তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৭

0
116

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

এই একমাসে শ্রেয়সীর সাথে দীপ্তির ফেসবুকের মেসেঞ্জারে বেশ ভালো কথার আদান-প্রদান চলেছে। নানারকম বিষয় নিয়ে ওদের আলোচনা হয়েছে। বই, মুভি, সিরিজ, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আবহাওয়া, এমনকি খেলাধূলা পর্যন্ত।

একদিন বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের সাথে জেতার পরে শ্রেয়সীর বেশ লম্বা চওড়া একটা পোস্ট দীপ্তির নিউজফিডে এসেছিল। সে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি খেলা বোঝেন?”

শ্রেয়সী লিখল, “মানে কী?”

“মেয়েদের স্পোর্টস নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“মেয়েরা এখন ক্রিকেট ফুটবলে কাপ পর্যন্ত আনছে, সেখানে এটা কি এত আবাক হবার মতো কিছু?”

“রাগ করলে?”

শ্রেয়সী বলল, “তা কিছুটা হয়েছেই। তবে ছেলেদের মেয়েদের সম্পর্কে এই যে লজিকলেস কনসেপ্ট সেট করা থাকে এই জিনিসটাই আমার পছন্দ না।”

দীপ্ত এর কী উত্তর কী করে দেবে গুছিয়ে উঠতে পারছে না, একবার লিখছে আরেকবার মুছে নতুন করে লিখছে, এরমধ্যে শ্রেয়সীর আরেকটা মেসেজ ঢুকল।

“আমি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট ম্যাচ দেখি, অবশ্য বাংলাদেশের ম্যাচগুলোই। এর বাইরে তেমন দেখি না এখন সময়ের জন্য। ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ দেখার পাশাপাশি আগে বাবার সাথে রাত জেগে লা লিগার ম্যাচ দেখতাম, বার্সেলোনার খেলা থাকলে। মেসির জন্য অবশ্য। মেসি বার্সা ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি। এখন অতটা সময় হয় না।”

শ্রেয়সীর সাথে কথা বলতে বলতে নানা আলোচনায় দীপ্ত বেশ চমৎকৃত হয়। কথা বলতে বলতে সময়টা চমৎকার কাটে। আলোচনা কখনো বোরিং হয় না। মেয়েটা ভীষণ জ্ঞান রাখে বিভিন্ন বিষয়ে, সাথে ভীষণ অকপট আর উচ্ছ্বল আবার দৃঢ়চেতা মনোভাব। তবে নিজের সীমা ধরে রাখে। মেয়েদের সম্পর্কে পুষে রাখা একপেশে ধারণায় খানিকটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। তবুও মাঝেমধ্যে শ্রেয়সীর কথার ধার ওর সহ্য হয় না। তখন যথারীতি কথা কাটাকাটি চলে। দীপ্তর প্রতিশোধের ইচ্ছে ফিরে আসে তখন। এভাবেই চলছিল ওদের।

ওদিকে শ্রেয়সীর দিক থেকেও দীপ্তকে চেনার, জানার পালা চলছে। একদিন ওদের আচমকা দেখা হয়ে গেল শ্রেয়সীর অফিসের সামনে। দীপ্ত বলল,

“এদিকে আমার ফ্রেন্ডের অফিস ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কেমন আছেন?”

শ্রেয়সী এগিয়ে এসে হেসে উত্তর দিল, “ভালো। আপনি?”

“ভালো।” দীপ্ত আকাশের দিয়ে তাকিয়ে বলল, “যা গরম৷ সূর্য মামা মাথার মগজ গলিয়ে দিচ্ছে। সামনের পার্কে কিছুক্ষণ বসতে পারি আমরা?”

