় ঠাঁই নেয়। যা মিলন সাহেব তার গোপন সূএের মাধ্যমে যানতে পারে। নীলয় সাহেব তখন বেকার ছিলেন কোনো চাকরি না করার কারণে তার সংসার অভাব দেখা দেয়। মিলন সাহেব গোপনে তার বন্ধুর এক কোম্পানিতে চাকরি করার সুযোগ করে দেয়। যদিও নীলয় সাহেব বা রেহানা বেগম এর বিষয়ে কিছুই যানত না। তাদের সংসার সুখে শান্তিতে চলতে থাকে। কয়েক বছর পর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় অরণ্য আর সায়মা।

অরণ্যর যখন দশ বছর বয়স তখন নীলয় সাহেব এক্সিডেন্ট মারা যান। মিলন চৌধুরী ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে বস্তিতে ছুটে আসে। কিন্তু তখন অরণ্য আর রেহানা বেগম মিলন সাহেবকে তার বাবার হত্যাকারী মনে করত। সম্পত্তির লোভে মিলন সাহেব তার আপন ভাইকে হত্যা করেছে এই কথা তাদের মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এরপর মিলন সাহেব তাদের সামনে আসে নাই, তার ভাইয়ের মৃত্যুর জানাযা ওনি পড়েছেন কিন্তু সেটা অরণ্যর চোখের অগোচরে। সকলে যখন নীলয় সাহেবের কবর দিয়ে চলে যান। তখন মিলন সাহেব তার ভাইয়ের কববের কাছে যায়। মৃত ভাইয়ের কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে কান্না করে।

স্বামীর মৃত্যুর পর আবার রেহানা বেগমের সংসারে অভাব ঘনিয়ে আসে। অরণ্য বয়স তখন মাএ দশ বছর আর সায়মার ছয় বছর। যুবতী বিধবা রেহানা বেগম শিক্ষিত ছিলেন যার জন্য ওনি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। মিলন সাহেব তখন রেহানা বেগমকে একটা স্কুলে চাকরি দেয়। তাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে যার বিষয়ে তারা কিছু যানত না। অরণ্য যখন ভার্সিটতে পড়ে তখন সে নতুন বিজনেস শুরু করার চেষ্টা করে। মিলন চৌধুরী সবসময় অরণ্যর প্রতিটা কার্যকলাপে নজর রাখে। অরণ্যর ব্যবসায় তাকে সাহায্য করে।

অতীতের কথা মনে হতেই মিলন চৌধুরীর চোখে জল চলে আসে। ওনি লাশের উপর থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে সাদা কাপড় সরান। এরপর যা দেখে তাতে ওনি অবাক হয়ে যান।
নাতাশা অনেক সময় ধরে তার বাবা আর ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তারা বাহির হচ্ছে না তার মনে ভয় করছে। প্রায় পাঁচমিনিট পর মিলন সাহেব আর ইভান বেরিয়ে আসে। দরজার কাছে আসতেই নাতাশা উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে –

“- আব্বু কি দেখলে তোমরা? যে লোক মারা গেছে ওনি অরণ্য ভাইয়া? না কি অন্য কেউ?

নাতাশার কথা শুনে মিলন সাহেব ওর মাথায় হাত রেখে বলে –

“- ওই মৃতদেহ অরণ্যর না “।

মিলন সাহেবের কথা শুনে নাতাশা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এরপর দৌড়ে যায় রেহানা বেগম আর অরুণা বেগমকে এই খবর দিতে।

#চলবে