#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১৯)
নুসরাত জাহান লিজা
ফেসবুকে লগইন করতেই নোটিফিকেশন থেকে শ্রেয়সী দীপ্তর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটা দেখল। ওর মন খানিকটা খারাপ হয়েছিল এখনো সিঙ্গেল স্ট্যাটাস রেখে দেয়ায়। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে কোথাও যেন বেঁধেছে। ভেবেছে হয়তো খেয়াল করেনি বা ফেসবুককে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি দীপ্ত। তবে আজ এটা দেখে ওর মনে ঝরঝরে সোনা রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঠোঁটের প্রান্তদ্বয় সম্প্রসারিত হলো। দীপ্ত তখনো বিছানার একপাশে বসে ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে আছে।
শ্রেয়সী বলল, “এতদিনে মনে পড়ল?”
দীপ্ত হঠাৎ বুঝতে পারল না শ্রেয়সী কোন প্রসঙ্গে কথাটা বলছে, সে জিজ্ঞেস করল, “কী মনে পড়ল?”
“নিজের বিয়ের কথা? নাকি বিবাহিত থাকলে সুন্দরী মেয়েরা এ্যাটেনশন দেবে না বলে ব্যাচেলর সেজে থাকা হচ্ছিল শুনি?”
শ্রেয়সীর এমন অভিযোগে দীপ্ত প্রথমে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেও পরক্ষণেই ভীষণ মজা লাগল, “আরে, ভালো আইডিয়া দিলে তো! তাহলে ভুল করে ফেললাম মনে হয়। এখন কী করা যায় বলো তো? এখন ডিলিট করে দিলেও তো লাভ নেই। অনেক সুন্দরী মেয়েরা উইশ করে ফেলেছে এই চৌদ্দ মিনিটে?”
শ্রেয়সীর গা জ্বলে গেল, বলল, “আমি সবসময় ভালো আইডিয়া দিই। ঘিলুর বিজনেস আইডিয়া দিয়েছিলাম মনে নেই? আর এত যখন দুঃখ হচ্ছে, তো যাও, আরেকবার চেঞ্জ করে সিঙ্গেলে ফিরে যাও।”
দীপ্ত কতদিন পরে শ্রেয়সীকে আবার এভাবে রাগতে দেখল। বন্ধুত্ব হবার পর থেকে ওদের ঝগড়াঝাটি প্রায় বন্ধ। এটাকে কি সে মিস করছিল? নইলে এটাকে এত উপভোগ্য মনে হচ্ছে কেন দীপ্তর! আরেকটু উসকে দেবার জন্য সে বলল,
“দিয়েই যখন ফেলেছি তখন আরেকটু ভালোভাবে দেই, কী বলো?”
বলেই শ্রেয়সীর কাছাকাছি এসে কাঁধে হাত দিয়ে টুক করে একটা সেলফি তুলে নিল। এরপর সরে গিয়ে সেটা আপলোড করে দিল।
শ্রেয়সী বুঝতে পেরে সাথে সাথে নিজের ফোন দীপ্তর থেকে আপলোড করা ছবিটা দেখল, একটা ভালোবাসা ইমোজি দিয়ে পোস্ট করেছে। শ্রেয়সী নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল, ভাগ্যিস ওড়না ঠিকঠাক ছিল। এরপর রেগে দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
“এভাবে আচমকা তোলা একটা ছবি কেউ ফেসবুকে পোস্ট করে? আমার চুল এলোমেলো, মুখ ফুলে আছে ঘুমানোর জন্য। এটা ফাজলামো না-কি?”
দীপ্ত মোলায়েম হেসে বলল, “তুমি যেমন আছো তেমনই সুন্দর। ইনস্ট্যান্ট ছবিতে যে অনুভূতি থাকে সেটা ন্যাচারাল। প্রস্তুতি নিতে গেলে একটা আর্টিফিশিয়াল ভাব আসত। মেমোরি এভাবে হুট করেই ক্রিয়েট করতে হয়, বুঝলে? আর আমি পোস্ট করার আগে দেখেই পোস্ট করেছি, কোনো সমস্যা নেই এই ছবিতে।”
আচমকা শ্রেয়সীর রাগ হালকা হয়ে এলো। তবে দীপ্তর পরের কথা শুনে আবারও মেজাজটা খিচড়ে গেল।
“আরও কিছু এডমায়ারার কমল মনে হয়।”
“এত চিন্তা হলে ডিলিট করে দাও। তারপর ওদের সাথে ডেট করা শুরু করো।”
দীপ্ত হেসে ফেলল, “ঈর্ষা হচ্ছে বুঝি?”