শ্রেয়সী হেসে বলল, “বিকেল গড়িয়ে যাবে। এখন টেম্পারেচার খানিকটা কমেছে। খুব একটা গায়ে লাগছে বলে মনে হয় না।”

দীপ্ত এবার খানিকটা ইতস্তত করতেই শ্রেয়সী বলল, “সরাসরি বলতেই পারেন যে আমরা কিছুক্ষণ বসে গল্প করতে পারি কি-না। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার বন্ধুর অফিস যেহেতু এদিকেই তাকেও ডাকতে পারেন।”

দীপ্ত হেসে ফেলল, “এদিকে সত্যিই আমার ফ্রেন্ডের অফিস। কিন্তু সে আজ আসেনি জেনেই এদিকে এসেছি।”

শ্রেয়সী হেসে বলল, “খুবই পুরোনো টেকনিক।”

ওরা পার্কে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ কথা বলার পরে একজন পথশিশু ফুল নিয়ে এলো। গোলাপ ফুল, বকুল ফুলের মালাও আছে।

“ভাইয়া, ভালা আছেন?”

“তোরা ভালো আছিস? পড়তে যাস তো?”

“হ। রাইতের ইশকুল তো। দিমে কাম করি, রাইতে পড়ি। আপনে আইসেন আরেকদিন।”

দীপ্ত বলল, “যাব। তোর হাতে কত টাকার ফুল।”

“আড়াইশো ট্যাকা।”

“আজকে সারাদিনে কত ইনকাম করলি?”

“হইছে এক-দেড়শো।”

“তোর মা কেমন আছে?”

“এহন আগের চাইতে ভালা।”

দীপ্ত তিনটা গোলাপ আর একটা বকুল ফুলের মালা নিল শুধু৷ এরপর একটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোর মায়ের জন্য ওষুধ কিনিস।”

ছেলেটা টাকাটা পেয়ে ভীষণ খুশি হলো৷ মলিন মুখে প্রাপ্তির হাসি। মায়ের ওষুধের টাকা হবে, ওর ছোট ভাই একটা খেলনা কিনে চেয়েছিল। সেটাও দিতে পারবে।

ছেলেটা চলে গেলে দীপ্ত ফুলগুলো শ্রেয়সীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নিন। আপনি ফুল খুব পছন্দ করেন বলেছিলেন।”

“আপনিও রাখুন একটা।”

“আমার ফুল অতটা ভালো লাগে না।”

“তাহলে কিনলেন কেন?”

“কত অল্পেই খুশি হলো দেখেছেন? ওই খুশিটুকু দেখার জন্য।”

ফুল পছন্দ নয় জেনে সেদিন প্রথমে কিছু কড়া কথা শ্রেয়সীর মুখে চলে এসেছিল, কিন্তু এই কথায় অদ্ভুত ভালো লাগল। ওর চোখে অপার মুগ্ধতা খেলা করছিল অবচেতনেই।

“স্কুলের ব্যাপারটা কী?”

“ওহ্! ওটা, এই এলাকায় আমার পরিচিত এক বড় ভাই থাকেন৷ ভার্সিটির বড় ভাই। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের খুব কাছের আরমান ভাই৷ তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে পথশিশুদের নিয়ে একটা রাতের স্কুল চালান। আমরা মাঝেমধ্যে ডোনেট করি, সামর্থ্য অনুযায়ী। আগে মাঝেমধ্যে ক্লাসও নিতাম আমি আর শিমুল।”

এরপর থেকেই শ্রেয়সী দীপ্তকে বন্ধু ভাবতে শুরু করল, ছেলেটাকে বাইরে থেকে যতটা দেখায় ততটা বোধহয় এ্যারোগ্যান্ট নয়।

আজ চ্যাটিং করতে করতেই কথা প্রসঙ্গে শ্রেয়সী জানাল সে বাড়ি যাচ্ছে সামনের সপ্তাহে। দীপ্ত বলল,
“বেড়াতে?”

“ওরকমই। আসলে আমি যেখানেই থাকি বছরের এই সময়টায় আমি বাবা-মার সাথে থাকি।”

“কোনো উপলক্ষ?”

