তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-১৪

0
105

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৪)
নুসরাত জাহান লিজা

শ্রেয়সী ঘুম থেকে উঠে পাশে দীপ্তকে পেল না। এই চারদিনে সে বুঝতে পেরেছে ছেলেটা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে। শ্রেয়সী আবার সকালে উঠতে পারে না, কিন্তু রাত জাগতে পারে। এলার্ম দিয়ে অনেকবার বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে কতবার। বাসায় থাকলে মা এসে ফ্যান বন্ধ করে দিতেন, এটা ওর ঘুম ভাঙানোর অব্যর্থ ওষুধ। যখন হলে থাকত, পরীক্ষার আগে ওর ঘুম পুরোপুরি না ভাঙা পর্যন্ত মা অনবরত কল দিয়ে যেতেন। এখন অফিস থাকে বলে সকালে উঠতে হয়, তাও মেরেকেটে সাড়ে সাতটা বেজে যায়।

ফ্রেশ হয়ে সে রুম থেকে বাইরে এলো, রান্নাঘর থেকে বাবা-ছেলের গলার আওয়াজ আসছে বলে সেদিকে পা বাড়াল। দুজন মিলে রান্না করছে।

“এত ঝাল দিচ্ছিস কেন? শ্রেয়সী কতটুকু ঝাল খায় তুই জানিস? তোর, আমার টেস্ট মতো দিলে খেতে পারবে না-কি?”

দীপ্ত বলল, “বাবা, ওদের বাড়িতে আমি দুইদিন খেলাম৷ ঝালের লেভেল আমাদের টেস্ট মতোই ছিল।”

“তাও ও তো নতুন মানুষ। জিজ্ঞেস করে নেয়া উচিত।”

এই পর্যায়ে শ্রেয়সী রান্নাঘরের ভেতরে চলে এলো। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কী হচ্ছে! এই দৃশ্য ওর জন্য একেবারে নতুন। বাসায় মা রান্না করেছেন সবসময়। রহিমা না এলে বাবা মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করেছেন অল্পবিস্তর। কিন্তু এভাবে আয়োজন করে রান্না করেননি। এখন বুঝল দীপ্ত রান্না কী করে শিখেছে।

“আপনারা নিজেরা রান্না করছেন, আমাকে ডাকলে না কেন দীপ্ত?” দু’জনকেই কথাগুলো বলল শ্রেয়সী।

দীপ্ত কিছু বলার আগেই মোহসীন সাহেব বললেন, “আমাদের সাথে রান্নাবান্না করার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। তুমি নতুন এসেছ, আগে অভ্যস্ত হও এখানে থাকতে এরপর কোরো।”

দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “খুব ইচ্ছে হলে দুপুরের জন্য রুই মাছটা রান্না করতে পারো।”

শ্রেয়সীর মুখ অস্বস্তিতে খানিকটা শুকিয়ে গেল। সে টুকিটাকি রান্না করতে পারে। ও রান্নাঘরে গেলে মা বলত, তাতে না-কি তার কাজ বেড়ে যায়, সব নাকি সে এলোমেলো করে ফেলে। মাছ সে এর আগে রাঁধেনি কখনো। মুরগি রান্না করতে পারে, বিরিয়ানিও পারে, তবে তার জন্য সব কেটে ধুয়ে দিতে হয়। মাছ সে তেমন খেতেও পারে না। এটা নিয়ে মায়ের বকুনি সে কম হজম করেনি।

“আঙ্কেল, আমি না রান্নাবান্না তেমন একটা করতে পারি না। দীপ্তর কাছ থেকে শুনেছি আপনি ওকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন, আমাকে শেখাবেন?”

দীপ্ত যেন আকাশ থেকে পড়ল, “তুমি রান্না করতে জানো না? এমন সহজ কাজ আর কিছু আছে?”

মোহসীন সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই যা পারিস, দুনিয়ার সবাই যে তা পারবে এটা ভাবার কি কোনো কারণ আছে?”

“তা নেই, কিন্তু রান্না…”

“তুই সেলাই ফোঁড়াই করতে পারিস?”

“ওটা করে আমার কী কাজ?”

এবার শ্রেয়সী বলল, “আমি পারি আঙ্কেল। সিক্স সেভেনের গার্হস্থ্য ক্লাসে শিখেছিলাম৷ আমার ভালো লাগে বলে শখের বেশ এখনো করি। মাফলার, সোয়েটারও বুনতে পারি।”

মোহসীন সাহেব বললেন, “দেখলি? শোন, সবাই সবটা জানে না। সবাইকে সব জানতে হবে এরকম কোনো মানে নেই। ও রান্না জানে না, তুই সেলাই। কাটাকাটি।”

দীপ্ত কিছু বলল না, ওদিকে তেলের মধ্যে পেঁয়াজ পুড়তে যাচ্ছে বলে সেদিকে মনোনিবেশ করল। শ্রেয়সী বলল, “আমি রান্না শিখতে চাই আঙ্কেল। আপনি শেখাবেন?”

