তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
4

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_৩৯ [ ইভান ইনায়ার নতুন জীবন একসাথে ]

সময় প্রায় রাত বারোটা হাসপাতালের এক বেডে ইনায়া অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে রয়েছে, তার হাতে ক্যানেলা দেওয়া। অতিরিক্ত চিন্তা আর হঠাৎ করে এমন দুর্ঘটনার কথা শুনে ইনায়ার পেশার কমে যায়, যার কারণে তার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ডক্টর তাকে স্যালাইন দিয়েছে। ইনায়ার জ্ঞান ফিরে আসে সে পিটপিট করে চোখ খুলে, সামনে এক পলক তাকিয়ে নিজেকে এক অজানা জায়গায় আবিস্কার করে। হাতে থাকা ক্যানেলার দিকে চোখে যায়, এরপর অরণ্যর এক্সিডেন্টর কথা তার মনে পড়ে। ডক্টরের মুখে অরণ্যর মৃত্যুর কথা শুনে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে, অরণ্যর কথা মনে পড়তেই ইনায়া চিৎকার দিয়ে উঠে বলে –

“- অরণ্য অরণ্য আমার অরণ্য কোথায়? আমি অরণ্যর কাছে যাব “।

ইনায়ার চিৎকার শুনে বাহিরে থাকা ইভান কেবিনের ভিতরে আসে। মূলত ইভান এতোসময় ইনায়ার কেবিনের বাহিরে তার জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু সারাদিন অনেক টার্য়াড থাকার ফলে তার শরীরের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো। যার জন্য সে বাহিরে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো, হঠাৎ করে ইনায়ার কণ্ঠ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। ইনায়া বেড থেকে নেমে যায়, তার হাতে থাকা ক্যানেলা জোরে টান দিয়ে খোলে ফেলতে যাবে তখন ইভান তার কাছে ছুটে আসে। ইভান বলে –

“- কি হয়েছে ইনায়া? কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার? শরীর কি অতিরিক্ত খারাপ লাগছে? ডক্টরকে ইনর্ফরম করব?

ইভানের কোনো কথা ইনায়ার কানে যায় না, তার চোখ শুধু অরণ্যকে খুঁজে যাচ্ছে। ইভান ইনায়ার কাছে যাওয়ার কারণে, সামান্য পিছিয়ে দুরত্ব বাড়ায় ইভানের সাথে। ইনায়া বলে –

“- অরণ্য কোথায়? আমি অরণ্যকে দেখব? ওর কাছে নিয়ে যান আমাকে ইভান ভাই?

ইনায়ার কণ্ঠে অরণ্যর নাম শুনে ইভান মৃদু হাসে। তার হাসির মধ্যে সকল বিষাদের বেদনা জড়িয়ে রয়েছে, সে তার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলেছে। সারাজীবনের জন্য সে অন্য কারো হয়ে গেছে, ভালোবাসার যুদ্ধে ইভান আজ পরাজিত সৈনিক। শত দুঃখ তার কষ্ট অন্তরে লুকিয়ে রেখে ইভান শান্ত স্বরে জবাব দেয় –

“- তোমার অরণ্য বেঁচে আছে ইনায়া। যাকে তুমি তোমার সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসো, সেই ভালোবাসার মানুষ জীবিত রয়েছে।

অরণ্যর বেঁচে থাকার কথা শুনে ইনায়ার হৃদয় জুড়ে প্রশান্তিতে ভরে যায়। তার সকল চিন্তা আর উন্মাদনা শান্ত হয়ে যায়, সে হাসি মুখে বলে –

“- সত্যি বলছেন ইভান ভাই। অরণ্য সুস্থ হয়ে গেছে। কোথায় অরণ্য ওর কাছে নিয়ে যান আমাকে। অরণ্যকে দেখব আমি “।

ইনায়ার হাসি মুখ দেখে ইভানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে। আজ থেকে ইনায়ার উপর সকল অধিকার তার মিথ্যা। অন্য পুরুষের ভালোবাসার মানুষ, আর বউয়ের প্রতি অনুভূতি তার মনে আর রাখবে না ইভান। তাদের মধ্যে থাকা সকল সম্পর্ক শেষ, তার চাচাতো ভাইয়ের প্রতি মনে আবেগ জমিয়ে রাখা তার জন্য পাপ। নিজের জীবন থেকে ইনায়া নামক মানুষটার ভালোবাসকে হারাম বলে দূরে সরিয়ে রাখে। ইভান বলে –

“- হুম চলেন ইনায়া আপনার অরণ্যর কাছে যাবো আমরা.

[রাত ১২: ১০ মিনিট ]

হাসপাতালে এক কেবিনের সামনে পায়চারি করছেন মিলন সাহেব। তার মুখে চিন্তা, ভয়, কষ্ট সবকিছুর ছাপ রয়েছে। কেবিনের ছোট জানলা দিয়ে ভিতরে থাকা রোগীর মুখ দেখার প্রয়াস করে যাচ্ছে। লাশঘর থেকে যখন মিলন সাহেব আর ইভান বেরিয়ে আসে, তখন এক ডক্টরের সাথে তাদের দেখা হয়। ডক্টর জানান অরণ্য রাজ চৌধুরীকে এক্সিডেন্টের পর তাকে এই কেবিনের সামনে রাখা রয়েছে যেখানে ওনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার অবস্থা খুব খারাপ, মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে, অরণ্যর অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে।

অরণ্যর কেবিনের সামনে উপস্থিত হয় ইনায়া, তার সাথে রয়েছে ইভান আর নাতাশা। রেহানা বেগম আর অরুণা বেগম এখন বাসায় গেছেন, নাতাশা তাদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছে যে অরণ্য সুস্থ হয়ে গেছে। কারণ রেহানা বেগম অতিরিক্ত কান্না করার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইনায়া দ্রুত এগিয়ে আসে কেবিনের কাছে এরপর বলে –

“- ভালো বাবা অরণ্য কোথায়? ডক্টর কি বলেছে?