শ্রেয়সী খানিকটা ইতস্তত করে বলল, “আমার জন্মদিন নয় তারিখ।”

দীপ্ত লিখল, “জন্মদিনে তো আপনাকে পাচ্ছি না। আমার ট্রিট দিয়ে যান।”

“ট্রিট দিলে গিফট দিতে হয়।”

“অবশ্যই দেব।”

শ্রেয়সী মজা করে বললেও দীপ্ত সিরিয়াস বুঝতে পেরে সে রাজি হলো। ঠিক হলো পাঁচ তারিখে দেখা করবে।”

রেস্টুরেন্টে এসে শ্রেয়সী দেখল আজও দীপ্ত আগে এসেছে। ঘড়ি দেখল, না, আজ সে লেট করেনি। বরং মহাশয় খানিকটা আগে এসেছেন।

দীপ্ত একটা বড় কেকের বক্স এগিয়ে দিল। শ্রেয়সী খুলে দেখল, হোম মেড কেক৷ দীপ্ত হেসে বলল,

“আমার নিজের হাতে বানানো। বাবা খুব পছন্দ করেন। তাই ভাবলাম গিফট হিসেবে এটা বোধহয় মন্দ হয় না।”

শ্রেয়সীর মুগ্ধতা বাড়ল। গিফটের কথা বলার পর থেকেই ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন ভারি শান্তি পেল। কিছুদিন আগের সেই সেলফ অবসেসড ছেলেটা নিজের হাতে ওর জন্য কেক বানিয়েছে, এই বিষয়টাই ওকে চমৎকৃত করল।

সুন্দর সময় কাটল ওদের। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কে এসে বসল। শ্রেয়সী বলেছে ওদের স্কুলটা সে দেখতে চায়। সে প্রতিবছর জন্মদিনে চেষ্টা করে মানুষের জন্য কিছু করার। তখন চাকরি করত না, বাবার কাছ থেকে পাওয়া টাকা থেকেই অল্পস্বল্প যা জমত, তাই দিয়ে চেষ্টা করত৷ এবার বেতন পাবার পরে প্রথম জন্মদিন।

আরমান ভাইয়ের সাথে দেখা হলো স্কুলে গিয়ে। শিশুরা তখনো আসেনি৷ সন্ধ্যার পর থেকে আসবে। তবুও কিছু শিশুর দেখা পেল। শ্রেয়সী আরমান ভাইয়ের সাথে কথা বলল, ভীষণ আন্তরিক তিনি।

“ভাইয়া, আপনার এমন উদ্যোগ অসাধারণ। আমি আমার সাধ্যমতো আপনার এই কাজের সাথে যুক্ত হতে পারলে আনন্দিত হবো।”

আরমান ভাই আনন্দিত হয়েই শ্রেয়সীর দানটুকু রাখলেন।

ফেরার সময় দেখল সূর্য ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আযান হয়েছে৷ ওরা পার্কের সামনের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। তখন কিছু বাজে মন্তব্য কানে এলো, খানিকটা এগুতেই বুঝল, কিছু বখাটে ছেলে, দুটো মেয়েকে ভীষণ বিরক্ত করছে, অশ্লীল ইঙ্গিতে কথা বলছে৷ মেয়ে দুটো ভয়ে কুঁকড়ে আছে। শ্রেয়সী প্রতিবাদ করতেই যাচ্ছিল, তার আগেই দীপ্ত গিয়ে বলল,

“কী হচ্ছে এখানে?”

ওরা মারমুখী হয়ে প্রতিউত্তর দিল, দীপ্তও রেগে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে একটা ছেলে আচমকা একটা ছু রি বের করে দীপ্তকে লক্ষ্য করে চালিয়ে দিয়েছিল৷ শ্রেয়সী যখন অবস্থা বেগতিক হতে দেখেছে, তখনই বুঝেছে এদের সাথে একা পেরে উঠতে পারবে না দীপ্ত, তাই এগিয়ে গিয়ে একজন টহল পুলিশকে ডেকে নিয়ে আসতে আসতেই আঁতকে উঠল শ্রেয়সী। পুলিশ দেখে ওরা পালিয়ে গেল দৌড়ে। দীপ্ত পেটের দিকে হাত চাপা দিল, সেখান থেকে রক্ত পড়ছিল। মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আছে।

শ্রেয়সী দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরল, আরও লোকজন জড় হয়েছে। এদের অনেকেই আগে থেকেই দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে, কিন্তু এতক্ষণ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি, কিংবা ঝামেলা ভেবে এগিয়ে আসেনি৷ সেখানে দীপ্ত যে অচেনা দুটো মেয়ের জন্য এভাবে রিস্ক নেবে, সেটা ওর জন্য কল্পনাতীত ব্যাপার।