“অবশ্যই শেখাব মা। নিজের রান্না আর এই গাধাটার রান্না খেতে খেতে মুখ পঁচে গেছে। মাঝেমধ্যে টেস্ট চেঞ্জ করতে হবে তো।”

দীপ্ত মুখ কুঁচকে বলল, “তুমি ওর সামনে আমাকে গাধা বলছ কেন?”

“নতুন বউয়ের সামনে প্রেস্টিজ গেল বলে?”

“বাবা তুমি কিন্তু…..”

“তুই সবজিটা তাড়াতাড়ি শেষ কর। আমি পরোটাগুলো নিয়ে যাচ্ছি। খিদে লেগেছে, এত প্যাঁচাল ভাল্লাগছে না। চলো তো মা, আমরা মা ছেলে মিলে গল্প করি।”

“এখন মা ছেলে বলে বলে দল পাকাচ্ছ? তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি কেউ না, বানের জলে ভেসে এসেছি?”

“তোর মেলোড্রামা দেখলে পেট ভরবে? এত ঢিলামো করছিস কেন?”

“আমি করছি মেলোড্রামা? ওটা তোমার ডিপার্টমেন্ট। তুমি মেলোড্রামার উপরে পিএইচডি শেষ করেছ।”

“তুই আমার কাছ থেকে কি খালি রান্নাই শিখেছিস? মেলোড্রামা শিখিসনি যেন?”

দীপ্ত অদ্ভুত এক ভঙ্গি করে হার মেনে নিল। শ্রেয়সী হেসে ফেলল। সে মোহসীন সাহেবের সাথে সাথে খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে এলো। মোহসীন সাহেবকে শ্রেয়সী যতটুকু ভেবেছিল, তিনি তারচাইতে ইন্টারেস্টিং। এত আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বললেন, মনে হলো শ্রেয়সী যেন বহুদিন থেকেই এই পরিবারের সদস্য। মুহূর্তেই সংসারটাকে নিজের মনে হলো, মানুষগুলোকে আরও বেশি কাছের মনে হলো।

শ্রেয়সী জানে ওর আপারগতার জন্য যেন সে অস্বস্তিতে না পড়ে সেজন্য পরিবেশ হালকা করতে এসব বললেন মোহসীন সাহেব। সে তাড়না অনুভব করল রান্নাটা শেখার। ধৈর্য্য একটু বেশি লাগবে, কিন্তু নিজের মানুষগুলোর জন্য এটুকু ধৈর্য্য সে ধরতেই পারে। সকাল সকাল ওর মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল।

খাবার টেবিলে মোহসীন সাহেব বললেন, “এখন তো তোদের ছুটি প্রায় শেষই, সামনে কুরবানী ঈদের ছুটি আছে, তখন তোরা দুজন একসাথে কোথাও ঘুরে আসবি।”

শ্রেয়সী কিছু বলার আগেই দীপ্ত বলল, “বাবা, তুমি আগে সুস্থ হও প্লিজ। তারপর যাওয়া যাবে। এখন তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে আমি যাব না।”

শ্রেয়সীও সাথে সাথে বলল, “দীপ্ত ঠিকই বলেছে আঙ্কেল। আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে।”

দীপ্তর মনে হচ্ছিল, শ্রেয়সী বোধহয় মন খারাপ করবে এখন হানিমুনে না যেতে পেরে। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে একেবারেই দেখা গেল না। একবার ওর কলিগ ওকে শুনিয়েছিল, বিয়ের পরে হানিমুনের জায়গা সিলেক্ট করা নিয়ে নাকি স্ত্রীর সাথে ভীষণ ঝগড়া লেগেছিল। বিয়ে ভাঙার উপক্রম পর্যন্ত হয়েছিল৷ পরে দুই পরিবারের সমঝোতায় তার মিটমাট হয়েছিল। মেয়েটা বলেছিল বিয়ের সাথে হানিমুনে পিরিয়ড নিয়েও মেয়েদের অনেক স্বপ্ন থাকে নাকি। শ্রেয়সীরও নিশ্চয়ই ছিল।

বাবার অসুস্থতার জন্য বিনা বাক্য বেয়ে হাসিমুখে সবটা মেনে নিতে দেখে দীপ্তর ভালো লাগল। শ্রেয়সীর হাসি ভীষণ সুন্দর, এখন চোখে পড়ল ওর। হাসলে চোখদুটো ছোট হয়ে যায়, বাচ্চাদের মতো। তখন মেয়েটাকে ভীষণ আদুরে লাগে দেখতে।

“দীপ্ত, আরেকটা জরুরি কথা। আমি তো গতবছর পেনশনের টাকাটা পেয়েছি। ওটা পড়েই আছে। কিছু টাকা তুলে এবার একটা গাড়ি কিনে ফেলি। আরও আগে কিনতে পারতাম৷ কিন্তু নানা ঝামেলায় আর ইচ্ছে হয়নি। শ্রেয়সীর অফিস এখান থেকে কিছুটা দূরে হবে। তাছাড়া তোরও দরকার হবে।”

দীপ্ত বলল, “বাবা, এখন এসবের কী দরকার?”

