তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-১৬

0
98

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা

মোহসীন সাহেবের দিন কাটছে খানিকটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। শোভাকে তিনি দীপ্তর সাথে দেখা করতে বাঁধা দিতে পারবেন না, এটা তার এখতিয়ারে নেই। দীপ্ত সবে সংসারের প্রতি তিক্ত ধারণাকে সরিয়ে শ্রেয়সীকে নিজের সাথে জড়াতে শুরু করেছে। ছেলেকে বেশ সুখীই দেখা যায় তার পুত্রবধূ আশেপাশে থাকলে। একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে দু’জনের মাঝে।

শোভাকে দেখলে দীপ্ত যদি আবার পুরনো… তিনি আর ভাবতে পারেন না। আশঙ্কা হয়। শোভা বরাবরই নিজের জেদ বজায় রেখে চলেছে। কখনো তার সাথে কথা কাটাকাটি হলেই গিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থেকেছেন। অনেকদিন তিনি অফিস থেকে ফিরে দেখেছেন দীপ্ত ক্ষুধায় কাতর হয়ে কাঁদছে, তিনি এসে ওকে শান্ত করে খাইয়ে দিয়েছেন। রাগের বশে শোভা সন্তানের দিকেও ততক্ষণ খেয়াল রাখতেন না, যতক্ষণ না মোহসীন নিজের হার মেনে নতি স্বীকার করে নিতেন।

শোভার সাথে তার দাম্পত্য এতটা বিষিয়ে উঠেছিল যে বিচ্ছেদ ভিন্ন অন্য কোনো উপার আর সামনে ছিল না।

তবে যাবার আগে শোভা দীপ্তকে সাথে নিয়ে যেতে খুব চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মা ন্যাওটা দীপ্ত ততদিনে মায়ের প্রতি বিমুখ হয়ে বাবাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তিনিও জেদি একরোখা শোভার হাতে ছেলেকে ছাড়তে এক বিন্দু ভরসা করে উঠতে পারেননি। ছেলেকে শোভা ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু তার কাছে সবকিছুর উপরে নিজের জেদ আর ইগো। তিনি কী করে ছেলেকে তার সাথে ছাড়তেন!

ডিভোর্সের পরে কেউ কেউ তাকে আরেকবার বিয়ে করতে বলেছিল। কিন্তু একবারের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সাথে নিজের সন্তানের প্রতি শোভার যে আচরণ, অন্য কেউ এসে যে তার সাথে মাতৃ সুলভ স্নেহশীল আচরণ করবে এই ভরসা তিনি করতে পারেননি। মোহসীন সাহেবের পুরো পৃথিবী হয়ে ওঠে কেবল দীপ্ত। তিনি নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন একমাত্র সন্তানের জন্য। তবুও কী তা পুরোপুরি সম্ভব! মায়ের শূন্যতা কী দীপ্তকে পোড়ায়নি! কিছু শূন্যস্থান পুরো পৃথিবীর বিনিময়েও পূর্ণ করা সম্ভব হয় না। তিনি তা বোঝেন। বোঝেন বলেই ভয় পান।

বিয়ের পর তিন সপ্তাহ গড়িয়েছে। শাফকাত সাহেব তাকে কল করে শ্রেয়সী আর দীপ্তকে একবার যেতে বলেছেন। মোহসীন সাহেব নিজেই ভাবলেন, এটাই ভালো হবে। সেখানে দু’দিন কাটিয়ে আসুক। তিনিও গ্রামের বাড়িতে যাবেন কাজে।

***
শ্রেয়সী আর দীপ্তর এই সময়টা চমৎকার কাটছে। একজন অপরজনকে আবিষ্কার করছে। সেদিন দুজন একসাথে আরমান ভাইয়ের স্কুল থেকেও ঘুরে এলো। ওই বয়সী অন্য শিশুগুলো জীবন কী তাও জানে না, ভাগ্য ওদের একই বয়সে জীবনের বন্ধুর পথে যু দ্ধে নামিয়ে দিয়েছে। একটু সাহচার্য, একটুখানা মায়া পেলে তাদের চোখেমুখে যে যে আনন্দের ফল্গুধারা নেমে আসে, তা ভীষণ তৃপ্তিদায়ক। মনে হয়, এই জীবনটা অন্তত কিছু একটা কাজে তো লাগল। অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর মতো প্রশান্তি দায়ক অনুভূতি সত্যিই অনন্য মনে হয় ওদের কাছে।

এই বৃহস্পতিবার শ্রেয়সী বাড়ি যাবে দীপ্তকে সাথে নিয়ে। যাবার আগে ওর ইচ্ছে ছিল বাবা-মার জন্য কিছু কেনাকাটা করবে। মোহসীন সাহেবের জন্যও কিছু কেনার ইচ্ছে আছে। কিন্তু ওর একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না। দীপ্তকে বলল, “দীপ্ত, চলো একটু শপিংয়ে যাই।”

দীপ্ত বিয়ের আগের কেনাকাটার কথা স্মরণ করে বিরস মুখে বলল, “তুমি যেতে পারবে না? আমার তেমন অভ্যাস নেই।”

শ্রেয়সীর মুখভঙ্গি আড়াল করে হাসার চেষ্টা করলেও কিঞ্চিৎ মেঘের ছায়া দীপ্তর অগোচরে রইল না।

“ঠিক আছে, আমি ম্যানেজ করে নেব।” বলে শ্রেয়সী ঘুরে চলে যাচ্ছিল, দীপ্ত পেছন থেকে বলল, “কখন যাবে? আমি অফিস থেকে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে তোমাকে পিক করি?”

