তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-১৫

0
160

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৫)
নুসরাত জাহান লিজা

শ্রেয়সী বিয়ের পর থেকে এই কয়েকদিন দীপ্তকে খুব ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করেছে। তার মধ্যে একটা স্বভাবে সে কিঞ্চিৎ বিরক্তই হয়। যেমন টেবিলে একটা বই রাখা, গুছিয়েই রাখা, কিন্তু সে সেটাকে যেন একেবারে ছোটবেলায় জ্যামিতিতে যেরকম লম্বচ্ছেদ করে চতুর্ভুজ আঁকা হতো, একেবারে একচুল এদিক ওদিক নেই, সেভাবে রাখবে। বিছানার চাদর যৎসামান্য বোঝাই যায় না, তেমন কুঁচকে গেলেও, সেটুকু নিয়েই টানাটানি করে ঠিকঠাক করে রাখে। বাইরে থেকে ফিরে জুতা সুন্দর করে গুছিয়ে মুছে রাখে, বাইরে যাবার আগে আরেকবার। ড্রেসটাও জায়গা মতো রাখে। পানি খেয়ে গ্লাসটাও জায়গায় রেখে আসে।

এমন জ্যামিতিক পরিমাপ ধরে গুছানো মানুষ শ্রেয়সী আগে দেখেনি। সে-ও যথেষ্ট পরিপাটি, তবে এমন মাপ ধরে সে পারবে না। মাঝেমধ্যে অলসতা পেয়ে বসলে সেদিনের জন্য সে ক্ষান্ত দিত, পরেরদিন হয়তো এলোমেলো জিনিস গুছিয়ে রাখত। এখন এই লোকের সাথে থাকতে থাকতে নিজেকে যথেষ্ট অগোছালো বলে মনে হচ্ছে। কোনো মানে হয় এসবের।

“কী ভাবছ মা?”

“আপনার ছেলে কি শুচিবাইগ্রস্ত?”

মোহসীন সাহেব হেসে ফেললেন, “না, কিন্তু সবকিছুতে ও পারফেকশন রাখতে চায়। ও বুঝতে পারে না, জীবনে কখনো কখনো ইমপারফেকশনটাই পারফেক্ট হয়।”

“অদ্ভুত তো। আচ্ছা আঙ্কেল, ও কী রান্নাটাও একেবারে মেপে করে, মাপে দুই টেবিল চামচ হলুদ, এক টেবিল চামচ ধনে গুঁড়ো?”

মোহসীন সাহেব আবারও হাসলেন, “রান্নাটায় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন আর মাপামাপিতে নেই।”

শ্রেয়সী এখন মোহসীন সাহেবের সাথে রান্না করছিল, গতকাল থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে ওরা।

“এখন ফোঁড়ন দাও, তারপর এই ঝোলটা এতে দিয়ে দিতে হবে।”

শ্রেয়সী এখন লার্নিং পিরিয়ডে আছে রান্নার। আজ একরকম জেদ ধরেই সে রাঁধতে এসেছে। শ্বশুরের কথামতো সে কাজটুকু করল।

“আপনার ছেলের আর কী কী গুণ আছে?”

মোহসীন সাহেব বললেন, “এগুলো কিঞ্চিৎ বিরক্তিকর হলেও ওর মনটা খুব ভালো। আসলে ওর ছেলেবেলাটা অন্য শিশুদের মতো হয়নি তো, কিছু ঘটনা ওর মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল খুব। তখন ওর কোনো বন্ধুও ছিল না। কারো সাথে কথা বলতেও হীনমন্যতায় ভুগত। সহপাঠীদের মায়েরা টিফিন পিরিয়ডে ওদের খাইয়ে দিত, এটা দেখে চুপচাপ এক কোণে বসে কাঁদত। আমি ওর সাথে স্কুলে যাওয়া শুরু করি এরপর থেকে। ওর টিচারদের সাথে, ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলে ওকে নর্মাল করার চেষ্টা করতাম৷ তখন বাসায় ওর গুমোট হয়ে থাকা কাটাতে ওকে আমার সাথে ঘরের কাজ, রান্না এসব শেখাতে শুরু করি। আবৃত্তি, আঁকা এসবেও যুক্ত হয়। ধীরে ধীরে ওর হীনমন্যতা কাটতে থাকে। ওর একেবারে ছোট্ট শিশু, তখন ভীষণ মা ন্যাওটা ছিল, ধীরে ধীরে চোখের সামনে অনেককিছু দেখে মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ে। যখন ডিভোর্স হলো, তখন ওর মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে ওর সবচাইতে কাছের মানুষই যদি ওকে ছেড়ে চলে যায়, আর কে ওকে ভালোবাসবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মোহসীন সাহেব, তার সদা হাস্যোজ্বল মুখ এখন ম্লান। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। সেখানে একটা বুক চাপা কষ্ট যেন জমে আছে।

