তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-০২

0
146

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

শ্রেয়সী পাত্র দেখার পাশাপাশি আরেকটা কারণে ঢাকায় এসেছিল এবার। একটা জবের জন্য ভাইভা ছিল। সৌম্যর বাড়ি ওদের জেলারই অন্য উপজেলায়। প্রথমে কথা ছিল তারাই যাবে, কিন্তু শ্রেয়সীর ভাইভার ডেট পড়ায় ওকে আসতেই হবে বলে এখানেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

শ্রেয়সী ইউনিভার্সিটির হল ছেড়েছে গত বছর। হলের রুমমেট আয়েশা আপুর বাসায় উঠেছিল এসে। আপু ওকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। ভাইভা খারাপ হয়নি, টিকেও যেতে পারে, বলা যায় না।

সে আজ বাসায় ফিরে এসেছে। মা এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “সৌম্যকে কেমন দেখলি?”

সেদিনের ঘটনা শ্রেয়সী আর মনে করতে চায়নি। এখন মা বলতে মনে পড়ল পরশু বিকেলের কাণ্ড। ভাইভা দেবার পর যেটুকু ভালো লাগছিল তা উবে গেছে দীপ্তর অযাচিত কথাবার্তায়। সেদিনের ঘটনা অথচ এখনো মনে পড়লেই মেজাজ গরম হচ্ছে।

“মা, একটা কথা স্ট্রেইট বলি?”

“বল। শুনছি।”

“এখন আমি কয়দিন একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতে চাইছি। একটা জব হোক। থিতু হই, তারপর বিয়ে করি? প্লিজ মা।”

কথা বলতে বলতে বাবা এলেন, “ঠিক আছে, মা। আর কিছুদিন দেখ।”

বাবার সাথে ওর সখ্যতা খানিকটা বেশি। মা অনেক প্রশ্ন করতেন বলে ফোনে তাকে তিক্ত কথাগুলো বলেনি। কিন্তু বাবা কোনো প্রশ্ন না করে মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শোনেন। তাই বাবাকে খানিকটা হিন্টস দিয়ে রেখেছিল শ্রেয়সী। বাবার এই রাজি হয়ে যাওয়াটা মা পুরোপুরি মানতে পারছেন না। বাবার সাথে এটা সেটা বলছেন। তবে সে জানে অন্তত মাস ছয়েকের জন্য এই ঝুটঝামেলা থেকে মুক্তি।

যাক আপাতত স্বস্তি। বিয়ের আগের এই দেখাদেখির নামে যা ঘটে তা ওর একেবারেই ভালো লাগে না।

***
“দীপ্ত, তোর তো ছুটি আছে দু’দিন। চল বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

দীপ্ত তরকারির জন্য আলু কাটছিল, বাবার কথা শুনে কাজ অব্যাহত রেখেই জিজ্ঞেস করল, “শুধু শুধু বাড়িতে গিয়ে কী করবে বাবা? কোনো দরকার?”

“পৈতৃক ভিটা। মন টানে মাঝেমধ্যে। সবসময় তো এখানেই কাটিয়ে দিলাম। ইদানিং নস্টালজিক হয়ে যাই। শৈশব বড্ড টানে। বুড়ো হয়ে গেছি তো।”

দীপ্ত একটু ভাবল, বাবার অন্য কোনো মতলব আছে কি-না। আগেরবার বলে কয়ে নিয়ে গিয়ে শ্রেয়সীর সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছিল। এবার অন্য কেউ জুটেছে কি-না কে জানে। তাই বলল,

“আমাকে যেতেই হবে?”

মোহসীন সাহেবের মুখ খানিকটা ম্লান হলো, বললেন, “তোর অন্য কোনো এপয়েনমেন্ট থাকলে আসতে হবে না। বয়স হয়েছে ছেলেকে সাথে নিয়ে যে নিজের এলাকায় যাব, সেই কপাল কি আর আমার আছে।”

দীপ্ত হেসে ফেলল। বাবা যে কী পরিমাণ ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেন এটা ওর থেকে ভালো আর কে জানে। তবে মানুষটার ভেতরে এখনো অদ্ভুত সারল্য বিদ্যমান, বয়স তার ভেতরের শিশুকে ছুঁতে পারেনি। তাই বোধহয় তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। দীপ্ত সেজন্যই আবেগ নামক অনুভূতিকে মোটেই পাত্তা দেয় না। আরেকটা মোহসীন আহমেদ সে হতে চায় না।

“ঠিক আছে, তাহলে কাল অফিস থেকে ফিরেই রওনা দেই? তুমি রেডি থেকো।” মৃদু হেসে বলল দীপ্ত।