দীপ্তর মনে হচ্ছিল, শ্রেয়সী তো ওর জন্য, ওর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে ইদানিং অনেককিছু করে। তার সবটাই কি মেয়েটার পছন্দের! সে করতে পারলে দীপ্তও নাহয় দুই একটা অপছন্দের কাজ করে নিল। এটুকু বোধহয় করা উচিত, তাতে ওর তো ক্ষতি কিছু হচ্ছে না। তাই রাজি হলো।

শ্রেয়সী ঘুরে তাকিয়ে হেসে বলল, “তোমার প্রবলেম হলে থাক। আমি ম্যানেজ করে নেব।”

“কোনো সমস্যা নেই। নতুন এক্সপেরিয়েন্সও হয়ে যাবে।”

শ্রেয়সীর মুখে আনন্দদায়ক প্রশান্তিটুকু ওকেও প্রশান্তি দিল।

দীপ্তর হাত ভর্তি শপিংব্যাগ দিয়ে।

“পুরো শপিংমল আমার হাতে ধরিয়ে দেবে নাকি? আমি সুপারম্যান নই কিন্তু।”

শ্রেয়সী অনেকদিন পরে দুষ্টু হেসে বলল, “ওয়াইফের জন্য মাঝেমধ্যে সব হাজব্যান্ডকে সুপার হাজব্যান্ড হতে হয়।”

এই মেয়ের ভেতরের দুষ্টু সত্তা আজ কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে এলো। দীপ্ত বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রেয়সী বলল,

“একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।”

মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় যখন পৌঁছে গেল দীপ্ত। তখন শ্রেয়সী হাসিমুখে এগিয়ে এসে ওর হাতে আরেকটা শপিংব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা তোমার জন্য।”

“কী আছে এতে?”

“বাসায় গিয়ে দেখবে।”

বাসায় এসে মোহসীন সাহেবের পাঞ্জাবি তাকে দিয়ে ভেতরে গেল ওরা। দীপ্ত ওর ছোট্ট শপিংব্যাগটা খুলে দেখল একটা ঘড়ি। এই ঘড়িটা সে সেদিন অনলাইনে দেখে অর্ডার করবে ভাবছিল। কিন্তু অন্য কাজে ব্যস্ত হওয়ায় আর করা হয়নি। কার্টে এড করে রেখেছিল। এরপর একেবারেই ভুলে গিয়েছিল।

শ্রেয়সী যে সেটা মনে রেখেছিল, বা খেয়াল রেখেছে এটা দীপ্তর ভীষণ ভালো লাগল। কতক্ষণ আগের বিরক্তি নিমিষেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলে গেল একেবারে। মনজুড়ে একরাশ স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে গেল। অবচেতনেই ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটল দীপ্তর।

***
শ্বশুরবাড়ি যাবার আগেরদিন শিমুল ওর অফিসে এসে হাজির। এটা-সেটা বলে সে ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “সৌম্য আমার কাছে এসে তোকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।”

“কী বলে?”

“বলে, তুই ওর হবু বউকে ভাগিয়ে বিয়ে করেছিস?”

“ও সামনে থাকলে ওর মাথায় আমি গাট্টা মারতাম৷ শ্রেয়সী ওর হবু বউ কবে হলো?”

“ওর জন্য পাত্রী হিসেবে দেখতে গিয়েছিল না! ওর নাকি স্থির বিশ্বাস তুই সেদিন বাগড়া না দিলে নাকি শ্রেয়সী ওকে পছন্দ করত।”

দীপ্ত ফুঁসে উঠে বলল, “ওই গবেটকে পছন্দ করত শ্রেয়সী? আমি সেদিন না গেলেও ব্যাটার কপালে সেই রিজেকশনই জুটত। শ্রেয়সীর টেস্ট এত খারাপ না। আমাকেই যেখানে রিজেক্ট করেছিল, সেখানে নাকি সৌম্য? সব বাদ দিলাম, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, সবকিছুর একটা লেভেল ম্যাচ করার ব্যাপার থাকে না? যায় ওর? ওই ব্যাটা আরেকদিন আমার সামনে পরুক, অন্যের বউ নিয়ে এমন কথা বলার জন্য ওকে আমি…”

এই পর্যায়ে সৌম্য স্থান, কাল, পাত্র ভুলে হো হো করে হেসে ফেলল।

দীপ্ত আরও রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই খামাখা হাসছিস কেন?”

শিমুল বহু কষ্টে নিজের হাসিকে যৎসামান্য নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “পজেসিভ হাসব্যান্ড মনে হচ্ছে তোরে দোস্ত। তুই যে প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস, বুঝতে পারছিস?”

দীপ্ত থমকে গেল মুহূর্তের জন্য! সত্যিই কি তাই! সে বুঝতে পারে না!
………
ক্রমশ