শ্রেয়সী তেড়েফুঁড়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, আচমকা থেমে গেল। কিছু একটা ভাবল যেন, এরপর শান্ত গলায় বলল,
“এক মাস পড়ে তোমার আজই হুট করে এই কাজ করতে ইচ্ছে হলো কেন?”
এবার দীপ্তর হাসি বন্ধ হলো, একটু আগে ঘটকের আনা শ্রেয়সীর বিয়ের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ে গেল, মনের অস্থির ভাব খানিকটা ফিরে এলো আবারও।
“সবাইকে জানিয়ে দেবার জন্য যে তুমি বিবাহিত। এখনো যেভাবে তোমার চারপাশে পাণিপ্রার্থীরা ভীড় করছে!”
শ্রেয়সী ঘটনাটা তখনো জানে না, তবে কিছুটা আন্দাজ করে হেসে বলল, “আমাকে বললে যে এতক্ষণ, তুমিও কি জেলাস?”
দীপ্তও কি তবে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিল শ্রেয়সীর জন্য! তাই তো! দীপ্ত যেন নিজেকেই চিনতে পারছিল না। এত বদলে গেল সে কী করে, শুধুমাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে! কী এক অচেনা টান সে অনুভব করছে শ্রেয়সীর প্রতি।
***
গতকাল শ্রেয়সী আর দীপ্ত বাসায় ফিরেছে। মোহসীন সাহেব এখনো আসেননি বাড়ি থেকে। দু’জনেই অফিসে গিয়েছিল। শ্রেয়সী সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে, তবে দূর্বলতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিজের কাজটুকু দ্রুত শেষ করে লাঞ্চ আওয়ারেই তাই ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।
ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে এসেছে, এরপর ঘণ্টাখানেক শুয়েছিল। এখন বাসাটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঘুমাবে ভেবেছিল, কিন্তু ক্লান্তি থাকলেও ঘুম এলো না। এরমধ্যে মোহসীন সাহেব কল দিলেন।
“বাবা, তুমি বাসায় ফিরবে কবে?”
“পরশু ফিরব। তোর শরীর এখন কেমন?”
“এখন বেটার।”
“এখন তুই বাসায়?”
“হ্যাঁ। একটু দূর্বল লাগছিল বলে চলে এলাম। তোমার ছেলে আর আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছি।”
“গাধাটা কই এখন? অফিসে?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“ও ছুটি নিতে পারেনি? অসুস্থতা নিয়ে একা একা এলি। যদি দূর্ঘটনা ঘটত রাস্তায়?”
“আমি ওকে জানাইনি বাবা। এমনিতেই গতকাল ছুটি নিয়েছিল। আবার আরেকটা ছুটি নষ্ট করার কী দরকার। তাছাড়া আমি একদম ঠিক আছি এখন।”
মোহসীন সাহেব ফোন রেখে নিজের কথা ভাবলেন। একবার শোভার জ্বর এলো। তিনি দুইদিন ছুটি নিলেন৷ এরপর তৃতীয় দিন অফিসে চলে গেলেন। ফিরে আসতেই শোভার আক্রমণাত্মক কথার শিকার হতে হয়েছিল।
“বাড়িতে আমি অসুস্থ। তুমি ঢ্যাংঢ্যাং করে অফিসে চলে গেলে? অসুস্থ বউকে ভালো লাগছে না আর? অফিসের সুন্দরী কলিগদের চোখে ধরেছে? ওদের না দেখে থাকতে পারছিলে না?”
“এসব কী বাজে কথা বলছ? অফিস কাজের জায়গা। সেখানকার কিছু ওয়ার্ক এথিকস আছে। রেসপনসেবলিটি থাকে। সরকার আমাকে বেতন দিচ্ছে মাস শেষে। এতদিন ছুটি কেন দেবে?”