মিলন সাহেব মুখ গম্ভীর করে বলে –

“- অরণ্যর অবস্থা ভালো না রে ইনায়া। ওর মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে। ডক্টর কেবিনের ভিতর গিয়েছে, এখনেন বের হন নাই “।

মিলন সাহেবের কথা শুনে ইনায়ার প্রতাশ্যিত মুখ চুপসে যায়, তার চোখ শান্ত হয়ে যায়। মনের মধ্যে জ্বলে উঠা আশার প্রদীপ, আবার ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। ইনায়ার চোখের মণি শান্ত, তার কানে শুধু ভেসে উঠে একটা কথা তার অরণ্য ভালো নেই। ইনায়া কথাটা মনে আওড়ালো অল্প সময়, এরপর কেবিনের দরজার সামনে যায়। কেবিনের ভিতরে থাকা দশ বারো জন ডক্টরের মধ্যে তার চোখ যায় এক নিথর দেহের দিকে। ইনায়ার মনটা বড্ড বেসামাল হয়ে যাচ্ছে, তার স্বামী নামক মানুষটার মুখটা একবার দেখার জন্য।

কিন্তু চারপাশে ডক্টররা ঘিরে রয়েছে, যার কারণে সে অরণ্যকে দেখতে পায় নাই। তবে শুধু অরণ্যর হাতটা দেখে সে, ডক্টর তার হাতে জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করছে। ইনায়া চাতক পাখির ন্যায় দীর্ঘ সময় অরণ্যর রক্ত মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় দশ মিনিট পর ডক্টর বের হয়ে আসে, মিলন সাহেব বলে –

“- ডক্টর অরণ্যর অবস্থা কেমন? ও কি সুস্থ হয়ে যাবে?

ডক্টর বলে –

“- দেখুন আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু ওনার মাথার আঘাতটা খুব ভয়ংকর, মাথার ভিতরে রক্ত জমে গেছে। আজ রাতের মধ্যে যদি অপারেশন না করা হয়, তবে ওনাকে বাঁচানো অসম্ভব “।

“- তাহলে অপেক্ষা কেনো করছেন ডক্টর? অপারেশন শুরু করেন? যতো টাকা লাগবে তত দিব। কিন্তু অরণ্য যেনো কিছু না হয় “।

“- টাকার কোনো সমস্যা হবে না সেটা আমি জানি। তবে এক্সিডেন্ট অরণ্যর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে। রাত প্রায় বারোটা এমন সময়, কোনো রক্তদান সেন্টার খোলা থাকবে না। আর ও পজিটিভ রক্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল “।

ডক্টরের কথা শুনে ইভান বলে উঠে –

“- ডক্টর আমার রক্ত ও পজিটিভ। যদি কোনো সমস্যা না থাকে তবে আমি রক্ত দিতে চাই “।
ইভানের রক্ত দেওয়ার কথা শুনে ইনায়া অবাক হয়। যে ইভান অরণ্যর নাম অবধি শুনতে পেতো না, সে তার জন্য রক্ত দিবে। রক্তের সম্পর্ক বুঝি এমনই হয়, শত ভুল রাগ অভিমান থাকুক না কেনো বিপদে আপদে একে অন্যর সাহায্য অবশ্যই করে। ইনায়া কথাটা ভেবে শত কষ্টের মধ্যে ভালো লাগে। ইভান রক্ত দেয় যতোই হোক তার ছোট ভাই অরণ্য। আর অরণ্যর সাথে তার শএুতা কি নিয়ে থাকবে। নিজের ভুল আর জিদের কারণে ইনায়াকে সে হারিয়ে ফেলেছে, অন্য তার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া জিনিসকে যত্ন করে আগলে রেখেছে তাকে ভালোবাসা দিয়েছে।

রাত বারোটার সময় হাসপাতালে অরণ্যর অপারেশনের জন্য প্রায় ছয় থেকে সাতজন ডক্টরকে দেখে অবাক হয় ইনায়া৷ এতো রাতে গ্রাম বা শহরের যেকোনো জায়গায় ডক্টর পাওয়া মুশকিল, সেখানে প্রায় ছয়জন ডক্টর উপস্থিত রয়েছে। ডক্টরদের দেখে মনে হচ্ছে তারা প্রতৈকে অনেক হাই কোয়ালিফাই, আর এর মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি ডক্টর। যেনো মনে হচ্ছে এক্সিডেন্টের ঘটনার বিষয়ে তার আগে থেকেই যানত, সব পূর্ব পরিকল্পনা। ইনায়া কতটা আর ভাবে না, অপরাশনের উপর মনোযোগ দেয়।

রাত প্রায় একটার দিকে অরণ্যর অপারেশন সম্পূর্ণ হয়। ইনায়ার চোখে ঘুম নাই, শুধু ইনায়া না প্রতৈকে জেগে রয়েছে। ডক্টর কেবিন থেকে বাহিরে বেরিয়ে আসে ইনায়া তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে –

‘- ডক্টর অরণ্যর কি অবস্থা? অপরাশেন কি সাকসেসফুল হয়েছে ?