“আমিই কি এসব রান্নাবান্না করতে পারতাম! খুব আগোছাল আর খেয়ালি ছিলাম। এটা নিয়েও শোভার সাথে আমার ঝগড়া হতো। আমার উপরে ওঠা রাগ দীপ্তর উপরেই একদিন মিটিয়েছিল সে। দীপ্তর ওই শৈশবের কোমল মনে এটা গেঁথে গিয়েছিল যে একটু অগোছালো হয়েছিল বলেই ওর শৈশব সুন্দর হয়নি বুঝি। সব নিজে নিজে গুছিয়ে রাখতে শুরু করে আমার ছোট্ট আট বছর বয়সী ছেলেটা। তখন হয়তো ওর মনে ক্ষীণ আশা আশা ছিল ও গুছিয়ে থাকলে বুঝি ওর মা ফিরে আসবে ওর কাছে।”

বলতে বলতে মোহসীন সাহেবের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল, শ্রেয়সীরও চোখের কোণে জল জমেছে। দীপ্তকে প্রথম দিকে ওর ভীষণ দাম্ভিক আর আত্ম অহংকারী বলে মনে হয়েছে। সেই ধারণা ওর আগেই মুছে গেছে। আজ এখনকার দীপ্তর জন্য যতটা তার চাইতে সে-ই শিশু বেলাকার দীপ্তর জন্য মনে একরাশ হাহাকার জন্মালো শ্রেয়সীর। মোহসীন সাহেবকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে তাও বুঝে উঠতে পারল না।

“পেঁয়াজের যে এত ঝাঁঝ, এতদিনে এটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারলাম না। দেখো না কী কান্ড।”

তিনি যে চোখের জল আড়াল করতে একটা ছুঁতো বের করতে চাইছেন, তা শ্রেয়সী জানে। তাই অনেক কৌতূহল হলেও এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ানো সমীচীন বলে মনে হলো না। সে বলল,

“বাবা, আমি আজ প্রথম মাছ রান্না করছি। যদিও তুমি দেখিয়ে দিচ্ছ, তাও তোমার পারফেকশনিস্ট ছেলে পছন্দ করবে তো?”

মোহসীন সাহেব সুযোগটাকে লুফে নিলেন, “আরে ছেলে কী ছেলের বাপ সুদ্ধ পছন্দ করবে।”

পরিবেশটা আবারও সহজ হয়ে উঠল, “তুই আমাকে বাবা ডাকলি, মনটা জুড়িয়ে গেল রে মা।”

মোহসীন সাহেব প্রীত হলেন শ্রেয়সীর প্রতি, এসব কথা তিনি এখনই বলতে চাননি৷ দীপ্ত ওই সময়ের কথা তুলতে চায় না একেবারেই। এখন যে বাড়তি কৌতূহল দেখাল না, পরিস্থিতি হালকা করে তাকে বাবা ডেকে তুমি সম্বোধন করল, এটাতে বুঝলেন একদম ভুল হয়নি। এর সাথে তার ছেলে সুখী হবে। শ্রেয়সী যে দীপ্তর জন্য সমব্যথী, সেটাও মেয়েটার চোখ বলছে। এমন একজনকেই তিনি নিজের ছেলের জন্য তিনি চেয়েছিলেন, যে তার ছেলের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে আজীবন পাশে থাকবে।

শোভা গতকাল রাতে তাকে হুমকি দিয়েছে, “আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করবই, তুমি আটকাতে পারবে না।”

এটাই তারজন্য আশঙ্কার, শ্রেয়সীর দিক থেকে তার ছেলের অনুভূতি তিনি পড়তে পেরেছেন, কিন্তু দীপ্ত! সে ইমোশনাল হয়ে যদি কোনো হঠকারী আচরণ করে ফেলে এই কোমল মনের মেয়েটার সাথে!