বাবা ভীষণ খুশি হলেন, ছোটবেলায় এভাবেই ওর কত অবুঝ আব্দার বাবা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন শুধুমাত্র ওর মুখের এক চিলতে হাসি দেখবার জন্য। সময়ের আবর্তে উল্টো স্রোত এসেছে সম্পর্কে। এখন দীপ্তর পালা বাবাকে হাসিটুকু ফিরিয়ে দেবার, অম্লান, উদ্ভাসিত হাসি।

***
শ্রেয়সীর চাকরিটা হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে জয়েনিং। বাবা-মা ভীষণ খুশি হয়েছেন ওর প্রাপ্তিতে। মা অবশ্য জয়েনিং লেটার হাতে নিয়েই বলেছেন,

“এবার কিন্তু আর কোনো অযুহাত শুনব না। বিয়ে এবার করতেই হবে।”

বাবা বললেন, “কটা দিন যাক না। ওকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও। এই মাসটা সময় নিক।”

মা কড়া চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের কথাবার্তা আজ শুরু করলে বিয়েটা কি আজই হয়ে যাচ্ছে না-কি! কত কী বিবেচনা করতে হয় তোমার ধারণা আছে?”

বাবা অবশ্য মা’কে মানিয়ে নিয়েছেন।

আগামী পরশু শ্রেয়সী চলে যাবে বলে প্রচুর কেনাকাটা চলছে। মা নিজে পছন্দ করে সব কিনে আনছেন৷ ওর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করছেন। অথচ সে ছয় বছর ঢাকায় থেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। কিন্তু এখন বাবা-মা’র অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছে সে যেন এই প্রথম বাইরে যাচ্ছে।

“তোর একটা দুটা ছেলেমেয়ে হোক, তারপর বুঝবি, কেমন লাগে।”

আজ শ্রেয়সী হাতে মেহেদী পরছিল, বাবা হুট করে বললেন, “মা, তোর মা’র হাতে একটু দিয়ে দিস তো।”

বাবা সবসময়ই এমন, ভীষণ রোমান্টিক মানুষ। মা কিঞ্চিৎ রাঙা হলেন অভ্যস্ততা সত্বেও। এই দু’জনের কেমিস্ট্রি ওর ভীষণ ভালো লাগে। তাদের ঝগড়া হয় বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে আনলে কিংবা বাবার কিছুটা অগোছালো স্বভাবের জন্য। মা তখন ভীষণ রেগে থাকেন। অবশ্য বাবার উপরে বেশিক্ষণ রাগ ধরেই রাখতে পারেন না।

ও সবসময় এমন একটা দাম্পত্য সম্পর্ক চায়, যেখানে আলু-পেঁয়াজের ফাঁকে মুগ্ধতা হারিয়ে যাবে না। অসম্ভব বোঝাপড়ায় পরস্পরকে আগলে রাখা যাবে, ঠিক ওর বাবা-মায়ের বোঝাপড়ার মতো।

***
বাবা-মা দুজনেই শ্রেয়সীর সাথে আসবেন বলে ঠিক হলেও শেষ মুহূর্তে তারা আসতে পারলেন না। বড় ফুপু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, শ্রেয়সীর জয়েনিং, অগত্যা ওকে একাই রওনা দিতে হলো।

বাবা অবশ্য ওকে বাসে তুলে দিয়ে গেলেন। চশমার ঝাপসা ফ্রেম মুছলেন বারকয়েক, তার মেয়েটা চোখের সামনে কেমন বড় হয়ে গেছে। নিজের পায়েও দাঁড়িয়ে গেছে। তার ভারি গর্ব হলো মেয়ের জন্য।

বাস যাত্রাবিরতি দিলে শ্রেয়সী নামল, তাতেই বিপত্তি বাঁধল। হয়তো খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল, হাতের ব্যাগে হ্যাঁচকা টান পড়তে যতক্ষণে সম্বিতে ফিরল ততক্ষণে লোকটা গায়েব। গলা দিয়ে অবচেতনেই একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো। আশেপাশে কয়েকজন এগিয়ে এলো। তাদের উপদেশমূলক তত্ত্বকথা শুনতে ওর বিরক্ত লাগছিল।

ওর বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিল একটা গা জ্বালানো অট্টহাসি।

“নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারার নমুনা তো দেখলাম। সামান্য একটা ব্যাগ সামলে রাখতে জানেন না।”

দীপ্তিকে এখানে দেখাটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কোত্থেকে উদয় ঘটল এই জঞ্জালের! একে তো এহেন পরিস্থিতি, সাথে কটাক্ষের তীর, তৃতীয় মহা যু দ্ধের দামামা বেজে উঠল শ্রেয়সীর মাথায়।
………….
(ক্রমশ)