ডক্টর বলে –

“- অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিন্তু মাথায় অতিরিক্ত রক্ত জমাট বাঁধার কারণে, অরণ্য রাজ চৌধুরী কোমায় চলে গেছেন।

ডক্টরের মুখে কোমায় চলে যাওয়া কথাটা শুনে ইনায়ার পা থমকে যায়, সে এক পা পিছিয়ে যায়। সেইদিন হাসপাতালে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কান্না করেছে সে। ইভান আর নাতাশা তাকে সান্তনা দিয়েছে, মিলন সাহেব নিজে ও পাথর হয়ে যান। ডক্টরের কথা অনুসারে অরণ্যর কোমা থেকে বের হওয়া আদৌ সম্ভব না।তার মাথায় জোরে আঘাত লাগার কারণে অতিরিক্ত রক্তপ্রাত হয়, যার ফলে হাতের এক সাইড অবশ হয়ে যায়। যদি অরণ্য কোনো দিন কোমা থেকে বের হয়, তবুও তার হাতের ডান সাইড অবশ থাকবে।

[ প্রায় দুই বছর পর ]

সময় চলে যায় তার আপন গতিতে, এই দুইবছরে ইনায়ার জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে একজন বিজনেস লেডি, তার এসএস কোম্পানির কেসের বিষয়ে অনেক ডিটেইলস সে খুঁজে বের করেছে। যার ফলে আদালতের সামনে প্রমাণিত হয়েছে ইনায়া নিদোষ, কিন্তু তবুও সে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে। চৌধুরী কোম্পানি ওর এখন যথেষ্ট সুনাম রয়েছে, অরণ্য দুইবছর পর ও কোমা থেকে বের হয় নাই।

সকালে ইনায়া অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে , আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চেহারা ভালো করে খেয়াল করছে। জীবন তার থেকে কতকিছু কেড়ে নিয়েছে তার হিসাব মিলিয়ে দেখছে, অন্যদিকে বিছানার উপর খেলা করছে এক ছোট শিশু। তার ছোট ছোট হাত টা দিয়ে বিভিন্ন খেলার জিনিস দেখছে। ছোট বাচ্চাটা ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে –

“- মাম্মা “।

ইনায়ার ভাবনার মাঝে হঠাৎ বাচ্চার কথা শুনে বিছানার কাছে যায, এরপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে –

“- কি হয়েছে আমার আম্মুটার “।

“- মাম্মা “।

#চলবে

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#কলমে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_৪০[ অরণ্য কোমা থেকে ফিরে এসেছে ]

ইনায়ার কোলে থাকা বাচ্চা তার ছোট ছোট হাত দিয়ে ইনায়ার মুখে আঘাত করছে। এতোখন ইনায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হয়েছে, তাকে কোলে নিয়ে আদর করে নি যার কারণে তার অভিমান বা রাগ হয়েছে। তাদের দুইজনের খুনসুটির মধ্যে রুমে প্রবেশ করে সায়মা, সায়মা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে –

“- আয়ান তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে মামির রুমে চলে এসেছো? মামি অফিসে যাবে রেডি হতে দাও সোনা?

সায়মা কথাটা বলে এগিয়ে আসে ইনায়া আর আয়ানের কাছে, এরপর আয়ানকে হাত বাড়িয়ে তার কোলে যাওয়ার জন্য ডাকে। কিন্তু আয়ান আরো শক্ত করে ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে, সে তার মাম্মাকে ছেড়ে যাবে না। আয়ানের এমন কাণ্ড দেখে ইনায়া আর সায়মা দুইজনে হেঁসে উঠে। সায়মা বলে –

“- কি সুন্দর মামিকে পেয়ে মা কে ভুলে গেলো। মামি একবার অফিসে যাক তখন দেখব আয়ানকে কে কোলে নেয় “।

অরণ্যর বাড়ির প্রাণ ফিরে এসেছে, সকলে এখন হাসি খুশি। প্রায় এক বছর ছয় আগে সায়মার সন্তান হয়েছে যার নাম আয়ান, আয়ানের বাবা বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগেই ফিরে এসেছে। অরণ্য কোমায় চলে যাওয়ার পর থেকে তার কোম্পানির সকল দায়িত্ব ইনায়া পালন করছে। অরণ্যর বাড়িটা এখন আগের মতো মৃত মানুষ দিয়ে ঘেরা নয়, বরং এখন প্রতৈকে হাসি খুশি। তবে সকল সুখ আর পূর্ণতার মধ্যে একজনের অনুপস্থিত সবাইকে পীড়া দেয়। যার নাম অরণ্য, ইনায়ার জীবন এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে সকালে অফিস আর রাতে বাড়ি ফিরে আসা।

দুইবছরে তার জীবন এমন করে চলছে, প্রতিটা দিন তার কাছে কয়েকশত বছরের সমান। অফিসের দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলা সব নাটক করে সে আজ বড্ড ক্লান্ত। একটু ভালোবাসার কাঙাল সে, তবে ইনায়ার অন্তের চাওয়া পাওয়া তার অন্তেরই দাফন করে সকলে মিথ্যা ভালো থাকার নাটক করে যাচ্ছে।

রেহানা বেগম এখন সংসারে এক মায়ের সকল দায়িত্ব পালন করে। আগের মতো ঘরে বন্ধী থাকেন না, বাড়িতে থাকা অবস্থায় নাতি আর মেয়ের সাথে সময় কাটান। আর বাকিটা সময় নামাজ পড়ে অরণ্যর সুস্থতার জন্য দোয়া করেন। অরণ্য কোমায় যাওয়ার পর থেকে হাসপাতালে নিয়মিত যান ওনি, কেবিনের কাছে গিয়ে অরণ্যর হাত ধরে কান্না করেন। কিন্তু অরণ্য এখন বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে গেছে, সকলের কান্না, কষ্ট তার পাষাণ হৃদয় গলাতে পারে না। সে শান্ত চুপচাপ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে, যেনো কোন মৌন ব্রত রেখেছে।