ওদের একটা গাড়ি ঠিক করে দিল পুলিশ, মেয়েদেরকেও পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করল।

শ্রেয়সী ওর ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে দীপ্তর কেটে যাওয়া অংশে ধরে আছে। আঘাতটা খুব বেশি গুরুতর নয়। তবে অঘটন ঘটতেই পারত। যদি কিনারে না লেগে গভীরভাবে কাটত! একটা বিশাল বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারত! শ্রেয়সী ভীষণ ভয় পেয়েছে।

দীপ্তকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। ওকে ড্রেসিং করতে ভেতরে নিয়ে গেলে দীপ্তর মোবাইলে কল এলো, বাবা…

শ্রেয়সী রিসিভ করল। নিশ্চয়ই তিনি চিন্তা করছেন। সে পার্কে দীপ্তর সামান্য আহত হবার বিষয়টা বলল, সাথে আশ্বস্ত করল। ক্লিনিকটা দীপ্তির বাসা থেকে কাছেই। মোহসীন সাহেব বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন। দীপ্ত ভেতরেই আছে।

“মা, তুমি?”

“জ্বী আঙ্কেল। দীপ্তর খুব বেশি লাগেনি। টেনশনের কিছু নেই।” আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল শ্রেয়সী।

শ্রেয়সীকে তিনি দেখেছেন দীপ্তর জন্যই। আগে একবার সামনা-সামনি দেখা হয়েছিল। তার খুব পছন্দ হয়েছিল ছেলের জন্য৷ কিন্তু হয়নি। আজ ওকে এখানে তিনি আশা করেননি।

“ধন্যবাদ মা। তুমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছ।”

“আমি তেমন কিছুই করিনি আঙ্কেল। আসলে পার্কে আজ উনার যাবার কথা-ই ছিল না। উনি আমার কথাতেই রাজি হয়েছিলেন। আরমান ভাইয়ের স্কুল দেখতে চেয়েছিলাম বলে।”

দীপ্তকে তখনই বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। সে আসতেই শ্রেয়সী বিদায় নিল, বলল, “আমি পরে কল করব। আসি আঙ্কেল।”

মোহসীন সাহেবের মাথায় তখন অন্য চিন্তা, ছেলের অবস্থা অতটা খারাপ নয় বলে স্বস্তি পেলেন৷ আরেকটা বিষয়ে তিনি স্বস্তি পেলেন, তা হলো শ্রেয়সী। রিজেকশনটা ওর তরফ থেকেই এসেছিল। আজ দেখল, মেয়েটা তার ছেলের জন্য চিন্তা করছে। দুটোতে বন্ধুত্বও হয়ে গেছে, আরও বেশি কিছুও হতে পারে। অবশেষে তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে চলেছে। এবার আর ছেলেকে পিছলে যেতে দেবেন না। আর সপ্তাহ খানেক যাক, মতিভ্রম হবার আগেই তিনি শ্রেয়সীর বাবার কাছে নিজে প্রস্তাব পাঠাবেন।

***
শ্রেয়সী রাতে শুয়ে পড়েছিল৷ ফেসবুকে ঢুকতেই অবচেতনে দীপ্তর প্রোফাইলে ক্লিক করল। আজ কোনো এসএমএস আসবে না সে জানে। তবুও কয়েকবার ইনবক্সে গিয়ে পুরনো মেসেজগুলো পড়ল। আরেকবার প্রোফাইলে এলো৷ কাভারে বাবার সাথে দীপ্তর ভীষণ আদুরে একটা ছবি। তাতে ক্লিক করে ক্যাপশন দেখল, “আমার পৃথিবী”

শ্রেয়সীর ভেতর থেকে কেউ ওকে বলল, “আমিও সেই পৃথিবীর একজন হতে চাই।”

দীপ্তর প্রোফাইল ছবিটা দেখে খানিকটা রাঙা আভা ফুটল শ্রেয়সীর মুখে। আশ্চর্য! সে তো কিশোরী মেয়ে নয়, তবে এ কেমন অদ্ভুত আবেগ ভেতরে তোলপাড় তুলছে! কিন্তু ওদিকে…..
………..
(ক্রমশ)