***
কলিংবেলের শব্দে শ্রেয়সী দরজা খুলে দিল, দীপ্ত ঢুকে বলল, “শিমুলের সাথে দেখা হয়ে গেল। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটু আড্ডা দিলাম, তাই দেরি হয়ে গেল।”

“ভেতরে এসো। খাবার দিচ্ছি। বাবা অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য।”

“আমি দশ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

দীপ্তর যাবার দিকে তাকিয়ে রইল শ্রেয়সী। মায়ার টান উত্তরোত্তর যেন বেড়েই চলছে এই মানুষটার জন্য।

খেতে বসে দীপ্ত বলল, “আজকের তরকারির টেস্ট কিছুটা আলাদা মনে হচ্ছে।”

মোহসীন সাহেব বললেন, “কেমন হয়েছে সেটা বল।”

“ভালো হয়েছে।”

“শ্রেয়সী রেঁধেছে।”

দীপ্ত হেসে বলল, “আরে, সারপ্রাইজিং। ম্যাডাম তাহলে রান্না শিখে নিচ্ছেন।”

শ্রেয়সী কপট রেগে বলল, “রান্নায় আমি একেবারে বকলম নই।”

ওর বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ফেলল, দীপ্ত আরেকবার বলল, “সত্যিই ভালো হয়েছে খেতে।”

মোহসীন সাহেব ওর মুখ রক্ষার জন্য নাহয় মিথ্যা করে হলেও বলতেন, কিন্তু দীপ্তর সে স্বভাব নেই। তার মানে আসলেই ভালো হয়েছে। যাদের জন্য কষ্ট করা, তাদের কাছ থেকে এটুকু এপ্রিসিয়েশন পেলে সে কষ্টে একটা পূর্ণতা আসে। এজন্যই বুঝি মা এত আগ্রহ ভরে রান্না করেন! প্রিয়জনের মুখে তৃপ্তি দেখার একটা মজা আছে তো!

***
আগামীকাল শুক্রবার, অফিস বন্ধ। শ্রেয়সী ভেবে রেখেছে আজ দীপ্তকে সাথে নিয়ে একটা মুভি দেখবে। সেই মতো প্ল্যান গুছিয়ে রেখেছে। রাতে সাড়ে এগারোটার দিকে দীপ্তকে বলল, “চলো আজ একটা মুভি দেখি।”

দীপ্ত ঘড়ি দেখে বলল, “স্যরি শ্রেয়সী। আজ পারব না। আজ পৌনে একটা থেকে রিয়ালের একটা ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাচ আছে। অন্য একদিন দেখি?”

শ্রেয়সী ঠিক আছে বলে শুয়ে পড়ল। দীপ্তর মনে হলো সে ওর ওপরে রেগে গেছে। কিন্তু কী করবে! এই ম্যচ মিস করা যাবে না। দীপ্ত বসার ঘরে এসে টিভি অন করল। ভলিউম অফ করে রেখেছে, নয়তো বাবা আর শ্রেয়সীর ঘুমের ডিস্টার্ব হবে। ম্যাচ শুরু হবার মিনিট পাঁচেক আগে শ্রেয়সী উঠে রান্নাঘরে গেল। আলো জ্বালিয়ে এত রাতে কি খুটখাট করছে কে জানে!

কিছুক্ষণ পরে শ্রেয়সী ফিরল ওর সামনে চানাচুর, সরিষার তেল আর শসা দিয়ে মুড়ি মাখা রাখল। এরপর পাশে এসে বসল।

“তুমি বসলে যে?”

শ্রেয়সী মুড়ি নিয়ে মুখে দেবার আগে বলল, “বৃহস্পতিবার রাতে আমার দ্রুত ঘুমিয়ে অভ্যাস নেই। ভাবলাম আমিও ম্যাচটা দেখি। এন্টি পার্টি ন থাকলে মজা পাবে না তো।”

দীপ্ত বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি সত্যিই ম্যাচ দেখবে?”

“মিথ্যা কেমনে দেখে? তুমি বোধহয় ভুলে গেছ আমিও মাঝেমধ্যে দেখি। আগে বাবার সাথে দেখতাম, আজ তোমার সাথে দেখব।”

দীপ্ত হাসল, ওর একটু আগে মনে হচ্ছিল শ্রেয়সী মন খারাপ করেছে, সেটা ভেবে ওর কিছুটা খারাপও লেগেছিল৷ কিন্তু এখন ভীষণ ভালো লাগছে। সব বন্ধুদের কাছে শুনেছে, খেলা দেখা নিয়ে ওদের ঝগড়াঝাটি হয়৷ এদিক থেকে তো বলা যায় ওর বউ ভাগ্য ভীষণ ভালো।

শ্রেয়সী বলল, “আমার হাতটা এভাবে ধরে রাখলে মুড়িটা শেষ করব কখন, ওদিকে চায়ের পানি দিয়ে এসেছি।”

দীপ্ত খেয়াল করল, অবচেতনে সে কখন যেন শ্রেয়সীর হাত ধরেছে।

“ধরে রাখতেই ভালো লাগছে।” অবচেতনেই কথাটা বলে ফেলল দীপ্ত।
……….
(ক্রমশ)