চৌধুরী বাড়ির সাথে এখন অরণ্যর পরিবারের সুসম্পর্ক হয়েছে, অরুণা বেগম আর মিলন সাহেব প্রায় এই বাড়িতে আসে। রেহানা বেগম আর সায়মা ও ওই বাড়িতে যায়,ইনায়া আর ইভান এখন বন্ধুর মতো থাকে। বিজনেস সহ অন্য বিষয়ে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা করে। ইভান আর প্রভার সম্পর্কে আগের মতো দুরত্ব নেই, একসাথে কাজ করার ফলে তারা এখন বন্ধুর মতো চলাচল করে। কখনো কোনো মানুষের অনুপস্থিততে জীবনে থেমে থাকে না, শুধু সকল কষ্ট লুকিয়ে হাসতে যানলে জীবনে সুন্দর। শহরের সবচেয়ে বড়ো কোম্পানির মধ্যে একটা চৌধুরী কোম্পানি আর অরণ্যর কোম্পানি যার নাম এআরসি “।

চৌধুরী বাড়িতে ইনায়া উপস্থিত হয়, গত কয়েকদিন ধরে অরুণা বেগম অনেক অসুস্থ। অফিসের অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে ইনায়া এতোদিন বিজি ছিলো, কিন্তু আজ সকল কাজ শেষ করে দেখা করতে এসেছে। ইনায়া এখন অরুণা বেগমের রুমে অবস্থান করছে, অরুণা বেগমের হাত ধরে বলে –

~~ মামণি তোমার শরীরের অবস্থা এখন কেমন? ডক্টর কি বলেছে?

অরুণা বেগম বলে –

“- আগের চেয়ে ভালো। ডক্টর ঔষধ দিয়েছে বলেছে নিয়মিন ঔষধ খেলে সুস্থ হয়ে যাব “।

ইনায়া অরুণা বেগমের সাথে অল্প সময় কথা বলে, অরুণা বেগম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইনায়ার মুখমণ্ডল, চেহারা সবকিছু
পর্যবেক্ষণ করে এরপর হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে। জন্ম থেকে ইনায়া মেয়েটা বড্ড অভাগা, জন্মের পর তার বাবার মৃত্যু হয়। সাত বছর বয়সী তার মায়ের অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয়, ইভানের সাথে জোর করে বিয়ে দেয় অরুণা বেগম কিন্তু সেখানে ও সুঃখ হয় না। আবার অরণ্যর সাথে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে, তবে আজ অরণ্য ও এক্সিডেন্ট করে কোমায় চলে গেছে।

অরুণা বেগমের বড্ড কষ্ট হয় ইনায়ার জন্য, মায়ের মন মেয়ে যদি কোনো কথা মুখ দিয়ে না ও বলে তবুও তা বুঝে নেয়। তার ইনায়া ভালো নেই, যা ইনায়ার চোখ মুখ দেখে ওনি বুঝে যান। শুধু সকলের সামনে মিথ্যা নাটক করে যায়, তার বান্ধবীর করা প্রমিজ সে রাখতে পারল না। অরুণা বেগমের হাত ইনায়ার মাথায় চলে যায়, আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইনায়া শান্ত হয়ে যায়, কতদিন পর আজ তার মামণির আদুরে হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে। হৃদয়ের কোণে জমে থাকা কষ্ট যেনো, তার চোখ দিয়ে পানির বিন্দুর ন্যায় ঝরে যাচ্ছে। ইনায়ার চোখে পানি দেখে অরুণা বেগম তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ইনায়া শক্ত করে তার মামণিকে জড়িয়ে ধরে আর বলে –

“- মামণি সুখ কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? আমি সমস্ত টাকা দিয়ে সুখ কিনতে চাই? সবসময় কেনো আমাকে সব কষ্ট সয্য করে হয়, কব অন্যায় বা পাপ করেছি আমি মামণি.

অরুণা বেগম ইনায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ইনায়া অঝরে কান্না করে দেয়। সে আজ বড্ড টায়ার্ড, জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিক। সামান্য সুখের আশায়, দুঃখের সমুদ্র ডুবে যাওয়া এক পরাজিত নারী। প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু সুখের মুহূর্ত থাকে, যা দিয়ে দুঃখের সময়টা সে পার করে দেয়। কিন্তু অভাগী ইনায়ার জীবনে শুধু দুঃখ, সুখ বুঝি সবার ভাগ্যে সয্য হয় না। একাকিত্ব নামক শব্দটা ইনায়ার সমস্ত অস্বস্তি জুড়ে রয়েছে, যা তার জীবনটা বিষিয়ে তুলছে। বড্ড শখ হয় ইনায়ার, সাধারণ নারীর মতো স্বামী সংসার, সন্তান নিয়ে সুখে থাকার। কিন্তু কিছু মানুষের শখ৷ শুধু সপ্ন হয়ে থেকে যায, ভাগ্য আর বাস্তবতার লড়াইয়ে নিয়মিত কাছে হেরে যায়।