“ওইটুকু বেতন দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে ফেলেছ।”
সময়টার কথা মনে পড়তেই একরাশ বিমর্ষতা তাকে ঘিরে ধরল। তিনি আজীবন সততাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। তার যে স্যালারি ছিল তখন তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটিয়ে দেয়া যেত৷ তবুও এসব শুনতে হতো৷
শোভা আর তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। শোভা পরবর্তীতে বলেছিল তার বোনদের মধ্যে সে-ই সবচাইতে সুন্দরী আর যোগ্য, মেধাবী৷ অথচ অন্যদের চাইতে তার বরভাগ্য নাকি সবচাইতে খারাপ ছিল। এটা নিয়ে তার আফসোসের শেষ ছিল না। অথচ একসময় আবেগের তাড়নায় সে-ই বাড়ি ছেড়ে এসে তার হাত ধরেছিল।
শ্রেয়সীর এই যে দীপ্তকে বাড়তি প্রেসার না দেবার চেষ্টা, এটা তার ভালো লাগল। যদিও এই চাপা স্বভাব ঠিক নয়। দীপ্তকে বলতে হবে বাড়তি খেয়াল রাখতে।
***
মোহসীন সাহেবের সাথে কথা শেষ করে শ্রেয়সী দেখল চারটা সাতান্ন বাজে। দীপ্ত সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাসায় চলে আসে। সে ভাবল আজ রান্না করা যাক৷ ছেলেটা ক্লান্ত হয়ে এসে আবার রান্না করবে ভেবে ওর কিছুটা অস্বস্তি হলো। বিশ্রাম নিয়ে এখন শরীরটা ভালো লাগছে।
রান্নাঘরে এসে আগে মশলা টশলা আছে কি-না সেটার খোঁজ করল। এর আগে যখন রান্না করেছে হয় মোহসীন সাহেব নয়তো দীপ্ত সাথে থেকেছে। মরিচ, হলুদের গুঁড়া পেয়ে গেল। পেঁয়াজ, মরিচও পেল। এরপর আলু দেখে ভাবল আলু দিয়ে ডিম রান্না করবে, সাথে ডাল।
পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখে এমন ঝাঁঝ লাগল, মনে হচ্ছিল কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলছে। মা দেখলে খুশি হতেন। তার মেয়েটা একেবারে অকর্মা নয় এটা বুঝতেন।
সব কা টা কু টি শেষ করে দেখল আলু আর ডিম সেদ্ধ হয়ে গেছে। রান্না শেষ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ ফেসবুকিং করল, এরপর উঠে দীপ্তর সংগ্রহ থেকে একটা বই নিয়ে বসল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘’বুকের ভেতর আগুন’। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা বই। ভালো লাগছিল পড়তে। কলিংবেল বাজতে ঘড়িতে দেখল আটটা সতেরো বাজে।
এতক্ষণে তার আসার সময় হলো। সে দরজা খুলতেই দীপ্ত বলল, “স্যরি। ফিরতে দেরি হয়ে গেল। তোমার বোরিং লেগেছে নিশ্চয়ই এই দুই ঘণ্টা একা থাকতে।”
“আমি লাঞ্চ আওয়ারেই চলে এসেছিলাম।”
“ও, তোমাকে কয়েকবার কল দিয়েছিলাম সাড়ে চারটার দিকে। তুমি ধরলে না। ভেবেছিলাম ওদিকে গিয়ে তোমাকে নিয়ে ফিরব।”
“খুব একটা বোরিং লাগেনি। রান্না করলাম, বই পড়লাম৷ সময় কেটে গেল।”
“সে কী, তুমি রান্না করেছ?”
“এভাবে আঁৎকে উঠকে কেন? আমি এতটাও খারাপ রাঁধি না যে খাওয়া যায় না।”
“আরে, আমি সেটা বলিনি৷ আমি ভাবলাম দেরি হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে রান্না করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে৷ তাই…”
ওর দিকে দুটো প্যাকেট এগিয়ে দিল দীপ্ত।
“তুমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে সেটা আমাকে আগে জানাবে না? আমি এত কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে রান্না করলাম কেন তাহলে?”
দীপ্ত এবার চিন্তিত গলায় বলল, “হাত পুড়েছে? কই দেখি? কে বলেছে তোমাকে রান্না…”
শ্রেয়সীর হাত ধরে ক্ষত খোঁজার চেষ্টা করতে করতে বলল দীপ্ত।
“আরে, হাতে কিছু হয়নি গাধা, ওটা কথার কথা।”
দীপ্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা তাই বলো।”
“আগে বলো, এটা আমাকে জানাতে পারোনি? মোবাইল ফোন বলে একটা বস্তু আছে, তাতে যোগাযোগ করা যায়।”
“ঠিক আছে। এরপর তোমাকে কল দেব দেরি হলে।”
“মনে থাকে যেন। এতগুলো খাবার নষ্ট হবে।”
“আরে নষ্ট হবে কেন? তোমার রান্নাটা ফ্রিজে রেখে দিই। সকালে চলে যাবে।”
বলার পরে সে শ্রেয়সীর দিকে তাকাল। শাড়ি পরেছে আজ। আঁচল কোমরে গুঁজা। দীপ্ত হেসে বলল,
“আজ তোমাকে কেমন বউ বউ লাগছে।”
শ্রেয়সীও হাসল, “এতদিন তাহলে কার মতো লেগেছে?”
দীপ্ত সেই হাসিতে বুঁদ হয়ে গেল। মোহাবিষ্টের মতো ধীরপায়ে সে এগিয়ে গেল শ্রেয়সীর দিকে, দৃষ্টিতে এক সমুদ্র প্রেমের উত্তাল ঢেউ।
………..
(ক্রমশ)