দীপ্তর মনে পড়ল অনেক বিষয়ের সাথে গাড়ি কেনা নিয়েও ওর মায়ের সাথে বাবার একবার বেশ বিরোধ হয়েছিল। যেদিন বাবা গাড়ি কিনে মা’কে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন, তার একদিন আগেই শোভা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর আর বাবা-ছেলে কেউই গাড়ি কেনার বা বায়না ধরার কথা মাথায় আনেনি।

“কথা বাড়াস না দীপ্ত, প্লিজ। ধরে নে তোদের বিয়েতে আমার পক্ষ থেকে উপহার। তুই গাড়ি দেখ, আলাপ কর, এরপর আমাকে দামটা জানা।”

পুরনো তিক্ত স্মৃতি মনে পড়ায় দু’জনেই কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেল। শ্রেয়সী বুঝল না হঠাৎ এদের কী হলো। কিন্তু জিজ্ঞেসও করল না কিছু। তারা যখন নিজে থেকে বলবে, তখন সে জানবেই। তাই অযথা এটা নিয়ে প্রশ্ন করল না। তাদের স্পেস প্রয়োজন সে বুঝল।

মোহসীন সাহেব তা আঁচ করতে পেরে বললেন, “তা গাধাটার রান্না কেমন লাগল তোমার মা?”

“গাধাও যে এমন ভালো রান্না করতে পারে জানতাম না।”

এই অর্থহীন রসিকতায় গোমট পরিবেশ কাটল, মেঘ সরে গিয়ে রোদ্দুর ঝলমল করে উঠল ওদের চোখে। দীপ্তও হাসল এবার। এই ছেলেটার হাসি এত মারাত্মক কেন! ভাবল শ্রেয়সী।

***
“তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল না?”

ঘুমানোর আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল শ্রেয়সী, দীপ্তর কথা শুনে আয়নার মধেই ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

“বয়ফ্রেন্ড থাকলে বাসা থেকে পাত্র খুঁজছিল কেন আর তোমাকে বিয়ে করলাম কেন?”

দীপ্ত বিছানায় বসেছে, আয়নায় ওকেও দেখা যাচ্ছে, সেখানে শ্রেয়সীর প্রতিবিম্বের উপরেই চোখাচোখি হলো দুজনের।

“না, এরকম হয় তো৷ টাইম পাসের জন্যও কোনো রিলেশনশিপ হয়নি?”

“আমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বিশ্বাসী। কখনো প্রেম হলে তাকেই বিয়ে করতাম। তেমন কাউকে পাইনি। যাকে বিয়ে করেছি, তার সাথেই শেষ অব্দি থাকতে চাই।”

দীপ্ত স্থির চোখে শ্রেয়সীর প্রতিবিম্ব দেখছে। ওর চোখের দৃষ্টি সহসা যেন খানিকটা উদভ্রান্ত মনে হলো মুহূর্তের জন্য।

“তুমি যে এতকিছু জিজ্ঞেস করছ, তোমার কথা বলো। তোমার কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল?”

“আমার কথা আলাদা।”

শ্রেয়সীর এবার প্রতিবিম্বিত দৃষ্টি বিনিময় পছন্দ হলো না, সে ঘুরে বসল, দীপ্তর চোখের দিকে সরাসরি চোখ রেখে বলল, “তুমি আলাদা কেন? তুমি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট?”

দীপ্ত উত্তর দিল না, সে চায় না কোন মনোভাব থেকে সে শ্রেয়সীর সাথে জড়িয়েছিল, তা সে জানুক। ভালোবাসা তো হয়নি, এত দ্রুত কি সেটা সম্ভব! তবুও কেন যেন ওকে ম্লামমুখে দেখতে চায় না দীপ্ত। শ্রেয়সীর হাসিমুখটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে ওর। ওই মুখে বিষাদী মেঘ দেখার আশঙ্কায় দীপ্ত খানিকটা তটস্থ হয় মনে মনে।

“তুমি এত সুন্দর করে হাসো কীভাবে শ্রেয়সী? এত চমৎকার হাসির কাউকে দেখিনি যে, তাই প্রেম হয়নি।”

শ্রেয়সীর ভীষণ ভালো লাগল কথাটা, তবে তা প্রকাশ না করে বলল, “ঢং।”

এরপর উঠে এসে বিছানায় দীপ্তর পাশে বসে শোবার প্রস্তুতি নিতে নিতে বলল, ““তুমি যখন উঠবে, আমাকে ডেকে দিও।”

“ঠিক আছে। তোমার তো অভ্যাস নেই।”

“অভ্যাস করে নিলেই হয়। পরিবারের দুজন সদস্য সবকিছু করছে, আরেকজন এভাবে, আমার ভীষণ অস্বস্তি হবে।”

কথাটা খুব সাধারণ, তবুও দীপ্তর অদ্ভুত ভালো লাগল! শ্রেয়সী এত দ্রুত পরিবারের একজন হয়ে উঠছে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছে, এটাতে কেন জানে না দীপ্তর মনে স্বস্তি এসে ঘিরল।

শ্রেয়সীর পাশে শুয়ে দীপ্ত ওকে জড়িয়ে নিল একরাশ আবেগ নিয়ে।
……………