মায়ের মৃত্যুর সময় যদি ইনায়া ও মারা যেতো, তবে হয়তো জীবনে এতো কষ্টের সম্মুখী হতে হত না। মৃত্যু কোনো সমাধান না, কিন্তু জীবন যদি মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে অধিক বিষাদময় হয়ে যায় তবে মৃত্যুই শ্রেয়। প্রায় এক ঘণ্টা অরুণা বেগমের সাথে সুঃখ দুঃখ সহ সব বিষয় নিয়ে কথা বলে ইনায়া। তারপর রুম থেকে বের হয়ে যায়, অফিসের কাজে ইভানের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার। কম্পিউটারে মুখ গুঁজে বসে আছে ইভান, তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি এখন কাজের উপর। হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ শুনে, কম্পিউটার থেকে মুখ না তুলেই বলে –

“- প্রভা রুমে আসার জন্য তোমার অনুমতি নেওয়ার কি দরকার? চলে আসো।

প্রভার নাম শুনে ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইভানের দিকে, এরপর মুখে একটা মিষ্টি হাসি বজায় রেখে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। কম্পিউটারে মুখ গুঁজে এখনো কাজ করছে ইভান, ইনায়া গিয়ে পাশে বসে। প্রভা সবসময় ইভানের রুমে আসে, তারা একসাথে গল্প করে, কথা বলে, কাজ করে যার জন্য ইভান মনে করেছে প্রভা এসেছে। ইভান তার পাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পারে, এরপর বলে –

“- প্রভা তুমি এমন চুপচাপ বসে আছে কেনো? কথা বলছ না?

প্রভাকে চুপচাপ থাকতে দেখে ইভান কাজ করা বন্ধ করে ফিরে তাকায়, তবে হঠাৎ করে ইনায়াকে দেখে অবাক হয়ে যায়। ইভান হয়তো ইনায়াকে প্রতাশ্যা করে নাই, ইভানের এমন মুখ করা দেখে ইনায়া হেঁসে উঠে। ইভান অবাক হয়ে বলে –

“- ইনায়া তুমি এখানে? আর প্রভা কোথায় ও আসে নাই?

“- না ইভান ভাই প্রভা আসে নাই। কিন্তু ইভান ভাই মনে হয় আপনি প্রভার জন্য, অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছেন?

ইনায়ার কথায় ইভান থতমত খেয়ে যায়, ইভান বলে –

“- না এমন কোনো বিষয় না। আসলে প্রভা বিকালে আমার রুমে আসে, কাজের বিষয়ে জানার জন্য এইজন্য মানে “।

“- আসলে মামণির অসুস্থতার জন্য কয়েকদিন ধরে আসতে চাই। কিন্তু কাজের প্রেসারে আসা হয় নাই, যার জন্য আজ চলে আসলাম। আর অফিসে কাল মিটিং রয়েছে, যার জন্য এসেছি “।

“- ওকে “।

ইনায়া আর ইভান অফিসের মিটিং বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে। প্রায় দশ মিনিট পর কথা বলা শেষ হয়, ইনাযা আর ইভানের মধ্যে এখন কোনো ধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক নাই। ইভান এখন তার কাজ আর বক্তিগত জীবন নিয়ে বিজি, ইভান যানে ইনায়া কখনো অরণ্যর জায়গায় অন্য কোনো পুরুষকে দিতে পারবে না। অসম্ভবের প্রতি অসম্ভব টান রেখে লাভ। যে মানুষ তোমার ভাগ্যে নাই, তার জন্য বৃথা চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নাই। ইনায়া ইভানের থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

চৌধুরী বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে ইনায়া, উদ্দেশ্য তার এখন হাসপাতালে যাওয়া। ইনায়া যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবে তার আগেই একজন পিছন থেকে বলে উঠে –

“- বিবাহিত মেয়ে মানুষ হয়ে ও অন্য ছেলের রুমে এতোখন থাকা কোন ভদ্র নারীর কাজ? জামাই হাসপাতালে ভর্তি মরে তো যায় নাই?

হঠাৎ এমন কথা শুনে ইনায়া দাঁড়িয়ে যায়, চৌধুরী বাড়িতে এমন কথা তাকে কে বলতে পারে সেটা সে যানে। প্রতিটা কথায় ইনায়ার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে, যা কারণে ইনায়ার আত্মসম্মানে লেগে যায়। যত তুমি চুপ করে সব সয্য করবে, ততই মানুষ তোমাকে দুবর্ল ভেবে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে। ইনায়াকে এতোখন কথা শুনানো মহিলা আর অন্য কেউ না প্রভার মা, বিদেশে এতোদিন থাকার পর ও যে একটা মানুষের মন মানসিকতা এতোটা নিচুঁ হতে পারে সেটা ওনাকে না দেখে যানত না ইনায়া। চৌধুরী বাড়িতে না আসার অন্যতম একটা কারণ হলেন ওনি। মহিলা অতিরিক্ত ফাজিল, আর অভদ্র।

প্রায় একমাত্র আগেই ওনি বিদেশ থেকে চৌধুরী বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। প্রভা যতটা ভদ্র আর শান্ত। তার মা ঠিক ততটাই অভদ্র আর বেয়াদব। এতো বয়স হয়ে যাওয়ার পর ও কোথায় কোন কথা বলতে হবে, এর নূন্যতম জ্ঞান বা বুদ্ধি ওনার নেই। প্রভার মা শায়লা বেগম ইনায়াকে একদম সয্য করতে পারে না। যার কারণ হয়তো ইভান আর ইনায়ার বিয়ের ঘটনা, নিজের মেয়ের সাথে ইভানের বিয়ে দিতে চান ওনি। ইনায়া পিছনে ফিরে শায়লা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে –

“- মিসেন শায়লা বেগম আপনি এই বাড়ির অতিথি, আর আমার মামণির বান্ধবী যার জন্য আপনাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু ইনায়ার চরিত্র নিয়ে যদি কেউ কথা বলে, তবে ইনায়া তাকে ছেড়ে দেয় না। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আপনার কোথায় কোন কথা বলতে হবে, সেটা আপনার নিশ্চয়ই জানা রয়েছে “।

ইনায়ার কথায় শায়েলা বেগম হাসে, এর মেয়ের সাথে তার শএুতা নেই। কিন্তু ইভান আর প্রভার বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা ইনায়া, স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অন্য পুরুষের সাথে সময় কাটায় সে। প্রভা খুব সহজ সরল মেয়ে, যার কারণে ইনায়ার এইসব জঘন্য খেলার বিষয়ে সে ধারণা করতে পারে না। কিন্তু শায়েলা বেগম ইনায়াকে ছেড়ে দিবেন না, অসম্ভব। শায়েলা বেগম বলে –

“- যার চরিত্র ঠিক নাই, সে আবার চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। প্রায় দশ মিনিট আগেই ইভানের রুমে গেলে, জামাই হাসপাতালে ভর্তি এইজন্য অন্য পুরুষের সাথে “।

শায়েলা বেগম কথাটা শেষ করার আগেই, ইনায়া তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। এরপর তেজ দীপ্ত কণ্ঠে বলে –

“- ভদ্র ভাষায় কথা বলেন আন্টি। আমার স্বামী অসুস্থ কিন্তু মারা যায় নাই কথাটা আমার মনে আছে৷ আর ইভান চৌধুরী আমার ভাসুন হন, স্বামী অসুস্থ থাকার কারণে ব্যবসা ঘর সংসার সব সামলাতে আমার একটু সমস্যা হয়। যার জন্য ভাসুর হিসাবে ইভান চৌধুরী আমাকে সাহায্য করছেন। সো ভদ্র ভাষায় কথা বলেন।

শায়েলা বেগম ইনায়ার এমন রাগ দেখে ভয় পান, তবুও ওনি বলেন –

“- ইনায়া তুমি শুধু টাকার জন্য ইভানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে চাও?

ইনায়ার ইচ্ছা করছে মহিলাকে থাপ্পড় দিতে, কিন্তু সে বয়স্ক মহিলার গায়ে হাত তুলতে পারবে না। ইনায়া বলে –

“- শুনুন আন্টি টাকার দরকার তার রয়েছে যে আপনার মতো এমন ছোটলোক। এই ইনায়া রাজ চৌধুরী টাকার প্রয়োজন নাই। শহরের সবচেয়ে বড়ো বিজনেস ম্যান আমার স্বামী, আর সে যা টাকা রেখে গেছে সেটা দিয়ে আপনার মতো এমন দশটা নষ্ট মহিলাকে কিনা যাবে। আর আমি এই বাড়ির বউ, যদি এখুনি মামণিকে আপনার বলা ব্যবহারের কথা বলি তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে বাড়ি। সো নেক্সট টাইম ভদ্রতা আর অসভ্যতা শিখে আমার সাথে কথা বলবেন, না হলে থাপ্পড় দিয়ে শিখিয়ে দিব মনে রাখবেন “।

শায়েলা বেগম কিছু বলতে যাবে, এর আগেই ইনায়া সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে যায়। হাসপাতাল এখন সময় সাতটা বাহিরে মাগরিবের আযান শুনা যাচ্ছে, কেবিনের মধ্যে হঠাৎ অরণ্যর হাত সামান্য নড়ে উঠে। প্রায় দুইবছর পর অরণ্যর চোখ খুলে যায়, পিটপিট করে চোখ খুলে দেখে। নিজেকে হাসপাতালে বেডে আবিস্কার করে, অরণ্য মাথায় ব্যাথা করছে। সামনে থাকা দেয়ালঘড়ির মধ্যে রাত সাতটা বাজার বেল বেজে উঠছে, ঘড়ির নিচে তারিখ আর সাল রয়েছে। অরণ্য সালটা দেখে অবাক হয়ে বলে –

‘- হোয়াট দ্যা হেল।

#চলবে

#তোমার_নামে_লেখা_চিঠি
#লেখনীতে_নওরিন_মুনতাহা_হিয়া
#পর্ব_৪১ [ অরণ্য ইনায়ার মিল ]

রাত প্রায় সাতটা গাড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে ইনায়া। মনটা তার আজ ভীষণ বিষন্ন, অরুণা বেগমের অসুস্থতা আর শায়েলা বেগমের এমন কড়া কথা শুনে তার খারাপ লাগছে। যদিও ইনায়ার মনে থাকা কষ্ট শেয়ার করার জন্য এখন কেউ নেই। বড্ড একা লাগে নিজেকে, সমস্ত দায়িত্ব, মিথ্যা নাটক আর ভালো থাকার অভিনয় করে এখন সে টার্য়াড। গাড়িতে যখন ইনায়া উদাসীন হয়ে বসে ছিলো তখন হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। হাসপাতালে থাকা ডক্টর তাকে কল করেছে, যা দেখে ইনায়া ভয় পেয়ে যায়। ডক্টর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তাকে কল দেয় না, তবে কি অরণ্যর। ইনায়া আর ভাবতে পারে না, সে তাড়াতাড়ি করে ফোন রিসিভ করে ভায়ার্ত কণ্ঠে বলে –

“- ডক্টর আপনি হঠাৎ কল করলেন? অরণ্যর কি কিছু হয়েছে ডক্টর?

“- ইনায়া ম্যাম ওই অরণ্য স্যার “।

“- অরণ্যর কি হয়েছে ডক্টর? আপনি অপেক্ষা করুন আমি হাসপাতালে আসছি এখুনি।

“- ম্যাম অরণ্যর স্যারের জ্ঞান ফিরেছে, ওনি কোমা থেকে বের হয়ে এসেছে।

“- হোয়াট “।

ডক্টরের বলা কথাটা ইনায়ার বিশ্বাস হয় না, প্রায় দুইবছর পর অরণ্য কোমায় থেকে বের হয়ে এসেছে। এরপর ডক্টর বলেছে ইনায়া তা শুনতে পাই না, তার কানে শুধু অরণ্যর নাম ভেসে আসছে। তার অরণ্য ফিরে এসেছে, এই কথাটা ভেবেই ইনায়ার মনে থাকা সমস্ত কষ্ট, দুঃখ, বিষন্নতা, দূরে হয়ে যায়। তার উদাসীন মনে আবার সুঃখের আগমন হয়, অশ্রুঝরা দুই আঁখিতে এখন শুধু অরণ্যকে দেখার অপেক্ষা করছে। ডক্টর অল্প সময় কথা বলে ফোন রেখে দেয়, ইনায়া বুঝি ডক্টরের সব কথা শুনতে পাই নাই। ইনায়া ফোন কানে ধরা অবস্থায় গাড়ির ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে –

“- ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়া ও, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। কাম ওন ফাস্ট “।

ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়, ইনায়া তাকে সর্বচ্চ দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর কথা বলে। গাড়ি এখন অনেক দ্রুত চলছে, হাসপাতাল থেকে প্রায় তিরিশ মিনিটের দূরে তারা রয়েছে। তবুও ইনায়ার শান্তি লাগছে না, তার অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষকে একবার জড়িয়ে ধরার জন্য, তাকে এক নজর চোখে দেখার জন্য যে মন কতটা ছটফট করে তা ইনায়া বুঝতে পারছে। ইনায়া ফোন বের করে ইভানকে কল দেয়, ইভান এখনো কম্পিউটারে বসে কাজ করে যাচ্ছে।

ফোন অনারবত বেজে যাচ্ছে, ইভান বিরক্ত হয়ে পাশে থাকা ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্কিনে ইনায়ার নাম্বার দেখে অল্প সময়ের জন্য অবাক হয়ে যায়, কারণ প্রায় পনেরো মিনিট আগেই ইনায়ার সাথে তার কথা হয়েছে। এখন আবার ইনায়া ফোন করছে, ইভান ফোন রিসিভ করে বলে –

“- হ্যালো ইনায়া কি হয়েছে?

‘- ইভান ভাই অরণ্য কোমা থেকে ফিরে এসেছে। ওর হুঁশ ফিরেছে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি ও আসেন ‘।

ইনায়া এতো তাড়াতাড়ি করে কথাটা বলেছে যে ইভানের বুঝতে অল্প সময় লাগে, এরপর যখন সে বুঝে যে অরণ্যর জ্ঞান ফিরে এসেছে তখন সে খুশি হয়ে যায়। ইভান তার কাজ রেখে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আসে, এরপর গাড়ি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায় পড়ে। ইভান তাড়াহুড়ো করে বের হয়, যার জন্য বাড়ির অন্য সদস্যকে যানাতে পারে না। প্রায় তিরিশ মিনিট পর ইনায়ার গাড়ি হাসপাতালে এসে পৌঁছায়, ইনায়া গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়।

হাসপাতালে কেবিনের সামনে এসে উপস্থিত হয় ইনায়া, আজ প্রায় দুইবছর পর তার স্বামীকে সে সুস্থ অবস্থায় দেখবে। অন্যদিকে অরণ্য কোমায় থেকে জ্ঞান ফিরে আসার পর শুধু ইনায়ার নাম বলে যাচ্ছে। ডক্টর যার অন্য অতিষ্ঠ হয়ে ইনায়াকে ফোন করেছে, তাকে অরণ্যর পাগলামি করার কথা বলেছে। কেবিনের দরজার জোরে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায় ইনায়া, এরপর ছুটে যায় অরণ্যর কাছে। অরণ্য ইনায়াকে দুইবছর পর দেখছে, সেই এক্সিডেন্টের সময় শুধু ইনায়ার চেহারা দেখেছে সে।

অরণ্য ইনায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, সেটা অনুসরণ করে ইনায়া শক্ত করে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ইনায়ার মাথাটা অরণ্য তার বুকে শক্ত করে চেপে ধরে। অঝরে কান্না করে যাচ্ছে ইনায়া, তবে সেটা দুঃখের না বরং সুখের কান্না। ইনায়া কান্না করতে থাকে, আর বলে –

‘- অরণ্য আমি আপনাকে অনেক মিস করেছি। এতোদিন আপনাকে ছাড়া আমি ভালো ছিলাম না। যায় হয়ে যাক না কেনো কখনো ছেড়ে যাবেন না আমার, কথা দিন আমাকে ‘।

ইনায়ার কণ্ঠে এমন আবেগময় কথা শুনে অরণ্যর মন হৃদয় প্রশান্তিে ভরে যায়। সে তার জীবনে যোগ্য একজন সঙ্গিনী পেয়েছে, যদি সে তার থেকে দীর্ঘসময় ও দূরে থাকে তবুও তাকে ভুলে যাবে না। শুধু দুইবছর না সারাজীবন তার অপেক্ষা করবে, শুধু তাকেই ভালোবেসে যাবে। অরণ্যর বুকে কান্না করা মেয়েটা তার বউ, যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। অরণ্যর বুক থেকে মুখ তুলে ইনায়া, তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। কতো রাত হাসপাতালে এই নিথর দেহের দিকে ইনায়া নির্বিকার তাকিয়ে থেকেছে, তার কণ্ঠে নিজের নাম শুনার জন্য আত্মানাথ করেছে অপেক্ষা করেছে।

হয়তো অভাগী ইনায়ার কথা উপর ওয়ালা শুনেছে এইবার, যার জন্য তার জীবনে থাকা সামান্য পরিমাণ সুখ কেঁড়ে নেয় নাই। অরণ্য ও ইনায়ার চোহারা ভালো করে লক্ষ্য করে, দুইবছর আগের ইনায়া আর এখনকার ইনায়ার মধ্যে কতো পার্থক্য। তার চোখে মুখে কালো দাগ, মুখটা ফেকাসে,নরম শরীরটা রোগা হয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে বিছানায় এতোদিন সে শুয়ে ছিলো না ইনায়া তা অরণ্য বুঝতে পারে না। তবে ইনায়ার প্রতি তার বড্ড মায়া হয়, মেয়েটাকে সে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে ফেলছে।

ইনায়ার মুখের উপর পড়া চুল অরণ্য সুন্দর করে কানের পিছনে গুঁজে দেয়। আজ তার বড্ড লোভ হচ্ছে ইনায়ার এমন বিষন্ন মুখটা একবার তার ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিতে। অরণ্য ইনায়ার গাল দুইটা হাত দিয়ে আলতো করে ধরে, এরপর তার ঠোঁট দিয়ে ইনায়ার, চোখে, গালে, নাকে সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ভালোবাসার পরশ দেয়। স্বামীর আদুরে স্পর্শে ইনায়া চোখে বন্ধ করে নেয়, অল্প সময় পর একে অপরকে আবার জড়িয়ে ধরে।

ইনায়া আর অরণ্যর রোমান্টিক খুনসুটির মধ্যে ইভান কেবিনে আসে। যেহেতু কেবিনের দরজা খোলা, তাই ইভান নক না করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। অরণ্য আর ইনায়াকে জড়িয়ে ধরা দেখে, ইভান এক পা পিছিয়ে যায় এরপর নিজের উপস্থিতি বোঝাতে দরজায় নক করে। দরজায় নক করার শব্দ শুনে ইনায়া অরণ্যর বুক থেকে উঠে পড়ে, অরণ্য কোনো নার্স এসেছে ভেবে বিরক্ত হয়। এতোদিন পর তার বউকে কাছে পেয়েছে, কিন্তু তাতে ও শান্তি নেই।

অরণ্য বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে, সামনে থাকা মানুষটা দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ইভান চৌধুরী তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ইনায়া ইভানকে দেখে অরণ্যর থেকে দূরে সরে যায়। যতই হোক ইভান তার ভাসুর হয়, তার সামনে এমন করে জড়িয়ে ধরা ঠিক নয়। ইভান হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসে অরণ্যর কাছে এরপর বলে –

“- কেমন আছো অরণ্য? তোমার শরীর ঠিক আছে এখন? ডক্টর কি বলেছে?

অরণ্য কি উত্তর দিবে সে শুধু অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মানে ইভান চৌধুরী তার চিরশত্রু, তার সতিন, তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে এসেছে। বিষয়টা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অরণ্যর, সে কিছুটা সময় ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ এতোটা সময় হয়তো ইনায়াকে ও দেখে নাই, যতটা সে ইভানকে দেখে যাচ্ছে। এরপর অরণ্য শান্ত হয়ে বলে –

“- হুম আই এম অল রাইট। কিন্তু ইভান চৌধুরী হঠাৎ আমাকে দেখতে কেনো এসেছে? আর আমার সুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইছে কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না “।

অরণ্যর কথা শুনে ইভান কিছু বলতে যাবে, এর আগেই ইনায়া ধমকের সুরে অরণ্যকে বলে –

“- অরণ্য ইভান ভাই আপনার বড় ভাই হয়। আপনি এতোদিন অসুস্থ ছিলেন, এখন সুস্থ হয়েছেন যার জন্য ওনি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে । এখানে বিশ্বাস না করার কি আছে?

ইনায়ার ধমক শুনে ইভান বলে –

“- আরে ইনায়া অরণ্যকে কেনো এমন করে বলছ? ওর কোনো দোষ নেই, আসলে আমার আব্বু অরণ্য বা তার পরিবারের সাথে যা করেছে তা অন্যায়। আর দুইবছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা অরণ্যর অজানা “।

ইভান ইনায়ার কথা শুনে অরণ্যর বিশ্বাস হচ্ছে না,তারা একে অপরের সাথে এতো সুন্দর করে কথা বলছে। প্রায় পাঁচ মিনিট ইভান অরণ্য আর ইনায়ার সাথে কথা বলে। এরপর কেবিন থেকে বের হয়ে যায়, অরণ্য মনে মনে বলে –

‘- হুম এইটা ভাই না সতিন। এতোদিন পর বউকে একটু আদর করছিলাম সেটার বারোটা বাজিয়ে দিলো। তবে সব প্রতিশোধ এখন আমি নিব, শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর তোকে যদি আমি আমার দশ বাচ্চার মামা না বানায় তবে আমার নাম অরণ্য রাজ চৌধুরী না। আমার দশটা বাচ্চা তোকে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা তোকে মামা মামা বলে ডাকবে তখন গিয়ে প্রতিশোধ পূরণ হবে।

#চলবে